রিটিন আর কোনো প্রশ্ন করল না, সে তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে।
.
রিটিনের পরীক্ষাটি হলো দীর্ঘ। প্রথমে তার শরীরে একটা ইনজেকশান দেয়া হলো, সেখানে কী ছিল কে জানে কিন্তু রিটিন অনুভব করতে থাকে কোনো বিষয় নিয়ে সে আর দীর্ঘ সময় চিন্তা করতে পারছে না। তাকে যখনই কোনো একটা প্রশ্ন করা হয় সে তাৎক্ষণিকভাবে তার উত্তর দিয়ে দেয়, উত্তরগুলো হয় সংক্ষিপ্ত এবং সুনির্দিষ্ট। পুরো সময়টিতে তার মাথার মাঝে অসংখ্য প্রোব লাগানো ছিল এবং সেই সিগনালগুলোর সাথে প্রশ্নের উত্তর মিলিয়ে তার সত্যি-মিথ্যা বের করে নেয়া হয়।
পরীক্ষার শেষের দিকে তাকে বলা হলো প্রত্যেকটা প্রশ্নে ভুল উত্তর দেয়ার জন্যে। রিটিন আবিষ্কার করল যেকোনো কারণেই হোক সেটি এখন তার জন্যে যথেষ্ট কঠিন। ভুল উত্তর দেয়ার জন্যে তাকে একটু চিন্তা করতে হয় কিন্তু সে এখন আর চিন্তা করতে পারছে না।
রিটিনের মনে হতে থাকে তার পরীক্ষা বুঝি কখনো শেষ হবে না। কিন্তু একসময় সেটি শেষ হলো। মাঝবয়সী মানুষটি এসে তার সাথে হাত মিলিয়ে নরম গলায় বলল, “পরীক্ষায় পাস করেছ। তোমাকে আমরা আমাদের সংগঠনে নিতে পারি। তোমার ট্র্যাকিওশান আমরা সরিয়ে দেব।”
রিটিন জড়িত গলায় বলল, “ধন্যবাদ।”
“তোমার শরীরে ইনজেক্ট করে দেয়া গ্লিফারুলটিকে মেটাবলাইজ করার জন্যে তোমার এখন ঘুমাতে হবে।”
“হ্যাঁ। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।”
“এসো, আমার সাথে এসো।”
মানুষটি রিটিনকে ছোট একটা খুপরির মতো ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে পরিপাটি করে সাজানো একটা বিছানা। রিটিন কোনো কথা বলে সাথে সাথে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল এবং কিছু বোঝার আগেই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে গেল।
রিটিনের ঘুম ভাঙল প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে। বিছানায় উঠে বসার পর সে কোথায় সেটি বুঝতে তার কিছুক্ষণ সময় লাগল। হঠাৎ করেই তার সবকিছু মনে পড়ে যায়। রিটিন তখন বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে বের হয়ে আসে। দরজার বাইরে একটা টানা বারান্দা, বারান্দার শেষ মাথায় একটি ঘরে আলো জ্বলছে। রিটিন বারান্দা দিয়ে হেঁটে ঘরটিতে উঁকি দেয়, ঘরের মাঝখানে একটা চতুষ্কোণ গ্রানাইটের টেবিল, টেবিলে হাত রেখে মাঝবয়সী একজন মানুষ ভিডি টিউবে কিছু একটা দেখছে। রিটিনকে দেখে মানুষটি মুখে হাসি ফোঁটানোর চেষ্টা করে বলল, “ঘুম ভাঙল?”
রিটিন নিঃশব্দে মাথা নেড়ে ঘরটির ভেতরে ঢুকে মানুষটির সামনে একটা চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করল, “আমি কতক্ষণ ঘুমিয়েছি?”
মানুষটি ভিডিও টিউব থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, “অনেকক্ষণ।”
রিটিন বলল, “আমার খুব খিদে পেয়েছে।”
মানুষটি বলল, “পাবার কথা। পাশের ঘরে কিচেন, সেখানে খাবার রয়েছে। খেয়ে এসো। সবাই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
রিটিন অবাক হয়ে বলল, “আমার জন্যে?”
