- বইয়ের নামঃ রবো নিশি
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ শিখা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. তরুণী মাটি অনেক কষ্ট করে উঠে
উৎসর্গ
সামিন রিয়াসাত, নাজিয়া চৌধুরী, তারিক আদনান মুন, হক মোহাম্মদ ইশফাঁক, প্রাণন রহমান খান, কাজী হাসান জুবায়ের এবং মোঃ আবিরুল ইসলাম
গণিত অলিম্পিয়াড এবং ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডের প্রতিযোগীরা
(আমি তাদের কথা দিয়েছিলাম তারা যদি বাংলাদেশের জন্যে পদক নিয়ে আসতে পারে আমি তাহলে আমার পরবর্তী সায়েন্স ফিকশনটি তাদের নামে উৎসর্গ করব। তারা পদক এনেছে আমিও আমার কথা রাখলাম!)
০১. পূর্বকথা
তরুণী মাটি অনেক কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে দোলনায় শুয়ে থাকা শিশুটির দিকে তাকাল। মাকে দেখে শিশুটির দাতহীন মুখে একটি মধুর হাসি ফুটে ওঠে। সে চঞ্চল হয়ে ওঠে এবং একসাথে দুই হাত আর দুই পা নাড়তে থাকে, ইঙ্গিতটি খুব স্পষ্ট, সে মায়ের কোলে উঠতে চায়। মায়ের শিশুটিকে কোলে নেওয়ার ক্ষমতা নেই, দুর্বল হাতে শিশুটির মুখ স্পর্শ করে ফিসফিস করে বলল, বেঁচে থাকিস বাবা। একা হলেও বেঁচে থাকিস।
শিশুটি মায়ের কথার অর্থ বুঝতে পারল না কিন্তু কথার পেছনের ভালোবাসা আর মমতাটুকু অনুভব করতে পারল। সে হঠাৎ করে আরো চঞ্চল। হয়ে ওঠে, দুই হাত আর দুই পা ছোড়ার সাথে সাথে মুখ দিয়ে সে একধরনের অব্যক্ত অর্থহীন শব্দ করল। মা আবার কিছু একটি বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে সে কাশতে শুরু করে এবং কাশির সাথে সাথে ঝলকে ঝলকে রক্ত বের হয়ে আসে। তরুণী মাটি অনেক কষ্ট করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঘুরে তাকাল। তার ঠিক পেছনেই ক্রিনিটি নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রিনিটি তৃতীয় মাত্রার। একটি রোবট, অনেকদিন থেকে সে এই পরিরারকে দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করে আসছে।
তরুণী মা একটু শক্তি সঞ্চয় করে বলল, ক্রিনিটি, আমার সময় শেষ হয়ে এসেছে। আমি তোমাকে যা বলি তুমি একটু মন দিয়ে শোনো।
ক্রিনিটি কোনো কথা বলল না, সে জানে মানুষ বেশিরভাগ সময়ই অর্থহীন কথা বলে। মানুষের যে কোনো কথাই তার গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হয়, সেটি আলাদাভাবে তাকে বলার প্রয়োজন নেই। তরুণী মাটি একটি বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আমার মনে হয় নিকি বেঁচে যাবে। যে ভাইরাসটি পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষকে মেরে ফেলছে সেটি আমার এই বাচ্চাটিকে মারতে পারেনি। আমার এই বাচ্চার শরীরে এই ভাইরাসের প্রতিষেধক আছে।
ক্রিনিটি বলল, তোমার ধারণা সত্যি। এই ভাইরাসের আক্রমণে সবার আগে শিশুরা মারা গেছে। নিকির কিছু হয়নি।
আমি আর কিছুক্ষণের মাঝেই মারা যাব ক্রিনিটি। তখন এই নিকিকে দেখার কেউ থাকবে না। কেউ থাকবে না। তরুণী মা কষ্ট করে একটি কাশির দমক সামলে নিয়ে বলল, ক্রিনিটি, তখন তোমাকে এই বাচ্চাটাকে দেখতে হবে। যতদিন সে নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে না পারবে ততোদিন তাকে তোমার দেখেশুনে রাখতে হবে।
ক্রিনিটি কোনো কথা বলল না, মানুষ যখন তাকে কোনো আদেশ দেয়। তাকে সবসময় সেই আদেশ মানতে হয়। তরুণী মাটি কিন্তু একটু অস্থির হয়ে উঠল, বলল, তুমি কথা বলছ না কেন ক্রিনিটি? তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ?
ক্রিনিটি বলল, আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি।
তাহলে তুমি আমাকে কথা দাও, তুমি আমার সোনামণি নিকিকে দেখে রাখবে।
আমি নিকিকে দেখে রাখব। তুমি আমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর।
ক্রিনিটি আর কপোট্রনে একটি অসম বৈদ্যুতিক চাপ অনুভব করল, মানুষ সময়ই অর্থহীন কাজ করে। একটি কথা উচ্চারণ করার জন্যে কখনোই কারো গা ছুঁতে হয় না। অন্যসময় হলে সে ব্যাপারটি বোঝানোর চেষ্টা করত কিন্তু এখন সে তার চেষ্টা করল না। কমবয়সী এই তরুণীটি কিছুক্ষণের মাঝেই মারা যাবে, সে কী কথা-ব্রলতে চায় সেটি জেনে রাখা প্রয়োজন। ক্রিনিটি তার শীতল হাত দিয়ে তরুণী মাটির হাত স্পর্শ করে বলল, আমি তোমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি।
তরুণী মাটির মুখে তখন অত্যন্ত ক্ষীণ একটি হাসি ফুটে ওঠে। সে একটি বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ক্রিনিটি। অনেক ধন্যবাদ।
ক্রিনিটি কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। এই তরুণী মাটির দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারছে খুব দ্রুত তার জীবনীশক্তি ফুরিয়ে আসছে। ছোট শিশুটি দোলনা থেকে আবার তার দুই হাত-পা ছুড়ে একটি অব্যক্ত শব্দ করে তার মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। মা শিশুটির দিকে একনজর তাকিয়ে আবার ঘুরে ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে বলল, ক্রিনিটি। তুমি আমাকে কথা দাও যে তুমি আমার বাচ্চাটিকে ভালোবাসা দিয়ে বড় করবে।
ক্রিনিটি নীচু গলায় বলল, আমি দুঃখিত। আমার ভেতরে কোনো মানবিক অনুভূতি নেই। কেমন করে ভালোবাসতে হয় আমি জানি না।
তরুণী মেয়েটি হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, তোমাকে জানতে হবে। সারা পৃথিবীর মাঝে শুধু আমার এই বাচ্চাটা বেঁচে আছে। তাকে মানুষের মতো বড় করতে হবে। তাকে ভালোবাসা দিয়ে বড় করতেই হবে।
পুরোপুরি অর্থহীন একটি কথা, কিন্তু ক্রিনিটি প্রতিবাদ করল না। এই মেয়েটির সাথে এখন যুক্তি দিয়ে কথা বলার সময় পার হয়ে গেছে; এখন কোনো প্রতিবাদ না করে মেয়েটির কথাগুলো শুনতে হবে। অর্থহীন, অযৌক্তিক এবং অবাস্তব হলেও শুনতে হবে।
তরুণী মাটি দোলনাটি ধরে কয়েকটা বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ক্রিনিটি তুমি ভালো করে গুনে রাখো। আমার এই বাচ্চাটি যেরকম বেঁচে গেছে সেরকম পৃথিবীতে হয়তো আর এক-দুটি বাচ্চা বেঁচে গেছে। তুমি আমার বাচ্চাটিকে তাদের কাছে নিয়ে যাবে। বুঝেছ?
ক্রিনিটি শান্ত গলায় বলল, বুঝেছি। কিন্তু-
আমি কোনো কিন্তু শুনতে চাই না ক্রিনিটি। তুমি যেভাবে পার তাদের খুঁজে বের করবে। আমার বাচ্চাটিকে তাদের কাছে নিয়ে যাবে। এই কথাটি তোমার মনে থাকবে?
ক্রিনিটি বলল, মনে থাকবে।
তুমি আমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর যে তুমি সেটি করবে।
অত্যন্ত অযৌক্তিক একটি ব্যাপার কিন্তু তবুও ক্রিনিটি তার শীতল ধাতব হাত দিয়ে দ্বিতীয়বার তরুণী মাটির হাত স্পর্শ করে বলল, আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে তোমার বাচ্চাটিকে আমি অন্য বাচ্চার কাছে নিয়ে যাব।
তরুণী মাটি ক্ৰিনিটির হাত ধরে বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ক্রিনিটি। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ক্রিনিটি তার নিস্পলক চোখে তরুণীটির দিকে তাকিয়েছিল, সে বলল, তোমাকে খুব দুর্বল দেখাচ্ছে। আমার মনে হয় উত্তেজিত না হয়ে তোমার বিশ্রাম নেয়া দরকার।
তুমি ঠিকই বলেছ ক্রিনিটি, আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। আমি এখন এখানেই শোবো। আমি জানি আমি আর কোনোদিন উঠতে পারবো না। তুমি কি আমাকে একটু সাহায্য করবে?
কী সাহায্য?
তুমি কি আমার বাচ্চাটিকে আমার বুকের ওপর শুইয়ে দিতে পারবে? আমি আমার জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোতে আমার বাচ্চার মুখটির দিকে তাকিয়ে থাকতে চাই।
ক্রিনিটি জানে এই দুর্বল মেয়েটির বুকের ওপর এই দুরন্ত ছটফটে শিশুটিকে শুইয়ে দিলে মেয়েটির অনেক কষ্ট হবে, কোনোভাবেই এই কাজটি করা উচিৎ হবে না। ক্রিনিটি তার কপোট্রনে একটি প্রবল বৈদ্যুতিক চাপ অনুভব করল কিন্তু সে চাপটিকে উপেক্ষা করে এই অযৌক্তিক কাজটি করল। শিশুটি দুই হাতে তুলে মেঝেতে শুয়ে থাকা তরুণীটির বুকে শুইয়ে দিলো।
শিশুটির দাঁতহীন মুখে মধুর একধরনের হাসি ফুটে ওঠে। সে তার ছোট হাত দুটি দিয়ে তার মায়ের রক্তমাখা ঠোঁট দুটি ধরে আনন্দে হাসতে থাকে। তরুণী মাটি তার দুই হাতে বাচ্চাটিকে তার বুকের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরে রেখে ফিসফিস করে বলল, সোনা আমার। যাদু আমার। বেঁচে থাকিস বাবা। যেভাবে পারিস বেঁচে থাকিস।
সন্ধ্যে হওয়ার আগেই তরুণী মাটি মারা গেল। ছোট শিশুটি সেটি বুঝতে পারল না, সে তার মায়ের চুলগুলো ধরে খেলতেই থাকল।
ক্রিনিটি নিস্পলক দৃষ্টিতে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে তার কপোট্রনে প্রবল একটি অসম বৈদ্যুতিক চাপ অনুভব করে।
০২. নিকি জানালাটি খুলে বাইরে তাকাল
নিকি জানালাটি খুলে বাইরে তাকাল। আকাশ নীল, কোথাও মেঘের চিহ্ন নেই। বাইরে রৌদ্রোজ্জ্বল একটি দিন। নিকি দুই গালে হাত দিয়ে বাইরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর হঠাৎ কী মনে করে সে নিজেকে কোনোমতে টেনে জানালার ওপর উঠে বসে।
ক্রিনিটি জিজ্ঞেস করল, নিকি, তুমি ঠিক কী করতে চাইছ?
বাইরে যাব।
মানুষ জানালা দিয়ে বাইরে যায় না। মানুষ দরজা খুলে বাইরে যায়।
জানালা দিয়ে বাইরে গেলে কী হয়?
কিছু হয় না। কিন্তু জানালা দিয়ে বাইরে যেতে হলে তোমাকে লাফিয়ে নামতে হবে। দরজা খুলে বের হতে হলে তুমি হেঁটে হেঁটে বের হতে পারবে।
নিকি তার দাঁতগুলো বের করে হাসল, বলল, কিন্তু আমি হেঁটে বের হতে চাই না। আমি লাফিয়ে বের হতে চাই। আমার লাফাতে খুব ভালো লাগে।
আমি সেটি লক্ষ করেছি। আজকাল বেশিরভাগ সময়ই তুমি লাফাতে পছন্দ করো।
আমি এখনো মিক্কুর মতো লাফাতে পারি না।
তুমি কখনোই মিরুর মতো লাফাতে পারবে না। মিক্কু হচ্ছে বানর আর তুমি মানুষ।
নিকি একটি ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমিও যদি বানর হতাম তাহলে খুব মজা হতো, তাই না ক্রিনিটি?
ক্রিনিটি তার কপোট্রনে একটি চাপ অনুভব করে। চাপটি কমিয়ে সে বলল, না। তুমি বানর হলে বেশি মজা হতো না।
নিকি মাথা নেড়ে বলল, হতো।
হতো না।
কেন হতো না?
কারণ মানুষের বুদ্ধিমত্তা বানরের বুদ্ধিমত্তা থেকে বেশি। যার বুদ্ধিমত্তা যতো বেশি সেততো বেশি উপায়ে মজা করতে পারে।
নিকি মুখ সুচালো করে কিছুক্ষণ ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে রইলতারপর জিজ্ঞেস করল, বুদ্ধিমত্তা কী?
তোমার চারপাশে যা কিছু আছে সেটি দেখে বোঝার ক্ষমতা এবং সেটিকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা হচ্ছে বুদ্ধিমত্ত্বা।
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, আমার কোনো বুদ্ধিমত্তা নেই।
কে বলেছে নেই?
আমি জানি।
কেমন করে জান?
এই যে তুমি কঠিন কঠিন জিনিম বলেছ আমি সেগুলো করতে পারিনা।
বুঝিনা।
তুমি যখন বড় হবে তখন বুঝবে।
আমি বুঝতে চাইনা।
তাহলে তুমি কী করতে চাও?
আমি মিষ্ণুর সাথে এক গাছ থেকে আরেকাছে লাফ দিতে চাই।
যাদের বুদ্ধিমত্তা আছে তাদের শুধু এক গাছ থেকে আরেকাছে মাফ দিয়ে জীবন কাটাতে হয়না। তাদের আরো বড় কাজ করতে হয়।
নিকি কিছুক্ষন চিন্তা করল, তারপর বলন, জমির বুদ্ধিমত্তা ভালো লাগে।
না।
ক্রিনিটি কোনো কথা না বলে নিকির দিকে তাকিয়ে রইল। নিকি ক্রিনিটির দৃষ্টি থেকে চোখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকালো তারপর দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে বের হবার ঠিক আগ মুহূর্তে ক্রিনিটি বলল, নিকি।
বল।
তুমি ঘরের বাইরে যাচ্ছ কিন্তু তোমার শরীরে কোনো কাপড় নেই।
আজকে অনেক সুন্দর রোদ। বাইরে ঠাণ্ডা নেই তাই আমার কাপড় পরারও কোনো দরকার নেই।
ক্রিনিটি কৃত্রিমভাবে তার গলার স্বরটি একটুখানি গভীর এবং থমথমে করে নিয়ে বলল, মানুষ শুধুমাত্র শীত থেকে বাঁচার জন্যে কাপড় পরে না। মানুষ হচ্ছে একটি সভ্য প্রাণী। মানুষকে সবসময় কাপড় পরতে হয়।
নিকি বলল, কিন্তু মিক্কু তো কাপড় পরে না।
মিক্কু মোটেও সভ্য প্রাণী নয়। মিক্ক একটি বানর। কিকি কাপড় পরে না! কিকি একটি পাখি।
নিকির চোখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, তুমি কোনো কাপড় পর না।
আমি একটি যন্ত্র। যন্ত্রদের কাপড় পরতে হয় না। তুমি মানুষ তোমাকে কাপড় পরতে হবে। সবসময় অন্ততপক্ষে কোমর থেকে হাঁটুর ওপর পর্যন্ত ডেকে একটি কাপড় পরতে হবে।
নিকি যুক্তিতর্কে সুবিধে করতে না পেরে অন্যপথে গেল। মুখ শক্ত করে বলল, আমি মানুষ হতে চাই না।
ক্রিনিটি বলল, না চাইলেও কিছু করার নেই, তুমি এখন অন্য কিছু হতে পারবে না। তোমাকে মানুষ হয়েই থাকতে হবে।
নিকি মুখ শক্ত করে বলল, কেন মানুষ হলে কাপড় পরতে হবে?
মানুষ সভ্য প্রাণী। যখন তোমার সাথে অন্য মানুষের দেখা হবে তখন তোমার শরীরে কাপড় না থাকলে তারা তোমাকে অসভ্য ভাববে।।
নিকি সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে সেরকম ভঙ্গি করে বলল, ঠিক আছে। যদি আমার সাথে কখনো অন্য মানুষের দেখা হয় তখন আমি দৌড় দিয়ে কাপড় পরে নেব।
ক্রিনিটি বলল, না। কাপড় পরা একটি অভ্যাসের ব্যাপার। যার সেই অভ্যাস নেই সে কখনো দৌড়ে কাপড় পরতে পারবে না। আর সবচেয়ে বড় কথা কী জান?
কী?
মানুষের সাথে কোনোদিন দেখা হোক বা না হোক তোমাকে কাপড় পরে থাকতে হবে।
নিকি মুখ গোঁজ করে বলল, কেন?
তোমার মা আমাকে তোমার দায়িত্ব দিয়ে গেছে। আমাকে বলেছে আমি যেন তোমাকে দেখে শুনে রেখে বড় করি। সেজন্যে আমার তোমাকে ঠিক করে বড় করতে হবে। সভ্য মানুষের মতো বড় করতে হবে।
নিকি এবার দুর্বল হয়ে পড়ল। তার মা-কে সে খুব ভালোবাসে। ক্রিনিটির কাছে তার মায়ের যে হলোগ্রাফিক ছবি আছে সে মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে, অনেকবার সে তার মা-কে ধরতে গিয়ে দেখেছে সেটি সত্যি নয়। তার খুব ইচ্ছে করে একদিন সে ধরতে গিয়ে দেখবে সেটি সত্যি তখন তার মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করবে। ক্রিনিটি তাকে বলেছে যে এটি কখনো হবে না, তবুও সে আশা করে আছে যে কোনো একদিন হয়তো এটি হয়ে যাবে।
নিকি ঘরের ভেতর ফিরে গেলো, এক টুকরো কাপড় নিয়ে সেটি তার। কোমরে বেঁধে নিল, তারপর ক্রিনিটিকে বলল, এখন আমি বাইরে যাই?
যাও।
নিকি দরজা খুলে বাইরে যেতেই কক কক শব্দ করে একটি পাখি তার দিকে উড়ে আসে, তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে সেটি তার ঘাড়ে বসার চেষ্টা করতে থাকে। নিকি তার হাতটি বাড়িয়ে দিতেই পাখিটি সেখানে বসে নিকির দিকে তাকিয়ে আবার কক কক শব্দ করে ডাকল। নিকি পাখিটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, আমি মোটেও দেরি করতে চাইনি। ক্রিনিটি আমাকে দেরি করিয়ে দিয়েছে।
পাখিটির গায়ের রং কুচকুচে কালো, চোখ দুটি লাল, সে ডানা ঝাঁপটিয়ে আবার কক কক শব্দ করল। নিকি বলল, উঁহু। ক্রিনিটি মোটেও দুই নয়। ক্রিনিটি হচ্ছে রোবট! রোবটেরা অন্যরকম হয়।
কিকি নিকির কথা বুঝে ফেলেছে সেরকম ভঙ্গি করে মাথা নেড়ে আবার শব্দ করে আকাশে উড়ে গেল, নিকি তখন তার পিছু পিছু ছুটতে থাকে। এটি তাদের একরকম খেলা, প্রতিদিনই সে কিকির পেছনে পেছনে ছুটে যায়, সারাদিন বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। দিনের শেষে কিকি তাকে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে যায়।
কিকির পেছনে পেছনে ছুটে ছুটে নিকি বনের ভেতর একটি হৃদের তীরে এসে দাঁড়াল। সেখানে অনেকগুলো বুনো পশু পানি খাচ্ছে, নিকিকে একনজর। দেখে তারা আবার পানি খেতে থাকে।
একটি বড় ঝাপড়া গাছের ডালে হঠাৎ একটি হুঁটোপুটি শোনা যায় সেদিকে না তাকিয়েই নিকি বুঝতে পারে এটি মিকু, ছোট একটি বানরের বাচ্চা, তার সাথে খেলতে এসেছে। নিকি ইচ্ছে করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল, আর মিক্কু গাছের উপর থেকে তার উপর লাফিয়ে পড়ল, তাল সামলাতে না। পেরে নিকি নিচে পড়ে যায়, মিক্কু তখন তার শরীরের ওপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে থাকে। নিকি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসে হি হি করে হাসতে থাকে আর মিক্কু তখন নিকিকে ঘিরে লাফাতে থাকে। নিকি মিক্কুর পেটে খোঁচা দিয়ে বলল, মিকু, তোমার বুদ্ধিমত্তা আছে?
