কন্ট্রোল সেন্টারে মিশনটি শেষ করার কারণে খুব বড় একটা লাভ হয়েছে বলে মনে হলো। ক্যাটাগরি সি মানুষের দলটি বিশাল একটি তথ্যভান্ডার সংগ্রহ করতে পেরেছে, যেটি অন্য কোনোভাবে সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। উপরের দিকের নেতৃস্থানীয় মানুষেরা খুবই উত্তেজিত। ঠিক কী ধরনের তথ্য পেয়েছে সেটি রিটিন কিংবা রিটিনের মতো মানুষেরা কিছুই জানে না। সম্ভবত জানার দরকারও নেই–যদি কখনো জানার দরকার হয় নিশ্চয়ই জানিয়ে দেবে। রিটিন তারপরও একদিন সেটা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করল।
ডাইনিং টেবিলে আরেক দিন ক্লিওন খাবারের ট্রে নিয়ে রিটিনদের টেবিলে এসে বসল। আগেরবারের মতো ক্লিওন এবারেও খাবারের মান নিয়ে নানা ধরনের কথা বলল এবং একসময় তারা কে
কী করছে সেটা জানতে চাইল। রিটিন নিজের কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল, “কন্ট্রোল সেন্টারের মিশন শেষ করে আমরা অনেক তথ্য পেয়েছি। সেগুলো কী ধরনের তথ্য আমাদের বলবে?”
ক্লিওন বলল, “এই তথ্যগুলো আসলে গোপন, তোমাদের জানার কথা নয়। কিন্তু তুমি যেহেতু জিজ্ঞেস করেছ বলি–”
রিটিন প্রস্তুত হয়ে বলল, “না না। গোপন হলে আমাদের বলতে হবে না। আমি বুঝতে পারিনি।”
ক্লিওন শুকনো এক টুকরো রুটি স্যুপে ভিজিয়ে নরম করে চিবুতে চিবুতে বলল, “তোমার কারণে আমরা এই তথ্যগুলো পেয়েছি, তাই তোমার নিশ্চয়ই জানার অধিকার আছে।”
টেবিলে দাঁড়ানো অন্যেরা দ্রতা করে উঠে দাঁড়িয়ে অন্য টেবিলে চলে যেতে চাইল যেন ক্লিওন নিরিবিলি রিটিনের সাথে কথা বলতে পারে, ক্লিওন হাত তুলে তাদের থামাল। বলল, “তোমরাও শুনতে পারবে। কোনো গুরুতর অন্যায় হয়ে যাবে না। তা ছাড়া কেউ যদি বুদ্ধিমান হয় তাহলে নিজেরাই চিন্তা করে এগুলো বের করে ফেলতে পারবে।”
রিটিনের পাশে বসে থাকা মেয়েটি হেসে বলল, “আমাদের মাঝে সেরকম বুদ্ধিমান কেউ আছে বলে মনে হয় না।”
ক্লিওন হাসল, বলল, “আছে, নিশ্চয়ই আছে। যাই হোক কন্ট্রোল সেন্টারের ওয়েভ গাইড দিয়ে নিরাপত্তা নিয়ে তথ্য আদান প্রদান করে। কাজেই বেশির ভাগ তথ্য নিরাপত্তা নিয়ে। কোথায় কোথায় নিয়ন্ত্রণ ভবন আছে সেগুলো আমরা মোটামুটি জানতাম এখন পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছি।”
রিটিনের পাশে বসে থাকা মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, “আমরা শুনেছি মূল যে নিয়ন্ত্রণ ভবন সেটি থার্মো নিউক্লিয়ার বোমা দিয়েও ধ্বংস করা যায় না? শুধুমাত্র পৃথিবী ধ্বংস হলেই সেটা ধ্বংস হবে?”
ক্লিওন মাথা নাড়ল। বলল, “তোমরা ঠিকই শুনেছ। মূল ভবনটি আসলেই এরকম। মনে হয় পৃথিবীটা ধ্বংস হলেও এই ভবনটি ধ্বংস হবে না।”
রিটিন বলল, “এর ভেতরে যারা থাকে তারা বের হয় কেমন করে?”
ক্লিওন বলল, “বের হয় না। ওটার ভেতরেই তাদের জীবন।”
“তাহলে নিশ্চয়ই রোবট?”
