হলঘরের দরজা খুলে বের হয়ে রিটিন একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার জীবনের একটাই স্বপ্ন ছিল সে লেখাপড়া করবে, গবেষণা করবে। ক্যাটাগরি সি মানুষের সেই সুযোগ নেই এটাও সে জানে। কিন্তু তার ধারণা ছিল তাকে কথা বলার সুযোগ দিলে সে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে পারবে। অনেক চেষ্টাচরিত্র করে সে কথা বলার সুযোগটা তৈরি করেছিল কিন্তু সে একবারও ভাবেনি পুরো বিষয়টা হবে একধরনের প্রতারণা, চতুর্থ শ্রেণির একটা রোবটকে মাঝবয়সী একটা মহিলা সাজিয়ে বসিয়ে রাখবে–যে রোবটটাকে সে একেবারে হাস্যকর ছেলেমানুষি একটা মেটাকোড দিয়ে অচল করে দিতে পারবে।
রিটিন রাস্তায় নেমে আসে। ব্যস্ত শহর, উঁচু দালানের নিচে সরু রাস্তা ধরে মানুষ যাচ্ছে এবং আসছে। তাদের ভেতর কতজন সত্যিকারের মানুষ কে জানে! রোবটগুলোকে কেন দেখতে মানুষের মতো হতে হবে? মাথার উপর দিয়ে ছোট ছোট বাই ভার্বাল উড়ে যাচ্ছে। মাটির নিচ দিয়ে একটু পরপর পাতাল ট্রেন ছুটে যাচ্ছে, রিটিন তার কম্পন অনুভব করে। হাঁটতে হাঁটতে রিটিন আনমনা হয়ে যায়, একজন মানুষের জীবন কেন এরকম অর্থহীন হতে হবে? কেন তাকে একজন শ্রমিকের জীবন বেছে নিতে হবে? কেন সপ্তাহ শেষে কিছু ইউনিটের জন্যে অর্থহীন পরিশ্রম করতে হবে? কেন সে তার পছন্দের একটা জীবন বেছে নিতে পারবে না? কেন তার বাবা-মা তাকে অন্যদের মতো জেনেটিক ডিজাইন করে ক্যাটাগরি এ মানুষ হিসেবে জন্ম দিল না?
রিটিনের ভেতরে তার মা-বাবার বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভের জন্ম হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে নিজের ভেতরে কোনো ক্ষোভ অনুভব করল না। রিটিন তার ছেলেমানুষ খামখেয়ালি বাবা-মায়ের জন্যে গভীর এক ধরনের মমতা অনুভব করে। তার মা-বাবা জেনেটিক ডিজাইন করে ক্যাটাগরি এ শিশু জন্ম দেয়া বিশ্বাস করতো না। তারা সাধারণ মানুষ হিসেবে সাদামাটা একটা জীবনে বিশ্বাস করত—তাদের সন্তানকে নিয়ে তারা একটা পর্বতের পাদদেশে জীবন কাটাতে চেয়েছিল। কিন্তু পর্বতের হিমবাহ প্রবাহে তার বাবা-মা হঠাৎ করে মারা যাওয়ায় সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেছে। সে অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে। সে যদি ক্যাটাগরি এ শিশু হতো তাহলে তাকে অনাথ আশ্রমে বড় হতে হতো না, তাহলে সে সত্যিকারের একটা পরিবারের সাথে বড় হতে পারত। কিন্তু ক্যাটাগরি সি মানুষ হিসেবে তাকে কোনো পরিবার পালকপুত্র হিসেবে বেছে নেয়নি। তাই তাকে অনাথ আশ্রমে অন্য ক্যাটাগরি সি শিশুদের সাথে বড় হতে হয়েছে। জন্মের মুহূর্তে তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। রিটিন বুঝতে পারে না কেন তাকে এখন জন্ম নিতে হলো, কেন সে আরো কয়েক শ বছর আগে জন্ম নিতে পারল না!