মিক্কু কিচিমিচি শব্দ করে একটি লাফ দিয়ে তার ঘাড়ে উঠে বসে তারপর সেখান থেকে নেমে তার কাপড়টা টানতে থাকে। নিকি মাথা নাড়ল, বলল, না। এই কাপড়টা খোলা যাবে না। আমার মা বলেছে আমাকে সবসময় কাপড় পরে থাকতে হবে।
মিকু কথাটা বোঝার মতো ভঙ্গি করল, নিকি তখন মিক্কুকে কাছে টেনে এনে বলল, তুমি বানর। আমি মানুষ। বানরের বুদ্ধিমত্তা নেই। মানুষের আছে। বুদ্ধিবৃত্তি কী জান?
মিকু মাথা নাড়ল। নিকি বলল, আমিও জানি না। ক্রিনিটি আমাকে বলেছে আমি বুঝিনি। তুমিও বুঝবে না। বোঝার দরকার নেই। চল আমরা খেলি।
মিকু কথাটা বুঝতে পেরে ছুটতে শুরু করে, তার পিছু পিছু নিকি। ছুটতে ছুটতে তারা বালুবেলায় আছড়ে পড়ে, গড়াগড়ি খেতে থাকে। তাদের মাথার উপর দিয়ে অনেকগুলো পাখি উড়তে থাকে, কিচিমিচি শব্দ করে তারা নিকির আশপাশে নেমে এসে খেলায় যোগ দেয়। নিকি হাত বাড়িয়ে পাখিগুলো ধরার চেষ্টা করে—একটি-দুটি ধরা দেয় অন্যগুলো সরে গিয়ে আবার তার কাছে ছুটে আসে।
বেলা গড়িয়ে এলে নিকি নরম বালুর ওপর মাথা রেখে শুয়ে থাকে। শুয়ে থাকতে থাকতে একসময় তার চোখে ঘুম নেমে আসে। সে পরম শান্তিতে বালুতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কাছাকাছি একটি গাছে বসে কিকি তার দিকে নজর রাখে, একটু দূরে একটি গাছে মিক্কু পা দুলিয়ে বসে থাকে।
ঠিক তখন নিঃশব্দে একটি চিতাবাঘ হেঁটে হেঁটে আসে। হ্রদের পানিতে পা ভিজিয়ে সে চুক চুক করে পানি খায়। তাকে দেখে হরিণের পাল সরে গেল, বুনো পাখিরা কর্কশ শব্দ করে উড়ে গেল।
চিতাবাঘটি মাথা তুলে তাকাল, একটু গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করল এবং হঠাৎ করে নিকিকে দেখতে পেল। সাথে সাথে সেটি সতর্ক পদক্ষেপে নিকির দিকে এগুতে থাকে। কাছাকাছি এসে সেটি খুঁড়ি মেরে বসে তারপর বিদ্যুৎগতিতে। নিকির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গাছের ডালে বসে থাকা কিকি আর মিক্কু তার স্বরে চিৎকার করে ওঠে সাথে সাথে।
নিকি চমকে উঠে চিতাবাঘটির দিকে তাকাল এবং মুহূর্তে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে চিতাবাঘটির গলা জড়িয়ে ধরে বলল, দুষ্টু! দুষ্টু চিতা! তুমি কোথায় ছিলে এতোদিন?
চিতাবাঘটি মুখ দিয়ে ঠেলে নিকিকে নিচে ফেলে দিয়ে পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। নিকি উঠে দাঁড়িয়ে চিতাবাঘটির গলা জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ ঘষে বলল, কোথায় ছিলে তুমি? কোথায়?
চিতাবাঘটি তার বুকের ভেতর থেকে ঘরঘর করে শব্দ করে, বন্ধুর সাথে। ভাব বিনিময়ের গভীর ভালোবাসার একধরনের শব্দ।
ক্রিনিটি নিকির প্লেটে একটু খাবার তুলে দিয়ে বলল, তোমার এখন বাড়ন্ত শরীর। এখন তোমাকে খুব হিসেব করে খেতে হবে। মানুষের শরীর তো আর যন্ত্র নয় যে একটি ব্যাটারি লাগিয়ে দিলাম আর সেটি চলতে থাকল। মানুষকে খেতে হয় খুব হিসেব করে।
নিকি এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে স্যুপে ভিজিয়ে খেতে খেতে বলল, হিসেব করে না খেলে কী হয়?
শরীর দুর্বল হয়ে যায়। শরীরে রোগজীবাণু বাসা বাঁধে।
তুমি বলেছ আমার শরীরে কোনো রোগজীবাণু বাসা বাঁধতে পারে না। সেই জন্যে সবাই মরে গেছে কিন্তু আমি বেঁচে গেছি।
হ্যাঁ। সেটি সত্যি। কিন্তু রোগজীবাণুর কী শেষ আছে। পৃথিবীতে কত রকম রোগজীবাণু আছে তুমি জান?
নিকি মাথা নাড়ল, না জানি না। জানতেও চাই না।
না জানলে হবে না। মানুষকে সবকিছু জানতে হয়।
আমি তোমাকে বলেছি আমি মোটেও মানুষ হতে চাই না?
না চাইলেও লাভ নেই। তোমার মানুষ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ক্রিনিটি তার প্লেটে একটু খাবার তুলে দিয়ে বলল, এইটুকু শেষ করে ফেল। তাহলে তোমার খাওয়াটা সঠিক হবে।
নিকি খাবারগুলো হাত দিয়ে নাড়তে নাড়তে বলল, ঠিক আছে, আমি খেতে পারি কিন্তু একশর্তে।
কী শর্ত? তুমি আমাকে আজকে গণিত পড়াতে পারবে না।
তুমি এখন বড় হচ্ছ। প্রতিদিন তোমাকে কিছু না কিছু পড়তে হবে। মানুষকে অনেক কিছু জানতে হয়।
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, না ক্রিনিটি আমি আজকে কিছু পড়তে চাই না।
তাহলে কী করতে চাও?
নিকি লাজুক মুখে বলল, আমি আমার মা-কে দেখতে চাই।
ক্রিনিটি কয়েক মুহূর্ত নিকির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, ঠিক আছে।
একটু পরেই দেখা গেল নিকি দুই গালে হাত দিয়ে বসে আছে, সামনের শূন্য জায়গাটিতে তার মা কথা বলছেন। হলোগ্রাফিক ছবি, দেখে মনে হয়। জীবন্ত কিন্তু নিকি জানে এটি জীবন্ত নয়। সে অনেকবার তার মা-কে ধরার। চেষ্টা করেছে, ধরতে পারেনি। যতবার ধরতে গিয়েছে দেখেছে সেখানে কিছু নেই।
নিকি ঘুমিয়ে যাবার পর ক্রিনিটি তাকে একটি পাতলা চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়। গলায় ঝোলানো মাদুলিটি খুলে নিয়ে সে ক্রিস্টাল রিড়ারের সামনে বসে। মাদুলিটির ভেতর থেকে ছোট ক্রিস্টালটা বের করে সে ক্রিস্টাল রিডারের ভেতর ঢুকিয়ে সেদিকে তাকায়। আজ সারাদিন নিকি কী কী করেছে সব এখানে রেকর্ড করা আছে।
ক্রিনিটি খানিকক্ষণ দৃশ্যগুলো দেখে তারপর ছোট একটি মাইক্রোফোন কাছে টেনে এনে নিচু গলায় কথা বলতে শুরু করে। রোবটের একঘেয়ে যান্ত্রিক স্বরে ক্রিনিটি বলে, আমি ক্রিনিটি। নিকি নামের মানবশিশুটির দায়িত্বে আছি। আমার দৈনন্দিন দায়িত্ব হিসেবে আজকের দিনের ঘটনাগুলো ভিডি মাধ্যমে উপস্থাপন করছি।
আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট। আমার পক্ষে এই দায়িত্ব নেয়া সম্ভব ছিল, কিন্তু অন্য কোনো উপায় না থাকার কারণে আমি দায়িত্বটি নিতে বাধ্য। হয়েছিলাম। আমাকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল সেই সিদ্ধান্তগুলো সঠিক সিদ্ধান্ত কিনা আমি সেটি এখনো জানি না। নিকির মা আমাকে বলেছিল আমি যেন ভালোবাসা দিয়ে নিকিকে বড় করি। আমি তৃতীয়। মাত্রার রোবট, ভালোবাসা বিষয়টি কী আমি জানি না। একজন মা যখন তার সন্তানের সাথে কথা বলার সময় কিছু অর্থহীন শব্দ করে, কিছু অর্থহীন কাজকর্ম করে সেগুলো সম্ভবত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। আমি সেই শব্দগুলো উচ্চারণ এবং সেই কাজকর্মগুলো করার চেষ্টা করে দেখেছি সেগুলো প্রকৃত অর্থেই অর্থহীন এবং হাস্যকর কাজকর্মে পরিণত হয়েছে। কাজেই আমি সেই বিষয়টি পরিত্যাগ করেছি।
আমার মনে হয়েছে আশপাশে কোনো মানুষ না থাকলেও অনেক পশুপাখি আছে এবং সেইসব পশুপাখিদের মাঝে একধরনের ভালোবাসা। আছে। মানুষ অনেক সময়ই পশুপাখিকে পোষ মানিয়েছে এবং তাদের সাথে একধরনের ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তাই আমি খুব সতর্কভাবে নিকির সাথে কিছু পশুপাখির সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করেছি। কাজটি আমাকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে করতে হয়েছে, প্রয়োজনে যেন তাকে ঘিরে একটি শক্তি বলয় তৈরি হয় এবং কোনো পশু যেন তার ক্ষতি করতে না পারে, গোড়াতে আমি সেই বিষয়টি নিশ্চিত করেছি। আমি এক মুহূর্তের জন্যেও নিকির প্রাণের ওপর কোনো ঝুঁকি আনিনি। এখনও আমি তাকে সতর্কভাবে রক্ষা করি। তার গলার মাদুলিটি একটি শক্তিশালী ট্রাকিওশান। মূল তথ্য কেন্দ্রের সাথে এটি যোগাযোগ রাখে এবং তাকে রক্ষা করে।
বনের কিছু পশুপাখির সাথে নিকির একধরনের গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক হয়েছে এবং আমার ধারণা নিকি ভালোবাসা গ্রহণ করতে এবং প্রদান। করতে শিখেছে। নিকির মা আমাকে প্রথম যে দায়িত্বটি দিয়েছিল আমি সেটি পালন করতে পেরেছি।
নিকির মায়ের দ্বিতীয় দায়িত্বটি অনেক কঠিন। সারা পৃথিবী খুঁজে আমার দেখতে হবে আর কোথাও কোনো মানুষ বেঁচে গিয়েছে কিনা। যদি বেঁচে থাকে তাহলে তার কাছে নিকিকে নিয়ে যেতে হবে। আমি সে জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। এখন তার বয়স মাত্র সাত বছর কিন্তু তার বুদ্ধিমত্তা দশ থেকে বারো বছরের বালকের মতো। তাই তাকে নিয়ে আমি বের হতে পারি। আমার ধারণা নিকি এখন এই ব্যাপারটির মুখোমুখি হতে পারবে।
ভূমিকা পর্ব শেষ হয়েছে। আমি এখন আজকের সারাদিনের সংক্ষিপ্ত দিনলিপি সংরক্ষণ করতে চাই। ভোরবেলা ঘুম ভাঙার পর নিকি শরীরে কাপড় রাখা নিয়ে একটি প্রতিবাদী ভূমিকা গ্রহণ করে। বিষয়টিকে আমার গুরুত্ব নিয়ে দেখতে হয়…
ক্রিনিটি তার একঘেয়ে যান্ত্রিক গলায় দিনলিপিটি সংরক্ষণ করে যায়। নিকির মা মারা যাবার পর থেকে প্রতিদিন সে এটি করে আসছে।
০৩. ক্রিনিটি তুমি কী করছ
নিকি জিজ্ঞেস করল, ক্রিনিটি তুমি কী করছ?
ক্রিনিটি টার্মিনালের সাথে একটি বড় তার জুড়ে দিয়ে উপরের স্কুটা লাগাতে লাগাতে বলল, আমি এই বাইভার্বালটি ঠিক করছি।
তুমি কেন এটি ঠিক করছ? আমরা ঘুরতে বের হব।
নিকির চোখে-মুখে আনন্দের ছাপ পড়ল, আমরা কোথায় ঘুরতে বের হব ক্রিনিটি?
নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় নয়। আমরা আসলে ঘুরে ঘুরে দেখব। কোথাও তোমার মতো মানুষ খুঁজে পাই কিনা।
এবারে নিকির মুখে দুশ্চিন্তার একটি ছাপ পড়ল, খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার মতো মানুষ?
হ্যাঁ, তোমার মতো মানুষ।
সেই মানুষের সাথে দেখা হলে আমি তাকে কী বলব ক্রিনিটি?
তোমার সেটি নিয়ে ভাবনা করতে হবে না। তোমার যেটি বলতে ইচ্ছে হয় সেটিই বলবে।
তখন সেই মানুষটি কী বলবে ক্রিনিটি?
সেই মানুষটিও তখন তার যেটি ইচ্ছে হয় সেটি বলবে।
আমি তোমার সাথে যেভাবে কথা বলি সেভাবে কথা বলব?
তার চাইতে অনেক সুন্দর করে কথা বলবে। আমি হচ্ছি মাত্র তৃতীয় মাত্রার রোবট আমি সত্যিকার মানুষের মতো কথা বলতে পারি না। আমি শুধু তোমার সাথে তথ্য বিনিময় করি।
সত্যিকার মানুষ কেমন করে কথা বলে ক্রিনিটি?
সেটি অনেক বিচিত্র। কথা বলার সময় তার হাত নাড়ে, মাথা নাড়ে। চোখ দিয়ে তাকায়, গলার স্বর কখনো উঁচু করে, কখনো নীচু করে। একটি সাধারণ কথা বলার জন্যেও অনেক কিছু করে। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা মুখ ফুটে বলে না। একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝে ফেলে।
নিকিকে এবারে খুব দুশ্চিন্তিত দেখায়। খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, ক্রিনিটি?
বল।
আমি তো চোখের দিকে তাকিয়ে কোনো কথা বুঝতে পারি না।
তোমার সেটি নিয়ে ভাবনা করতে হবে না। তুমি যদি কখনো কোনো মানুষের দেখা পাও তাহলে দেখবে তুমি বুঝতে পারছ।
আর যদি না পারি?
পারবে। যদি না পার তাহলে তুমি শিখে নেবে।
ক্রিনিটি।
বল?
আমি কিন্তু শিখতে পারি না। মিক্কু কী সুন্দর একটি গাছের ডাল ধরে লাফ দিয়ে আরেকটি ডাল ধরে ফেলে। আমি অনেকদিন থেকে চেষ্টা করছি, শিখতে পারছি না।
ক্রিনিটি ঘুরে নিকির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সেটি অনেক চেষ্টা করেও শিখতে পারবে না। মিক্কু হচ্ছে বানর, তুমি মানুষ। মানুষ চেষ্টা করলেও বানর হতে পারে না। মানুষের অন্য মানুষ থেকে শিখতে হয়, বানর থেকে শিখতে হয় না।
নিকি বলল, ও।
ক্রিনিটি বাইভার্বালের নীচে গিয়ে একটি গোলাকার ফুটোর ভিতরে উঁকি দেয়, সেখান থেকে জংধরা একটি রিং খুলে নতুন একটি রিং লাগাতে শুরু করে। ঠিক তখন তার মাথার উপর দিয়ে কিকি উড়ে এসে বাইভার্বালের একটি হ্যান্ডেলে বসে কর্কশ স্বরে কঁ কঁ করে ডাকল।
নিকি বলল, কিকি আমরা ঘুরতে বের হব। তুমি আমাদের সাথে যাবে?
কিকি কী বুঝল কে জানে, নীচু স্বরে আবার ক ক করে শব্দ করল। নিকি ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে বলল, ক্রিনিটি।
বল।
কিকি আমাদের সাথে ঘুরতে যেতে পারবে?
যেতে চাইলে যাবে। তবে—
তবে কী?
কিকি হচ্ছে কাক জাতীয় পাখি। পাখিদের মাঝে সবচেয়ে বুদ্ধিমান। এরা দল বেঁধে থাকে, আর দলের সবাইকে ছেড়ে সে আসলে যেতে পারবে না।
কেন যেতে পারবে না?
সব পশু-পাখিদের নিজেদের নিয়ম আছে। পাখিরা থাকে দল বেঁধে। বাঘ থাকে একা একা।
নিকি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কিকি তার দলের পাখি থেকে আমাকে বেশি ভালোবাসে। তাই না কিকি?
কিকি মাথা নেড়ে বলল, কঁ কঁ।
ক্রিনিটি নিকির কথা শুনে তার দিকে ঘুরে তাকালো, সে এই মাত্র তার কথায় ভালোবাসা শব্দটি ব্যবহার করেছে এবং মনে হয় ঠিকভাবেই ব্যবহার। করেছে। নিকির মা তাকে দায়িত্ব দিয়েছিল ভালোবাসা দিয়ে বড় করতে তার নিজের ভালোবাসা অনুভব করার ক্ষমতা নেই তারপরেও এই ছেলেটিকে সে মনে হয় ভালোবাসার ব্যাপারটি বোঝাতে পেরেছে। ক্রিনিটি দেখল নিকি কালো রঙের পাখিটিকে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিয়ে তাকে আদর করতে থাকে।
ক্রিনিটি যখন বাইভার্বালের সামনে বড় বড় দুটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র স্ক্রু দিয়ে লাগানো শুরু করেছে তখন নিকি জিজ্ঞেস করল, এগুলো কী ক্রিনিটি।
এগুলো হচ্ছে অস্ত্র।
অস্ত্র দিয়ে কী করে?
অস্ত্র দিয়ে ধ্বংস করে।
নিকি অবাক হয়ে বলল, ধ্বংস করে? কেমন করে ধ্বংস করে?
এর মাঝে বিস্ফোরক রয়েছে। যখন ট্রিগার টানা হয় তখন বিস্ফোরকগুলো ছুটে যায়, যেখানে সেটি আঘাত করে সেখানে বিস্ফোরণ হয়ে সব ধ্বংস হয়ে যায়।
নিকি চোখ বড় বড় করে ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে রইল তারপর ইতস্তত করে বল, কিন্তু ক্রিনিটি–
কিন্তু কী?
তুমি কেন এই বাইভার্বালে অস্ত্র লাগাচ্ছ? তুমি কাকে ধ্বংস করতে চাও?
আমি কাউকে ধ্বংস করতে চাই না। কিন্তু সবসময় একটু সতর্ক থাকতে হয়। এই বনে সব পশুপাখি তোমার বন্ধু। কিন্তু অন্য কোথাও অন্য পশুপাখি তোমার বন্ধু নাও হতে পারে। তারা তোমাকে আক্রমণ করে বসতে পারে—
নিকি মুখ শক্ত করে বলল, না। কখনো কোনো পশুপাখি আমাকে। আক্রমণ করবে না। আমি পশুপাখিকে ভালোবাসি। পশুপাখিও আমাকে ভালোবাসে।
ক্রিনিটি বলল, সেটি সত্যি কথা। কিন্তু আমি কোনো ঝুঁকি নিতে চাই। তুমি হচ্ছ একমাত্র জীবিত মানুষ—তোমার যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেটি আমাকে সবসময় লক্ষ রাখতে হয়।
তুমি বেশি বেশি লক্ষ রাখ।
তা ছাড়া আমরা যখন ঘুরতে বের হব তখন আরো অনেক কিছুর সাথে আমাদের দেখা হবে। তাদের থেকেও বিপদ হতে পারে।
নিকি একটু চিন্তিত সুরে বলল, কার সাথে দেখা হতে পারে?
রোবটদের সাথে।
নিকি এবারে শব্দ করে হেসে ফেলল। রোবট বলতে সে শুধু ক্রিনিটিকে বোঝে, ক্রিনিটি বা ক্রিনিটির মতো কারো কাছ থেকে কোনো বিপদ হতে পারে সেটি এতো অবাস্তব একটি বিষয় যে সেটি কল্পনা করে নিকি না হেসে পারল না। নিকি হাসতে হাসতে বলল, ক্রিনিটি, তুমি বলেছ যে রোবটদের তৈরি করা হয়েছে মানুষদের সেবা করার জন্যে। একটি রোবট কখনো কোনো মানুষের ক্ষতি করতে পারে না। চেষ্টা করলেও পারে না।
সেটি সত্যি কথা। কিন্তু—
কিন্তু কী?
একসময় পৃথিবীতে মানুষ ছিল তখন রোবটদের জন্যে এই নিয়ম ছিল। এখন তো পৃথিবীতে মানুষ নাই তাই রোবটদের মাঝে এই নিয়মগুলো আছে। কিনা সেটি তো জানি না। এখন এই পৃথিবীতে আছে শুধু রোবট তারা কী করছে কে জানে।
নিকি খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, রোবটদের এখন কোনো কাজ নেই। তাই তারা মনে হয় অনেক মজা করছে।
ক্রিনিটি বলল, সব রোবট মজা করতে পারে না।
কেন ক্রিনিটি? কেন সব রোবট মজা করতে পারে না?
মজা করার জন্যে বুদ্ধিমত্তা থাকতে হয়। সব রোবটের বুদ্ধিমত্তা নেই। যাদের মানুষের সমান বুদ্ধিমত্তা তারা মজা করতে পারে।
তুমি কী মজা করতে পার?
না। আমি পারি না। আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট। আমার বুদ্ধিমত্তা মানুষ থেকে কম। চতুর্থ মাত্রার রোবটের বুদ্ধিমত্তা মানুষের বুদ্ধিমত্তার সমান।
আর পঞ্চম মাত্রা?
