প্রায় প্রতিদিনই প্রফেসর রাইখ এখানকার বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে বসে। প্রফেসর রাইখ ক্যাটাগরি এ মানুষ, যাদের বিরুদ্ধে এখানে সবাই সংগ্রাম করছে কাজেই প্রথম দিকে তাকে নিয়ে সবার ভেতরেই একধরনের সন্দেহ এবং অবিশ্বাস ছিল। প্রথমবার বসার পরেই সেটি অনেকখানি কেটে গেল। একেবারে প্রথম দিন রিটিন সুপ্রিম কাউন্সিলের সবার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার সাথে সাথে ক্লিওন জ কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিল, “প্রফেসর রাইখ, তোমাকে একটা নির্দিষ্ট কাজের জন্যে এখানে আনা হয়েছিল। কাজ শেষ হয়েছে এখন তুমি কেন ফিরে যাচ্ছ না?”
প্রফেসর রাইখ বলল, “আমি বিজ্ঞানের মানুষ। বিজ্ঞানের চ্যালেঞ্জ আমার ভালো লাগে–তোমাদের এখানে যে চ্যালেঞ্জ শুরু হয়েছে তার তুলনা নেই।”
“শুধু তাই? তুমি ক্যাটাগরি এ মানুষ আমাদের পুরো প্রোগ্রামটুকু হচ্ছে তোমাদের বিরুদ্ধে। তোমাকে এখানে রাখা আমাদের জন্যে মোটেও নিরাপদ নয়।”
প্রফেসর রাইখ একটু রেগে উঠল, বলল, “তোমরা আমাকে অবিশ্বাস করছ?”
একজন কমবয়সী তরুণ যে এখানে কাজ চালানোর মতো ইঞ্জিনিয়ারিং শিখেছে, মুখ শক্ত করে বলল, “একজন ক্যাটাগরি এ মানুষকে আমরা কখনো বিশ্বাস করি না।”
“আমাকে ক্যাটাগরি এ মানুষ হিসেবে না দেখে একজন মানুষ হিসেবে দেখো।”
“কেন?”
প্রফেসর রাইখ গলা উঁচু করে বলল, “তোমরা বলেছ এবং আমি পরীক্ষা করে দেখেছি যে, মানুষের মাঝে এই বিভাজন কৃত্রিম। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তোমরা এবং আমরা একই মানুষ।”
কমবয়সী তরুণটি আরো বেশি গলা উঁচু করে বলল, “কিন্তু তারপরও তোমরা শত শত বৎসর থেকে আমাদের উপর অবিচার করে যাচ্ছ, অত্যাচার করে যাচ্ছ।”
প্রফেসর রাইখ তখন গলা নরম করে বলল, “আমি সেজন্যে ক্ষমা চাইছি। আমি আমার ব্যক্তিগত অপরাধের গ্লানি কমাতে চাই–তাই আমি আমার পরিবারকে ছেড়ে এখানে থাকতে চাই!”
কমবয়সী তরুণটি আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ক্লিওন হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রফেসর রাইখের দিকে তাকিয়ে বলল, “প্রফেসর রাইখ, আমরা তোমাকে সাদরে আমাদের ক্যাটাগরি সি পরিবারে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। শুধুমাত্র আমরা আশা করব আমাদের নিরাপত্তার জন্যে তুমি আমাদের নিয়মকানুনগুলো মেনে চলবে।”
প্রফেসর রাইখ বলল, “তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো।”
“চমৎকার! আমরা তাহলে কাজের কথা শুরু করে দিই।” ক্লিওন সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা সবাই জানো রিটিনকে পাঁচশ বছর অতীতে পাঠানোর জন্যে আমাদের একটা টাইম ক্যাপসুল বানাতে হবে। কীভাবে বানাব আমরা জানি না কিন্তু আমরা যে শেষ পর্যন্ত বানাতে পারব সেটা জানি। কারণ আমরা দেখেছি রিটিন অতীতে পৌঁছেছে।”
একজন জিজ্ঞেস করল, “আমরা কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকি না কেন? প্রকৃতির দায়িত্ব তাকে অতীতে পৌঁছে দেয়া!”
