প্রফেসর রাইখ রিটিনের কথা শুনল বলে মনে হলো না। রিটিনের দিকে অনিশ্চিতের মতো তাকিয়ে রইল। রিটিন আবার বলল, “প্রফেসর রাইখ, তোমার মনে হয় এখন একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার।”
প্রফেসর রাইখ বিড়বিড় করে বলল, “হয়ে গেছে।”
“কী হয়ে গেছে?”
“সমাধান হয়ে গেছে।”
রিটিন হাসিমুখে একটুখানি এগিয়ে গিয়ে বলল, “সমাধান হয়ে গেছে? চমৎকার! তোমাকে অভিনন্দন প্রফেসর রাইখ।”
“তার মানে জানো?”
“কী? তার মানে কী?”
“এই সমাধান থেকে আমি বলতে পারি যে সময় পরিভ্রমণ সম্ভব।”
রিটিন বলল, “আমি তোমাকে আগেই বলেছি সময় পরিভ্রমণ সম্ভব! আমি আমার ছবি দেখেছি–”
প্রফেসর রাইখ মাথা নেড়ে বলল, “আমি তোমার গাঁজাখুরি গল্প বিশ্বাস করিনি! কিন্তু এখন দেখছি সময় পরিভ্রমণ সম্ভব। একজন মানুষকে অতীতে পাঠানোর জন্যে একটা ক্যাপসুল তৈরি করা সম্ভব। এর জন্যে ওয়ার্ম হোলের প্রয়োজন নেই। স্পেস টাইম ফেব্রিকে খুব সূক্ষ্ম একটা ফুটো করে সেখান দিয়ে একটা ক্যাপসুলকে ঠেলে দেয়া সম্ভব! যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন সেই পরিমাণ শক্তি বর্তমান প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি করা সম্ভব। নিউক্লিয়ার প্লাজমা-”
রিটিন হাত তুলে প্রফেসর রাইখকে থামাল। বলল, “খুঁটিনাটি নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। আমার মনে হয় তোমার এখন একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার।”
প্রফেসর রাইখ মাথা নাড়ল, বলল, “না। আমি বিশ্রাম নিতে পারব না। আমার মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়ে আছে। আমি ঘুমাতে পারব না। খেতে পারব না।”
রিটিন বলল, “ক্লিওন আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে তোমাকে দেখাশোনা করার জন্যে। সে যখন দেখবে আমি তোমাকে কোনো কিছু খাওয়াতে পারিনি, বিশ্রাম নেয়াতে পারিনি তখন সে আমার উপর খুব রাগ করবে।”
প্রফেসর রাইখ রিটিনের কথা শুনল বলে মনে হয় না। তার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “একটা বিন্দুতে শক্তি কেন্দ্রীভূত করতে হবে। গামা লেজার দিয়েও করা যায়। ধরা যাক, দুই ডজন। গামা লেজার এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করা হলো, স্পেস টাইম ফেব্রিককে তখন ফুটো করা সম্ভব—”
প্রফেসর রাইখ আপন মনে বিড়বিড় করে কথা বলে যেতে লাগল। রিটিন তখন আবার চেষ্টা করল, বলল, “আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম সমীকরণটি সমাধান করা হলে আমি তোমাকে তোমার বাসায় পৌঁছে দেব। এখন তোমার সমাধান হয়ে গেছে। আমি ক্লিওনের কাছে অনুমতি নিয়ে তোমাকে তোমার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।”
প্রফেসর রাইখ এই প্রথমবার রিটিনের কথা শুনতে পেল। রিটিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “না, না আমি এখন বাসায় যেতে চাই না।”
“বাসায় যেতে চাও না?”
“না। আমি যদি বাসায় না যাই তাহলে আমার স্ত্রী মনে হয় খুশিই হবে।”
“তুমি এখানে থাকতে চাও?”