পঞ্চম মাত্রার রোবট পৃথিবীতে তৈরি হয় নি।
কেন তৈরি হয় নি?
পঞ্চম মাত্রার রোবটের বুদ্ধিমত্তা হবে মানুষ থেকে বেশি সেই জন্যে কখনো পঞ্চম মাত্রার রোবট তৈরি করা হয় নি। পৃথিবীর মানুষ নিজের থেকে বুদ্ধিমান রোবট তৈরি করতে চায় নি।
নিকি কিছুক্ষণ ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ক্রিনিটি।
বল।
আমার মনে হয় তুমি যদিও তৃতীয় মাত্রার রোবট কিন্তু তুমি ইচ্ছা করলে মজা করতে পারবে।
ক্রিনিটি তার কপোট্রনে একধরনের চাপ অনুভব করল, সে চাপটুকু কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে বলল, তুমি তাই মনে কর?
হ্যাঁ।
তুমি কী রকম মজা করার কথা ভাবছ?
বনে একটি গাছে একটু হলুদ একটু লাল রঙের ফল পাওয়া যায় সেটি খেতে খুব মজা। তুমি সেটি খেয়ে দেখতে পার।
মানুষ হচ্ছে স্তন্যপায়ী প্রাণী তার শরীরে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা থাকতে হয়। সেইজন্যে মানুষকে একটু পরে পরে খেতে হয়। আমি রোবট, আমার শরীরে একটি ব্যাটারি লাগানো আছে, আমাকে খেতে হয় না।
নিকি বলল, আমি জানি। কিন্তু আমার মনে হয় এই ফলটি তবু তোমার খেয়ে দেখা উচিৎ। এই ফলটি খেলে তোমার যেটি মনে হবে সেটি হচ্ছে মজা।
ক্রিনিটি কোনো উত্তর না দিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দুটি লাগানো শেষ করে তার লেজার আলোটি পরীক্ষা করল।
নিকি বলল, গাছের উপর থেকে হ্রদের পানিতে লাফ দিলেও অনেক মজা হয়।
ক্রিনিটি বলল, আমার ধাতব শরীর পানিতে ভেসে থাকতে পারে না।
নিকি বলল, ড়ুবে থাকলে আরও বেশি মজা। পানিতে লাল রঙের কাকড়া থাকে। সেগুলো দেখা যায়।
ক্রিনিটি কোনো কথা বলল না। সে তৃতীয় মাত্রার রোবট হয়েও এই মানব শিশুটির সাথে কথা বলতে পারে, কিন্তু অনেক সময়ই আবিষ্কার করে সে কোনো একটি কথার উত্তরে যৌক্তিক কোনো কথা বলতে পারছে না। তখন সে চুপ করে থাকে।
নিকির হাতে বসে থাকা পাখিটি একটু চঞ্চল হয়ে আকাশের দিকে তাকাল তারপর চাপা স্বরে ডাকল, কঁ কঁ।
নিকি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে চল।
ক্রিনিটি বলল, কোথায় যাচ্ছ?
কিকি আকাশে উড়বে। আমি ওর পিছু পিছু দৌড়াব।
ও।
আমার মনে হয় পাখিরা মানুষ থেকে বেশি মজা করতে পারে।
কথাটি সত্য নয়, শুদ্ধ করে নিকিকে সেটি বলা উচিৎ ছিল, কিন্তু ক্রিনিটি কোনো কিছু বলল না। দীর্ঘদিন নিকির সাথে থেকে ক্রিনিটি কিছু জিনিস করতে শিখেছে। নিকিকে সে প্রায় সময়েই যুক্তিহীন বা অতিরঞ্জিত কথা বলতে দেয়। ক্রিনিটি জানে কারণে-অকারণে মানুষ অযৌক্তিক কথা বলে। মানুষকে অযৌক্তিক কথা বলতে না দিলে কিংবা অযৌক্তিক কাজ করতে না দিলে তারা মনে হয় পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারবে না।
কিকির পেছনে পেছনে নিকি ছুটতে থাকে। কিকি উড়তে উড়তে আবার নিকির কাছে ফিরে আসে, নিকি তাকে ধরার চেষ্টা করে কিকি শেষ মুহূর্তে উড়ে সরে যায়, এটি দুজনের মাঝে একরকম খেলা। নিকি বারকয়েক চেষ্টা করে কিকিকে ধরে আনন্দে হি হি করে হাসতে থাকে। ক্রিনিটি তার কাজ থামিয়ে নিকিকে লক্ষ করে, নিকিকে বড় করতে গিয়ে সে মানুষের অনেক কিছুই বুঝতে শিখেছে, কিন্তু হাসির ব্যাপারটি সে এখনো ধরতে পারে নি। মানুষ। কেমন করে হাসে সেই ব্যাপারটি তার কাছে এখনো দুর্বোধ্য। সে যদি তিন মাত্রার রোবট না হয়ে চার মাত্রার রোবট হতো তাহলে সে হয়তো এটি বুঝতে পারত, তিন মাত্রার রোবট হিসেবে সে কখনোই এটি জানতে পারবে না।
নিকি কিকির শরীরে হাত বুলিয়ে বলল, ক্রিনিটি বলেছে তুমি নাকি সামাজিক প্রাণী।
কিকি মাথা নেড়ে বলল, কঁ কঁ।
সামাজিক প্রাণী কথাটার মানে বুঝেছ? যারা দল বেঁধে থাকে তাদেরকে বলে সামাজিক প্রাণী। তুমিও কি দল বেঁধে থাক?
কিকি মাথা নেড়ে বলল, কঁ কঁ।
আমি তোমাকে কখনো দল বেঁধে থাকতে দেখি নি।
কিকি আবার মাথা নেড়ে বলল, কঁ কঁ।
বিকেলবেলা ক্রিনিটি যখন বাইভার্বালটির কাজ শেষ করে ইঞ্জিনটি প্রথমবার চালু করেছে তখন সে একটি অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখতে পেল। বনভূমির আকাশ কালো করে হাজার হাজার পাখি কর্কশ শব্দ করে উড়ে বেড়াচ্ছে। বনভূমির সামনে খোলা জায়গাটিতে নিকি দুই হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে আনন্দে চিৎকার করছে আর হাজার হাজার পাখি তাকে ঘিরে ঘুরছে আর ঘুরছে।
নিকি ঘুমিয়ে যাবার পর ক্রিনিটি তার শরীরটি একটি পাতলা চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়। তারপর তার গলার মাদুলিটি খুলে নিয়ে সে ক্রিস্টাল রিডারের সামনে বসে। মাইক্রোফোনটি টেনে নীচু গলায় দিনলিপিটি রেকর্ড করতে শুরু করে :
পৃথিবী থেকে সব মানুষের মৃত্যু হবার পর মূল তথ্য কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেছে, এই এলাকার যোগাযোগটিও বিচ্ছিন্ন। আমি তাই কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছি না। আমি বিচ্ছিন্ন ভাবে স্মরণ করতে পারি, কোনো একটি মানব শিশু যদি কোনো পশুপাখি দ্বারা লালিত পালিত হয়। তাহলে সে সেই পশুপাখির কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারে। নেকড়ে বাঘ। দিয়ে লালিত কিছু শিশু নেকড়ে বাঘের মতো চার পায়ে ছুটতে পারত, বুনো কুকুর দ্বারা লালিত শিশু কুকুরের কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিল। ওরাংওটাং দিয়ে পালিত শিশু গাছে ওরাংওটাং-এর মতো ছুটে বেড়াতে পারত।
নিকি খুব শৈশব থেকে এই বনের কিছু পশুপাখির সাথে বড় হয়েছে। আমি সতর্ক দৃষ্টি রেখেছি বলে পশু পাখির প্রবৃত্তি তার মাঝে গড়ে ওঠে নি, কিন্তু আমার বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে যে নিকি পশুপাখির সাথে কোনো একটি উপায়ে তথ্য বিনিময় করতে পারে।
আমি আজকে নিকিকে বলেছি কিকি কাক জাতীয় প্রাণী এবং কাক জাতীয় প্রাণীরা দল বেঁধে থাকে। নিকি বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে কিকিকে তার প্রমাণ দেখাতে বলেছে। কিকি তার প্রমাণ হিসেবে বনভূমির সকল পাখিকে তার সামনে হাজির করেছে। আমি দেখেছি হাজার হাজার পাখি নিকিকে ঘিরে ঘুরছে। নিকি পাখি বা অন্যান্য প্রাণীর সাথে কিভাবে তথ্য বিনিময় করে সেটি আমি এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি নি। তৃতীয় মাত্রার রোবট হিসেবে আমার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, আমি হয়তো কখনোই বিষয়টি বুঝতে পারব না।
আমি বাইভার্বালটি প্রস্তুত করেছি। খুব দ্রুত আমি নিকিকে নিয়ে বের হব। মানুষ যখন বেঁচেছিল আমি তখন তাদের মুখে এই বনভূমিটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা যোগাযোগের নেটওয়ার্কের বাইরে। পৃথিবীতে কোনো মানুষ জীবিত আছে কিনা সেটি বের করতে হলে আমাকে সভ্যতার আরো কেন্দ্রবিন্দুতে উপস্থিত হতে হবে।
নিকির দৈনন্দিন কার্যাবলির মাঝে আজকের উল্লেখযোগ্য ঘটনা বাইভার্বালের গঠন প্রকৃতি সম্পর্কে তার প্রথম বাস্তব ধারণা। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে…
ক্রিনিটি তার নিখুঁত ইলেক্ট্রনিক মেমোরি থেকে নিকির সারাদিনের প্রতিটি ঘটনার খুঁটিনাটি ক্রিস্টাল রিডারে লিপিবদ্ধ করতে শুরু করে।
০৪. ক্রিনিটি নিকির কোমরে বেল্ট বেঁধে
ক্রিনিটি নিকির কোমরে বেল্ট বেঁধে সেটি বাইভার্বালের কন্ট্রোল প্যানেলের একটি হুঁকের সাথে লাগিয়ে দিলো। নিকি জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন বেল্ট দিয়ে বেঁধে নিলে?
তোমার নিরাপত্তার জন্যে। তুমি তো আগে কখনো বাইভার্বালে ওঠ নি। তাই হঠাৎ করে যদি পড়ে যাও সে জন্যে।
আমি মোটেও পড়ে যাব না।
আমি জানি তুমি পড়ে যাবে না। কিন্তু তুমি জান তোমার ব্যাপারে আমি কখনো কোনো ঝুঁকি নেব না। তুমি যখন বাইভার্বাল চালানো শিখে যাবে তখন নিরাপত্তার এই ব্যাপারগুলো দরকার হবে না।
আমি কী এটি চালাতে পারব?
অবশ্যই পারবে। পৃথিবীতে যখন মানুষ বেঁচে ছিল তখন অবশ্যি কখনোই তোমার বয়সী একটি শিশুকে কেউ বাইভার্বাল চালাতে দিত না।
কেন দিত না?
প্রয়োজন হতো না। সেজন্যে দিত না। তখন ছোট শিশুদের কোনোরকম দায়িত্ব ছিল না। তারা শুধু মজা করত।
আমারও কোনো দায়িত্ব নাই। নিকি গম্ভীর হয়ে বলল, আমিও শুধু মজা করি।
না। ক্রিনিটি তার গলার স্বরে খানিকটা কৃত্রিম গাম্ভীর্য এনে বলল, তোমার অনেক দায়িত্ব। তুমি এর মাঝে কাপড় পরা শিখে গেছ। এখন তোমাকে এই বাইভার্বাল চালানো শিখতে হবে। তোমাকে যোগাযোগ মডিউল ব্যবহার করা শিখতে হবে। তোমাকে মনে হয় একটু-আধটু অস্ত্র ব্যবহার করা শিখতে হবে। তাছাড়া–
তা ছাড়া কী?
আমরা যদি সত্যি সত্যি কোনো মানুষের দেখা পেয়ে যাই তাহলে আমি সেখানে কোনো কথা বলতে পারব না। আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট, মানুষের সাথে কথা বলার যোগ্যতা আমার নেই। তোমাকে তার সাথে কথা বলতে হবে।
আমি তার সাথে কী কথা বলব?
সেটা যখন সময় হবে তখন তুমি ভেবে বের করে ফেলতে পারবে। এখন চল সকাল থাকতে থাকতে আমরা রওনা দিই।
বাইভার্বালটির কাছাকাছি একটি গাছে কিছু পাখি বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের লক্ষ করছে। কাছাকাছি আরেকটি গাছে নানাবয়সী বানর। ক্রিনিটি বলল, নিকি, তুমি তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নাও।
কেন বিদায় নেব ক্রিনিটি? আমি কী মরে যাব?
না। মরে যাবে না। কিন্তু যখন কোনো মানুষ অন্যদের কাছ থেকে চলে যায় তখন বিদায় নেয়।
নিকির মুখটা হঠাৎ ব্যাথাতুর হয়ে ওঠে। সে নিচু গলায় বলল, আমি চলে যেতে চাই না। আমি এখানে থাকতে চাই।
ক্রিনিটি তার কপোট্রনে একধরনের চাপ অনুভব করে, সে চাপটি কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল তারপর ঘুরে নিকির দিকে তাকিয়ে বলল, নিকি, তুমি সারাজীবন এখানে থাকতে পারবে না। তোমাকে এখন যেতে হবে, অন্য মানুষকে খুঁজে বের করতে হবে।
আমি যেতে চাই না। আমি অন্য মানুষ খুঁজে বের করতে চাই না।
তোমার মা আমাকে বলেছে আমি যেন অন্য মানুষকে খুঁজে বের করে তোমাকে তাদের কাছে নিয়ে যাই। তোমাকে যেতে হবে নিকি।
মায়ের কথা বলা হলে নিকি কখনো অবাধ্য হয় না। এবারেও হলো না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে আমি যাব। কিন্তু আগে বল তুমি আমাকে আবার এখানে নিয়ে আসবে।
তুমি যদি চাও তাহলে আমি আবার তোমাকে এখানে নিয়ে আসব। কিন্তু কিছুদিনের মাঝেই তুমি নিজেই বড় মানুষের মতো হয়ে যাবে। তুমি তখন
একা একা এখানে ফিরে আসতে পারবে।
আমি বড় মানুষের মতো হতে চাই না। আমি ছোট থাকতে চাই।
ক্রিনিটি এই কথাটির উত্তর দিলো না–বলল, তুমি তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নাও, বাইভার্বাল চালু করা হলে তার ইঞ্জিনের শব্দে তারা ভয় পেয়ে চলে যেতে পারে।
নিকি তখন মাথা ঘুরিয়ে গাছের ওপর চুপ করে বসে থাকা পশুপাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, বলল, বিদায় কিকি। বিদায় মিকু। বিদায় সবাই
কিকি এবং মিক্কু নিচু স্বরে একধরনের শব্দ করল কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে বাইভার্বালের ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল এবং তার তীব্র শব্দে তাদের কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে গেল। বাইভার্বালটি একটি ঝাঁকুনি দিয়ে মাটি থেকে এক মিটারের মতো উপরে উঠে গেল এবং আবার একটি ঝাঁকুনি দিয়ে সেটি সামনের দিকে ছুটে যেতে শুরু করে। নিকি মাথা ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকাল, অনেকগুলো পাখি কর্কশ শব্দ করে উড়ছে, তার মাঝে কোনো একটি কিকি। দূরে একটি গাছে একধরনের উত্তেজনা দেখা যায় সেখানে নিশ্চয়ই মিক্কু এই মুহূর্তে গাছের একটি ডাল ধরে তার ভাষায় চিৎকার করছে। নিকি চাপা স্বরে বলল, আমি ফিরে আসব। আমি আবার ফিরে আসব। আসবই আসব।
নিকি অবাক হয়ে লক্ষ করল তার চোখে কেন জানি পানি চলে এসেছে। ব্যাপারটি সে বুঝতে পারল না।
ক্রিনিটি বলল, নিকি। তুমি প্রথমে লক্ষ কর আমি কেমন করে বাইভার্বালটি চালাই, তারপর আমি তোমাকে চালাতে দেব।
আমি লক্ষ করছি ক্রিনিটি। কিন্তু তুমি কিছুই করছ না।
তুমি ভুল বল নি। আমি আসলে কিছুই করছি না—এই বাইভার্বালগুলোর ভেতরে সে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি দেওয়া হয়েছে সেটি নিজে থেকেই সবকিছু করতে পারে। আমি শুধু কন্ট্রোল প্যানেলে চোখ রাখছি আর স্টিয়ারিং হুঁইলটা ধরে রেখেছি।
নিকি কন্ট্রোল প্যানেলটির দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, এখানে কী দেখা যায়?
সামনে কী আছে সেটি দেখা যায়।
আমি তো কিছু বুঝি না। এখানে তো শুধু লাল নীল কিছু রং!
তোমাকে এটি শিখতে হবে। রংগুলো দেখাচ্ছে তাপমাত্রা। আকৃতিগুলো দেখে কী দিয়ে তৈরি সেটি বোঝা যায়। কতদূরে সেটি আছে সেটিও বোঝা যায়। ক্রিনিটি ছোট একটি বিন্দুকে দেখিয়ে বলল, যেমন এটি হচ্ছে একটি প্রাণী। সম্ভবত হরিণ।
কেমন করে বুঝলে?
অভিজ্ঞতা থেকে। আমি আগে বাইভার্বাল চালিয়েছি।
নিকি দেখল ক্রিনিটির অনুমান সত্যি, বাইভার্বালটি যখন কাছে এসেছে তখন দেখা গেল একটি গাছের কাছাকাছি একটি বড় হরিণ দাঁড়িয়ে আছে। হরিণটি বাইভার্বালটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, ইঞ্জিনটির শব্দ স্পষ্ট হওয়ার সাথে সাথে সেটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেল।
নিকি বাইভার্বালের রেলিংটি ধরে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বনভূমিটি পার হয়ে তারা বিশাল একটা জলাভূমিতে চলে এলো। জলাভূমিটি পার হওয়ার পর শুকনো পাহাড়ি এলাকা শুরু হল। এখানে তারা কিছু বিধ্বস্ত বাড়িঘর দেখতে পায়, গাছপালা এবং লাতগুল্ম সেই বাড়িগুলোকে ঢেকে ফেলছে, কোথাও কোনো প্রানীর চিহ্ন নেই। ক্রিনিটি তার বাইভার্বালটি নিয়ে খুব নীচে দিয়ে বাড়িঘরগুলোর উপর দিয়ে উড়ে গেল, বাইভার্বালের ইঞ্জিনিরে শব্দে সচকিত হয়ে কিছু পাখি কিছু বুনো প্রাণী এদিক-সেদিক ছুটে গিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে তাদের লক্ষ করতে থাকে।
সারাদিন তারা বাইভার্বালে করে মাটির কাছাকাছি দিয়ে উড়ে যেতে থাকে। যতদূর চোখ যায় ধ্বংসস্তুপের মতো ছোট ছোট বাড়িঘর। গাছপালা ঝোপঝাড় আর লতাগুল্মে ঢাকা। ঝড় বৃষ্টিতে বিধ্বস্ত। শ্যাওলায় ঢাকা। দেখে দেখে নিকি একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
সন্ধ্যেবেলা ক্রিনিটি একটি বাড়ির সামনে তার বাইভার্বালটি থামাল। নিকি জিজ্ঞেস করল, এখানে কেন থেমেছ ক্রিনিটি?
আমরা রাতে এখানে থামব। তুমি ঘুমাবে। আমি একটু কাজ করব।
কী কাজ?
আমি নেটওয়ার্কের ভেতর ঢুকতে চাইছি। মানুষের নেটওয়ার্ক যদি নাও থাকে রোবটদের একটি নেটওয়ার্ক থাকার কথা?
নিকি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, আমরা তাহলে মানুষদের খুঁজে পাব? শুধু রোবটদের খুঁজে পাব?
এখনো সেটি আমরা জানি না নিকি। যদি রোবটদের নেটওয়ার্কটি খুঁজে পাই তাহলে সেখানে সবরকম খোঁজ পাব। মানুষ আছে কী নেই সেটিও আমরা জানতে পারব।
ও।
বাইভার্বালটি থামার পর নিকি লাফিয়ে সেটি থেকে নেমে এল। বড় বাসাটির দিকে তাকিয়ে সে যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেল ক্রিনিটি তখন তাকে থামাল, বলল, নিকি, দাঁড়াও।
কী হল?
তুমি একা একা এখানে ঢুকো না।
কেন ক্রিনিটি?
