মাঝখানে ফাঁকা জায়গা, রিটিন সেখানে দাঁড়াতেই উপর থেকে একটা ড্রোন নিচে নেমে আসে, তারপর চোখের পলকে তাকে জাপটে ধরে সেটি আবার উপরে উঠে যায়। রিটিন ইতস্তত গুলির শব্দ শুনতে পায় কিন্তু সে জানে তাকে সেগুলো আর তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। দুই ঘণ্টা পর রিটিনের সাথে ক্লিওনের দেখা হলো। ক্লিওন একটা টেবিলে পা তুলে চেয়ারে মাথা হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে ছিল, রিটিনকে দেখে সে সোজা হয়ে বসে বলল, “এসো রিটিন।”
রিটিন বলল, “মিশন শেষ হয়েছে।”
ক্লিওন বলল, “আমরা সেই খবর পেয়েছি। আমরা একটা কোয়ার্টজ গাইডের কিছু তথ্য এখন বের করে ফেলতে পারব। তোমাকে বলা হয়েছিল সেটা অক্ষত রেখে অন্যগুলো ধ্বংস করতে।”
“মনে হয় করতে পেরেছি।”
“হ্যাঁ। তুমি করতে পেরেছ। এখন সবগুলো কোয়ার্টজের ওয়েব গাইডের তথ্যগুলো এটা দিয়ে যাবে। আমরা বিশাল একটা তথ্যভান্ডার পেয়ে যাব। তোমাকে ধন্যবাদ রিটিন।”
রিটিন হাসল, বলল, “আমাকে ধন্যবাদ দেয়ার কিছু নেই ক্লিওন। তুমি জানো আমাকে প্রায় প্রোগ্রাম করে পাঠানো হয়েছিল। আমি নিজে কিছু করিনি, যেভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছিল ঠিক সেভাবে যখন যেটা করার কথা সেটা করে গেছি!”
ক্লিওন বলল, “এর আগে আমরা যাদের পাঠিয়েছিলাম তাদেরও আমরা ঠিক তোমার মতো প্রোগ্রাম করে পাঠিয়েছিলাম। তাদের কেউ তোমার মতো বেঁচে ফিরে আসতে পারেনি।”
রিটিন বলল, “আমি নিশ্চয়ই অনেক ভাগ্যবান একজন মানুষ।”
ক্লিওন মাথা নাড়ল, বলল, “না, শুধু ভাগ্য দিয়ে এটা সম্ভব না। অন্য কিছু প্রয়োজন।”
রিটিন একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “অন্য কিছু? অন্য কিছু কী? আজকের আগে আমি জীবনে একটি অস্ত্র কখনো স্পর্শ করিনি–এখানে আমার নিজের বিন্দুমাত্র দক্ষতা ছিল না।”
ক্লিওন বলল, “আমি তোমার দক্ষতার কথা বলছি না।”
“তাহলে কিসের কথা বলছ?”
“আমরা সবাই মিলে একটু আগে তোমার মিশনের খুঁটিনাটি দেখেছি, আমাদের সিস্টেম দিয়ে বিশ্লেষণ করিয়েছি। আমরা যেটা দেখেছি সেটি অবিশ্বাস্য–”
“সেটি কী?”
“এই মিশন থেকে তোমার জীবিত ফিরে আসার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না। তোমাকে লক্ষ করে মানুষ রোবট এবং স্বয়ংক্রিয় প্রতিরক্ষা অস্ত্র অসংখ্যবার গুলি করেছে। মিশন শুরু করার পাঁচ মিনিটের ভেতর তোমার সারা শরীর গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু–”
“কিন্তু কী?”
“কিন্তু একটি গুলিও তেমার শরীরে লাগেনি। মনে হয়েছে” ক্লিওন কথা শেষ না করে থেমে গেল।
রিটিন জিজ্ঞেস করল, “কী মনে হয়েছে?”
