প্রফেসর রাইখ মুখ বিকৃত করে নিজের চুল খামচে ধরে চিৎকার করে বলল, “সর্বনাশ!”
ক্লিওন জানতে চাইল, “কী হয়েছে?”
“দেখছ না, স্পেস টাইম ফেব্রিকের ফুটোটা যথেষ্ট বড় না, এটা ঢুকতে পারছে না!”
“এখন কী হবে?”
কী হবে কেউ জানে না, সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে এবং তখন হঠাৎ মনে হলো নিচের অদৃশ্য পর্দাটা ছিঁড়ে গেল। সবাই সবিস্ময়ে দেখল গোলকটি নিচে নামতে নামতে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সাথে সাথে হঠাৎ করে সবকিছু নীরব হয়ে যায়। অ্যালার্মের আর্তনাদ, এক্সরে ডিটেক্টরের শব্দ, যন্ত্রপাতির গুঞ্জন সবকিছু থেমে যায়। এই নীরবতাটুকু কেমন জানি অস্বাভাবিক মনে হতে থাকে। প্রফেসর রাইখ বুকের ভেতর আটকে থাকা নিঃশ্বাসটি বের করে দিয়ে কাঁপা গলায় বলল, “পৃথিবীর ইতিহাসের জন্যে এটি একটি মাইলফলক! আমরা প্রথমবার একজন অভিযাত্রীকে সময় পরিভ্রমণে পাঠাতে পেরেছি।”
ঘরের সবাই তখন এক সাথে আনন্দোৎসবের মতো করে চিৎকার করে হাততালি দিতে শুরু করে।
ক্লিওন প্রফেসর রাইখের কাঁধে হাত রেখে নিচু গলায় বলল, “আমি দুঃখিত প্রফেসর রাইখ, বিজ্ঞানের এত বড় একটা ঘটনার কথা পৃথিবীর কাউকে আমরা জানাতে পারছি না।”
ক্লিওনের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা সিকিউরিটির মানুষটি নিচু গলায় বলল, “আমরা জানাতে না চাইলেও এটা জানাজানি হয়ে গেছে ক্লিওন।”
ক্লিওন চমকে উঠে বলল, “কী বললে?”
“আমার কাছে তথ্য এসেছে আমাদের এই গোপন আবাসস্থলের কথা জানাজানি হয়ে গেছে। একটু আগে এখানে যে অচিন্তনীয় শক্তি কেন্দ্রীভূত করা হয়েছিল সেটা গোপন রাখা সম্ভব নয়।”
ক্লিওন একটা নিঃশ্বাস ফেলল, সারাটি জীবন সে গোপন একটি আস্তানা থেকে আরেকটি আস্তানায় পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে, তার কাছে এটি নতুন নয়। সে ক্লান্ত গলায় বলল, “সবাইকে নিরাপদে সরে যেতে বলো।”
“তুমি?”
“আমি এখানেই থাকব।”
সিকিউরিটি অফিসার ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকাল, বলল, “তুমি শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা দেবে?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
ক্লিওন হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমি জানি না কেন। হয়তো প্রফেসর রাইখের কথাই সত্যি। প্রকৃতি যেভাবে চায় তাকে সেভাবে সাহায্য করতে হয়। আমি প্রকৃতিকে সাহায্য করি।”
প্রফেসর রাইখ হাসার ভঙ্গি করে বলল, “আমিও তাহলে প্রকৃতিকে সাহায্য করি। আমিও তোমার সাথে থাকি।”
ক্লিওন বলল, “চমৎকার। চলো তাহলে স্নায়ু শীতল করার চমৎকার এক বোতল পানীয় পাওয়া গেছে। সময় পরিভ্রমণের এই বিশাল সাফল্যটা আমরা সেই পানীয় খেয়ে উদযাপন করি!”
প্রফেসর রাইখ বলল, “চলো।”
দুজন শান্ত ভঙ্গিতে করিডর ধরে হেঁটে যেতে থাকে। দুজনেই ক্লান্ত। খুবই ক্লান্ত।
১১-১২. টাইম ক্যাপসুলের ভেতরে বসে
১১.
টাইম ক্যাপসুলের ভেতরে বসে বাইরে কী ঘটছে সেটা সম্পর্কে রিটিনের বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা ছিল না। সে জানত তাকে স্পেস টাইমের ফেব্রিকের ফুটো দিয়ে ঠেলে ঢুকিয়ে দেয়া হবে, এরপরের অভিজ্ঞতাটা কেমন হবে সেটি পৃথিবীর কেউ জানে না। রিটিন সেটা দেখার জন্যে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে।
হঠাৎ রিটিনের মনে হলো সে পড়ে যেতে শুরু করেছে। যেরকম হঠাৎ করে এই অনুভূতিটি শুরু হয়েছে ঠিক সেভাবেই আবার মনে হলো সে কোথাও আটকে গেছে। সে সত্যিই টাইম ক্যাপসুল দিয়ে সময় পরিভ্রমণ করতে শুরু করেছে কি না বুঝতে পারল না। যদি সত্যিই সে পরিভ্রমণ শুরু করে থাকে তাহলে বুঝতে হবে অভিজ্ঞতাটুকু চমকপ্রদ কিছু নয়।
ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ রিটিনের মনে হলো তার সমস্ত শরীর বিস্ময়কর এক শক্তির আকর্ষণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। সে সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করল কিন্তু মনে হলো তার শরীরের প্রতিটি অণু পরমাণু বুঝি শরীর থেকে খুলে বের হয়ে যেতে শুরু করেছে। চোখের সামনে লাল একটি পর্দা নেমে আসে, সে কিছু দেখতে পায় না, সে কিছু চিন্তা করতে পারে না, কিছু শুনতে পায় না। রিটিনের সমস্ত অনুভূতি লোপ পেয়ে গেল। কিন্তু আশ্চর্য তারপরও রিটিনের নিজের অস্তিত্বের অনুভূতিটি লোপ পেল না। তার ভেতরে কোথা থেকে কে জানি তাকে মনে করিয়ে দিতে থাকে, আমি আছি। আমি আছি। আমি আছি।
ধীরে ধীরে রিটিনের সময়ের অনুভূতি লোপ পেতে থাকে। এই টাইম ক্যাপসুলে সে কী এক মুহূর্তের জন্যে আছে না এক সহস্র বছরের জন্যে আছে সে বুঝতে পারে না। তার মনে হতে থাকে সময় বলে কিছু নেই, কখনো ছিল না, কখনো থাকবে না।
রিটিনের মনে হতে থাকে সবকিছু স্থির হতে শুরু করেছে, তার হৃৎস্পন্দন যেন ধীরে ধীরে থেমে আসতে শুরু করেছে। একটি হৃৎস্পন্দন থেকে অন্য হৃৎস্পন্দনের ভেতর অনন্তকাল সময় পার হয়ে যেতে থাকে কিন্তু তবু তার মনে হতে থাকে সে বেঁচে আছে। তার অস্তিত্ব বেঁচে আছে। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথায় আছে সে জানে না কিন্তু সে যে আছে সেটি সে জানে।
এভাবে কতকাল কেটে গেছে রিটিন জানে না। তার মনে হতে থাকে সেটি জানা না জানার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো কিছুতে তার আর কিছু আসে যায় না। তাকে শুধু অনন্তকাল এভাবে বেঁচে থাকতে হবে। সৃষ্টির আদিকাল থেকে শেষকাল সে এভাবে স্থির সময়ে ভেসে থাকবে। যার কোনো শুরু নেই। যার কোনো শেষ নেই।