বহু বছর এখানে কেউ থাকে না। ভেতরে কী আছে আমরা জানি না। হয়তো এমন কিছু আছে যেটি দেখে তোমার খারাপ লাগবে। হয়তো কোনো বুনো পশু, বিষাক্ত সাপ–
আমি বুনো পশু আর বিষাক্ত সাপকে ভয় পাই না।
কিন্তু তারা তোমাকে দেখে ভয় পেতে পারে। কেউ যখন ভয় পায় তখন তারা খুব অদ্ভুত কাজ করে ফেলতে পারে।
ক্রিনিটি বাইভার্বাল থেকে কিছু যন্ত্রপাতি আর একটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নামিয়ে নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকল। ঘরের ভেতর আলো জ্বালিয়ে এদিক-সেদিক দেখল। ঘরের মাঝখানে একটি আলট্রাসনিক বীপার বসিয়ে অপেক্ষা করল। নিকি লক্ষ করল ঘরের ভেতর থেকে কিছু পোকামাকড়, ছোট ছোট প্রাণী ছুটে বেরিয়ে যেতে থাকে। ক্রিনিটি তার ফটোসেলের চোখ দিয়ে চারদিকে দেখে নিশ্চিত হয়ে নিয়ে বলল, নিকি, তুমি এখন ভেতরে আসতে পার।
নিকি বাসাটির ভেতরে ঢুকল। বহুবছর এখানে কোনো মানুষের পা পড়ে নি, তারপরেও বাসাটি সাজানো গোছানো। ক্রিনিটির সাথে সে বাসাটির ভেতর ঘুরে দেখে, উপর তলায় দুটি ছোট ঘরে দুটি ছোট বিছানা। এখানে নিশ্চয়ই দুটি ছোট শিশু ঘুমাতো। ঘরের দেয়ালে শিশুগুলোর ছবি টানানো, হাসিখুশি দুটি বাচ্চা।
নিকি বাচ্চাগুলোর ছবি দেখে বুকের ভেতর একধরনের ব্যথা অনুভব করে। সারা পৃথিবীর এরকম লক্ষ লক্ষ শিশু বেঁচেছিল,এখন কেউ নেই। সে একা এখন এই নির্জন পৃথিবীতে মানুষ খোঁজ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে জানে না যদি একসাথে অনেকগুলো মানুষ থাকে তাহলে কিভাবে কথা বলতে হয়। কী করতে হয়। সত্যি সত্যি যদি কোনো মানুষের সাথে দেখা হয়ে যায় তাহলে সে কী করবে? তার সাথে কী কথা বলবে?
রাতে ঘুমানোর সময় ক্রিনিটি উপর তলায় ছোট একটি বাচ্চার বিছানা গুছিয়ে নিকিকে শেয়ার ব্যবস্থা করে দিলো। কিছুক্ষণ পর সে তাকে একবার দেখতে এসে আবিষ্কার করল নিকি বিছানা থেকে চাদরটা নিয়ে মেঝেতে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। যে বিছানাটি অন্য একজন শিশুর সেখানে সে শুতে চাইছে না। কেন নিকি বিছানায় শুতে চাইছে না ক্রিনিটি সে বিষয়টা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করল না। মানুষের অনেক বিষয় সে বুঝতে পারে না, সে বোঝার চেষ্টাও করে না, বিষয়টি মেনে নেয়।
ক্রিনিটি নিকির শরীরটি চাদর দিয়ে ভালো করে ঢেকে দিয়ে তার গলার মাদুলিটি খুলে নীচে নেমে আসে। ক্রিস্টাল রিডারে দিনলিপি রেকর্ড করে সে তার যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে বসল। যখন পৃথিবীতে মানুষ বেঁচে ছিল তখন বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের পুরো স্পেকট্রামটা ব্যস্ত ছিল, অসংখ্য সিগনাল আনাগোনা করত। এখন পুরো স্পেকট্রামটি আশ্চর্যরকম নীরব। ক্রিনিটি একটু একটু করে বিশ্লেষণ করতে করতে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যে অত্যন্ত দুর্বল একটি সিগনাল আবিষ্কার করল। সে দীর্ঘ সময় সেটিকে বিশ্লেষণ করে, এখান থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে শখানেক কিলোমিটার দূর থেকে সেটি আসছে। কাছাকাছি গেলে হয়তো উৎসটা খুঁজে বের করা যাবে।
ক্রিনিটি বাকি রাতটুকু বাইভার্বালকে আরেকটি দীর্ঘ যাত্রার জন্যে প্রস্তুত করে কাটিয়ে দিল। মানুষের মতো রোবটকে ঘুমাতে হয় না,রোবটকে বিশ্রমিও নিতে হয় না। ক্রিনিটি তাই দিনরাত একটানা কাজ করতে পারে। যখন পৃথিবীর মূল তথ্যকেন্দ্র চালু ছিল তখন সে ব্যাপারটি বোঝার জন্যে নানারকম তথ্য সংগ্রহ করেছে, ব্যাপারটি সে বুঝতে পারে নি। ঘুম বিষয়টি তার বোঝার ক্ষমতার বাইরে। স্বপ্ন বলে মানুষের ঘুম সম্পর্কিত আরো একটি বিষয়ের কথা সে শুনেছে, সেটি কী ক্রিনিটি তা অনুমান পর্যন্ত করতে পারে না।
ভোরবেলা নিকিকে নিয়ে ক্রিনিটি আবার রওনা দিয়ে দেয়। কোনদিকে যেতে হবে সেটি মোটামুটিভাবে জানে তাই ক্রিনিটি নিকিকে মাঝে মাঝেই বাইভার্বালটি চালাতে দিচ্ছে। আগে হোক পরে হোক নিকিকে এই ধরনের কাজগুলো শিখতেই হবে। যে শিশুটি পৃথিবীর একমাত্র জীবিত মানুষ তার দায়িত্ব অনেক বড়, তাকে সেভাবে গড়ে নিতে হবে।
উত্তর-পশ্চিমে যেতে যেতে হঠাৎ করে তারা একটি রাস্তা আবিষ্কার করল, কংক্রিটের রাস্তা অব্যবহারের কারণে জঞ্জালে ঢাকা পড়ে আছে। নিকি এই রাস্তা ধরে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে নিল। ডানপাশে একটি নীল, হ্রদ আবিষ্কার করে নিকি অকারণেই পুরো হ্রদটি একবার ঘুরে এলো। ক্রিনিটি নিকিকে বাধা দিল না, বাইভার্বালটি আবার যখন পথের উপর উঠে এলো তখন ক্রিনিটি বলল, নিকি, তুমি বাইভার্বালটি ডান দিকে ঘুরিয়ে নাও।
কেন?
সামনে আমি একধরনের সিগন্যাল দেখেছি।
কোথা থেকে আসছে সিগন্যালটি?
আমি এখনও জানি না। কাছে গেলে বুঝতে পারব।
নিকি বাইভার্বালটিকে ডান দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে অল্প কিছুদূর এগিয়ে যেতেই কন্ট্রোল প্যানেলে দুটি ছোট ছোট বিন্দু ফুটে ওঠে। নিকি বলল, ক্রিনিটি, এই দেখ সামনে আরো দুটি হরিণ।
ক্রিনিটি মাথা নাড়ল, বলল, না এগুলো হরিণ না।
এগুলো তাহলে কী?
আমার মনে হয়, এগুলো রোবট।
রোবট?
হ্যাঁ। এটির শরীর ধাতব। এটি নড়ছে।
কী মজা! নিকির মুখে হাসি ফুটে উঠল, তোমার সাথে তোমার রোবট বন্ধুদের দেখা হবে।
নিকির কথা শেষ হবার আগেই কর্কশ গুলির শব্দ শোনা গেল এবং বাইভার্বালের সামনে বায়ুনিরোধক স্বচ্ছ কাচের একটি অংশ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। নিকি বিদ্যুৎগতিতে নীচু হয়ে চিৎকার করে উঠল, কী হয়েছে?
ক্রিনিটি বলল, গুলি করছে।
কে গুলি করছে?
রোবটগুলো।
কেন গুলি করছে রোবটগুলো?
মনে করছে আমরা তাদের এলাকায় বেআইনীভাবে ঢুকে পড়েছি। ক্রিনিটির গলার স্বরে বিন্দুমাত্র উত্তেজনা নেই, খুবই স্বাভাবিক গলায় বলল, তুমি নিচু হয়ে থাক। তোমার শরীরে যেন গুলি না লাগে।
তুমিও নিচু হয়ে যাও ক্রিনিটি।
আমি রোবটগুলির সাথে যোগাযোগ করছি।
ক্রিনিটির কথা শেষ হবার আগে দ্বিতীয়বার কর্কশ শব্দ করে এক ঝাঁক গুলি ছুটে এলো, বাইভার্বালের বায়ুনিরোধক যেটুকু কাচ বাকি রয়ে গিয়েছিল সেটুকুও এবার উড়ে গেল। নিকি চিৎকার করে বলল, ক্রিনিটি বসে পড়!
ক্রিনিটি বসে পড়ল না বরং মাথা উঁচু করে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ করে বাইভার্বালটি ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে পড়ে এবং চোখের পলকে চারদিক দিয়ে অনেকগুলো বীভৎস ধরনের রোবট বাইভার্বালটিকে ঘিরে ধরে। তাদের হাতে বিকট-দর্শন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। বাইভার্বালটি থামার সাথে সাথে রোবটগুলো একসাথে তাদের অস্ত্রগুলো উঁচু করে চারদিক থেকে তাদের দিকে তাক করে ধরল।
নিকি চাপা গলায় বলল, বোকা! কী বোকা!
একটি রোবট মাটিতে পা ঠুকে বলে, বোকা কে বলেছে আমাদের?
নিকি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি।
তুমি? তুমি কেন আমাদের বোকা বলেছ?
তোমরা সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে অস্ত্র তাক করেছ। এখন সবাই যদি গুলি কর তাহলে একজন আরেকজনকে মেরে ফেলবে।
রোবটগুলো বেশ কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা বলল না, তারপর সবাই একসাথে তাদের অস্ত্র নামিয়ে বিড়বিড় করে কথা বলতে লাগল। শেষে একটি রোবট জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?
আমার নাম নিকি।
তুমি কত মাত্রার রোবট? সিস্টেম কতো ধাপের?
আমি রোবট না।
তাহলে তুমি কী?
আমি মানুষ।
সাথে সাথে রোবটগুলোর মাঝে ভয়ংকর এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে গেল। তারা একে অপরকে ধাক্কা দিতে থাকে, কথা বলতে থাকে, একবার অস্ত্র উপরে তুলে তারপর নামিয়ে আনে এবং সেগুলো কঁকাতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যায় তখন ক্রিনিটি হাত তুলে বলল, তোমরা খাম।
রোবটগুলো সাথে সাথে থেমে যায়। একটি রোবট মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে নিকিকে দেখিয়ে বলল, এই যন্ত্রটি আমাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
ক্রিনিটি বলল, নিকি যন্ত্র নয়। নিকি আসলেই মানুষ।
রোবটটা আবার মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, পৃথিবীতে কোনো মানুষ বেঁচে নেই। সব মানুষ মরে গেছে।
দ্বিতীয় একটি রোবট বলল, মরে গেছে।
তখন অন্য সবগুলো রোবট হল্লা করতে শুরু করল, মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে শুরু করল, মরে গেছে। মরে গেছে।
নিকি অবাক হয়ে এই বিভৎস দর্শন রোবটগুলোকে দেখে, তাদের এই বিচিত্র ব্যবহার দেখে সে হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেলল।
সাথে সাথে সবগুলো রোবট হঠাৎ পাথরের মতো জমে যায়। সবগুলো। রোবট তাদের ফটোসেলের চোখ দিয়ে নিকির দিকে তাকিয়ে থাকে, তারা। অস্ত্রগুলো নামিয়ে নেয় তারপর একে অন্যের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করে, হেসেছে।
এটি নিশ্চিত ভাবে হাসি। অন্যকিছু নয়।
অন্যকিছু নয়।
শুধু মাত্র মানুষ হাসতে পারে।
মানুষ শুধুমাত্র মানুষ।
তার অর্থ এই বস্তুটি একটি মানুষ।
সত্যিকারের মানুষ।
আমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। আমরা সত্যিকারের একটি মানুষকে দেখতে পাচ্ছি।
সৌভাগ্যবান। অনেক সৌভাগ্যবান।
আমাদেরকে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছিল। সকল মানুষ মারা যায় নি।
মারা যায় নি।
বস্তুটি একটি মানুষ। আমি মানুষটিকে স্পর্শ করে দেখতে চাই।
স্পর্শ করতে চাই। আমার তথ্যকেন্দ্রে তথ্য রয়েছে মানুষের শরীরে তাপমাত্রা নির্দিষ্ট। এটি স্থির থাকে।
চামড়া কোমল এবং খানিকটা আর্দ্র।
এদের চোখ অত্যন্ত সংবেদনশীল।
সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ এদের মস্তিস্ক। দশ বিলিয়ন নিউরন।
আলোচনা এভাবে হয়তো আরো দীর্ঘ সময় ধরে চলত কিন্তু ক্রিনিটি হাত তুলে তাদের থামাল। বলল, তোমাদের অনুমান সত্যি। আমার সামনে পঁড়িয়ে থাকা এই শিশুটি একটি সত্যিকারের মানব শিশু। আমি তৃতীয় মাত্রার একটি রোবট। আমার প্রতিষ্ঠানিক নাম ক্রিনিটি।
সামনে উপস্থিত রোবটগুলো একসাথে কথা বলতে শুরু করে, আমরা দ্বিতীয়মাত্রার রোবট। আমাদের নাম নেই, শুধু সংখ্যা দিয়ে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বাইনারীতে আমার সংখ্যাসূচক শূন্য এক শূন্য শূন্য এক…
ক্রিনিটি আবার তাদের থামাল, বলল, তোমাদের সংখ্যা সূচক বলার। প্রয়োজন নেই। আমরা যে কাজে এসেছি তোমরা আমাদের সে কাজে সাহায্য কর।
অবশ্যই অবশ্যই আমরা সাহায্য করব। আমাদের যেটুকু ক্ষমতা আছে তার পুরোটুকু দিয়ে আমরা সাহায্য করব।
পৃথিবীর মানুষের মৃত্যু হবার পর তাদের নেটওয়ার্কটি অচল হয়ে গেছে। আমরা কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারছি না। আমরা খোঁজ করছি অন্য কোনো নেটওয়ার্ক চালু আছে কিনা। যদি চালু থাকে তাহলে আমরা কিছু তথ্য পেতে চাই।
আমাদের একটি নেটওয়ার্ক আছে। আমরা সেই নেটওয়ার্ক থেকে কিছু তথ্য পেতে পারি। মানুষের মৃত্যুর পর তথ্যের গুরুত্ব কমে গেছে। আমাদের দায়িত্ব নিয়ে আদেশ নির্দেশ আর পাঠানো হয় না। আমরা সেই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করি না।
ক্রিনিটি বলল, আমি সেই নেটওয়ার্কটি ব্যবহার করে একটু তথ্য সংগ্রহ করতে চাই।
বিভৎস দর্শন একটি রোবট বলল, চল, আমাদের সাথে চল। আমাদের কন্ট্রোল রুমে নেটওয়ার্ক সংযোগ আছে।
নিকি বলল, আমি কন্ট্রোল রুমে যেতে চাই না। নেটওয়ার্ক দেখতে চাই।
ক্রিনিটি জিজ্ঞেস করল, তাহলে তুমি কী করতে চাও?
আমি জায়গাটি ঘুরে ঘুরে দেখতে চাই।
এটি অপরিচিত জায়গা। তোমার যদি কোনো বিপদ হয়?
মাঝারি আকারের বিদঘুটে একটি রোবট বলল, আমি মহামান্য নিকিকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা প্রদান করব।
সাথে সাথে আরো কয়েকটি রোবট বলল, আমরাও মানব সন্তান মহামান্য নিকিকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিতে পারি।
ক্রিনিটি বলল, তা হলো আমরা দুইভাগে ভাগ হয়ে যেতে পারি। কয়েকজন আমার সাথে এসো, অন্যেরা নিকির সাথে থাকো।
বিভৎস রোবটটি বলল, ঠিক আছে।
বিশাল একটি বিল্ডিং-এর পাশে একটি কৃত্রিম হ্রদ। হ্রদটি ঘিরে বড় বড় গাছ। সেই গাছে পাখি কিচিরমিচির করছে। নিকি মাথা তুলে পাখিগুলোকে দেখার চেষ্টা করল।
একটি রোবট বলল, মহামান্য নিকি? পাখিগুলোর চেঁচামেচি কী আপনাকে বিরক্ত করছে? আমি তাহলে এই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে পাখিগুলোকে শেষ করে দিতে পারি।
নিকি আঁতকে উঠে বলল, না, না, না! খবরদার পাখিগুলোর কখনো কোনো ক্ষতি করবে না।
আপনার ইচ্ছা মহামান্য নিকি। আপনি যেটি বলবেন সেটিই আমরা মেনে নেব।
নিকি হি হি করে হেসে বলল, আর আমাকে মহামান্য নিকি বলে ডেকো না! যখন আমাকে তোমরা মহামান্য নিকি বলে ডাকো তখন আমার যা হাসি পায় সেটি বলার মতো না। হাসতে হাসতে আমার পেট ব্যথা হয়ে যায়।
রোবটটি বিড় বিড় করে বলল, হাসি এবং ব্যথা এই দুটিই একটি মানবিক প্রক্রিয়া। আমরা এই প্রক্রিয়াগুলো বুঝি না।
নিকি গম্ভীর হয়ে বলল, ভাগ্যিস ক্রিনিটি এখানে নেই। সে থাকলে বলত তোমাদের বুদ্ধিমত্তা কম! ক্রিনিটি সারাক্ষণ আমাকে শুধু বুদ্ধিমত্তা বোঝানোর চেষ্টা করে।
রোবটগুলো কোনো কথা বলল না। নিকি বলল, আমার কী মনে হয়। জানো?
কী?
ক্রিনিটির নিজেরই বুদ্ধিমত্তা কম।
রোবটগুলো এবারেও কোনো কথা বলল না। নিকি বলল, তবে ক্রিনিটির মনটি খুব ভালো। সে আমাকে খুব ভালোবাসে।
০৫. রোবটগুলো বাইভার্বালটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল
রোবটগুলো বাইভার্বালটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল। ক্রিনিটি ইঞ্জিনটিকে চালু করার সাথে সাথে তারা হাতের অস্ত্র উপরে তুলে চিৎকার করে বলল, জয়, মহামান্য নিকির জয়।
নিকি হাসি মুখে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, বিদায়! আবার দেখা হবে তোমাদের সাথে।
রোবটগুলো গম্ভীরমুখে বলল, মহামান্য নিকি দীর্ঘজীবী হোন।
বাইভার্বালটি মাটি থেকে মিটার খানেক উপরে উঠে একটু কাত হয়ে ঘুরে গিয়ে ছুটে যেতে শুরু করে। নিকি মাথা ঘুরিয়ে দেখল রোবটগুলো তাদের অস্ত্র উপরে তুলে আবার চিৎকার করে বলল, জয়, মহামান্য নিকির জয়।
নিকি ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে বলল, ক্রিনিটি, এরা আমাকে সবসময় মহামান্য নিকি কেন বলে?
তাদের কপোট্রনে এটি ইলেকট্রনিকভাবে গেঁথে দেয়া আছে। পাকাপাকিভাবে? সবসময় তাদের মানুষকে সম্মান করতে হয়।
সব রোবটরাই কী এরকম?
না। এটি করা আছে শুধু দ্বিতীয় আর প্রথম মাত্রার রোবটে।
তোমার মাঝে নেই?
আমার মাঝে ওদের মতো হার্ডওয়্যার করা নেই। অন্যভাবে আছে। সিস্টেমে রাখা আছে। আমরাও মানুষকে গুরুত্ব দিই।
আর চতুর্থ মাত্রার রোবট?
তারাও মানুষকে গুরুত্ব দেয় কিন্তু তাদের কপোট্রনের দক্ষতা মানুষের মস্তিষ্কের সমান। তাই তারা সমান সমানভাবে গুরুত্ব দেয়।
আর পঞ্চম মাত্রার রোবট?
পৃথিবীতে পঞ্চম মাত্রার রোবট নেই।
কেন নেই?
তৈরি করা হয় নি। আমি তোমাকে বলেছি তাদের বুদ্ধিমত্তা মানুষের। বুদ্ধিমত্তা থেকে অনেক বেশি হবে তাই ইচ্ছে করে তৈরি করা হয় নি। আমার কি মনে হয় জানো?
কী?
পঞ্চম মাত্রার রোবট মানুষকে মনে হয় সম্মান করবে না। তাদের বুদ্ধিমত্তা যদি মানুষ থেকে বেশি হয় তাহলে তাদের সম্মান করার দরকারও নেই। তুমি কী মিক্কুকে সম্মান কর?
নিকি খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, কিন্তু আমি তো মিকুকে অনেক ভালোবাসি। পঞ্চম মাত্রার রোবট মানুষকে ভালোবাসবে না?
মনে হয় ভালোবাসবে। মানুষকে ভালোবাসতে হয়।
ক্রিনিটি বাইভার্বালটিকে একটি হ্রদের কাছাকাছি নিয়ে এলো, হ্রদের তীর ঘেঁষে বাইভার্বালটি গর্জন করে ছুটে যেতে থাকে। বাইভার্বালের শব্দ শুনে অসংখ্য পাখি সচকিত হয়ে উড়ে যেতে থাকে। নিকি পাখিগুলোকে দেখতে দেখতে ক্রিনিটিকে জিজ্ঞেস করল, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি ক্রিনিটি?
একটি রোবোনগরীতে।
রোববানগরী কী?
পৃথিবীর সব মানুষ মরে যাবার পরে রোবটেরা পৃথিবীর দায়িত্ব নিয়েছে। তারা নগর তৈরি করেছে। সেই নগরকে বলে রোবোনগরী।
সেখানে কী আছে ক্রিনিটি?
আমি এখনো জানি না। এখানে রোবটদের যে নেটওয়ার্ক আছে সেই নেটওয়ার্কে একটু খোঁজ নিয়েছি। মানুষের শহরে যা যা থাকার কথা মনে হয় তার সবই আছে। সিনেমা হল, আর্ট গ্যালারি, মিউজিক হল, স্টেডিয়াম, দোকানপাট।
সবকিছু রোবটদের জন্যে?
