.
১০.
রিটিন ঘুম থেকে উঠে দেখল তার ঘরে সাদা পোশাক পরা কয়েকজন টেকনিশিয়ান অপেক্ষা করছে। রিটিন বুঝতে পারল আজকে সেই দিন। তার বুকের ভেতর রক্ত ছলাত করে উঠল। এটুকুই–বাড়তি কোনো উত্তেজনা কিংবা আতঙ্ক কিছুই হলো না। সাদা পোশাক পরা মানুষগুলোর পিছু পিছু সে হেঁটে যেতে থাকে। তারা তাকে সময় পরিভ্রমণের জন্যে প্রস্তুত করিয়ে দেবে।
তাকে কিছু খেতে হলো, শরীরে কিছু ইনজেকশান দেয়া হলো, শরীরের ভেতর কিছু এঙ্গুল ঢোকানো হলো। শরীরের নানা জায়গায় মনিটর লাগানো হলো। বিশেষ একটা পোশাক পরতে হলো, সেই পোশাক পরিয়ে তাকে যখন করিডর ধরে টাইম ক্যাপসুলের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন রিটিন দেখল করিডরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। ক্লিওন একটা সুন্দর পোশাক পরে আছে, সুপ্রিম কাউন্সিলের সব সদস্যই তাদের বুকে ব্যাজ লাগিয়ে এসেছে। সবাই রিটিনের সাথে হাত মিলাল, দুই-একটা ভদ্রতার কথা বলল। বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়াররাও সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। রিটিন তাদের সাথেও হাত মিলিয়ে ছোটখাটো ভদ্রতার কথা বলে এগিয়ে যায়। সবার শেষে প্রফেসর রাইখ দাঁড়িয়ে আছে, সে রিটিনের দুই কাঁধ ধরে ছোট একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “মনে রেখো, পৌঁছেই তোমার বান্ধবীর সাথে ছবি তুলে আমাদের পাঠাবে!”
রিটিন বলল, “পাঠাব!”
টাইম ক্যাপসুলটি স্ট্যান্ডের উপর বসিয়ে রাখা হয়েছে। রিটিনকে ঢুকিয়ে ঢাকনাটি ফেলে ক্যাপসুলটি বন্ধ করে দেবার পর সেটাকে সুপারকন্ডাক্টিং ম্যাগনেট দিয়ে লেভিটেড করা হবে, সেটি তখন শূন্যে ঝুলে থাকবে।
সাদা কাপড় পরা টেকনিশিয়ানরা রিটিনকে টাইম ক্যাপসুলের ভেতর ঢুকিয়ে সিলিন্ডারের সাথে স্ট্যাপ দিয়ে আটকে দিতে থাকে। শরীরের মনিটরগুলো পরীক্ষা করে, যন্ত্রপাতিগুলো পরীক্ষা করে।
তখন একজন একটা চেক লিস্ট ধরে রিটিনকে শেষ মুহূর্তের জন্যে সবকিছু বুঝিয়ে দেয়। বিদায় নেবার আগে টেকনিশিয়ানরা নিজেদের উত্তেজনা ঢেকে জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, “তোমার সময় পরিভ্রমণ শুভ হোক, রিটিন।”
রিটিনও মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “ধন্যবাদ।
“তোমাকে অচেতন করা হবে না, তাই পরিভ্রমণ পুরোটাই তুমি অনুভব করবে। যদি দেখা যায়, তোমার কোনো এক ধরনের শারীরিক কষ্ট হচ্ছে শুধুমাত্র তখন তোমাকে অচেতন করে দেয়া হবে। বুঝেছ?”
“বুঝেছি।”
“তোমার নিরাপত্তার জন্যে একটা অ্যাটমিক ক্লাস্টার দেয়া হয়েছে। যদিও আমরা আশা করছি সেটা তোমাকে কখনো ব্যবহার করতে হবে না।”
“ঠিক আছে।”
“নিও মিসাইল আর বিস্ফোরকগুলো দেখে নিয়ো।”
“দেখে নেব।”
“তোমার দুই আঙুলে দুটো বিস্ফোরক আছে। মনে আছে তো?”
