ক্লিওন রিটিনকে বলল, “রিটিন, তুমি বসো। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।”
সবাই স্থির দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকিয়ে আছে, রিটিন একধরনের অস্বস্তি অনুভব করে। সে জোর করে অস্বস্তিটুকু কাটিয়ে তার জন্য আলাদা করে রাখা চেয়ারটাতে বসল।
ক্লিওন তার সামনে রাখা একটা ফ্লাক্স থেকে খানিকটা পানীয় একটা গ্লাসে ঢেলে গ্লাসটা তার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, “নাও খাও। এটা তোমার স্নায়ুকে শীতল করবে। আমরা এখন তোমাকে যেটা বলব সেটা শোনার জন্যে তোমার স্নায়ুকে শীতল রাখতে হবে।”
রিটিন পানীয়ের গ্লাসটি হাতে নিয়ে ইতস্তত করে বলল, “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কী হয়েছে?”
“বলছি। তার আগে পানীয়টাতে চুমুক দাও। সত্যি সত্যি তোমার স্নায়ু শীতল রাখা দরকার। আমরা সবাই আমাদের পানীয় খাচ্ছি।”
রিটিন তার পানীয়তে চুমুক দিল এবং সত্যি সত্যি তার শরীরে আরামদায়ক এক ধরনের শীতলতা ছড়িয়ে পড়ল। রিটিন দ্বিতীয়বার পানীয়টিতে চুমুক দিয়ে ক্লিওনের দিকে উৎসুক চোখে তাকাল।
ক্লিওন বলল, “আমি তোমাকে এখন একটি ছবি দেখাব। সত্যি ছবি। ছবিটি দেখে তোমার বলতে হবে ছবিটি কার।”
রিটিনের কাছে ক্লিওনের কথাগুলো একধরনের হেঁয়ালির মতো মনে হলেও সে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকে। ক্লিওন তার সামনে অদৃশ্য মনিটরটি স্পর্শ করতেই দেয়ালে একটা ছবি ফুটে উঠল, সাদা কালো একটি ছবি। ছবিতে রিটিন হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে, তার কোলে একটি চার-পাঁচ বছরের শিশু, পাশে একটি হাসিখুশি তরুণী।
ক্লিওন জিজ্ঞেস করল, “চিনতে পারছ?”
রিটিন অনিশ্চিতের মতো বলল, “হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি। এটি আমার ছবি। কিন্তু এই ছবিটি আমি কখন তুলেছি মনে করতে পারছি না। এই মেয়েটি কে আমি জানি না–শিশুটি কে সেটাও জানি না।”
ক্লিওন বলল, “তুমি এই মেয়েটিকে চিনবে না, শিশুটিকেও চিনবে না কারণ তোমার সাথে এখনো তাদের দেখা হয়নি। ছবিটি কখন তোলা হয়েছে তুমি সেটিও জানো না কারণ ছবিটিও এখনো তোলা হয়নি। তবে ছবিটি তোলা হবে।”
রিটিন ইতস্তত করে বলল, “ভবিষ্যতে কখনো আমি এই ছবিটি তুলব? তোমরা ভবিষ্যতের একটা ছবি এখন পেয়ে গেছ?”
ক্লিওন মাথা নাড়ল, বলল, “তোমার প্রশ্নের উত্তর একই সাথে হ্যাঁ এবং না। হ্যাঁ–তুমি তোমার জীবনের ভবিষ্যতে এই ছবিটি তুলবে এবং না–ভবিষ্যতে কখনো এই ছবিটি তোলা হবে না। এই ছবিটা তোলার জন্যে তুমি আজ থেকে পাঁচশত বছর অতীতে যাবে। সেভাবে দেখলে বলা যায় ছবিটা তোলা হয়ে গেছে! পাঁচশ বছর আগে এই ছবিটি তোলা হয়ে গেছে! আমরা পুরাতন আর্কাইভে এই ছবিটি পেয়েছি! এই ছবিটি বহুদিন আগে আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। কে পাঠিয়েছে কেন পাঠিয়েছে আমরা জানতাম না। এখন আমরা অনুমান করছি”
রিটিন কাঁপা গলায় বলল, “আমি পাঠিয়েছি তোমাদের কাছে?”
