রিটিন ভয় পাওয়া গলায় বলল, “তাহলে সবকিছু পূর্ব নির্ধারিত?”
রিটিনের বিপরীতে বসে থাকা একজন বৃদ্ধ বলল, “এই প্রশ্নটির কোনো অর্থ নেই। যদি পূর্ব নির্ধারিত হয়েও থাকে আমরা সেটা জানি শুধুমাত্র সেটা ঘটার পর। কাজেই পূর্ব নির্ধারিত হওয়া না হওয়ায় জগৎ সংসারের কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হয় না!”
রিটিন একধরনের শূন্য দৃষ্টিতে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর শুকনো গলায় বলে, “এখন তোমরা কী করবে?”
ক্লিওন বলল, “আমরা তোমাকে অতীতে পাঠাব রিটিন। অতীতে একটি মেয়ে তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে।”
মধ্যবয়স্ক মহিলাটি নিচু গলায় বলল, “শুধু সে জানে না যে সে তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে।”
রিটিন দেয়ালে বড় ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকে। হাসিখুশি একটি মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো ক্ষোভ নেই, অভিযোগ নেই, সেই চোখে শুধু বিস্ময়কর এক সারল্য।
রিটিন হঠাৎ করে এই অপরিচিত মেয়েটির জন্যে তার বুকের ভেতর গভীর এক ধরনের মমতা অনুভব করে।
.
০৮.
প্রফেসর রাইখ চমকে উঠে দেখলেন তার সামনে একটা ছোট বাইভার্বাল থেমেছে। সে স্পেস টাইমের যে সমীকরণটির সমাধান তার মস্তিষ্কের ভেতর প্রায় শেষ করে এনেছিল সেটি এলোমেলো হয়ে গেল। প্রফেসর রাইখ খুব বিরক্ত হয়ে বাইভার্বালটির দিকে তাকাল এবং দেখল তার দরজা খুলে ভেতর থেকে কম বয়সী একজন তরুণ নেমে এসেছে। তরুণটি যে রিটিন, প্রফেসর রাইখের সেটি জানার কোনো উপায় ছিল না।
রিটিন প্রফেসর রাইখের দিকে কয়েক পা এগিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, “শুভসন্ধ্যা প্রফেসর রাইখ। আমি তোমাকে নিতে এসেছি।”
রিটিনের কথা শুনে প্রফেসর রাইখের বিরক্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছাল। সে জ কুঁচকে বলল, “আমি নিজে নিজে আমার বাসায় যেতে পারব। কাউকে আমাকে নিয়ে যেতে হবে না।”
রিটিন তার মুখের হাসিটি আরেকটু বিস্তৃত করে বলল, “তুমি আমার কথাটি ঠিক বুঝতে পারোনি। আমি তোমাকে জোর করে ধরে নিয়ে যেতে এসেছি।”
প্রফেসর রাইখ অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ, সে সাথে সাথে বিপদটুকু আঁচ করতে পারল। মুখে একটা শান্তভাব ফুটিয়ে বলল, “তুমি নিশ্চয়ই এরকম একটি কাজ করবে না। কেন আমাকে ধরে নিতে এসেছ আমি জানি না, কিন্তু আমি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় আছি–আমাকে ধরে নিয়ে তুমি হজম করতে পারবে না।”
রিটিন বলল, “তোমাকে কে বলেছে আমি তোমাকে হজম করতে চাই। আমি তোমাকে খানিকটা ব্যবহার করতে চাই।”
“জোর করে কাউকে ব্যবহার করা যায় না।”
“কে বলেছে তোমাকে আমি জোর করে ব্যবহার করব? আমাদের কাছে তোমার জন্যে এমন চমকপ্রদ একটি সমস্যা আছে যে, দেখবে সেটা সমাধান করার জন্যে তুমি রীতিমতো পাগল হয়ে যাবে!”
