“প্রথমেই তোমাদের কিছু তথ্য দিই। পৃথিবীতে ক্যাটাগরি এ এবং সি মানুষের সংখ্যা সমান নয়। ক্যাটাগরি সি-এর মানুষ ক্যাটাগরি এ থেকে প্রায় দশ গুণ বেশি। অর্থাৎ পৃথিবীর দশ ভাগের এক ভাগ মানুষ অন্যদের উপর একধরনের কর্তৃত্ব করে যাচ্ছে–”
রিটিন জিজ্ঞেস করল, “ক্যাটাগরি এ এবং সি আছে। ক্যাটাগরি বি নেই কেন?”
ট্রানা হাসল, বলল, “আমি জানতাম তোমাদের কেউ না কেউ এই প্রশ্নটা করবে। সব মানুষকে শুধু দুটি ভাগে ভাগ করলে বিভাজনটি দৃষ্টিকটু মনে হতে পারে, তাই মাঝখানে একটা কাল্পনিক প্যাডিং রাখা হয়েছে। সবাই ধরে নেয় ক্যাটাগরি বিও নিশ্চয়ই আছে।”
টেবিলের চারপাশে বসে থাকা সবাই বিস্ময়ের মৃদু শব্দ করল, একজন মহিলা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ট্রানা বলল, “আমি জানি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছ না যে, অল্পসংখ্যক ক্যাটাগরি এ মানুষ বিপুলসংখ্যক ক্যাটাগরি সি মানুষকে পায়ের নিচে চাপা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু জেনে রাখো আমি তোমাদের ভুল বলছি না। গত কয়েক শতাব্দীর ভেতরে মানুষ অনেক ধরনের সামাজিক উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে গিয়েছে, সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে মানুষকে তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া, তাদের মাথার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া যে, তাদের জন্ম হয়েছে। নির্দিষ্ট একধরনের কাজ করার জন্যে। তারা শুধু সেই কাজটি করতে পারবে, এর চাইতে ভিন্ন কোনো কাজ করার ক্ষমতা তাদের নেই।”
রিটিন নিজের অজান্তেই তার মাথা নাড়ল। ট্রানা মুখে প্রায় জোর করে একধরনের হাসি ফুটিয়ে বলল, “মানুষের মাঝে বিভাজন করে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার এই পদ্ধতিটি অনেক প্রাচীন এবং খুবই কার্যকরি। গত কয়েক শতাব্দীতে মানুষের সমাজে কোনো সংঘাত হয়নি।”
“কিন্তু তোমরা যে রকম নিজ থেকে এই পদ্ধতিটির সমস্যাটি ধরতে পেরেছ, এর একটি সমাধান বের করতে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছ এবং নিজের জীবনের উপর অচিন্তনীয় একটা ঝুঁকি নিয়েছ। ঠিক সেরকম আরো অনেকেই তোমাদের আগে এই কাজটি করে এসেছে। তারা সংগঠিত হয়েছে, তারা সুনির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। যখন সময় হবে তোমরা সেগুলো সম্পর্কে জানতে পারবে।”
কঠিন চেহারার নিরাপত্তারক্ষীটি বলল, “আমাদের একটা সশস্ত্র বিপ্লব করা উচিত–”
ট্রানা হেসে ফেলল, বলল, “সশস্ত্র বিপ্লব জাতীয় বিষয়গুলো কয়েক শতাব্দী আগেই পরিত্যক্ত হয়ে গেছে–তবে হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আমাদের সশস্ত্র হতে হয়, ছোটখাটো গোলাগুলি বিস্ফোরণের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। তোমরাও নিশ্চয়ই যাবে।”
নিরাপত্তারক্ষীটি বলল, “আমি নিজের হাতে ক্যাটাগরি এ মানুষকে খুন করতে চাই।”
ট্রানার হাসিমুখটিতে হঠাৎ একধরনের কাঠিন্য চলে আসে, সে মাথা নেড়ে বলল, “তোমাদের এখনই কিছু বিষয় বলে দেয়া দরকার। আমরা সংখ্যায় এখনো খুবই কম, কাজেই আমাদের টিকে থাকার উপায় মাত্র একটি। সেটি হচ্ছে আমরা কেউ নিজেদের ভিন্ন একটি মানুষ বলে মনে করব না। আমরা সবসময়ই মনে করব আমরা সবাই মিলে একটা অস্তিত্ব। কাজেই আমাদের কাউকেই নিজেদের গন্ডীর বাইরে যাওয়া চলবে না। যতদিন আমরা পৃথিবীর এই বিভাজনটি দূর করতে না পারব ততদিন আমরা আমাদের উপর দেয়া সুনির্দিষ্ট দায়িত্বের বাইরে কিছু করব না। আমার ক্যাটাগরি মানুষকে খুন করে ফেলার ইচ্ছা করলেও সেটা মুখে উচ্চারণ পর্যন্ত করব না।”
শিক্ষিকা একজন মহিলা বলল, “ট্রানা–”
ট্রানা মহিলাটির দিকে ঘুরে তাকাল, “বলো।”
“আমরা কি সত্যি একদিন পৃথিবীর এই বিভাজন দূর করতে পারব?”
ট্রানা হাসল, বলল, “সেই পুরানো কথাটি শুনোনি? লক্ষ্যে পৌঁছানো আমাদের উদ্দেশ্য নয়। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে চেষ্টা করা আমাদের উদ্দেশ্য।”
রিটিন বলল, “আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাব ট্রানা।”
“পৌঁছাব?”
“হ্যাঁ, আমরা নিশ্চয়ই পৃথিবীর মানুষের মাঝে এই ভাগাভাগি দূর করে ফেলতে পারব।”
ট্রানা একধরনের অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
মেকানিক মানুষটি বলল, “আমরা কেমন করে অগ্রসর হব ট্রানা? আমাদের পরিকল্পনাটা কী?”
ট্রানা হাসল, বলল, “সময় হলেই জানতে পারবে। খুঁটিনাটি সবকিছু আমরা জানি না। নিরাপত্তার জন্যে সবাইকে সবকিছু জানানো হয় না। তবে তুমি জেনে রাখো আমাদের একটা পরিকল্পনা আছে।”
রিটিন বলল, “আমি বলব পরিকল্পনাটা কী?”
ট্রানা একটু অবাক হয়ে বলল, “তুমি জানো?”
“না। জানি না, অনুমান করতে পারি।”
“শুনি তোমার অনুমান।”
রিটিন গলার স্বরটা যথাসম্ভব গম্ভীর করে বলল, “পৃথিবীর মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সবার আগে তাদের সব রকম তথ্যের দরকার। সব তথ্য সংগ্রহ করা হয় ট্র্যাকিওশান দিয়ে। ট্রাকিওশানের তথ্য প্রক্রিয়া করার জন্যে নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও একটা তথ্যভান্ডার আছে, বিশাল নেটওয়ার্ক আছে। আমাদের সেই তথ্যভান্ডার ধ্বংস করে নেটওয়ার্ক ছিন্নভিন্ন করে দিতে হবে। সাথে সাথে পুরো পৃথিবীর সব মানুষ মুক্ত হয়ে যাবে!”
মেকানিক মানুষটি বলল, “তুমি মনে হয় ঠিকই বলেছ ছেলে। তোমার মাথায় বুদ্ধি আছে, কেমন করে তুমি ক্যাটাগরি সি হলে বুঝতে পারছি না!”
নিরাপত্তাকর্মী মানুষটি বলল, “ছেলে, তুমি একটা জিনিস ভুলে যাচ্ছ।”