“হ্যাঁ। তোমাদের মতো কয়েকজন আছে তাদের নিয়ে ট্রানা এক সাথে বসবে। যাও খেয়ে এসো।”
রিটিন সচরাচর খায় কিচেনে বসে তার থেকে অনেক বেশি খেয়ে ফেলল। খাওয়া শেষে একটা গ্লাসে তার পছন্দের একটা পানীয় নিয়ে সে মানুষটির কাছে ফিরে আসে। মানুষটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো যাই।”
বেশ কয়েকটা সরু করিডর ধরে হেঁটে দুজনে একটা বন্ধ ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল, মানুষটি দরজা খুলে রিটিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “যাও। ভেতরে সবাই আছে।”
রিটিন ভেতরে ঢুকল। ঘরের মাঝখানে একটা কালো টেবিল, টেবিলের চারপাশে আরামদায়ক চেয়ার কিন্তু কেউ চেয়ারে বসে নেই। ঘরের মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাঁচজন মানুষ, দুজন পুরুষ, তিনজন মহিলা। মানুষগুলো সবাই মধ্যবয়স্ক, সম্ভবত এদের মাঝে রিটিনের বয়স সবচেয়ে কম। রিটিন ঘরে ঢোকার সাথে সাথে সবাই মুখ তুলে তার দিকে তাকাল, রুপালি চুলের একজন মহিলা বলল, “তুমি নিশ্চয়ই রিটিন। এসো রিটিন, আমরা তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।”
রিটিন তার পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “আমি দুঃখিত। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তোমাদের দেরি করিয়ে দিলাম।“
রুপালি চুলের মহিলাটি বলল, “না, তুমি দেরি করিয়ে দাওনি। তোমার শরীরের মেটাবলিজম যথেষ্ট বেশি, তুমি অনেক তাড়াতাড়ি উঠেছ। এসো বসো। আমার নাম ট্রানা। আমাকে তোমাদের ব্রিফিংয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।”
ঘরের মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলো এবারে টেবিলের চারপাশের আরামদায়ক চেয়ারগুলোতে বসে পড়ল। রিটিন টেবিলটা স্পর্শ করতেই সেখানে স্বচ্ছ একটা স্ক্রিন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সেখানে টেবিলের অনন্য মানুষগুলোর পরিচয় ভেসে উঠল। একজন মেকানিক, দুজন শিক্ষক এবং আরেকজন নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করত। মধ্যবয়স্ক মেকানিকটির বয়স পঁয়তাল্লিশ, মহিলা দুজন ত্রিশ এবং পঁয়ত্রিশ। রিটিনের বিপরীতে বসে থাকা কঠিন চেহারার নিরাপত্তাকর্মীর বয়স ত্রিশ, এদের মাঝে রিটিনের বয়স সবচেয়ে কম, মাত্র তেইশ।
ট্রানা বলল, “তোমাদের শরীর থেকে ট্র্যাকিওশান এখনো সরিয়ে নেয়া হয়নি, তাই টেবিলে রাখা ভিডি স্ক্রিনে তোমরা একে অন্যের পরিচয় জেনে নিতে পারছ। ট্রাকিওশান সরিয়ে নেয়ার পর তোমাদের আর কোনো পরিচয় থাকবে না। আমি সরাসরি কাজের কথায় চলে আসি।”
রিটিন তার চেয়ারে একটু নড়েচড়ে বসে উৎসুক চোখে ট্রানার দিকে তাকাল। ট্রানা বলল, “পৃথিবীর মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ক্যাটাগরি এ এবং সি। তোমরা যারা এখানে এসেছ সবাই ক্যাটাগরি সি। তোমরা সবাই তোমাদের জীবনে কোনো না কোনো বৈষম্যের শিকার হয়েছ, সেই বৈষম্য থেকে তোমাদের কোনো এক ধরনের আত্মোপলব্ধি হয়েছে, তোমরা বুঝতে পেরেছ এই বৈষম্যটি অমানবিক, মানুষ হিসেবে অসম্মানজনক। তোমরা কীভাবে তার প্রতিবাদ করবে সেটি বুঝতে পারোনি, তাই এখানে এসেছ কোনো কোনোভাবে প্রতিবাদ করার জন্যে। তোমাদের ধন্যবাদ।”