“কী জিনিস?”
“পৃথিবীর সব তথ্য সংরক্ষণ করার জন্যে যে বিল্ডিংটি আছে সেটার ভেতরে কোনো মানুষ কখনো যেতে পারবে না। থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা ফেলেও সেটার দেয়ালে একটা ফাটল তৈরি করা যাবে না। এর ভেতরে যে নিরাপত্তা সেই নিরাপত্তা ভেঙে একটা মানুষ দূরে থাকুক একটা ব্যাকটেরিয়া পর্যন্ত যেতে পারবে না।”
রিটিন কঠিন মুখে বলল, “তুমি কেমন করে জানো?” “আমি নিরাপত্তাকর্মী। আমি জানি।”
রিটিন কঠিন মুখে বলল, “তবুও নিশ্চয়ই মূল তথ্যভান্ডার ধ্বংস করা যাবে। নিশ্চয়ই করা যাবে।”
নিরাপত্তাকর্মী কঠিন মুখে বলল, “মাত্র চার বিলিয়ন বছর অপেক্ষা করতে হবে। তাহলে সূর্য রেড জায়ান্টে পরিণত হয়ে পুরো পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলার সাথে সাথে তোমার তথ্য ভান্ডারকেও–” কথা শেষ করে মানুষটি কাঠ কাঠ শব্দে হেসে উঠল।
রিটিন হঠাৎ করে বুঝতে পারল কেন মানুষটি এত কম হাসে–কারণ নিরাপত্তাকর্মীর হাসিটির ভেতর কোনো আনন্দ ছিল না। আনন্দহীন হাসির মতো অসুন্দর জিনিস বুঝি পৃথিবীতে আর কিছু নেই।
০৫-০৬. ট্রাকিওশান সরিয়ে ফেলার প্রক্রিয়া
০৫.
ট্রাকিওশান সরিয়ে ফেলার প্রক্রিয়াটি ছিল যন্ত্রণাহীন, তবে খুবই সময়সাপেক্ষ। এটি রক্তের সাথে মিশে শরীরের ভেতর দিয়ে হৃৎপিণ্ডের ভেতর একটি জায়গায় স্থিতি হয়। সেখান থেকে এটাকে মুক্ত করে ধমনির ভেতর দিয়ে হাতের কোনো একটা আঙুলের মাঝে নিয়ে আসা হয়, এই সময়টিতে খুব সতর্ক থাকতে হয় যেন এটি কোনোভাবে রক্তের প্রবাহের সাথে মস্তিষ্ক চলে না যায়, একবার সেটি মস্তিষ্কে হাজির হলে আর মুক্ত করে আনা যায় না। এছাড়া ট্রাকিওশানের সিগন্যাল আদান-প্রদান মস্তিষ্কে একধরনের অনুরণন তৈরি করে, সে কারণে তখন মানুষের হ্যাঁলুসিনেশন শুরু হতে পারে।
রিটিন একটা অপারেশন টেবিলে শুয়ে ছিল, তার শরীরের বিভিন্ন জায়গা টেবিলের সাথে আঁটকে রাখা হয়েছে–মাঝে মাঝে তাকেই নানা ধরনের শারীরিক প্রক্রিয়া করতে বলা হচ্ছিল এবং সে বাধ্য ছেলের মতো সেগুলো করে যাচ্ছে। তার উপর একজন মানুষ এবং দুইটা রোবট ঝুঁকে আছে। তারা চাপা স্বরে কথা বলছে, হঠাৎ করে তাদের মাঝে একধরনের উত্তেজনা দেখা গেল, একজন তার ডান হাতের তর্জনীটি চেপে ধরল, রোবটটি একটা সিরিঞ্জ দিয়ে তার ৩র্জনীর মাথা থেকে এক ফোঁটা রক্ত টেনে বের করে নেয় এবং তখন সম্মিলিতভাবে সবাই একটা আনন্দধ্বনি করে। রিটিন বুঝতে পারল ট্রাকিওশানটি বের করা সম্ভব হয়েছে।
মানুষ দুজন তার শরীরের বাঁধন খুলতে থাকে। একটি রোবট বলল, “তোমাকে অভিনন্দন ছেলে, তুমি এখন একজন ট্র্যাকিওশান মুক্ত মানুষ।”
মানুষটি বলল “অভিনন্দন শব্দটি যথার্থ হলো কি না বুঝতে পারলাম না। সম্ভবত বলা উচিত তুমি এখন থেকে একজন অভিশপ্ত মানুষ।” কথা শেষ করে মানুষটি আনন্দহীন একধরনের হাসি হাসতে থাকে।
একটি রোবট রিটিনের ট্র্যাকিওশানসহ রক্তের ফোঁটাটি সিরিঞ্জের ভেতর থেকে একটা এম্পুলে ঢুকিয়ে দিতে থাকে। রিটিন উঠে বসতে বসতে বলল, “আমার ট্র্যাকিওশানটি এখন কী করবে?”