হ্যাঁ। সবকিছু রোবটদের জন্যে।
সেখানে কী আমার মতো কোনো মানুষ আছে?
এখনো জানি না। গেলে বুঝতে পারব। আমার মনে হয় নাই। গেলে। খোঁজ পাব, অন্য কোনো রোবোনগরীতে আছে কি নেই। যতক্ষণ না পাই আমরা খুঁজতে থাকব।
তোমার কি মনে হয় ক্রিনিটি, আমরা কি খুঁজে পাব?
আমার মনে হয় পাব। তুমি যেরকম বেঁচে গিয়েছ সেরকম নিশ্চয়ই আরো কেউ বেঁচে গিয়েছে। তারা নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও আছে।
নিকি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আরেকজন মানুষের সাথে দেখা হলে আমি তাকে কী বলব?
আমি তোমাকে বলেছি তোমার সেটি নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তুমি তখন নিজেই বুঝতে পারবে কী বলতে হবে।
কী মজা হবে তখন, তাই না ক্রিনিটি?
ক্রিনিটি মজা শব্দটি অনুভব করতে পারে না, কিন্তু সে সেটি নিকিকে বুঝতে দিল না।
সন্ধ্যেবেলা রোবোনগরী পৌঁছানোর অনেক আগেই বাইভার্বালের মনিটরে তার উপস্থিতি ধরা পড়ল। সেখানে অনেকগুলো বিন্দু বিন্দু আলো এবং বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের বিচ্ছুরণ দেখা গেল। নিকি সেদিকে তাকিয়ে বলল, অনেক হইচই হচ্ছে। তাই না ক্রিনিটি?
হ্যাঁ।
সেখানে রোবটগুলো কয় মাত্রার?
বেশিরভাগই চার মাত্রার। হয়তো কিছু তিন মাত্রার।
তারা আমাকে দেখলে কী করবে?
আমি এখনও জানি না। সেজন্যে আমি সাবধান থাকতে চাইছি।
কিভাবে তুমি সাবধান থাকবে?
তোমাকে আমি আগেই নিয়ে যাব না। আমি নিজে গিয়ে আগে দেখে আসি।
আমাকে কোথায় রেখে যাবে?
তোমার জন্যে একটি নিরাপদ আশ্রয় বের করে সেখানে রেখে যাব।
আমি একা একা থাকব?
হ্যাঁ।
আমার একা থাকার ইচ্ছে করছে না।
ক্রিনিটি তার কপোট্রনে মৃদু চাপ অনুভব করল। সে চাপটি কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে জিজ্ঞেস করল, তাহলে তুমি কী করতে চাও?
আমি তোমার সাথে যেতে চাই।
তোমাকে দেখলেই রোববানগরীতে বিশাল উত্তেজনার সৃষ্টি হবে। সেটি ভালো হবে না খারাপ হবে আমি সেটি এখনো অনুমান করতে পারছি না। আমি তোমাকে নিয়ে কখনো কোনো ঝুঁকি নেব না।
ঠিক আছে আমি তাহলে লুকিয়ে থাকব।
কোথায় লুকিয়ে থাকবে?
এই বাইভার্বালের পিছনে যে বাক্সটা আছে তার ভেতরে। তাহলে কেউ আমাকে দেখতে পাবে না।
ক্রিনিটি বলল, বাক্সটা বেশি বড় না, তুমি কি আরাম করে থাকতে পারবে?
হ্যাঁ পারব। আমি গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে যাব। তুমি কোনো চিন্তা করো না।
ঠিক আছে। ক্রিনিটি বলল, আমার মনে হয়, এটি একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান হতে পারে।
কাজেই বাইভার্বালটি থামিয়ে তার পেছনের বাক্সে বেশ খানিকটা জায়গা করে নিয়ে ক্রিনিটি সেখানে নিকিকে শুইয়ে দিল। জিজ্ঞেস করল, তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?
না। এখানে খুব আরামে ঘুমানো যাবে। এখন থেকে প্রত্যেকদিন আমি এখানেই ঘুমাব।
ঠিক আছে, তুমি ঘুমাও। আমি বাইভার্বালটিকে নিয়ে রোবোনগরীতে ঢুকি।
রোববানগরের গেটে দুটি ভয়ংকর দর্শন রোবট ক্রিনিটির বাইভার্বালটিকে থামাল। একজন জিজ্ঞেস করল, তুমি এই কিম্ভুতকিমাকার জঞ্জাল নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?
এটি কিম্ভুতকিমাকার জঞ্জাল নয়। এটি বাইভার্বাল।
এটি এতো পুরানো যে এটাকে জঞ্জাল বলা যায়। যাই হোক তুমি কোথায় যাচ্ছ?
আমি রোববানগরীর ভেতরে যেতে চাই।
তোমার কী লাইসেন্স আছে?
না। আমার লাইসেন্স নেই। আমি অনেকদূর থেকে এসেছি। আমি আগে কখনো রোবোনগরীতে যাইনি।
সেটি আমি তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি। তোমার কপোট্রন থেকে এখনো প্রাচীন কোডিং রেডিয়েট করছে।
আমি কী করতে পারি?
তোমাকে আমি সাময়িক একটি লাইসেন্স দিচ্ছি, চব্বিশ ঘণ্টার। এর মাঝে তোমাকে স্থায়ী লাইসেন্স করাতে হবে।
ঠিক আছে।
রোবটটি তার কিছু যন্ত্রপাতিতে চাপ দিতেই ক্রিনিটি তার কপোট্রনে কিছু তথ্যেরে অনুপ্রবেশ টের পেল। সে কপোট্রনটিকে দ্রুত ফায়ারওয়াল দিয়ে ঢেকে ফেলে। তার কপোট্রনে তথ্য ঢুকে গেলে সমস্যা নেই, কিন্তু কোনোভাবে। সেখান থেকে তথ্য বের করে নিলে তারা নিকির তথ্য জেনে নেবে।
ভয়ংকর দর্শন রোবটটি বলল, যাও। তোমার এই লক্করঝক্কর বাইভার্বালটি নির্দিষ্ট জায়গায় পার্ক করে নিও। আমরা কোডিং দিয়ে দিচ্ছি।
ঠিক আছে। তোমার কাছে কি কোনো ইউনিট আছে?
না নেই।
রোবটটি শীষ দেয়ার মতো শব্দ করে বলল, তাহলে তুমি স্ফূর্তি করবে। কেমন করে। রোববানগরীতে এসেছ ফূর্তি না করে চলে যাবে?
আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট। আমার ভেতরে স্ফূর্তি করার মডিউল নেই!
রোবোনগরীতে সস্তায় এই মডিউল লাগানো হচ্ছে। লাগিয়ে নিয়ে স্ফূর্তি করতে পারবে। সত্যি কোনো ইউনিট নেই।
না। তবে—
তবে কী?
আমি একটি মানুষ পরিরারের গৃহস্থালি রোবট হিসেবে কাজ করতাম। সেই পরিরারের অব্যবহৃত কিছু ইউনিট আমার কাছে আছে। খুবই কম।
বল কী? এটি তো সোনার খনি। সোনার খনি?
হ্যাঁ। মানুষের হাতের স্পর্শ পাওয়া ইউনিট রীতিমতো মূল্যবান বস্তু। এর একটি বিক্রি করেই তুমি বড়লোক হয়ে যাবে। মানুষের যে কোনো কিছু খুবই মূল্যবান।
ক্রিনিটি নিজের কপোট্রনে একধরনের চাপ অনুভব করল, সে চাপটি কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর বলল, মানুষের যে কোনো কিছুই মূল্যবান?
হ্যাঁ। মানুষের চুল। নখ। ব্যবহারী কাপড়। এমনকি মানুষের আসল ভিড়িও অনেক ইউনিটে বিক্রি হয়। তোমার কাছে কি কিছু আছে?
আমি গৃহস্থালি রোবট হিসেবে কাজ করেছি, কাজেই আমার কাছে কিছু আছে।
চমৎকার। বিক্রি করে তুমি রাতারাতি ধনী হয়ে যাবে। কপোট্রনের আপগ্রেড করে চারমাত্রায় চলে যেতে পারবে। নতুন পৃথিবী উপভোগ কর।
ক্রিনিটি বলল, আমি চেষ্টা করব।
রোবট দুটি সুইচ টিপে দিতেই ঘরঘর শব্দ করে গেটটা খুলে যায়, ক্রিনিটি তার বাইভার্বালটি নিয়ে রোববানগরীর ভেতর ঢুকল।
রাস্তায় নানা আকারের বাইভার্বাল, আধুনিক এবং স্বয়ংক্রিয়। সেগুলোর তুলনায় তার নিজের বাইভার্বালটি রীতিমতো হাস্যকর একটি যন্ত্র। চতুর্থ মাত্রার কিছু রোবট মাথা ঘুরিয়ে সেটি দেখছে। ক্রিনিটি অনুমান করতে পারে হাসার ক্ষমতা থাকা এই রোবটগুলো নিশ্চয়ই তার বাইভার্বালটিকে দেখে মনে মনে হাসছে।
বাইভার্বালটি নির্দিষ্ট জায়গায় পার্ক করে ক্রিনিটি পেছনে বাক্সের ভেতরে উঁকি দিল, নীচু গলায় ডাকল, নিকি?
নিকি ফিসফিস করে বলল, বল ক্রিনিটি।
তুমি বলেছিলে ঘুমাবে।
ঘুম পাচ্ছে না।
না পেলেও চুপ করে শুয়ে থাক। আমি শহরটা ঘুরে দেখে একটু খোঁজ। খবর নিয়ে চলে আসব।
ঠিক আছে।
ক্রিনিটি এদিক সেদিক তাকায়, তার ইলেকট্রনিক সিগন্যাল বিস্তৃত করে। আশপাশে কেউ তাদের লক্ষ করছে না বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর সে হাঁটতে থাকে। দুটো রাস্তা পরেই দেখা যায় সেখানে বিশাল উত্তেজনা। উজ্জ্বল আলো এবং নানা আকারের রোবোটের অনেক ভিড়। তাদের হইচই চেঁচামেচিতে জায়গাটি মুখরিত হয়ে আছে।
ক্রিনিটি সতর্কভাবে হাঁটতে থাকে। সে টের পায় তার কপোট্রনে অনেক তথ্য জোর করে ঢোকার চেষ্টা করছে, বিষয়টিতে সে অভ্যস্ত নয় তাই ফায়ারওয়াল দিয়ে সে নিজের কপোট্রনে একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে রাখে। আশপাশের ঘরগুলো থেকে তাকে রোবটগুলো ডাকাডাকি শুরু করে দেয়। সংগীতের একটি দোকান থেকে একট রোবট বলল, এই যে রূপবান! আমার ঘরে এস কিনিস্কির নবম সিম্ফোনি শুনে যাও। আজকে ছাড় দিয়েছি, মাত্র আট ইউনিটে পেয়ে যাবে।
ক্রিনটি বলল, আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট। সংগীত উপভোগ করার ক্ষমতা নেই।
তাতে কী আছে। কিনে নিয়ে যাও যখন চতুর্থ মাত্রার কপোট্রন বসবে এখন উপভোগ করবে।
চতুর্থমাত্রার কপেট্রনে আপগ্রেড করার মতো ইউনিট আমার কাছে এখন নেই।
এখন নেই তো কী হয়েছে? ভবিষ্যতে হবে।
ভবিষ্যতে যখন হবে তখন আমি বিবেচনা করব।
সংগীতের দোকানের রোবটটি হতাশার মতো শব্দ করে বলল, এই জন্যে তৃতীয় মাত্রার রোবটকে বলে জংধরা জঞ্জাল।
ক্রিনিটি তাচ্ছিল্যটুকু উপেক্ষা করে এগিয়ে যায়। সামনে একটি ঘরের বাইরে অনেক ধরনের উজ্জ্বল আলো জ্বলছে এবং নিভছে। বাইরে উজ্জ্বল রঙের দুটি রোবট একই সাথে ঠিক একইভাবে তাদের যান্ত্রিক হাত নেড়ে কথা বলছে, এসো, আনন্দের ভুবনে এসো। কপোট্রনে সঠিক তরঙ্গ উপস্থাপনের মাধ্যমে মাদকের আনন্দ। সম্পূর্ণ আইনসিদ্ধ বিনোদন, চলে এসো। চলে এসো সবাই।
অনেক রোবট সেখানে ঢুকছে। ক্রিনিটি কয়েক মুহূর্ত ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে রইল তারপর আবার হাঁটতে শুরু করল।
ভয়ংকর ধরনের কিছু অস্ত্রের দোকান, কোল্ড ফিউসান ব্যাটারির একটি দোকান, তারপর কপোট্রন আপগ্রেডের অনেকগুলো দোকান পার হয়ে ক্রিনিটি আরো এগিয়ে যায়। বাইভার্বালের বড় একটি দোকান সে ঘুরে ঘুরে দেখল, নতুন নতুন ইঞ্জিনগুলো চমকপ্রদ তার বাইভার্বালটি নিয়ে নগররক্ষী রোবটগুলো যে তামাশা করেছে তার একটি কারণ আছে।
বাইভার্বালের দোকান থেকে সে নানাধরনের বিনোদনের আরো কয়েকটি ধর পার হয়ে একটি চিড়িয়াখানা দেখতে পেল অনেক ধরনের পশু সেখানে খা আছে। এরপরে একটি আর্ট গ্যালারি এবং কয়েকটি থিয়েটার। তার ঠিক মুখোমুখি একটি বড় হলঘরের সামনে সে দাঁড়িয়ে গেল। এতক্ষণ ধরে সে যেটি খুঁজছে ঠিক সেটি পেয়ে গেছে, হলঘরের উপরে নানা রঙের আলোর ঝলকানি, সেখানে বড় বড় করে লেখা, বিস্ময়কর মানবশিশু। দর্শনীয় দশ ইউনিট।
ক্রিনিটি তার পুরানো ইউনিট পরিবর্তন করে অনেকগুলো নতুন ইউনিট পেয়ে গেল। সেখান থেকে দশ ইউনিট ব্যবহার করে সে হলঘরে ঢুকে যায়। ভেতরে আবছা অন্ধকার, অনেকগুলো রোবট সেখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। সামনে একটি বড় স্টেজ, সেখানে চতুর্থমাত্রার ছিমছাম একটি রোবট কথা বলছে, বন্ধুগণ পৃথিবীর বিস্ময় হচ্ছে মানব শিশু। তোমাদের সামনে এখনি উপস্থিত হবে সেই বিস্ময়কর মানবশিশু, তোমরা তাকে দেখবে, তার সাথে কথা বলবে, তার গান শুনবে। মাত্র দশ ইউনিটের বিনিময়ে আর কোথাও এই বিনোদন তোমরা খুঁজে পাবে না।
একটি বিচিত্র শব্দ হতে থাকে এবং পেছনের পর্দাটি ধীরে ধীরে সরে গেল, দেখা গেল মঞ্চের মাঝখানে একটি ছোট টুল সেখানে তিন-চার বছরের ছোট একটি শিশু বসে আছে। মঞ্চে তীব্র আলো, সেই আলোতে শিশুটির বড় বড় চোখ খুলে রোবটগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে।
ছিমছাম রোবটটি তার গলায় কৃত্রিম একটি আনন্দের ভান ফুটিয়ে নিয়ে বলল, এই মানব শিশুটির নাম লিশুয়া তার জন্ম দক্ষিণের সমুদ্রতীরে ভাইরাসের কারণে তার পরিরারের সবাই মৃত্যুবরণ করলেও রহস্যময়ভাবে সে। বেঁচে যায়। তাই না লিশুয়া?
লিলুয়া নামের শিশুটি মাথা নাড়ল। ছিমছাম রোবটটি বলল, লিওয়া মানুষের কণ্ঠে কথা বলে শোনাবে—গান গেয়ে শোনাবে। নাচবে, খেলা দেখাবে।
উপস্থিত রোবটগুলোর একজন তখন বলল, হাসি দেখতে চাই। হাসি।
অন্য রোবটগুলো প্রতিধ্বনি করল, বলল, হাসি। হাসি।
ছিমছাম রোবটটি ইতস্তত করে বলল, লিশুয়া একা একা বড় হয়েছে, তাই সে হাসতে ভুলে গেছে। তাই না লিশুয়া?
লিশুয়া মাথা নাড়ল। ছিমছাম রোবটটি বলল, তারপরও সে তোমাদের সামনে হাসার চেষ্টা করবে। কিন্তু তার আগে সে তোমাদের সাথে কথা বলবে। তোমরা প্রশ্ন কর, লিশুয়া সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে। তাইনা লিশুয়া।
লিশুয়া মাথা নাড়ল এবং ক্রিনিটি বুঝতে পারল লিন্ডয়া আসলে সত্যিকারের মানব শিশু নয়। এটি জোড়াতালি দিয়ে মানবশিশুর মতো তৈরি করা একটি নিচু শ্রেণীর রোবট। ক্রিনিটি তখন রোবটদের ভিড় ঠেলে বের হয়ে যেতে শুরু করে।
ছিমছাম রোবটটি বলল, এই যে! এই যে রূপবান! তুমি চলে যাচ্ছ।
কেন?
ক্রিনিটি বলল, এটি সত্যিকার মানবশিশু নয়।
তুমি কেমন করে জান?
আমি জানি। কারণ আমি একটি গৃহস্থালি রোবট। আমি মানব শিশু দেখেছি।
ছিমছাম রোবটটি বলল, অন্তত লিশুয়ার একটি গান শুনে যাও।
সত্যিকারের মানব শিশু হলে নিশ্চয়ই শুনতাম।
মাত্র দশ ইউনিটে সত্যিকারের মানব শিশুর গান শোনা যায় না।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি রোবট বলল, লক্ষ ইউনিটেও তুমি সত্যিকারের মানব শিশুর গান শুনতে পারবে না। তার কারণ পৃথিবীতে কোনো মানব শিশু নেই।
জরাজীর্ণ একটি রোবট নিচু গলায় বলল, আছে।
তার কথায় অন্য রোবটেরা কোনো গুরুত্ব দিল না, শুধু ক্রিনিটি রোবটটির দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, কোথায় আছে?
জাতীয় গবেষণাগারে। একটি মেয়ে শিশু আছে।
তুমি কেমন করে জান?
জরাজীর্ণ রোবট টি আরো নীচু গলায় বলল, আমি কেমন করে জানি তুমি কেন সেটি জানতে চাইছ?
ক্রিনিটি বলল, আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট। আমার বুদ্ধিমত্তা নিম্নস্তরের। আমি নিজে থেকে একটি তথ্যের সত্য মিথ্যা বুঝতে পারি না। আমাকে যাচাই বাছাই করতে হয়।
রোবটটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ক্রিনিটির দিকে তাকাল। ক্রিনিটি বুঝতে পারল সেটি তার কপোট্রনে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করছে। ক্রিনিটি ফায়ারওয়ালটি উজ্জীবিত করে রেখে তাকে তার কপোট্রনের ভেতর ঢুকতে দিল না।
রোবটটি এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ করে বলল, যে নিজের কপোট্রনকে ফায়ারওয়াল দিয়ে ঢেকে রাখে আমি তাকে বিশ্বাস করি না। তুমি নিশ্চয়ই নিরাপত্তা বাহিনীর একজন গুপ্তচর।
ক্রিনিটি বলল, না। আমি গুপ্তচর না।
জরাজীর্ণ রোবটটি গলা উঁচিয়ে বলল, গুপ্তচর। গুপ্তচর।
হঠাৎ করে রোবটদের মাজে একটি হল্লা শুরু হয়ে গেল। মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা ছিমছাম রোবটটা হাত তুলে বলল, থাম। সবাই থাম। কী হয়েছে এখানে?
নিরাপত্তা বাহিনীর একটি গুপ্তচর এখানে ঢুকে গেছে।
ক্রিনিটি বলল, না। আমি গুপ্তচর না।
তাহলে তোমার কপোট্রন ফায়ারওয়াল দিয়ে ঢেকে রেখেছ কেন?
আমি আমার তথ্য সবাইকে দিতে চাই না।
রোবটগুলো আবার হল্লা করতে শুরু করল। মঞ্চে দাঁড়ানো ছিমছাম রোবটটি বলল, চুপ কর। তোমরা সবাই চুপ কর। তা না হলে আমি জ্যামার সিগন্যাল দিয়ে সবার কপোট্রন জ্যাম করে দেব।
কিছু কিছু রোবট তখন একটু শান্ত হয়। ক্রিনিটি রোবটদের ভিড় ঠেলে বের হয়ে যেতে থাকে। জরাজীর্ণ রোবটটি বলল, তুমি কেনো চলে যাচ্ছ?
এখানে থাকার আমার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি সত্যিকার মানব শিশু খুঁজছি। এটি সত্যিকার মানবশিশু নয়।
তুমি সত্যিকার মানবশিশু দিয়ে কী করবে?
আমি গৃহস্থালি রোবট। আমি সবসময় সত্যিকার মানব এবং সত্যিকারে মানব শিশুর সাথে কাজ করেছি। কৃত্রিম মানব এবং কৃত্রিম মানবশিশুতে আমার কোনো আগ্রহ নেই।
বুঝতে পেরেছি।
কী বুঝতে পেরেছ?