“হ্যাঁ। তুমি পাঠিয়েছ আমাদের কাছে। যেন আমরা এটা পাই এবং বুঝতে পারি সময় পরিভ্রমণের সর্বশেষ যে তাত্ত্বিক গবেষণাটি এসেছে সেটি সত্যি। সেটি ব্যবহার করে সত্যি সত্যি সময় পরিভ্রমণ করে অতীতে যাওয়া সম্ভব।”
রিটিনের মাথাটি হঠাৎ কেমন জানি ঝিমঝিম করতে থাকে। সে পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারে না। হাতের গ্লাসে যেটুকু পানীয় ছিল সে এক টেকে পুরোটুকু শেষ করে দিয়ে বলল, “তার মানে সময় পরিভ্রমণ করে আমি অতীতে যাব?”
“হ্যাঁ রিটিন, সময় পরিভ্রমণ করে তুমি অতীতে যাবে।”
“কেন যাব সেটা কি আমরা জানি?”
ক্লিওনের পাশে বসে থাকা ধবধবে সাদা চুলের বৃদ্ধমানুষটি এবারে রিটিনের প্রশ্নের উত্তর দিল। বলল, “না, আমরা এখনো পুরোপুরি জানি না। শুধু অনুমান করতে পারি।”
“কী অনুমান করেছ?”
“তুমি যাবে নিয়ন্ত্রণ ভবন ধ্বংস করতে।”
রিটিন চোখ বড় বড় করে তাকাল, বলল, “যে নিয়ন্ত্রণ ভবন থার্মো নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে ধ্বংস করা যায় না, পৃথিবী ধ্বংস হলেও যেটা ধ্বংস হবে না, আমি সেটা ধ্বংস করব?”
“হ্যাঁ।”
“কীভাবে?”
“কারণ তুমি কিছু বিস্ফোরক নিয়ে এই ভবনটির ভেতর হাজির হবে। বাইরে থেকে ভবনের ভেতর ঢোকা যাবে না–কিন্তু যেখানে ভবনটি তৈরি হবে তুমি সেখানে হাজির থাকবে।”
“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।” রিটিন অসহায়ের মতো মাথা নাড়ল, বলল, “আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
রিটিনের কাছাকাছি বসে থাকা মধ্যবয়সী একজন মহিলা কোমল গলায় বলল, “তোমার এখন কিছু বুঝতে হবে না রিটিন। যখন বোঝার সময় হবে তখন বুঝলেই হবে। আমরাও এখনো সবকিছু বুঝে উঠতে পারিনি।”
রিটিন হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলল, “কিন্তু, কিন্তু–”
“কিন্তু কী?”
“সময়ে যদি সত্যি পরিভ্রমণ করা সম্ভব হয় তাহলে আমি যদি অতীতে গিয়ে আমার বাবাকে কিংবা মাকে খুন করে ফেলি তাহলে আমার জন্ম হবে কেমন করে?”
ক্লিওন বলল, “সময় পরিভ্রমণ নিয়ে শেষ যে তত্ত্বটি আমরা পেয়েছি সেখানে এর ব্যাখ্যা দেয়া আছে। আমরা পুরোটা এখনো বুঝতে পারিনি। জটিল জটিল সমীকরণ দিয়ে যেটা ব্যাখ্যা করা হয়েছে সেটা হচ্ছে, সময় পরিভ্রমণ করে তুমি নিকট অতীতে যেতে পারবে না যেখানে তুমি নিজের ভবিষ্যৎকে পরিবর্তন করতে পারো। চেষ্টা করলে ভয়ংকর কিছু ঘটবে। তোমাকে যেতে হবে দূর অতীতে যেন কোনো পরিবর্তন করলেও তার প্রভাব তোমার ভবিষ্যতে চলে আসে। অর্থাৎ তুমি যদি যথেষ্ট অতীতে গিয়ে তোমার কোনো পূর্বপুরুষকে হত্যা করো তারপরও তোমার জন্ম হবে অন্য কোনো পূর্বপুরুষ দিয়ে–”