ক্লিওন একটা নিঃশ্বাস নিল, নিজের হাতের দিকে তাকাল তারপর ঘুরে রিটিনের দিকে তাকাল। বলল, “মনে হয়েছে কেউ তোমাকে খুব যত্ন করে রক্ষা করছে।”
“রক্ষা করছে? আমাকে?”
“হ্যাঁ।”
রিটিন প্রায় হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে কে রক্ষা করবে?”
“প্রকৃতি।”
“প্রকৃতি?” রিটিন হকচকিত হয়ে ক্লিওনের দিকে তাকাল; জিজ্ঞেস করল, “প্রকৃতি একজন মানুষকে রক্ষা করতে পারে?”
ক্লিওন মাথা নাড়ল, বলল, “নিশ্চয়ই পারে। তা নাহলে তুমি কেমন করে জীবন্ত ফিরে এলে? প্রকৃতির নিশ্চয়ই যেকোনো মূল্যে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তোমার নিশ্চয়ই কোনো একটি কাজ করার কথা যেটি আমরা জানি না। প্রকৃতি জানে, সে জন্যে তোমাকে রক্ষা করেছে।”
রিটিন মাথা নেড়ে বলল, “তুমি কী বলছ এসব? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
ক্লিওন হাসার চেষ্টা করল, বলল, “আমি কী বলছি সেটা আসলে আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। কিন্তু এছাড়া আমার আর কোনো ব্যাখ্যা নেই। তোমার এখনো কোনো একটা কাজ করা বাকি। গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ।”
রিটিন হকচকিতের মতো ক্লিওনের দিকে তাকিয়ে রইল।
০৭-০৮. প্রথম কয়েকদিন রিটিন
০৭.
প্রথম কয়েকদিন রিটিন ক্লিওনের কথাগুলো নিজের ভেতর নানাভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করল। ক্লিওনের কথা যদি সত্যি হয় তাহলে এই পৃথিবীর সবকিছু পূর্ব নির্ধারিত। কোনো না কোনোভাবে নির্ধারণ করা হয়ে আছে যে রিটিনকে ভবিষ্যতে কোনো একটা বিশেষ কাজ করতে হবে, সেই কাজটি যেন সে করতে পারে সেজন্যে প্রকৃতির তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে! ভাবনাটিই অতি বিচিত্র, প্রকৃতি কেমন করে জানবে যে তাকে ভবিষ্যতে একটা কাজ করতে হবে? ভবিষ্যৎটি এখনো আসেনি কাজেই সেই বিশেষ কাজটি তাকে দিয়েই করাতে হবে সেটি কে বলেছে?
অনেক ভেবে ভেবে সে যখন এই বিচিত্র ধাঁধাটি সমাধান করতে পারল না তখন সে ব্যাপারটি ভুলে যাবার চেষ্টা করল। ধরে নিল কন্ট্রোল সেন্টারের মিশনে তার জীবন্ত ফিরে আসার ব্যাপারটি হচ্ছে একটি কাকতালীয় ঘটনা। এটি ছিল অস্বাভাবিক কম সম্ভাবনার একটি ঘটনা কিন্তু তারপরও সেটি ঘটে গেছে। ব্যাপারটি এভাবে মেনে নেয়ার পর রিটিনের পুরো ঘটনাটি ভুলে যাবার কথা ছিল কিন্তু কোনো একটি বিচিত্র কারণে রিটিন ঘটনাটি ভুলতে পারল না। সেই ভয়ংকর রাতটিতে যেকোনো মুহূর্তে সে গুলি খেয়ে মারা যেতে পারত কিন্তু তার মাথায় একটিবারও মৃত্যুভয় আসেনি। একবারও মনে হয়নি সে গুলি খেয়ে মারা যাবে, এই অতি বিচিত্র আত্মবিশ্বাসটি কেমন করে তার ভেতরে জন্ম নিয়েছিল? সত্যিই কি প্রকৃতির সাথে সাথে সেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ না করা পর্যন্ত তার মৃত্যু নেই? সে এখন মারা যেতে পারে না? কী আশ্চর্য!