তোমার কপোট্রনে মানব শিশু নিয়ে অনেক তথ্য আছে। সে জন্যে তুমি তোমার কপোট্রন ফায়ার ওয়াল দিয়ে আড়াল করে রেখেছে।
ক্রিনিটি তার কপোট্রনে প্রবল একধরনের চাপ অনুভব করে, কিন্তু জরাজীর্ণ রোবটের পরের কথায় তার চাপ দ্রুত কমে আসে। জরাজীর্ণ রোবটটি বলল, আমি এখন বুঝতে পেরেছি তুমি কেন তোমার কপোট্রনটি ফায়ারওয়াল দিয়ে আড়াল করে রেখেছ। সত্যিকারের মানবশিশুর তথ্য অনেক। ইউনিটে বিক্রি হয়। এই তথ্যগুলোকে সবাইকে জানতে দিও না।
ক্রিনিটি বলল, দেব না।
দেখে শুনে বিক্রি করো।
করব।
তৃতীয় মাত্রার রোবটটি হিসেবে তোমার বুদ্ধিমত্তা খারাপ নয়। কিছু ইউনিট পেলে কপোট্রনটি চারমাত্রায় আপগ্রেড করে নিও।
করে নেব।
ভালো কোম্পানি থেকে কপোট্রন কিনবে। কপো-কট কোম্পানিটা ভালো। রক্ষণাবেক্ষণের ভালো প্যাকেজ আছে।
ঠিক আছে।
জরাজীর্ণ রোবটটা উপদেশ দিয়ে আরো কিছু একটি বলতে যাচ্ছিল, ক্রিনিটি তার আগেই জিজ্ঞেস করল, তুমি বলেছ জাতীয় গবেষণাগারে একটি মেয়ে শিশু আছে।
হ্যাঁ বলেছি।
জাতীয় গবেষণাগারটি কোথায়?
নতুন রোবনগরী ইস্পনাতে।
সেটি কোথায়?
বেশি দূরে নয়, এখান থেকে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার পশ্চিমে। নেটওয়ার্কে ইস্পনার অবস্থান দেয়া আছে। বাইভার্বালে কো অর্ডিনেট ঢুকিয়ে নিও।
চুকিয়ে নেব।
জরাজীর্ণ রোবটটি আরো কিছু একটি বলতে চাইছিল কিন্তু ঠিক তখন মঞ্চের কৃত্রিম মানবশিশুটি তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে হাত-পা নেড়ে তীক্ষ্ণ গলায় গান গাইতে শুরু করে। ক্রিনিটির সংগীত অনুভব করার ক্ষমতা নেই। তাই সে বুঝতে পারল না সেটি ভালো না খারাপ। সে অবশ্যি তার চেষ্টাও করল না, রোবটদের ভীড় ঠেলে বের হয়ে এলো।
রোবনগরীর রাজপথ ধরে হেঁটে হেঁটে ক্রিনিটি তার বাইভার্বালের কাছে ফিরে এলো। জায়গাটি অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং নিরিবিলি। ক্রিনিটি এদিক সেদিক তাকিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে নিল আশে পাশে কেউ নেই তখন সে বাই ভার্বালের পেছনে গিয়ে ছোট বাক্সটি সাবধানে খুলে উঁকি দেয়, সেখানে নিকির ঘুমিয়ে থাকার কথা। কিন্তু ভেতরে কেউ নেই।
ক্রিনিটি তৃতীয় মাত্রার রোবট তার বিচলিত অথবা আতংকিত হওয়ার ক্ষমতা নেই। তাই সে বিচলিত অথবা আতংকিত হল না। বাইভার্বালের সামনে লাগানো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি খুলে নিয়ে কন্ট্রোল প্যানেলের ওপরে রেখে বিড়বিড় করে বলল, এখন মনে হচ্ছে অস্ত্র নিয়ে আসার সিদ্ধান্তটি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।
০৬. ক্রিনিটি চলে যাবার পর
ক্রিনিটি চলে যাবার পর নিকি ছোট খুপরির মতো বাক্সের ভেতর ঘুমানোর চেষ্টা করল। তার চোখে সহজে ঘুম নেমে এল না, যখনি তার চোখে একটু ঘুম নেমে আসছিল ঠিক তখনই কাছাকাছি রোববানগরীর কোনো এলাকা থেকে বিচিত্র একধরনের হল্লার শব্দে সে পুরোপুরি জেগে উঠতে থাকল।
শেষ পর্যন্ত সে হাল ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি উঠে বসে এবং বাক্সের ডালাটা একটু খুলে বাইরে উঁকি দেয়। বাইরে আবছা অন্ধকার দূর থেকে রঙিন আলোর ভুটা এসে মাঝে মাঝে জায়গাটি একটু আলোকিত করে দিচ্ছে। আশপাশে কেউ নেই শুধু, বাইভার্বালগুলো সারি সারি সাজানো। নিকি কিছুক্ষণ চারদিকে লক্ষ করে, যখন সে দেখল কোথাও কেউ নেই তখন সে সাবধানে বাক্সের। ভেতর থেকে বের হয়ে এল। নিকি কিছুক্ষণ বাইভার্বালের মেঝেতে বসে রইল তারপর সে সেখান থেকে নেমে এল। কাছাকাছি অনেকগুলো বাইভার্বাল, নিকি হেঁটে হেঁটে কাছাকাছি বাইভার্বালটার কাছে দাঁড়ায়। আবছা অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না তারপরেও বোঝা যায় তাদের বাইভার্বাল থেকে এটি অনেক বেশি সুন্দর, অনেক চকচকে। নিকি হাত দিয়ে স্পর্শ করল, রাইভার্বালের আবরণটি মসৃণ এবং শীতল। নিকি হেঁটে হেঁটে পাশের বাইভার্বালের কাছে গেল, সেটিকেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখল। পরের বাইভার্বালটির কাছে গিয়ে সে হতবাক হয়ে যায়। এই বাইভার্বালটি অনেক বড়, পেছন দিকে বড় বড় দুটি জেট, ওপরে একটি পাখা। সামনে অনেকগুলো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। আবছা অন্ধকারে বাইভার্বালটিকে একটা বিশাল দৈত্যের মতো দেখায়। নিকি কাছে গিয়ে বাইভার্বালটিকে স্পর্শ করল।
সাথে সাথে একটি ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে যায়। বাইভার্বালটি জীবন্ত প্রাণীর মতো ঝটকা দিয়ে নড়ে উঠে, তীব্র আলোতে চারদিকে ঝলসে উঠে আর তীক্ষ্ণ এলার্মের শব্দে চারদিক সচকিত হয়ে ওঠে। নিকি ভয় পেয়ে লাফিয়ে সরে আসে, বাইভার্বাল থেকে অনেকগুলো সার্চ লাইট তার দিকে ঘুরে আসে, তীব্র আলোতে নিকির চোখ ধাধিয়ে যায়।
নিকি দুই হাতে চোখ ঢেকে ছুটতে থাকে, কোথায় কোনদিকে যাচ্ছে সে বুঝতে পারছিল না, যতক্ষণ পর্যন্ত তীব্র এলার্ম আর আলোর ঝলকানি হতে থাকল ততক্ষণ সে ছুটতে থাকল। যখন এলার্মের শব্দ শেষ পর্যন্ত কমে এলো নিকি তখন থামল এবং তাকিয়ে দেখল সে একটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। দূরে আলো জ্বলছে এবং সেই আলোতে দেখা যাচ্ছে নানা আকারের কিছু রোবট ইতস্তত হাঁটছে।
নিকি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাপাতে থাকে। সে তার এলাকায় জঙ্গলের প্রতিটি গাছকে চিনত, এখানে সে কিছুই চেনে না। ক্রিনিটি ফিরে এসে তাকে খুঁজে না পেলে কী করবে সে জানে না। ক্রিনিটি বলেছিল বাইভার্বালের বাক্সটায় শুয়ে ঘুমাতে, নিকি তার কথা শুনে নি, কাজটা মোটেও ভালো হয় নি। নিকির মনে হল সে কেঁদে ফেলবে কিন্তু সে কঁাদল না। ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে একটু শান্ত করে সে যেদিক থেকে হেঁটে এসেছে সেদিকে হেঁটে যেতে শুরু করল।
খানিকদূর হেঁটে নিকি বুঝতে পারল সে ভুল দিকে চলে এসেছে রাস্তায় অনেকগুলো দোকান এবং সেই দোকানের আশপাশে বেশ কিছু রোবট। একটি রোবট তার পাশে দিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে লম্বা পা ফেলে হেঁটে হেঁটে চলে গেল। রোবটটি তাকে দেখেছে কিনা নিকি বুঝতে পারল না। নিকি আবার ঘুরে উল্টো দিকে হাঁটতে থাকে খানিকটা নির্জন জায়গা পার হয়ে সে একটি দেয়ালের সামনে এসে দাঁড়াল তখন কোনদিকে যাওয়া উচিৎ সে বুঝতে পারছিল না। যখন সে ডানে-বামে তাকাচ্ছে তখন দেখতে পেল দুটি রোবট লম্বা পা ফেলে তার দিকে এগিয়ে আসছে।
রোবট দুটি কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে গেল, তাদের সবুজ ফটোসেলগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠল। ধাতব গলায় একটি রোবট জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ।
নিকি কিছু বলার আগেই অন্য রোবটটা বলল, খেলনা। নিশ্চয়ই খেলনা। দেখছ না কত ছোট?
প্রথম রোবটটা বলল, কিন্তু কোনো রেডিয়েশন নাই। বৈদ্যুতিক সিগন্যাল ছাড়া কেমন করে চলছে?
খুব ভালো করে সিল করেছে। দামি খেলনা।
প্রথম রোবটটা আরো একটু কাছে এসে বলল, তুমি কে?
নিকি বলল, আমি নিকি।
রোবট দুটি কেমন যেন ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। প্রথম রোবটটা বলল, শব্দের কম্পাঙ্ক ষোল থেকে শুরু করে পঁচিশ কিলো হার্টজ পর্যন্ত গিয়েছে। অপূর্ব সুষম উপস্থাপন!
সত্যিকারের মানব শিশুর মতো।
নিশ্চয়ই অত্যন্ত দামি খেলনা। ভালো কোম্পানির তৈরি।
দ্বিতীয় রোবটটি বলল, কোন কোম্পানির তৈরি?
পিঠে কোম্পানির লোগো আছে নিশ্চয়ই।
দ্বিতীয় রোবটটি তখন খপ করে নিকিকে ধরে ফেলল, এবং সাথে সাথে ছেড়ে দিল। প্রথম রোবটটি জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
এর ত্বকটি পলিমারের নয়। জৈবিক পদার্থ। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত। গঠন অবিশ্বাস্য।
প্রথম রোবটটি বলল, ব্যাটারিটা খুলে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা যাক।
কানের নিচে সুইচ থাকে। আগে সুইচটি অফ করে নাও।
প্রথম রোবটটা এবারে নিকিকে ধরার চেষ্টা করল, নিকি তখন ছিটকে পেছনে সরে এল। রোবটটা থমকে গিয়ে বলল, একটি খেলনার জন্য এটি যথেষ্ট ক্ষিপ্র!
নিকি একটি দৌড় দেবার চেষ্টা করল কিন্তু তার আগেই রোবটটি তাকে ধরে ফেলেছে। নিকি প্রাণপণে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে করতে বলল, ছেড়ে দাও! ছেড়ে দাও আমাকে।
রোবটটি তাকে ছাড়ল না। শক্ত করে ধরে তার কানের নিচে সুইচ খোঁজার চেষ্টা করতে থাকল।
সেখানে কিছু না পেয়ে তার পিঠে হাত বুলিয়ে ব্যাটারি প্যাক খুঁজতে লাগল। সেখানেও কিছু পেল না, তখন রোবটটি থেমে গেল। নিকির হাতটি শক্ত করে ধরে রেখে বলল, অবিশ্বাস্য। এটি অবিশ্বাস্য।
দ্বিতীয় রোবটটি বলল, কী অবিশ্বাস্য।
এর কোনো ব্যাটারি প্যাক নেই।
তার মানে?
তার মানে এটি একটি জৈবিক প্রাণী। এটি একটি জীবন্ত মানবশিশু।
জীবন্ত মানব শিশু? হ্যাঁ।
প্রথম রোবটটি এদিক-সেদিক তাকাল, তারপর বলল, এই মুহূর্তে আমাদের কপোট্রন ফায়ারওয়ালে আড়াল করে নিতে হবে যেন আর কেউ খোঁজ না পায়।
হ্যাঁ। আড়াল করে নিতে হবে।
দুটি রোবটই তাদের কপোট্রন ফায়ারওয়ালে আড়াল করে রোবটদের নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিল। তারপর নিচু হয়ে বসে নিকিকে পরীক্ষা করতে থাকে।
নিকি ছটফট করে নিজেকে মুক্ত করে নেয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও আমাকে।
প্রথম রোবটটি বলল, তোমাকে আমরা ছাড়ব না। তুমি সত্যিকারের মানব শিশু। পৃথিবীতে সত্যিকারের মানব শিশু নেই। তোমাকে কিছুতেই ছাড়া যাবে না।
কেন ছাড়া যাবে না।
তার কারণ তুমি পৃথিবীতে এখন অমূল্য সম্পদ।
দ্বিতীয় রোবটটি উঠে দাঁড়াল, চারদিকে একবার তাকাল তারপর বলল, আমরা এই মানবশিশুটিকে নিয়ে কী করব?।
অনেক কিছু করতে পারি। বিজ্ঞান একাডেমীতে বিক্রয় করতে পারি। থিয়েটারে দেখাতে পারি। শরীরের অংশ কেটে কেটে বিক্রয় করতে পারি। আমাদের অফুরন্ত সুযোগ।
আমরা দুজন সুযোগটা কিভাবে গ্রহণ করব?
প্রথম রোবট বলল, সেটি কোনো সমস্যা হবার কথা নয়।
কেন?
তার কারণ আমি আমার কপোট্রনে কিছুদিন আগে ভিগা মডিউল লাগিয়েছি।
ভিগা মডিউল? এটি বেআইনি। সম্পূর্ণ বেআইনি। কেউ তার কপোট্রনে ভিগা মডিউল লাগালে তাকে ধ্বংস করে দিতে হয়।
সেটি আমি জানি।
তাহলে কেন লাগিয়েছ?
ভিগা মডিউল কপোট্রনের নৈতিক ব্যাপারগুলো অচল করে বড় বড় অপরাধ করার ব্যবস্থা করে দেয়। আমি যে কোনো অনৈতিক কাজ করতে পারি। অপরাধ করতে পারি।
দ্বিতীয় রোবটটি একটু বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। সেটি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, কিন্তু সেটি অত্যন্ত বিপজ্জনক কাজ। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী খবর পেলে তোমাকে সাথে সাথে ধ্বংস করে দেবে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কেমন করে খবর পাবে? আমি কাউকে এই তথ্যটি দিই নি।
এই যে আমাকে দিলে।
আমি তোমাকে দিয়েছি কারণ আমি তোমাকে এক্ষুণি ধ্বংস করে দেব। এই মানবশিশুর মালিকানায় আমি কাউকে কোনো অংশ দিতে চাই না।
রোবটটি কথা শেষ করার আগেই তার শরীরের ভেতর থেকে একটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বের করে দ্বিতীয় রোবটটির মাথা লক্ষ করে গুলি করল। একটি ছোট বিস্ফোরণের মতো শব্দ হলো এবং দ্বিতীয় রোবটটি কয়েকবার দুলে উঠে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রথম রোবটটি সেটিকে পরীক্ষা করে অস্ত্রটি আবার তার শরীরের ভেতর ঢুকিয়ে নেয়।
নিকি নিজেকে মুক্ত করার জন্যে আরেকবার চেষ্টা করে চিৎকার করে বলল, আমাকে ছেড়ে দাও।
আমি তোমাকে ছাড়ব না। তোমাকে আমি নিয়ে যাব।
আমি তোমার সাথে যাব না।
সেটি কোনো সমস্যা নয়। আমি তোমাকে জোর করেই নিয়ে যাব। কিন্তু সারাক্ষণ তুমি যদি চিৎকার করতে থাক তাহলে অনেক সমস্যা হতে পারে। নিরাপত্তাবাহিনী এসে গেলে অনেক ঝামেলা হবে।
নিকি চিৎকার করে বলল, আমি চিৎকার করব।
রোবটটি গম্ভীর গলায় বলল, আমি তোমাকে তার সুযোগ দেব না। মানব শিশুর ঘাড়ে জোরে আঘাত করলে মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালনের বাধার কারণে সে অচেতন হয়ে পড়ে। আমি তোমাকে অচেতন করে নিয়ে যাব।
নিকি নিজেকে ছুটিয়ে নেবার চেষ্টা করতে করতে বলল, না। না–আমাকে ছেড়ে দাও।
তবে কতো জোরে আঘাত করতে হয় আমি জানি না। একটু জোরে আঘাত করলে মস্তিষ্কের রক্তবাহী ধমনী ছিঁড়ে যেতে পারে। মেরুদণ্ড ভেঙে যেতে পারে। আমি তারপরেও সেই ঝুঁকি নেব। ঘটনাক্রমে তুমি মরে গেলেও তোমার দেহটি থাকবে। সেটিও অনেক মূল্যবান।
রোবটটি নিকিকে তার একটি ধাতব হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রাখে এবং অন্য হাতটি দিয়ে আঘাত করার জন্যে হাতটি উপরে তোলে।
ঠিক তখন তার পেছনে একটি বাইভার্বাল এসে থামল আর সেখান থেকে ক্রিনিটি তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি হাতে নিয়ে নেমে আসে। রোবটটি কিছু একটি বুঝতে পেরে হাতটি স্থির রেখে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। ক্রিনিটি সাথে সাথে তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটির ট্রিগার টেনে ধরে এবং একটি বিস্ফোরণের শব্দের সাথে সাথে রোবটটির পুরো মাথাটি ভস্মীভূত হয়ে উড়ে যায়। তীব্র উত্তাপের একটি হলকায় সাথে সাথে ঝাঝালো একটি গন্ধে পুরো এলাকাটি ভরে গেল। রোবটটি কয়েকবার দুলে উঠে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
নিকি ঝটকা দিয়ে নিজের হাত-পা টেনে ধরতেই রোবটের অ্যাঙ্গেলগুলো খুলে যায়, নিজেকে মুক্ত করে সে ক্রিনিটির দিকে ছুটে গিয়ে বলল, ক্রিনিটি! তুমি এসেছ।
হ্যাঁ। আমি এসেছি। তাড়াতাড়ি বাইভার্বালে উঠে পড়।
উঠছি ক্রিনিটি।
বিস্ফোরণের শব্দে অন্য রোবট এসে পড়বে। তখন আমাকে আরো রোবটের কপোট্রন ভস্মীভূত করতে হতে পারে। আমি এখন সেটি করতে চাই না।
নিকি বাইভার্বালে উঠে ক্রিনিটিকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি কী আমার ওপরে রাগ করেছ ক্রিনিটি?
ক্রিনিটি বলল, আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট। আমার রাগ করার ক্ষমতা নেই নিকি। যদি থাকত তাহলে আমি হয়তো রাগ করতাম।
আমি তোমাকে বলছি ক্রিনিটি, আমি আর কক্ষনো তোমার কথার অবাধ্য হব না।
তুমি যখন আরেকটু বড় হবে, তখন তুমি তোমার নিজের দায়িত্ব নিতে পারবে। তখন তোমার আমার কথা শোনার প্রয়োজন হবে না। কিন্তু এখন আমার কথাগুলো শোনা তোমার নিরাপত্তার জন্যে ভালো।
ক্রিনিটি বাইভার্বালটা মাটি থেকে একটু উপরে তুলে সেটিকে উড়িয়ে নিতে থাকে। নিকি জিজ্ঞেস করল, আমরা এখন কোথায় যাব ক্রিনিটি।
প্রথমে এই শহর থেক বেরিয়ে যাব।
তারপর?
তারপর যাব ইম্পানা নামে নগরে।
সেখানে কী আছে?
শুনেছি সেখানে একজন মানবশিশু আছে।
নিকি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ক্ৰিনিটির দিকে তাকাল। বলল, মানবশিশু? আমার মতো?
হ্যাঁ, তোমার মতো।
তার সাথে দেখা হলে আমি কী বলব ক্রিনিটি?