প্রফেসর রাইখ জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না, না, না। সেটা হবে ভয়ংকর বিপজ্জনক একটা কাজ। তোমরা যখন রিটিনকে কন্ট্রোল সেন্টারে পঠিয়েছিল সেটাও ছিল ভয়ংকর বিপজ্জনক একটা কাজ–তার শরীরে যদি একটা গুলি কোনোভাবে লেগে যেত তাহলে পুরো প্রকৃতি ওলটপালট হয়ে যেত–”
“মানে?”
“তোমাদেরকে আমি সবকিছু বোঝাতে পারব কি না জানি না। এটা বোঝার জন্যে আমাকে স্পেস টাইম ফেব্রিক স্ট্রেচিং মাল্টিডাইমেনশনাল সমীকরণ সমাধান করতে হয়েছে। তার সমাধানের একটা অংশ হচ্ছে একটা ঘটনা ঘটার প্রোবাবিলিটি বা সম্ভাবনা। প্রকৃতির নিজস্ব পরিকল্পনার সাথে যতটুকু সম্ভব মিল রেখে একটা পরিবেশ তৈরি করে দিতে হয় যেন প্রকৃতি সেটা করে নিতে পারে। প্রকৃতিকে সাহায্য করতে হয় যেন প্রকৃতি সেটা করতে পারে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যেতে হয় না। সেটা হচ্ছে আত্মহত্যা। আমার সমীকরণে জিটা নটের মানটা দেখো, এটা কমপ্লেক্স, যার অর্থ–”
ক্লিওন হাত তুলে প্রফেসর রাইখকে থামাল, বলল, “আমাদের বেশির ভাগ তোমার জিটা নটের মানের মাথামুণ্ডু বুঝব না। সেটা থাকুক। আমরা যেভাবে বুঝি সেভাবে বলো।”
প্রফেসর রাইখ বলল, “ঠিক আছে। প্রথমে মূল পরিকল্পনায় আসা যাক। তোমাদের মূল উদ্দেশ্যটা তোমরা বলো। কিছু গোপন করবে না।”
ক্লিওন কয়েক মুহূর্ত কিছু একটা চিন্তা করল। তারপর বলল, “আমি নিজেও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না একজন ক্যাটাগরি এ মানুষের গুরুত্বপূর্ণ একজন বিজ্ঞানীর সামনে আমি আমাদের সবচাইতে গোপন পরিকল্পনাটা প্রকাশ করে দিচ্ছি।”
প্রফেসর রাইখ বলল, “আমি আর ক্যাটাগরি এ মানুষ নই। আমি শুধু মানুষ। তোমরাও আর ক্যাটাগরি সি মানুষ নও। তোমরাও শুধু মানুষ।”
“ঠিক আছে।” ক্লিওন বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “অল্প কিছু ক্যাটাগরি এ মানুষের পক্ষে বিশালসংখ্যক ক্যাটাগরি সি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সেটি করা সম্ভব হয়েছে কারণ তারা আলাদা আলাদাভাবে প্রত্যেকটা মানুষকে তার ট্র্যাকিওশান দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই ট্র্যাকিওশান হচ্ছে আসলে এক ধরনের দাসত্ব। এটি দিয়ে তারা আলাদা আলাদাভাবে সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
“আমরা ট্র্যাকিওশান ফেলেও দিতে পারি না। কারণ ট্র্যাকিওশান বের করে ফেলে দিলে হঠাৎ করে পুরো নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যাই। তখন আমি আর মানুষ থাকি না, অস্তিত্ববিহীন একটি অশরীরী হয়ে যাই। কোথাও যেতে পারি না, কিছু খেতে পারি না, কোনো রকম দুর্ঘটনা হলে চিকিৎসাটাও পাই না। তা ছাড়া ট্র্যাকিওশান সরিয়ে ফেলা ভয়ংকর একটি অপরাধ। ট্রাকিওশান ছাড়া অবস্থায় কাউকে ধরা হলে তার মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন না করে সাথে সাথে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মেডিকেল ভল্টে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমাদের অনেক কর্মী এভাবে ধরা পড়ে জীবন হারিয়েছে।”