রিটিন এবার দুই পা এগিয়ে গিয়ে খপ করে প্রফেসর রাইখকে ধরে ফেলল, তারপর বলল, “এখানে সময় নষ্ট করা খুব বুদ্ধিহীন মানুষের কাজ হবে। তোমাকে রক্ষা করার জন্যে মনে হয় নিরাপত্তা বাহিনী ড্রোন আর বাইভার্বালের বহর রওনা দিয়ে দিয়েছে।” কথা শেষ করে রিটিন হ্যাঁচকা টান দিয়ে প্রফেসর রাইখকে বাইভার্বালের উপরে তুলে ফেলল। ড্রোনের দরজাটি সাথে সাথে বন্ধ হয়ে উপরে উঠে গেল।
প্রফেসর রাইখ বলল, “তুমি নিতান্তই নির্বোধ। তুমি বুঝতে পারছ না আগামী পনেরো মিনিটের ভেতর তুমি মারা পড়বে।”
রিটিন বাইভার্বালের কন্ট্রোল প্যানেলে হাত রেখে স্বাভাবিক গলায় বলল, “আমি তোমার কথা অবিশ্বাস করছি না। আমি সম্ভবত যথেষ্ট নির্বোধ। কিন্তু তুমি একটা জায়গায় ভুল করছ। আমি মারা পড়ব না। আমাকে পৃথিবীর কেউ হত্যা করতে পারবে না। সময় পরিভ্রমণ করে আমি আনুমানিক পাঁচশ বৎসর অতীতে যাব, আমি যে গিয়েছিলাম তার প্রমাণ আছে। কেউ আমাকে মেরে ফেললে আমি কেমন করে যাব? তাই এখন কেউ আমাকে মারতে পারবে না। প্রকৃতি আমাকে রক্ষা করছে।”
প্রফেসর রাইখ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল। তাকে জোর করে ধরে নিয়ে আসার আগে সে স্পেস টাইমের ঠিক এই সমস্যার একটি সমাধান বের করার চেষ্টা করছিল–তবে সেটি জীবন্ত একটি মানুষকে নিয়ে নয়, এক জোড়া ইলেকট্রন পজিট্রন নিয়ে। প্রফেসর রাইখ অবিশ্বাসের গলায় বলল, “কী বলছ তুমি?”
“আমি সত্যি কথা বলছি। তুমি কিছুক্ষণের ভেতর নিজেই দেখতে পাবে।”
“তোমরা কারা?”
“আমরা ক্যাটাগরি সি মানুষ! তুমি যেহেতু বড় প্রফেসর জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা করো তাই ধরে নিচ্ছি তুমি ক্যাটাগরি এ মানুষ।”
“অবশ্যই আমি ক্যাটাগরি এ।”
রিটিন হাসল, বলল, “পদার্থবিজ্ঞানে তোমার যথেষ্ট জ্ঞান থাকলেও মানবসমাজ বা পৃথিবীর ইতিহাস নিয়ে তুমি বিশেষ কিছু জানো না। মানুষের ভেতর এই ক্যাটাগরি এ এবং সি বিভাজনের পুরো ব্যাপারটা আসলে ভুয়া। তোমার আর আমার মাঝে আসলে কোনো পার্থক্য নেই।”
প্রফেসর রাইখ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আছে। আমাদের মস্তিষ্কের গঠন এবং তোমাদের মস্তিষ্কের গঠনে মৌলিক পার্থক্য আছে। নিউরনের সংখ্যায় পার্থক্য আছে। তাদের সিনান্স সংখ্যায় পার্থক্য আছে। কাজেই চিন্তা করার ক্ষমতার পার্থক্য আছে!”
“তোমাদেরকে সেটা বোঝানো হয়েছে। সেটা সত্যি নয়, আমাদের সুযোগ না দেয়ার কারণে আমরা আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়েছি তার বেশি কিছু নয়।”
“ক্যাটাগরি এ মানুষের মস্তিষ্কের গঠন নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে।”