“হ্যাঁ। টাইম ক্যাপসুল তৈরি করার সময় আমি থাকতে চাই। আমি সমীকরণটির সমাধান করেছি কিন্তু খুঁটিনাটি হিসেব করিনি। তুমি যদি টাইম ক্যাপসুল তৈরি করতে চাও তাহলে শক্তিক্ষয়ের একটা হিসেব করতে হবে। তোমরা সেই হিসেব করতে পারবে না। আমাকে করতে হবে। তা ছাড়া–”
“তা ছাড়া কী?”
প্রফেসর রাইখ একটু বিব্রত হয়ে বলল, “না কিছু না।”
“তুমি বলে ফেল কী বলতে চাইছিলে।”
প্রফেসর রাইখ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল, “আমার মনে হয় ক্যাটাগরি এ মানুষেরা ক্যাটাগরি সি মানুষদের উপর খুব বড় অবিচার করছে। ক্যাটাগরি এ মানুষ হিসেবে সেজন্যে আমি লজ্জিত। এবং নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। আমি তোমাদের সাথে কাজ করে আমাদের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই!”
রিটিন কী বলবে বুঝতে পারল না, খানিকক্ষণ অবাক হয়ে প্রফেসর রাইখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “এই গোপন আবাসস্থলটিতে আমি খুব ছোট একজন মানুষ। তোমাকে নিয়ে এসেছিলাম বলে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তোমাকে দেখে শুনে রাখার জন্যে। খাবার, পানীয়, ঘুমের ব্যবস্থা করার জন্যে! তুমি এখন যে কথাগুলো বলছ সেগুলো আমার মতো ছোট মানুষের কাছে বলার কথা নয়। এগুলো অনেক বড় কথা, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা। এই কথাগুলো তোমার আমাদের সুপ্রিম কাউন্সিলের কাছে বলা দরকার। তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি তাদের ডেকে নিয়ে আসি।”
প্রফেসর রাইখ মাথা নেড়ে বলল, “না, না, না, তুমি সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্যদের ডেকে এনো না! আমার যা বলার তোমাকেই বলব। দরকার হলে তুমি অন্যদের বলো। তোমার সাথে আমার এক ধরনের আত্মিক যোগাযোগ হয়েছে–অন্যদের সাথে হয়নি।”
রিটিন বলল, “তোমার মতো একজন মানুষের সাথে আমার আত্মিক যোগাযোগ হয়েছে, এটি আমার জন্যে অনেক বড় ব্যাপার।”
প্রফেসর রাইখ রিটিনের কথাটি শুনতে পেল বলে মনে হলো না, অন্যমনস্কভাবে বলল, “শক্তির ব্যাপারটা এখনই নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু সময়ের ব্যাপারটা কী হবে বুঝতে পারছি না। একটু উনিশ বিশ হলেই সময়ের বিশাল গোলমাল হয়ে যাবে। হয়তো একেবারে ডাইনোসরের এলাকায় গিয়ে হাজির হবে।”
প্রফেসর রাইখ হাহা করে হেসে উঠল। রিটিন লক্ষ করল মানুষটি যখন হাসে তখন তাকে হঠাত করে খুব সহজ সরল সাধারণ একজন মানুষ বলে মনে হয়!
০৯-১০. সময় পরিভ্রমণের সমীকরণ
০৯.
সময় পরিভ্রমণের সমীকরণটি প্রফেসর রাইখ এক রাতে সমাধান করে ফেলেছিল কিন্তু সময় পরিভ্রমণ করার জন্যে টাইম ক্যাপসুলটি তৈরি করার বিষয়টি মোটেও এক রাতের ব্যাপার নয়। সত্যি কথা বলতে কি সেটি কীভাবে তৈরি হবে সে সম্পর্কে পৃথিবীর কারো কোনো ধারণা নেই। প্রফেসর রাইখ নিজের পরিবারকে ছেড়ে ক্যাটাগরি সি মানুষদের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত না নিলে এটি একটি অসম্ভব প্রোজেক্ট হয়ে দাঁড়াত।