“না। রোবট না। মানুষ। যারা মানুষের মাঝে বিভাজন করেছে তারা নিশ্চয়ই মানুষ।”
আলোচনার এই পর্যায়ে মানুষে মানুষে বিভাজন, পৃথিবীর সমাজব্যবস্থা, পৃথিবীর ইতিহাস এরকম একটা আলোচনা শুরু হয়ে গেল। রিটিন একধরনের বিস্ময় নিয়ে অবিষ্কার করল ক্লিওনের ভেতরে কোনো কিছু নিয়ে কোনো ক্ষোভ নেই। সে সবকিছুকে মেনে নিতে পারে এবং সবকিছু মেনে নিয়েও তার বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ করে যেতে পারে। রিটিন অবাক হয়ে ভাবল সে যখন ক্লিওনের বয়সে পৌঁছাবে তখন সেও কি ক্লিওনের মতো বুকের ভেতর থেকে সব ক্ষোভ, সব প্রতিহিংসা দূর করে দিতে পারবে?
খাবার শেষ করে ক্লিওন উঠে যাবার আগে রিটিন জিজ্ঞেস করল, “কন্ট্রোল সেন্টার ধ্বংস হবার পর আমরা কি আর কোনো তথ্য পেয়েছি?”
ক্লিওন মাথা নাড়ল, বলল, “পেয়েছি। আমরা গবেষণার অনেক তথ্য পেয়েছি। কিন্তু সেগুলো বেশির ভাগ আমরা ব্যবহার করতে পারব না।”
“সময় পরিভ্রমণ নিয়ে কোনো তথ্য?”
“হ্যাঁ পেয়েছি। কেন?”
রিটিন একটু লজ্জা পেয়ে গেল, লাজুক মুখে বলল, “সময় পরিভ্রমণ নিয়ে আমার খুব কৌতূহল। আমার এই বিষয় নিয়ে কাজ করার খুব শখ।”
ক্লিওন শব্দ করে হাসল। হেসে বলল, “একজন মানুষের শখ কখনো অপূর্ণ রাখতে হয় না। বিশেষ করে তোমার শখ অবশ্যই আমাদের পূরণ করতে হবে। তুমি হচ্ছ বিশেষ মানুষ, প্রকৃতি তোমাকে নিজের হাতে রক্ষা করে”
হঠাৎ করে ক্লিওন মাথা ঘুরিয়ে রিটিনের দিকে তাকাল। তার চোখে-মুখে হঠাৎ করে এক সাথে বিচিত্র একধরনের উত্তেজনা এবং অবিশ্বাস উঁকি দিয়ে যায়। রিটিন বুঝতে পারল ক্লিওন তার ভেতরকার এই অনুভূতিটি জোর করে চেপে রাখার চেষ্টা করেছে। সে কয়েক সেকেন্ড বিস্ফারিত দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর অনেকটা জোর করে রিটিন থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিল এবং একধরনের হতবিহ্বলভাবে খাবারের খালি ট্রে হাতে নিয়ে বের হয়ে গেল।
রিটিনের পাশে বসে থাকা মেয়েটি অবাক হয়ে রিটিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হলো? হঠাৎ করে ক্লিওন এত বিচলিত হলো কেন?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “জানি না।”
.
ক্লিওন হঠাৎ করে কেন এমনভাবে বিচলিত হয়েছিল সেটি অবশ্যি রিটিন সেদিন বিকেলবেলাতেই জানতে পারল। একজন এসে তাকে আবাসস্থালের শেষ মাথায় দুর্ভেদ্য অংশটুকুতে ডেকে নিয়ে গেল। নিরাপত্তার তিনটি স্তর পার হওয়ার পর একটা মাঝারি কনফারেন্স রুমে হাজির হয়ে রিটিন আবিষ্কার করে একটা গোল গ্রানাইটের টেবিলকে ঘিরে বেশ কয়েকজন বসে আছে, একটা চেয়ার আলাদাভাবে তার জন্যে খালি করে রাখা আছে। যারা বসে আছে তাদের মাঝে রিটিন শুধু ক্লিওনকে চিনতে পারল, অন্যেরা সবাই ক্লিওনের বয়েসী কিংবা তার থেকেও বৃদ্ধ কিন্তু তাদের কাউকে সে আগে দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছে ক্যাটাগরি সি মানুষদের সংগ্রামে এরা সবাই বড় বড় দায়িত্বে থাকে।