রিটিন দূর থেকে জটলাটি কিছুক্ষণ উপভোগ করে নিজের আস্তানায় ফিরে এল।
.
সন্ধেবেলা ডাইনিং টেবিলে একটা ঘটনা ঘটল। সে অন্যদের সাথে খেতে বসেছে, তখন হঠাৎ বুঝতে পারল ঘরের মাঝে একধরনের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে, কারণটি বোঝার জন্যে সে পাশের মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
মেয়েটি বলল, “ক্লিওন।”
“ক্লিওন কে?”
মেয়েটি চাপা গলায় বলল, “তুমি ক্লিওনের নাম শোননি? আমাদের পুরো আন্দোলনের নেতা।”
রিটিন অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “কেউ আমাকে বলেনি। আমি কেমন করে জানব?”
রিটিন মাথা ঘুরিয়ে ক্যাটাগরি সি মানব প্রজাতির অধিকার আদায়ের নেতা ক্লিওনকে দেখার চেষ্টা করতে করতে বলল, “কোন জন ক্লিওন?”
“ওই যে বয়স্ক মানুষটি, খাবারের ট্রে থেকে খাবার নিচ্ছে।”
ঠিক কী কারণ জানা নেই রিটিন ভেবেছিল এরকম গুরুত্বপূর্ণ মানুষটিকে নিশ্চয়ই আলাদাভাবে চোখে পড়বে কিন্তু সে দেখল ক্লিওন মানুষটির চেহারা খুবই সাধারণ। এলোমেলো চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনে একটা রং জ্বলে যাওয়া শার্ট এবং একটা বর্ণহীন ট্রাউজার।
মেয়েটি ফিসফিস করে বলল, “কখনো ডাইনিং রুমে খেতে আসে না, আজকে কেন এসেছে কে জানে!”
রিটিন খেতে খেতে চোখের কোনা দিয়ে ক্লিওনকে লক্ষ করার চেষ্টা করল। দেখল ক্লিওন তার ট্রেতে খাবার তুলে ডাইনিং হলের মানুষগুলোকে দেখার চেষ্টা করছে। মনে হলো সে কাউকে খুঁজছে।
ক্লিওন রিটিনদের টেবিলের দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে তাদের টেবিলের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। কাছাকাছি এসে থেমে গিয়ে রিটিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি নিশ্চয়ই রিটিন?”
টেবিলের সবাই তখন খাওয়া বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেছে, রিটিনও দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, “জি। আমি রিটিন।”
ক্লিওন বলল, “আমি কি তোমাদের টেবিলে বসতে পারি?”
টেবিলের সবাই একসাথে বলল, “অবশ্যই অবশ্যই।”
একজন উঠে প্রায় দৌড়ে গিয়ে ক্লিওনের জন্যে একটা চেয়ার নিয়ে এল। ক্লিওন ঠিক রিটিনের সামনের চেয়ারটিতে বসে খাবারের ট্রেটা টেবিলের উপর রাখে। তারপর প্লেটের খাবার এবং বাটির স্যুপের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “স্যুপের চেহারা দেখেছ? মনে হচ্ছে হাতধোয়া পানি!”
রিটিনের পাশে বসে থাকা মেয়েটি বলল, “কিন্তু এটি খুব পুষ্টিকর। এর মাঝে কিশিনি ফর্টি টু আছে।”
ক্লিওন হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “সেটাই হচ্ছে সমস্যা। জৈব খাবার উঠে সব কৃত্রিম খাবার। আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে জন্ম নেয়া উচিত ছিল–তাহলে সত্যিকারের জৈব খাবার খেতে পারতাম। না জানি সেগুলো খেতে কেমন ছিল!”
রিটিন সাহস করে আলোচনায় যোগ দিল, বলল, “আমি প্রাচীন সাহিত্যে দেখেছি সেখানে সবসময় খাবারের বর্ণনা থাকে। সেই সময় খাবারে অনেক বৈচিত্র্য ছিল।”
ক্লিওন মাথা নাড়ল বলল, “হ্যাঁ, মানুষ তখন সভ্য ছিল। এখন আমরা অসভ্য। বর্বর।”
ক্লিওনের কথার ভঙ্গি দেখে সবাই হেসে ওঠে। ক্লিওন এক চামচ স্যুপ খেয়ে রিটিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আসলে তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি।”
রিটিনের গলায় খাবার আটকে গেল, কোনোমতে সেটা গলা দিয়ে নিচে নামিয়ে অবাক হয়ে বলল, “আমার সাথে?”
“হ্যাঁ। তোমার সাথে।” ক্লিওন আরেক চামচ স্যুপ মুখে দিয়ে বলল, “ট্রাকিওশান সরানোর পর আজকে তুমি প্রথমবার বাইরে গিয়েছিলে?”
রিটিন হঠাৎ একধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। ট্র্যাক্রিওশান ছাড়া বের হবার পর তাদের খুব সতর্ক থাকার কথা। সে প্রথম দিকে সতর্ক ছিল কিন্তু ধীরে ধীরে তার ভেতর খানিকটা নির্বোধ আত্মবিশ্বাস চলে এসেছিল, শহরের কেন্দ্রে সে একটা নিচু শ্রেণির সাইবর্গকে মেটাকোড দিয়ে অচল করে দিয়েছিল।
রিটিন যেটা ভয় পাচ্ছিল সেটাই হলো। ক্লিওন জিজ্ঞেস করল, “প্রথম দিন তুমি ঘর থেকে বের হয়ে শহরের কেন্দ্রে গাড়ি বাইভার্বাল ট্রাক লরির মহা জটলা লাগিয়ে চলে এসেছ?”
রিটিন শুকনো মুখে মাথা নেড়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু ক্লিওন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “সেটা ঘটিয়েছ খুব কায়দা করে, একটা পিক্সি সাইবর্গকে মেটাকোড় দিয়ে অচল করে। এমনভাবে অচল করেছ যে রাস্তার ঠিক কেন্দ্রে গিয়ে তার কোঅর্ডিনেশন নষ্ট হয়েছে।”
রিটিন আবার কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। ক্লিওন হাসি হাসি মুখে রিটিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার একটি প্রশ্ন।”
রিটিন শুকনো গলায় বলল, “কী প্রশ্ন?”
“তোমার ভয় করেনি? কাজটি অসম্ভব বিপজ্জনক ছিল। এত অবলীলায় এত বিপজ্জনক কাজ করতে তোমার ভয় করেনি?”
রিটিন বলল “না, ভয় করেনি।”
“কাঁদের ভয় করে না, বলো দেখি।”
“নির্বোধদের। নির্বোধদের ভয় করে না।”
“তুমি কি নির্বোধ?”
রিটিন নিচু গলায় বলল, “আমি নিজেকে নির্বোধ মনে করি না। কিন্তু কী কারণ জানা নেই আমার নিজের উপর খুব বিশ্বাস–মনে
হয় কিছু হবে না।”
ক্লিওন কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “আমি তোমার মতো একজনকে খুঁজছি। যে নির্বোধ না কিন্তু নির্বোধদের মতো যার কোনো কিছু ভয় করে না।”
“কেন?”
“একটা মিশনে পাঠাব। এই মিশনে পাঠানোর জন্যে আমার বিশেষ একজন মানুষ দরকার। তুমি রাজি আছ?”
“আছি। রাজি আছি।” রিটিন উত্তেজিত গলায় বলল, “অবশ্যই রাজি আছি।”