মানুষটি বলল, “সংরক্ষণ করব, অনেক সময় পুরানো ট্র্যাকিওশান কাজে লাগানো যায়।”
“আমি শুনেছি শরীর থেকে বের করলে সেটা অকেজো হয়ে যায়।”
“হ্যাঁ। সেটাকে রক্তের প্রবাহে রাখতে হয়। যোগাযোগ না থাকলে ট্রাকিওশান নিজ থেকে বন্ধ হয়ে যায়।”
রিটিন টেবিল থেকে নামতে নামতে বলল, “আমি কি এখন যেতে পারি?”
“হ্যাঁ যেতে পারো। শরীর থেকে ট্র্যাকিওশান বের করার পর সবাইকে একটা কঠিন ট্রেনিংয়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। তোমাকেও যেতে হবে।”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”
.
রিটিন ভেবেছিল কঠিন শব্দটি একটি কথার কথা। কিন্তু সে আবিষ্কার করল ট্রেনিংটি সত্যিকার অর্থেই কঠিন। যেহেতু পুরো পৃথিবীটাকে সাজানো হয়েছে ট্র্যাকিওশানের তথ্যের উপর নির্ভর করে, সব মানুষ এটার ব্যবহার এত অভ্যস্ত হয়ে যায় যে, হঠাৎ করে সেটা শরীর থেকে সরিয়ে নেয়া হলে সে খুব সহজেই বিপদে পড়ে যাবে। অবাক হয়ে লক্ষ করবে ট্রেনের দরজা খুলছে না, দোকানে ঢুকতে পারছে না, রাস্তা পার হতে পারছে না, এক বোতল পানি পর্যন্ত কিনতে পারছে না। একজন মানুষ হঠাৎ করে অনুভব করতে থাকবে একটি দেহ থাকার পরও সে যেন অদৃশ্য, কেউ যেন আর তাকে দেখতে পাচ্ছে না।
কাজেই ট্রেনিংয়ের মাঝে রিটিনকে অসংখ্যবার একই জিনিস করতে হলো যতক্ষণ পর্যন্ত মাথার মাঝে সেটা ঢুকে না যায়। শুধু মাথার মাঝে নয় যতক্ষণ পর্যন্ত বিষয়টুকু তার অবচেতন মনেও ঢুকে না যায়। দীর্ঘ দুই সপ্তাহ পর রিটিনের ইন্ট্রাক্টর ঘোষণা করল সে ইচ্ছে করলে এখন শহরে যেতে পারবে। রাস্তায় হাঁটতে পারবে। দোকানে ঢুকতে পারবে–এমনকি একটা তরুণীকে নিয়ে ক্যাফেতে পানীয় খেতেও যেতে পারবে। তবে প্রতিটি মুহূর্ত তাকে সতর্ক থাকতে হবে, এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারবে না যে এখন সে কার্যত অদৃশ্য একজন মানুষ!
পরদিন রিটিন প্রথমবার তার গোপন আস্তানা থেকে বের হলো। জায়গাটা শহরতলিতে একটা নির্জন এলাকা। এক পাশে একটি অরণ্য, অন্য পাশে সারি সারি ওয়ারহাউস। বড় বড় স্বয়ংক্রিয় লরি ট্রাক যাচ্ছে-আসছে। রোবটেরা সেখান থেকে মালপত্র নামাচ্ছে এবং তুলছে। রিটিন পাশের সরু রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেল এবং প্রথমবার ট্র্যাকিওশানহীনভাবে একটি স্বয়ংক্রিয় ট্রামে উঠে গেল। নিয়মটি সহজ–অন্য একজন মানুষের সাথে সাথে উঠে যেতে হবে–কারণ তার জন্যে ট্রামের দরজা খুলবে না কিংবা বন্ধ হবে না। শহরকেন্দ্রে অন্যান্য মানুষের ভিড়ে নেমে গিয়ে সে ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করল, রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে মানুষজনকে যেতে-আসতে দেখল এবং তাদের মাঝে রোবটদের আলাদা করার চেষ্টা করতে থাকল। শুধু তাই নয় নিম্নশ্রেণির একটা সাইবর্গকে পেয়ে সে পাশাপাশি হেঁটে যেতে যেতে একটা মেটাকোড বলে সেটাকে অচল করে দিল। দূর থেকে লক্ষ করল সেটি একটি ব্যস্ত রাস্তার মাঝখানে থেমে গিয়ে হঠাৎ করে পুরোপুরি উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে শুরু করে এবং মুহূর্তের মাঝে অসংখ্য স্বয়ংক্রিয় গাড়ি এবং বাইভার্বালের একটি জটলা তৈরি হয়ে যায়।