“হ্যাঁ। মনে আছে।”
“ঢাকনাটা ফেলে দেয়ার পর আমাদের সাথে তোমার আর কোনো যোগাযোগ থাকবে না। তোমার অন বোর্ড প্রসেসর তোমার সব দয়িত্ব নেবে।”
“চমৎকার।”
“আমরা তাহলে যাই? কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে।”
“যাও।”
টেকনিশিয়ানরা সামরিক কায়দায় স্যালুট দিয়ে ঢাকনাটা নামিয়ে দিতে থাকে। ধাতব একটা শব্দ করতে করতে ঢাকনাটা নেমে আসে। গোলকটাকে স্পর্শ করার সাথে সাথে ক্লিক করে একটা শব্দ হলো। সাথে সাথে রিটিন পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে আলাদা হয়ে গেল। এখন এই টাইম ক্যাপসুলের ভেতর থেকে একটি অণু বা পরমাণুও বের হতে পারবে না।
রিটিন সিলিন্ডারের ভেতর লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। সে খুব সূক্ষ্ম একটা কম্পন অনুভব করে, বাইরে কী হচ্ছে সে আর কোনো দিন জানতে পারবে না। যেকোনো মুহূর্তে সে সময় পরিভ্রমণের যাত্রা শুরু করবে, রিটিন নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকে। এর আগে কেউ কখনো স্পেস টাইম ফেব্রিক ভেদ করে যাত্রা করেনি, কেউ জানে না অভিজ্ঞতাটি কী রকম, রিটিন সেই মুহূর্তটির জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। মাথার ভেতর কিছু একটা দপদপ করছে, রিটিন জোর করে তার সমস্ত চিন্তা দূর করে মস্তিষ্কের ভেতরটুকু শূন্য করে ফেলার চেষ্টা করে।
.
বাইরে বড় একটা মনিটরের সামনে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল একটি গোলক শূন্যে ঝুলে আছে, দৃশ্যটি খানিকটা অস্বাভাবিক। সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করে আছে কখন একটি বিন্দুতে অচিন্তনীয় শক্তি কেন্দ্রীভূত করে স্পেস টাইমকে ফুটো করে ফেলা হবে।
কোনো একটা স্পিকার থেকে কাউন্ট ডাউনের শব্দ শোনা যেতে থাকে। কাঁপা গলায় কেউ একজন বলছে, “দশ নয় আট সাত ছয় পাঁচ চার তিন দুই এক শূন্য–”
সাথে সাথে দুশ ছাপ্পান্নটি গামা লেজার থেকে অদৃশ্য রশ্মি ট্রিটিয়ামের ছোট এম্পুলটিকে আঘাত করল। ফিউসানের প্রচণ্ড শক্তি ক্ষুদ্র একটা বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হয়, তার তীব্র আলো ঝলসে উঠে মনিটরটিকে মুহূর্তের জন্যে বর্ণহীন করে দেয়। প্রচণ্ড একটি বিস্ফোরণে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে ওঠে এবং সবগুলো বিপদসূচক অ্যালার্ম এক সাথে আর্তনাদ করে ওঠে। কয়েক মুহূর্ত পর মনিটরটি আবার চালু হয়, তীব্র আলোতে চারদিক ধাধিয়ে গেছে, পরিষ্কার করে দেখা যায় না, আবছাভাবে দেখা গেল গোলকটি দুলতে শুরু করেছে। হঠাৎ করে এক্সরে ডিটেক্টরগুলো একসাথে শব্দ করে ওঠে, প্রফেসর রাইখ উত্তেজিত গলায় বলল, “স্পেস টাইম ফেব্রিকে ফুটো হয়েছে! ফুটো হয়েছে!”
সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকে, এখন গোলকটি নেমে আসবে তারপর সেই ফুটো দিয়ে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে যাবে। সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে, টাইম ক্যাপসুলের গোলকটি দুলতে শুরু করেছে, হঠাৎ সেটি মুক্ত হয়ে নিচে নামতে শুরু করে। একটা ফুটো দিয়ে অদৃশ্য হওয়ার বদলে হঠাৎ করে সেটি কোথায় যেন আটকে গেল, দেখে মনে হতে থাকে অদৃশ্য একটা পর্দার মাঝে গোলকটি ঝুলে আছে। এটি নিচে নামতে পারছে না!