কিহি একটু চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, কী বললে? তুমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস কর?
হ্যাঁ।
কেন?
কারণ আপনি আমার কাছে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন যে ঈশ্বর আছেন।
আমি? কখন?
এই মহাকাশযানটি ধ্বংস হওয়ার কথা ছিল, আপনি ঈশ্বরের কাছে এটি রক্ষা করার জন্যে প্রার্থনা করেছেন। ঈশ্বর আছেন বলে তিনি সেটা রক্ষা করেছেন।
কিহি হেসে বলল, আমার প্রার্থনার সাথে এই মহাকাশযান রক্ষা পাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি প্রার্থনা না করলেও এটি রক্ষা পেত। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা আসলে বড় বিপদে নিজেকে শান্ত রাখার একটা উপায়।
আমি সব সময় বড় বিপদে শান্ত থাকি–ক্রিটন শান্ত গলায় বলল, তবু আমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি। আমি নিজের চোখে দেখেছি যখন মহাকাশযানটি রক্ষা পাবার সম্ভাবনা ছিল মাত্র দশমিক শূন্য শূন্য নয় তিন, আপনি ঈশ্বরকে দিয়ে এটি রক্ষা করিয়েছেন।
কিহি কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, এই নির্বোধ যন্ত্রের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলার কোনো অর্থ হয় না। ক্রিটন হেঁটে চলে যেতে যেতে আবার ফিরে এসে জিজ্ঞেস করল, ঈশ্বর কি মানুষ না রবোট?
কিহি কোনো উত্তর দিল না। ক্রিটন এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, তাহলে কি মানুষ কিংবা রবোট থেকেও উন্নত কোনো প্রাণী?
কিহি এবারেও কোনো উত্তর দিল না, খানিকটা হতচকিত হয়ে ক্রিটনের দিকে তাকিয়ে রইল। উত্তর না পেয়েও ক্রিটন নিরুৎসাহিত হল না, আরো এক পা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ঈশ্বরের কাছে কেমন করে প্রার্থনা করতে হয়? তার কি বিশেষ কোনো নিয়ম আছে?
এবারে শেষ পর্যন্ত কিহির ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। সে উঠে দাঁড়িয়ে গলার স্বর উঁচু করে বলল, ক্রিটন তোমাকে ঈশ্বরের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে না। তুমি নিচে যাও। জ্বালানি কেন্দ্রের বড় টিউবটির ওপরে আমাকে একটি রিপোর্ট দাও। পাম্পগুলোর কী অবস্থা আমাকে এসে বল। বড় রিজারভয়ারে কোনো জ্বালানি রয়েছে কি না জানাও, শক্তিকেন্দ্রের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে একটা অনুমান করে এস। যাও–
ক্রিটন মাথা নাড়ল এবং বলল, আমি যাচ্ছি। সে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ দুই হাত জোড় করে উপরের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, হে ঈশ্বর, তুমি আমাকে আমার দায়িত্ব পালনে সাহায্য কর।
.
মহাকাশযানে এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবার কারণে পরবর্তী কয়েকদিন কিহির সময় কাটল খুব ব্যস্ততার মাঝে। তাকে বিধ্বস্ত জ্বালানিকেন্দ্রটি পর্যবেক্ষণ করতে হল, বিপজ্জনক অংশগুলো সরিয়ে নিতে হল, ফেটে যাওয়া টিউবগুলো পাল্টাতে হল, নূতন ইঞ্জিন লাগাতে হল, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের সফটওয়ার পাল্টাতে হল, মহাকাশ কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হল, জ্বালানির অভাব হয়ে যাওয়াতে কক্ষপথ পরিবর্তন করতে হল। সমস্ত কাজকর্ম শেষ করতে তাকে পরবর্তী কয়েকদিন অমানুষিক পরিশ্রম করতে হচ্ছিল, বিশেষ উত্তেজক গ্রহণ করে সে প্রথম কয়েকদিন এক মুহূর্তের জন্য ঘুমাতেও গেল না। সমস্ত কাজকর্ম শেষ করে একটানা আঠার ঘণ্টার জন্যে কিহি ঘুমাতে গেল, তার এই অস্বাভাবিক দৈনন্দিন ব্যস্ততার। জন্যে সে জানতে পারল না মহাকাশযানে রবোটদের নিয়ে এক ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। জটিলতার খবরটি পেল চতুর্থ দিনে, ঘুম থেকে ওঠার পর আবিষ্কার করল। মহাকাশযানের কিউ–২ ধরনের দুটি রবোট তার সাথে দেখা করার জন্যে অপেক্ষা করছে। রবোট দুটির মুখপাত্র হচ্ছে ক্রিটন। কিহি জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার ক্রিটন? কোনো সমস্যা?
ক্রিটন তার যান্ত্রিক গলায় বলল, আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন, আমাদের একটি ছোট সমস্যা হয়েছে।
রবোটদের সমস্যা মূলত যান্ত্রিক অথবা ইলেকট্রনিক। তার সমাধানও সেরকম সহজ এবং যন্ত্রণাহীন। কিহি জিজ্ঞেস করল, কী সমস্যা?
গ্রুজানের সাথে আমার একটি ব্যাপার নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। আপনি বিতর্কটি নিষ্পত্তি করে দেবেন।
কিহির ভুরু কুঞ্চিত হয়ে উঠল, কিউ–২ ধরনের রবোট অত্যন্ত উচ্চ যুক্তিতর্কের রবোট, রবোটদের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে এগুলো এখনো কোনো ভুল করেছে বলে জানা যায় নি নিজেদের মাঝে বিতর্কের কোনো প্রশ্নই আসে না। কিহি জিজ্ঞেস করল, তোমাদের কী নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে?
ঈশ্বরকে নিয়ে।
কিহি চমকে উঠল। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে করতে বলল, ঈশ্বরকে নিয়ে কী সমস্যা হচ্ছে?
ক্রিটন বলল, আমরা জানি ঈশ্বর হচ্ছেন নিরাকার। তিনি বিশ্বজগতের প্রভু। জলে স্থলে অন্তরীক্ষে তার অবাধ বিচরণ
কিহি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এসব কোথা থেকে জেনেছ?
পৃথিবীর তথ্যকেন্দ্র থেকে।
পৃথিবীর?
হ্যাঁ। সেখান থেকে আমি ঈশ্বর সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য এনে পড়াশোনা করেছি মহামান্য কিহি।
তুমি– তুমি ঈশ্বর নিয়ে পড়াশোল করেছ?
এই মহাকাশযানের কিউ–২ ধরনের রবোট, গ্রুজান এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। এবারে সে তার ধাতব স্বরে উচ্চ কম্পনের খনখনে গলায় বলল, ক্রিটন আমাকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাস করানোর পর আমি নিয়মিত প্রার্থনা করছি।
তুমি তুমি নিয়মিত প্রার্থনা করছ?
মহামান্য কিহি আমরা কিউ–২ ধরনের রবোটরা অত্যন্ত যুক্তিপ্রবণ রবোট। যুক্তি ছাড়া আমরা কোনো কিছু গ্রহণ করি না। ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস আনার ব্যাপারেও আমরা যুক্তি ব্যবহার করেছি।