সেটি নিয়ে এই মুহূর্তে তোমার চিন্তা করতে হবে না। তুমি বরং এখন বাক্সটার ভেতর ঢুকে যাও। আমি চাই না আর কোনো রোবট তোমাকে দেখুক।
ঠিক আছে ক্রিনিটি।
নিকি চলন্ত বাইভার্বালেই গুড়ি মেরে পেছনে গিয়ে বাক্সটার ভেতর ঢুকে গেল।
গভীর রাতে একটি হ্রদের পাশে ক্রিনিটি তার বাইভার্বালটি নামিয়ে আনে। খাবারের কৌটা খুলে কিছু খাবার বের করে সেগুলো একটু গরম করে সে নিকির কাছে নিয়ে যায়। বাইভার্বালের পেছনের বাক্সটি খুলে ক্রিনিটি আবিষ্কার করল নিকি শুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। ক্রিনিটি নীচু গলায় তাকে ডাকল। নিকি ঘুমের মাঝে অস্পষ্ট একটি শব্দ করে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
ক্রিনিটি কিছুক্ষণ খাবারগুলো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তারপর নিচু হয়ে নিকির গলা থেকে মাদুলিটি খুলে নিয়ে বাইভার্বালের মেঝেতে বসে পড়ে। মাদুলির ভেতর থেকে ছোট ক্রিস্টালটা বের করে সে ক্রিস্টাল রিডারে ঢুকিয়ে একটি মাইক্রোফোন টেনে নেয়। রোবটের একঘেয়ে যান্ত্রিক গলার স্বরে সে বলতে থাকে, রোবোনগরীর প্রথম দিনের অভিজ্ঞতাটি ছিল যথেষ্ট উত্তেজনাময়। মানবশিশু নিয়ে রোবটসমাজের অস্বাভাবিক একধরনের আগ্রহ রয়েছে। নিকি যখন রোববানগরীতে হারিয়ে গিয়েছিল তখন সে দুটি চতুর্থ মাত্রার রোবটের কবলে পড়ে। তাদের একটি ছিল অপরাধকর্মে পারদর্শী। নিকির গলায় মাদুলির আকারে যে ট্রাকিওশানটি রয়েছে সেটির কারণে আমি তাকে খুঁজে পাই। তাকে রক্ষা করার জন্যে আমি কোনো ঝুঁকি নিই নি। অপরাধ করতে পারদর্শী রোবটের কপোট্রনটি সে কারণে আমার ধ্বংস করে। দিতে হয়।
আমি আশা করছি নিকির কথা এই রোবট দুটির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে নি। আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি রোবটদের মাঝে নিকির উপস্থিতি মোটেও নিরাপদ নয়। ইস্পানা নগরে যে মানবশিশুটি রয়েছে বলে শুনেছি তার সাথে দেখা করার প্রক্রিয়াটি হবে অনেক বিপজ্জনক।
আজকের দিনটির মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল…
ক্রিনিটি নিখুঁতভাবে পুরো দিনলিপিটি লিপিবদ্ধ করতে থাকে।
০৭. নিকি বাইভার্বালের বাক্সের ভেতর
নিকি বাইভার্বালের বাক্সের ভেতর থেকে গুড়ি মেরে ফের হয়ে এলো। চারপাশে বড় বড় গাছ, তার মাঝে একটি হ্রদ। হ্রদের অন্যপাশে দূরে একটি উঁচু বিল্ডিং। বিল্ডিংয়ের চারপাশে উঁচু পাথরের দেওয়াল। নিকি জিজ্ঞেস করল, আমরা কোথায় এসেছি ক্রিনিটি?
ক্রিনিটি বলল, এটি ইস্পানা নগর।
যেখানে আরেকজন মানুষের বাচ্চা আছে?
হ্যাঁ।
কোথায় আছে মানুষের বাচ্চাটি?
ঐ যে বিল্ডিংটা দেখছ, সেখানে!
সত্যি?
হ্যাঁ। এই বিল্ডিংটি হচ্ছে জাতীয় গবেষণাগার।
নিকি বাইভার্বাল থেকে নেমে দূরে বিল্ডিংটির দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পরে জিজ্ঞেস করল, আমরা বিল্ডিং-এর ভেতর কখন যাব?
ক্রিনিটি তার কপোট্রনে একধরনের চাপ অনুভব করে। সে চাপটি কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে বলল, সেটি এখনো ঠিক করা হয় নি।
কেন ঠিক করা হয় নি।
তার কারণ রোবটরা যদি তোমাকে দেখে তাহলে তোমাকে ধরে ফেলবে। কখনো বের হতে দেবে না। তাই ভেতরে যদি যেতে হয় তাহলে আমাদের যেতে হবে গোপনে।
গোপনে?
হ্যাঁ। এমনভাবে যেতে হবে যেন কেউ জানতে না পারে।
সেটি কেমন করে হবে?
ক্রিনিটি বলল, আমি এখনও জানি না। আমাদের এই জাতীয় গবেষণাগার নিয়ে প্রথমে সব রকম তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।
কেমন করে কবে?
সেটি এখনো জানি না।
যখন তুমি সবরকম তথ্য সংগ্রহ করবে, তখন তুমি কী করবে ক্রিনিটি?
আমি সেটি এখনো জানি না।
নিকি এবারে খুক খুক করে একটু হাসল। ক্রিনিটি জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন হাসছ?
আমি তোমাকে যেটিই জিজ্ঞেস করি তুমি তার উত্তরে বল আমি সেটি এখনো জানি না?
ক্রিনিটি বলল, কোনো কিছু না জানার মাঝে হাস্যকর কিছু নেই। তোমাকে নিয়ে আমি কোনো ঝুঁকি নিতে চাই না।
আমার খুব ভেতরে গিয়ে মানুষের বাচ্চাটিকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু তোমাকে তার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।
আমার অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করছে না।
ক্রিনিটি নিকির দিকে তাকিয়ে বলল, তার পরেও তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ আমি বাইভার্বালটিকে এই বনের মাঝে নামিয়েছি। কেউ যেন আমাদের দেখতে না পারে সেজন্যে। তুমি এই মুহূর্তে বাইরে খোলা জায়গায় বের হয়ো না।
কেন ক্রিনিটি?
খোলা জায়গায় বের হলে তোমাকে দেখে ফেলতে পারে।
ও।
বিল্ডিংটায় চারপাশে দেওয়ালের ওপরে ইলেকট্রিক তার লাগানো আছে। কেউ যেন দেওয়াল টপকাতে না পারে সেজন্যে।
নিকি মাথা নাড়ল, ধলল, ও।
আমি নিশ্চিত সেখানে লেজার লাইট আছে। নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে। কোনোকিছু স্পর্শ করলেই এলার্ম বেজে উঠবে।
নিকি এবারে জোরে জোরে মাথা নাড়ল, রোবনগরীতে একটি বাইভার্বাল শুধুমাত্র ছোঁয়ার সাথে সাথে কী বিকট স্বরে এলার্ম বেজে উঠেছিল সেটি তার এখনো মনে আছে।
ক্রিনিটি বলল, আমি ইতোমধ্যে আমার নেটওয়ার্ক চালু করেছি। রোবটদের কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করছি। ভেতরের ম্যাপটা পেয়ে গেলে বুঝতে পারব। মানবশিশু কোথায় থাকে সেটিও অনুমান করতে হবে।
আমি তাহলে কী করব?
তুমিও বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করো। আমরা রোবটেরা শুধুমাত্র যুক্তিপূর্ণ সমাধান বের করি। মানুষ মাঝে মাঝে অযৌক্তিক এবং অবাস্তব সমাধান বের করে ফেলে।
নিকি গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।।
ক্রিনিটি সারাদিন নানাধরনের যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যস্ত থাকল। নিকি প্রথমে কিছুক্ষণ তার পাশে থেকে সে কী করছে বোঝার চেষ্টা করল কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। তখন সে বনের ভেতর ইতস্তত ঘুরতে শুরু করে। পৃথিবীর সব মানুষ মরে গিয়েছে কিন্তু অন্যসব প্রাণী, পোকামাকড়, পাখি, সরীসৃপ সবকিছু বেঁচে আছে। তাদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে নিকির খুব ভালো লাগে। সে অনেকক্ষণ একটি গুবরে পোকাকে মাটির ভেতর ঢুকে যেতে দেখল। একটি ছোট মাকড়শাকে খুব ধৈর্য ধরে একটি জাল তৈরি করতে। দেখল। একটি প্রজাপতির পেছনে পেছনে সে অনেকক্ষণ হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াল। তারপর সে ধবধবে সাদা পুতুলের মতো একটি খরগোশের বাচ্চাকে দেখে তার সাথে ভাব করার চেষ্টা করল।
খরগোশের বাচ্চাটি সতর্ক দৃষ্টিতে নিকিকে লক্ষ করে, তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারবে কিনা সেটি বুঝতে পারছিল না বলে একটু কাছাকাছি যেতেই ছোট ছোট কয়েকটি লাফ দিয়ে সেটি একটু দূরে সরে যাচ্ছিল। খরগোশটার পিছু পিছু নিকি অনেকদূর চলে এল, হঠাৎ করে আবিষ্কার করল সামনে টলটলে পানি। সে একটি খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সামনে একটি হ্রদ হ্রদের উপর দিয়ে খাড়া দেওয়াল উপরে উঠে গেছে। ক্রিনিটি বলেছিল সে যেন খোলা জায়গায় না যায়, খরগোশের পিছু পিছু সে ঠিক খোলা জায়গায় চলে এসেছে।
নিকি কী করবে বুঝতে পারল না। ক্রিনিটি তাকে খোলা জায়গায় আসতে নিষেধ করেছে সত্যি কিন্তু আবার তাকে ভেতরে ঢোকার বিষয়টি নিয়ে চিন্তাও করতে বলেছে। কাজেই বিল্ডিং ঘিরে তৈরি করা উঁচু দেওয়ালটার এতো কাছাকাছি যখন চলেই এসেছে তখন আরেকটু কাছে গিয়ে দেওয়ালটা ভালো করে দেখে আসা মনে হয় খুব অন্যায় হবে না।
নিকি তখন হ্রদের তীর ঘেষে দেওয়ালটার দিকে ছুটে যেতে থাকে। দেওয়ালটার কাছাকাছি এসে সে থেমে গেল। সতর্কভাবে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখল তাকে কেউ দেখে ফেলেছে কিনা। কেউ তাকে দেখে নি, চারপাশে একধরনের সুনসান নীরবতা।
নিকি দেয়ালটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল, শক্ত পাথরের উঁচু দেয়াল। উপরে ধাতব জাল দিয়ে ঘেরা, ক্রিনিটি বলেছে কেউ যেন সেদিক দিয়ে যেতে না পারে সেজন্যে সেখানে উঁচু ভোল্টেজের বিদ্যুৎ রয়েছে। নিকি দেয়ালটা স্পর্শ করে হ্রদের দিকে এগিয়ে গেল। টলটলে হ্রদের পানিতে দেয়ালটা ড়ুবে। রয়েছে। নিকি সেদিক দিয়ে তাকিয়ে থাকে, মাঝখানে হ্রদের পানি যেখানে। গভীর সেখানে দেয়ালটাও কী অনেক গভীর থেকে শুরু হয়েছে?
নিকি কিছুক্ষণ দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে থাকে, দেয়ালের ওপর দিয়ে কেউ যেতে পারবে না, কিন্তু নীচে দিয়ে কী যাওয়া যাবে না? এমনকি হতে পারে হ্রদের পানির যেখানে দেয়ালটা উঠে এসেছে সেখানে বড় বড় গর্ত রয়েছে? কেউ ইচ্ছে করলে সেদিক দিয়ে ঢুকে যেতে পারবে? নিকি নিজে নিজে বিষয়টা চিন্তা করে, তারপর বড় মানুষের মতো গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল। ক্রিনিটিকে বলতে হবে কোনো একটি যন্ত্র দিয়ে হদের নিচে পরীক্ষা করে দেখতে। ক্রিনিটিকে সে কখনো পানিতে নামাতে পারে নি। রোবটের ধাতব দেহ নাকি পানিতে ভেসে থাকতে পারে না শুধু তাই না সার্কিটে পানি ঢুকে গেলে নাকি অনেক বড় সমস্যা হয় তাই কেউ পানির কাছে আসতে চায় না।
নিকি হ্রদের তীর ধরে একটি দৌড় দিতে গিয়ে থেমে গেল। ইচ্ছে করলে সে নিজেই তো হ্রদের পানিতে ড়ুব দিয়ে নিচে নেমে দেখতে পারেন, ক্রিনিটির যন্ত্রপাতির জন্যে অপেক্ষা করে থাকতে না। নিকি দুই এক মুহূর্ত ভাবল, তারপর হলের পানিতে নেমে এলো।
হ্রদের কনকনে ঠাণ্ডা পানিতে তার শরীরটি কাটা দিয়ে ওঠে, নিকি এক লাফে পানি থেকে উঠে আসতে চাইছিল কিন্তু সে উঠে এলো না। নিকি জানে পানিতে নামলে সবসময় প্রথমে শরীর কাটা দিয়ে ওঠে, একটু পর শরীর সেও ঠাণ্ডায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। নিকি দাঁতে দাঁত চেপে আরো গভীর পানিতে নামতে থাকে। পায়ের নিচে শ্যাওলা ঢাকা পিচ্ছিল নুড়িপাথর। নিকি সাবধানে দেয়ালটা ধরে আরো গভীরে নেমে যায়। নিকি জানে ধীরে ধীরে শীতল পানিতে নামা থেকে এক ঝটকায় নেমে পড়া সহজ। তাই সে আর দেরি না। করে মাথা নিচু করে পানিতে ড়ুবে যায়। তীক্ষ্ণ কনকনে শীতে তার সারা শরীর শিউরে ওঠে। নিকি সেটা সহ্য করে নিঃশ্বাস বন্ধ করে পানির নিচে নেমে যেতে থাকে। দেয়ালটি স্পর্শ করে দেখে, শ্যাওলা ঢাকা পিচ্ছিল দেয়ালটি বৈচিত্র্যহীন। পানির নীচে সবকিছুকেই ঝাঁপসা দেখায়, মনে হয় দেয়ালটি হ্রদের গভীরে নেমে গেছে।
যতক্ষণ বুকের মাঝে বাতাস আটকে রাখতে পারল নিকি দেয়ালটি পরীক্ষা করে দেখল তারপর ভুস করে ভেসে উঠল। কনকনে ঠাণ্ডা পানিতে তার শরীরটা কাটা দিয়ে উঠছে। নিকি পানি থেকে উঠে পড়তে চাইল কিন্তু কী মনে করে আরো একবার সে পানিতে ড়ুব দেয়। দেয়ালটা স্পর্শ করে আরো গভীরে নেমে পড়ে। নিচে অন্ধকার ভালো করে কিছু দেখা যায় না-হাত বুলাতে বুলাতে হঠাৎ সে একটি ফাঁকা জায়গা আবিষ্কার করে নিকির মনে হয় দেয়ালটার মাঝখানে একটি গর্ত। নিকি গর্তটা ভালো করে পরীক্ষা করতে পারল না তার আগেই তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। নিকি ভূঁস করে আবার। উপরে উঠে আসে। বড় করে একটি নিঃশ্বাস নিয়ে আবার সে ড়ুব দিল, দ্রুত নিচে নেমে এসে সে গর্তটি পরীক্ষা করে, ছোট একটি গর্ত দেয়ালের অন্যপাশে চলে গেছে, নিকি ভেতর দিয়ে যেতে পারবে কিনা পরীক্ষা করার জন্যে তার মাথাটা ঢোকালো, চওড়া দেয়ালের অন্যপাশে মাথাটা বের করে সে উপরে তাকায় পানির নীচে সবকিছু আবছা দেখায় তার মাঝে সে ফাঁকা একটা জায়গা দেখতে পেল। ইচ্ছে করলেই সে এখন দেয়ালে ঘেরা জাতীয় গবেষণাগারের এলাকার ভেতরে ভেসে উঠতে পারে।
নিকি ভেসে ওঠার চেষ্টা করল না, সেখানে কী আছে সে জানে না, হঠাৎ করে এদিকে ভেসে উঠলে বিপদে পড়ে যেতে পারে। নিকি আবার পিছন দিকে ফিরে যেতে গিয়ে আবিষ্কার করল সে ছোট গর্তটার মাঝে আটকে গিয়েছে, বের হতে পারছে না। হঠাৎ করে সে আতঙ্ক অনুভব করে, প্রাণপণে সে নিজেকে ছোটানোর চেষ্টা করল, কী করছে বুঝতে না পেরেই সে ছটফট করে সামনের দিকেই বের হয়ে এল। অল্প একটু বাতাসের জন্যে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল, নিকি দুই পা দিয়ে দেয়ালটা ধাক্কা দিয়ে উপরে ভেসে উঠে, তারপর বুক ভরে কয়েকবার নিঃশ্বাস নেয়।
নিকি এবার ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকাল, বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা ধ্বক ধ্বক করে শব্দ করছে। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে সে নিজেকে একটু শান্ত করল। দূরে জাতীয় গবেষণাগারের বিল্ডিংটি দেখা যাচ্ছে। ভেতরে বড় একটি খোলা জায়গা সেখানে ছোট বড় অনেকগুলো গাছ। নিকি চারদিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, কোথাও অস্ত্র হাতে কোনো রোবট পাড়িয়ে নেই। সে বুকের ভেতর আটকে থাকা নিঃশ্বাসটা বের করে দিয়ে দেওয়ালটা ধরে পানিতে ভেসে থাকে। তার এই মুহূর্তে বের হয়ে যাওয়া উচিৎ কিন্তু নিকি বের হল না, বিস্ময় নিয়ে সে এদিক-সেদিক তাকাল, তারপর ভেসে ভেসে তীরে উঠে এল। পানি থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটেই সে খানিকদূর এগিয়ে যায়। একটি গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে সে জাতীয় গবেষণাগারের বিল্ডিংটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। ক্রিনিটির কথা যদি সত্যি হয় তাহলে এখানে ঠিক তার মতো একজন মানব শিশু আছে। সেই মানবশিশুটির সাথে কী তার দেখা হবে? যদি সত্যি দেখা হয় তাহলে দুজন কী নিয়ে কথা বলবে?
ঠিক এরকম সময় তার পেছন থেকে কে যেন খুব স্পষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?
নিকি পাথরের মতো জমে গেল, প্রথমে মনে হলো সে এক ছুটে পানিতে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে কিন্তু সে তা করল না। খুব ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকাল, দেখল তার পেছনে কয়েক হাত দূরে একজন দাঁড়িয়ে আছে। যে দাঁড়িয়ে আছে সে রোবট নয়, সে তার মতো মানুষ। তার থেকে একটু বড়, চুলগুলো লম্বা এবং কুচকুচে কালো। শরীরে হালকা সবুজ রঙের একটি কাপড়।
মানুষটি আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? গলার স্বরটি ভারী সুন্দর। শুনলে আরো শুনতে ইচ্ছে করে।
নিকি কাঁপা গলায় বলল, আমি নিকি।
নিকি?
হ্যাঁ।
তুমি কি রোবট?
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, না। আমি রোবট না।
তুমি তাহলে কী?
আমি মানবশিশু।
নিকি দেখল তার মতো দেখতে মানুষটির মুখে একধরনের হাসি ফুটে ওঠে, হাসি হাসি মুখে বলল, মিথ্যে কথা বল না। পৃথিবীতে কোনো মানুষ নেই। সব মানুষ মরে গেছে।
নিকি বলল, তাহলে তুমি কেমন করে বেঁচে আছ।
সেটি কেউ জানে না। আমি কিভাবে কিভাবে জানি বেঁচে গেছি।
তুমি যেরকম কিভাবে কিভাবে বেঁচে গেছ আমিও সেরকম কিভাবে কীভাবে বেঁচে গেছি।
ছোট মানুষটি জিজ্ঞেস করল, সত্যি?
সত্যি।
পৃথিবীতে শুধু সত্যিকারের মানুষেরা হাসতে পারে। তুমি কী হাসতে পার?
পারি।
হাস দেখি।
নিকি গম্ভীর মুখে বলল, এমনি এমনি কেউ হাসতে পারে না। হাসির কোনো কারণ ঘটলে মানুষ হাসতে পারে।
নিকি থেকে একটু বড় আর ঘাড় পর্যন্ত নেমে আসা কালো চুলের ছোট মানুষটি মাথা নাড়ল, বলল, তুমি এটি ঠিকই বলেছ। রোবটেরা যখন আমাকে নিয়ে গবেষণা করে তখন মাঝে মাঝে আমাকে বলে তুমি একটু হাস। আমি তাদেরকে বলি মানুষ ইচ্ছে করলেই হাসতে পারে না। তারা আমার কথা। বিশ্বাস করে না।
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, রোবটদের কোনো কোনোদিক দিয়ে অনেক বুদ্ধি আবার কোনো কোনোদিক দিয়ে তারা অনেক বোকা।
মানুষটি কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, তুমি সত্যি। সত্যি একজন মানুষ?
হ্যাঁ।
কী আশ্চর্য! তুমি একজন মানুষ আবার আমি একজন মানুষ। কিভাবে কিভাবে আমাদের দেখা হয়ে গেল। তাই না?
নিকি বলল, মোটেও কিভাবে কিভাবে আমাদের দেখা হয় নি। তোমাকে খুঁজে বের করতে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।
মানুষটি অবাক হয়ে বলল, তোমরা আমাকে খুঁজে বের করেছ?
আমি আর ক্রিনিটি।
ক্রিনিটি কে?
ক্রিনিটি আমাকে দেখে শুনে রাখে। একটি রোবট—আমার বন্ধু। সে। আমাকে খুব ভালোবাসে।
ছোট মানুষটি না সূচক ভাবে মাথা নাড়ল, বলল, রোবট কাউকে ভালোবাসতে পারে না। ভালোবাসার জন্যে হরমোন দরকার হয়। রোবটদের। কোনো হরমোন নেই। শুধু মানুষের হরমোন আছে।
তুমি কেমন করে জান?
আমি জানি। আমি পড়েছি। ছেলেদের একরকম হরমোন মেয়েদের অন্যরকম। ছোট মানুষটি এবারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিকিকে লক্ষ করল তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি ছেলে না মেয়ে?
আমি ছেলে। তুমি?
আমি মেয়ে। আমার বয়স এগারো। তোমার বয়স কতো?
নিকি বলল, আমার বয়স সাত।
এগারো বছরের মেয়েটি বলল, তুমি যখন বড় হবে তখন আমি আর তুমি বিয়ে করতে পারি। তখন আমাদের ছেলেমেয়ে হবে।
বিয়ে কেমন করে হয়?