রিটিন একটা উঁচু বিল্ডিংয়ের নিচে দাঁড়িয়েছিল, তার সামনে দিয়ে অসংখ্য মানুষ এবং রোবটেরা হেঁটে যাচ্ছে। যন্ত্রে তার কোনো আগ্রহ নেই কিন্তু মানুষ দেখতে তার খুব ভালো লাগে। সে পথের ধারে কোনো একটা বেঞ্চে বসে বসে সারাদিন সারারাত মানুষ দেখতে পারবে। মানুষের মুখে কত বিচিত্র অনুভূতির ছাপ, সেই অনুভূতির পরিবর্তনগুলো কত সূক্ষ্ম! মানুষ শুধুমাত্র আনন্দ দুঃখ হাসি কান্না এরকম অল্প কয়টি মোটা দাগের অনুভূতি নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে অথচ এর বাইরেও আরো কত সূক্ষ্ম অনুভূতি রয়েছে। রিটিনের মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সে এই অনুভূতিগুলোর একটি একটি করে নাম দেবে। যেমন ধরা যাক প্রিয়জনকে বিদায় জানাতে গিয়ে চোখে পানি এসে যাচ্ছে কিন্তু তাকে চোখের পানি দেখতে দেবে না বলে ফিক করে হেসে দিল, চোখে পানি কিন্তু মুখে হাসি এই অনুভূতিটির কী নাম দেয়া যায়?
রিটিন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ মনে হলো কেউ তার কাঁধে স্পর্শ করেছে।
রিটিন ঘুরে তাকাল, প্রায় তার বয়সী একটা মেয়ে তার কাঁধ স্পর্শ করেছে। মেয়েটির মুখ ভাবলেশহীন, অন্তত সে নিজে এরকম একটা ভাব দেখানোর চেষ্টা করছে। রিটিন অবশ্যি এই ভাবলেশহীন মুখের পেছনে খুব সূক্ষ্ম এক ধরনের উত্তেজনা লক্ষ করল। রিটিন মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি আমাকে কিছু বলবে?”
“হ্যাঁ।” মেয়েটি মাথা নাড়ল, “বলব। তুমি কী করেছ? তোমার ট্রাকিওশান থেকে অ্যালার্ট সিগন্যাল বের হচ্ছে।”
রিটিন অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “কী বললে?”
মেয়েটি বলল, “তুমি শুনেছ আমি কী বলেছি। কেউ যখন অপরাধ করে তখন তার ট্র্যাকিওশান থেকে এই সিগন্যাল বের হয়। তুমি কী করেছ? খুন? ড্রাগ? ডাকাতি? ভায়োলেন্স?”
“আমি কিছু করি নাই।”
মেয়েটা হাসল। বলল, “পুলিশকে সেটা বোঝাতে পারবে? চিন্তা করে দেখো; নিশ্চয়ই কিছু একটা করেছ।”
“আমি আমি–” রিটিন হঠাৎ থেমে গেল, ভ্রূ কুঁচকে বলল, “একটু আগে মেটাকোড দিয়ে একটা রোবটকে ক্র্যাশ করিয়েছি। খুবই নির্বোধ রোবট–পাইয়ের একটা সিকোয়েন্স দিয়ে ক্র্যাশ করানো যায়!”
মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, “হ্যাঁ, এটাও অপরাধ! এই অপরাধের জন্যে তোমার ট্র্যাকিওশানকে ট্রিগার করতে পারে।”
“কিন্তু আমি এটা পেয়েছি একটা বাথরুমের দেয়ালের লেখা থেকে–”
মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, “বাথরুমের দেয়ালে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানের কথা লেখা থাকে। আমি অনেক কিছু শিখেছি। যাই হোক তোমাকে জানিয়ে রাখলাম তোমার ট্র্যাকিওশান ট্রিগার করেছে। যেকোনো সময় পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে! গুডলাক–” বলে মেয়েটা পেছন দিকে হাঁটতে শুরু করে।