সেটি আমি এখনো জানি না। আমি বিয়ে করার জন্যে একটি ছেলে পাব কখনো ভাবি নি তাই সেটি নিয়ে পড়াশোনা করি নি।
ও।
মেয়েটি কিছুক্ষণ নিকির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কী আমাকে বিয়ে করবে?
যদি পৃথিবীতে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ না থাকে তাহলে তো করতেই হবে।
মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, তাহলে অনেক মজা হবে। তুমি আর আমি এখানে থাকতে পারব।
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, আমি এখানে থাকতে চাই না।
কেন?
আমি এই জায়গাটা চিনি না।
কয়েকদিন থাকলেই তুমি চিনে নেবে।
এখানে রোবটরা আমাকে নিয়ে গবেষণা করবে। আমার সেটি ভালো লাগে না।
মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, সেটি মোটেও খারাপ না। রোবটেরা আমাকে নিয়ে গবেষণা করে, আমি জানি। মাঝে মাঝে আমি ইচ্ছে করে ভুল কথা বলে দিই তখন তাদের কপোট্রন উল্টাপাল্টা হয়ে যায়। খুব মজা হয়। তখন।
নিকি চারদিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু এটির চারদিকে দেয়াল। আমি দেয়াল দিয়ে ঘিরে থাকা জায়গায় থাকতে পারব না। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে।
নিকির কথা শুনে মনে হলো মেয়েটি একটু অবাক হল। বলল, কেন, নিঃশ্বাস কেন বন্ধ হবে? দেয়াল দিয়ে ঘেরা বলে জায়গাটা খুব নিরাপদ। বন্য পশু আসতে পারে না। কপোট্রন বিগড়ে গেছে এরকম রোবটও আসতে পারে না।
নিকি বলল, সেটি আমি জানি না। কিন্তু খোলা জায়গায় থাকলে অনেক মজা। যেখানে খুশি যাওয়া যায়। যা খুশি করা যায়।
যদি কোনো বিপদ হয়?
হলে হবে।
মেয়েটি কেমন যেন বিভ্রান্তির মাঝে পড়ে গেল। বলল, কিন্তু এখানে থাকলে কোনো বিপদ নেই। কোনো কিছু নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তোমাকে খেতে দেবে। তোমাকে বই পড়তে দেবে। আনন্দ করতে দেবে। যদি তোমার অসুখ হয় তাহলে চিকিৎসা করবে।
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, কিন্তু এর মাঝে কোনো আনন্দ নেই।
তাহলে তুমি কী করতে চাও?।
তুমি আমার সাথে চল, আমরা দুজন মিলে থাকব। আমি যেখানে থাকি সেটি খুব সুন্দর জায়গা। খুব ভালো জায়গা। সেখানে কিকি আছে, মিক্কু আছে আরো অনেকে আছে। আমরা তাদের সঙ্গে খেলব। আনন্দ করব।
কিকি কে? মিক্কু কে?
কিকি হচ্ছে পাখি। আর মিক্কু বানর।
তুমি বনের পশুপাখির সাথে খেল? তারা তোমাকে আক্রমণ করে না?
নিকি খুক করে হেসে ফেলল, বলল, কেন, বনের পশু আমাকে আক্রমণ করবে? বনের পশুরা আমার বন্ধু। তারা কখনো আমাকে আক্রমণ করে না।
মেয়েটি খুব অবাক হয়ে নিকির দিকে তাকিয়ে রইল। ইতস্ততঃ করে। বলল, বন্ধু, বনের পশুরা তোমার বন্ধু?
হ্যাঁ।
তাহলে আমাকে যে সবাই বলেছে বাইরের পৃথিবীতে আমার নিরাপদে থাকার কোনো উপায় নেই?
মিথ্যে কথা।
ঠিক এরকম সময় দূর থেকে ঘণ্টা বাজার মতো একটি শব্দ হলো। মেয়েটি তখন বলল, ঐ যে ঘণ্টা বাজছে।
কিসের ঘণ্টা?
আমার ফিরে যাবার ঘণ্টা। এখন আমার ফিরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে হবে। তারপর বিকেলের নাস্তা খেয়ে লেখাপড়া করতে হবে।
নিকি একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, ও।
তুমি কী আমার সাথে যাবে? আমার মনে হয় তোমাকে পেলে রোবটরা খুশি হবে।
নিকি মাথা নাড়ল। বলল, না, আমি যাব না।
তাহলে আমি যাই। আমার যেতে দেরি হলে–মেয়েটি থেমে গেল।
তোমার যেতে দেরি হলে কী হবে?
মেয়েটির মুখটি কেমন যেন ম্লান হয়ে যায়, সেখানে কেমন যেন ভয়ের ছাপ পড়ে। সে মাথা নেড়ে বলল, না। কিছু না।
মেয়েটি বলল, আমি এখন যাই?
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, যাও।
মেয়েটি যখন মাথা নীচু করে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছিল তখন সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিকির মনে হলো এই মেয়েটি আসলে খুব দুঃখি একটি মেয়ে। কেন মেয়েটা দুঃখি সেটি সে বুঝতে পারল না কিন্তু অকারণে তার মনটাও কেমন জানি দুঃখ দুঃখ হয়ে গেল।
নিকি অন্যমনস্কভাবে হ্রদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে—তখন হঠাৎ তার মনে হলো মেয়েটিকে তার নাম জিজ্ঞেস করা হয় নি।
০৮. ক্রিনিটি জিজ্ঞেস করল
ক্রিনিটি জিজ্ঞেস করল, মেয়েটি তোমাকে কী জিজ্ঞেস করেছে?
আমি তাকে বিয়ে করব কী না।
তুমি কী বলেছ?
আমি রাজি হয়েছি।
ক্রিনিটি তার কপোট্রনে একধরনের চাপ অনুভব করে। সে চাপটি কমে। যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর বলল, তুমি মেয়েটির নাম জান না, কিন্তু তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছ?
সারা পৃথিবীতে যদি শুধু আমরা দুজন থাকি তাহলে আমাদের দুজনকে বিয়ে করতে হবে না?
সম্ভবত তোমার কথা সত্যি।
তাহলে তুমি আমার কথা শুনে এতো অবাক হচ্ছ কেন?
আমি মোটেও অবাক হচ্ছি না। আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট, আমার অবাক হবার ক্ষমতা নেই। আমি শুধু নিশ্চিতভাবে তোমাদের ভেতরে কী কথাবার্তা হয়েছে সেটি জানতে চেয়েছি।
আমি সেটি তোমাকে বলেছি।
হ্যাঁ বলেছ।
নিকি গম্ভীরমুখে বলল, তাহলে কি তুমি এখন আমাকে বলবে বিয়ে মানে কী?
পৃথিবীতে যখন মানুষেরা বেঁচে ছিল তখন একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা একসাথে থাকার পরিকল্পনা করত। তাদের দুজনের একসাথে থাকার শুরু করার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়াটার নাম বিয়ে।
নিকি বিষয়টা ঠিক পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারল না, তারপরেও সে এটি বুঝে ফেলার ভান করে বলল, তাহলে আমার মা কী বিয়ে করেছিল?
হ্যাঁ করেছিল। তোমার বাবার সাথে তোমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে তোমার বাবা তোমার মা-কে ছেড়ে চলে যায়। তোমার মা তখন উষ্ণ অঞ্চলের এই ছোট দ্বীপটিতে চলে যায়। গৃহস্থালি কাজে সাহায্যের জন্যে আমাকে নিয়ে আসে।
নিকি ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল না, বলল, আমার বাবা কেন আমার মাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল? এটি অত্যন্ত বিচিত্র ব্যাপার।
ক্রিনিটি বলল, মানুষ অত্যন্ত বিচিত্র একটি প্রাণী, আমি সেটি ব্যাখ্যা। করতে পারব না। আমি কখনও তাদের চরিত্র ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি না।
কিন্তু কেন আমার বাবা আমার মা-কে ছেড়ে চলে গেল?
আমি তোমাকে বলেছি সেটি ব্যাখ্যা করতে পারব না। মানুষের মস্তিষ্ক অত্যন্ত জটিল, সেটি কিভাবে কাজ করে আমাদের মতো তৃতীয় মাত্রার রোবট সেটি অনুমান পর্যন্ত করতে পারি না। দুজন মানুষ যখন পাশাপাশি থাকে তখন। তাদের পরস্পরের পছন্দ অপছন্দ অত্যন্ত সূক্ষ্ম একটি পর্যায়ে চলে যায়। সেটি অত্যন্ত ভঙ্গুর, অত্যন্ত নাজুক অত্যন্ত সংবেদনশীল।
নিকি ক্রিনিটির কথাগুলো বুঝতে পারল না। খানিকক্ষণ কিছু একটি ভেবে বলল, আমি আর ওই মেয়েটা যদি বিয়ে করি তাহলে আমি কী কখনো তাকে ছেড়ে চলে যাব?
সেটি এই মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। আমি তোমাকে বলেছি মানুষ অত্যন্ত জটিল একটি প্রাণী।।
নিকি কিছুক্ষণ ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে বলল, ক্রিনিটি।
বল।
তুমি তো মানুষ নও। তুমি হচ্ছ রোবট।
হ্যাঁ, আমি রোবট।
তার মানে তুমি মানুষের মতো জটিল নও?
না, আমি মানুষের মতো জটিল না।
নিকি এবারে ক্লিনিটিকে জড়িয়ে ধরে বলল, তাহলে তুমি কোনোদিন আমাকে ছেড়ে চলে যেও না।
ক্রিনিটি কপোট্রনে একটি প্রবল চাপ অনুভব করে। এই শিশুটির মা যেরকম অযৌক্তিক কথা বলত এই শিশুটিও সেরকম অযৌক্তিক কথা বলতে শুরু করেছে। ক্রিনিটি কী বলবে বুঝতে পারল না। নিকি ক্রিনিটিকে আরও জোরে চেপে ধরে বলল, বল। বল তুমি আর কোনোদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না।
ক্রিনিটি বলল, আমি তোমাকে কোনোদিন ছেড়ে চলে যাবো না।
অন্ধকার নেমে আসার পর নিকি বাইভার্বালের এক কোণায় গুটিশুটি মেরে বসে একটি ছোট কৌটা থেকে খাবার খেতে খেতে বলল, এই কৌটার খাবারগুলো খেতে একেবারেই ভালো না।
ক্রিনিটি বলল, আমি খাবারের স্বাদ গ্রহণ করতে পারি না। কিন্তু আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি। কৌটার খাবার সম্ভবত তোমাদের ভাষায় বিস্বাদ। কিন্তু তবুও তুমি জোর করে খেয়ে ফেল। তুমি তোমার শরীরের প্রয়োজনীয়
প্রোটিন কার্বোহাইড্রেট আর ভিটামিন এখান থেকে পেয়ে যাবে।
মনে আছে আমরা কী সুন্দর বাইরে আগুন জ্বালিয়ে সেখানে খাবারগুলো ঝলসে ঝলসে গরম করে খেতাম?
ক্রিনিটি বলল, হ্যাঁ। মনে আছে। কিন্তু এখানে আমরা বাইরে আগুন জ্বালাতে চাই না। আমাদেরকে কেউ দেখে ফেললে আমরা বিপদে পড়ে যাব।
আমরা যখন আমাদের জায়গায় ফিরে যাব তখন আমরা আবার আগুন জ্বালিয়ে খেতে পারব। তাই না?
হ্যাঁ।
আমাদের সাথে তখন ঐ মেয়েটিও থাকবে?
হ্যাঁ।
সে যদি আমাদের সাথে যেতে না চায়?
তাকে রাজী করাতে হবে।
সে যদি রাজী না হতে চায়?
তাকে বোঝাতে হবে।
সে যদি বুঝতে না চায়?
তাহলে কী করতে হবে আমি এখনো জানি না।
নিকি একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি যখনই তোমাকে কিছু একটি জিজ্ঞেস করি তখনই তুমি বল যে তুমি কিছু জান না।
আমি দুঃখিত নিকি। আমি তৃতীয় মাত্রার একটি রোবট। আমার কপোট্রনের ক্ষমতা খুবই সীমিত। আমি সব সমস্যার সমাধান করতে পারি না।
নিকি ক্রিনিটিকে স্পর্শ করে বলল, তুমি সেটি নিয়ে মন খারাপ করো
তোমার কপোট্রনের ক্ষমতা কম হলে কী হবে, তুমি আসলে সেটি দিয়েই সবকিছু করতে পার।
আমাকে সবকিছু করার জন্যে তৈরি করা হয় নি, আমাকে তৈরি করা হয়েছে শুধু তোমাকে সাহায্য করার জন্যে। বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করার জন্যে।
তুমি সবসময় আমাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করে এসেছ। মনে নেই যখন রোবনগরীতে দুটি রোবট আমাকে ধরে ফেলেছিল তখন তুমি আমাকে রক্ষা করেছিলে?
হ্যাঁ মনে আছে। কিন্তু কাজটি আমার জন্যে আস্তে আস্তে কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
কেন ক্রিনিটি?
কারণ তুমি নিজে নিজে অনেক সময় অনেকগুলো কাজ কর যেটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যেটি খুবই বিপজ্জনক। তুমি হয়তো না বুঝে করে ফেল, কিংবা হয়তো মানুষ সবসময় এরকম করে। তখন আমার কিছু করার থাকে না।
ক্রিনিটি, আমি কখন সেটি করেছি?
তুমি যখন হদে ড়ুব দিয়ে দেয়ালের গর্ত দিয়ে অন্যপাশে চলে যাবার চেষ্টা করেছিলে, সেটি ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক কাজ। গর্তের মাঝে তুমি আটকে গিয়েছিলে। যদি সেখান থেকে ছুটে আসতে তোমার আর একটুও দেরি হতো তা হলেই তোমাকে কেউ রক্ষা করতে পারতো না।
নিকি কোনো কথা না বলে একটু অপরাধীর মতো মুখ করে ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে রইল। ক্রিনিটি বলল, আমি তোমাকে বলেছি সতর্ক থাকার জন্যে কিন্তু আমার ধারণা তুমি আবার বিচিত্র কিছু করে ফেলবে। কাজেই তোমাকে কিছু ব্যাপার শিখিয়ে দিই।
নিকির চোখ আগ্রহে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সে জিজ্ঞেস করল, কী শিখিয়ে দেবে?
ক্রিনিটি ছোট একটা ব্যাগ টেনে নিয়ে বলল, এই যে ব্যাগটা দেখছ এর মাঝে বেঁচে থাকার কিছু সরঞ্জাম আছে। হাত দিয়ে ভেতর থেকে প্রথমে যেটি বের করল সেটি হচ্ছে একটি চাকু। সেটি দেখিয়ে বলল, এটি হচ্ছে একটি চাকু, এর আটটা ব্লেড। প্রত্যেকটা ব্লেড দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কাজ করা যায় কিন্তু সেটি ব্যবহার করা জানতে হয়। আমি তোমাকে এখন এটা দেখাচ্ছি, কিন্তু আশা করছি ব্যবহার করতে শেখার আগে তুমি এটিতে হাত দেবে না।
নিকি বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ল। ক্রিনিটি আবার ব্যাগের ভেতর হাত দিয়ে ছোট একটি টিউব বের করে বলল, এই ব্যাগের ভেতর এটি হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ংকর একটি জিনিস।
নিকি জানতে চাইল, কি জিনিস?
এটি একটি ইনফ্রারেড লেজার। মানুষ খালি চোখে এর আলো দেখতে পায় না, আমরা পারি। এই লেজারের ঠিক মাথায় ইনফ্রারেড আলোটা ফোকাস হয়। সেটি এতো তীব্র যে এটি দিয়ে দুই ইঞ্চি পুরু ইস্পাতের প্লেট কেটে ফেলা যায়। তবে ছোট নিউক্লিয়ার ব্যাটারি চার্জ চলে গেলেই এটির কাজ শেষ। ক্রিনিটি তার সামনে লেজারটিকে রেখে বলল, আশা করছি তুমি এখনও এটি ব্যবহার করার চেষ্টা করবে না। একটু ভুলভাবে ব্যবহার করলেই ভয়ঙ্কর বিপদ ঘটতে পারে।
ক্রিনিটি আবার ব্যাগের ভেতর হাত ঢোকালো এবারে ছোট এ্যালুমিনিয়ামের একটি ট্রিপ বের করে, তার মাঝে ছোট ছোট অনেকগুলো হলুদ রঙের ট্যাবলেট লাগানো। ক্রিনিটি স্ট্রিপটি দেখিয়ে বলল, এর প্রত্যেকটা ট্যাবলেট এক পেট পরিচ্ছন্ন খাওয়া। তোমার যদি কখনো খেতে হয় পুরোটা খাবে না। অর্ধেকটা খাবে। কারণ পুরোটা একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের খাবার তোমার জন্যে অনেক বেশি। বুঝেছ?
নিকি মাথা নেড়ে জানাল যে সে বুঝেছে। ক্রিনিটি আবার তার ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে ছোট বোতামের মতো একটি যন্ত্র বের করে আনল, নিকিকে দেখিয়ে বলল, এটি হচ্ছে একটি কীপার। কেউ হারিয়ে গেলে এর সুইচটা অন করে দেয় তখন এর ভেতর থেকে নির্দিষ্ট সময় পরপর একটি শক্তিশালী সিগন্যাল বের হয়। তবে এখন আমরা গোপনে কাজ করছি এখন আমাদের এটার প্রয়োজন নেই। ভুলেও এর সুইচটা অন করবে না তাহলে সবাই বুঝে যাবে আমরা কোথায় আছি।
নিকি বলল, ঠিক আছে।
ক্রিনিটি আবার তার ব্যাগে হাত দিয়ে একটি ছোট সিলিন্ডারের মতো টিউব বের করল। বলল, এর ভেতরে রয়েছে প্রায় দুই কিলোমিটার কার্বন ফাইবার। অসম্ভব শক্ত ফাইবার দুই থেকে তিনশো কেজি কিছু একটি ঝোলালেও এটি ছিড়বে না। এক মাথায় রয়েছে ইলেকট্রোম্যাগনেট, স্টিল যা লোহার সাথে আটকে দেওয়া যায়। আমি তোমাকে দেখাচ্ছি কিন্তু তুমি এখনও এটি ব্যবহার করার জন্যে প্রস্তুত হও নি। বুঝেছ?
নিকি বলল, বুঝেছি।
ক্রিনিটি আবার তার ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে ছোট একটি প্যাকেট বের করল, নিকিকে দেখিয়ে বলল, এটি কী তুমি কী বলতে পারবে?
নিকি ব্যাগটা পরীক্ষা করে বলল, এর ভেতরে খুব ছোট ছোট অনেকগুলো বল। মনে হয় একটি বল খেলে পেট ভরে পানি খাওয়া হয়ে যাবে।
কাছাকাছি বলেছ। এর মাঝে আসলে বাতাস ভরা আছে। মুখে দিয়ে দাতে কামড় দিয়ে এটি ভাঙলে ভেতর থেকে নিঃশ্বাস নেবার মতো বাতাস বের হয়ে আসে। আটাত্তর ভাগ নাইট্রোজেন বাইশ ভাগ অক্সিজেন। পানিতে ড়ুবে থাকতে হলে এটি কাজে লাগে। এটিও ব্যবহার করার আগে একটু শিখতে হয়। পানির নীচে নিঃশ্বাস নিতে হলে নাকটা বন্ধ রাখতে হয়।
নিকির হাত থেকে ছোট প্যাকেটটা নিয়ে সামনে সাজিয়ে রেখে ক্রিনিটি আবার তার ব্যাগে হাত ঢোকাল, এবার তার হাতে উঠে এলো লাল রঙের চতুষ্কোণ একটি ছোট যন্ত্র। তার একপাশে একটি ডায়াল। ক্রিনিটি চতুষ্কোণ বাক্সটা হাত দিয়ে ধরে বলল, এটি তোমাকে কখনোই স্পর্শ করতে দেওয়া হবে না। কাজেই এটি আমি আগেই সরিয়ে রাখি।
নিকি বলল, ঠিক আছে। কিন্তু তুমি আমাকে আগে বল এটি কী?
ক্রিনিটি বলল, এটি হচ্ছে ভয়ঙ্কর একটি বিস্ফোরক। সাথে একটি টাইমার লাগানো আছে। কেউ ইচ্ছে করলে টাইমারটি একটি সময়ের জন্যে সেট করে এই বিস্ফোরকটি কোনো জায়গায় রেখে আসতে পারে। নির্দিষ্ট সময় পরে বিস্ফোরকটিতে বিস্ফোরণ ঘটবে। ক্রিনিটি বিস্ফোরকটি সাবধানে সামনে রেখে বলল, এটি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর একটি বিস্ফোরক, তুমি কখনোই এটিতে হাত দেবে না।
ক্রিনিটি কিছু একটি বের করার জন্যে আবার ব্যাগে হাত দিল, তখন নিকি বলল, ক্রিনিটি তুমি জীবন রক্ষা করার এই ব্যাগটা থেকে অনেক কিছু বের করে আমাকে দেখিয়েছ কিন্তু আমাকে বলছ কোনোটাই আমি ব্যবহার করতে পারব না।
হ্যাঁ। বেশিরভাগ।
তাহলে কেন আমাকে দেখাচ্ছ?
তোমার যেন একটি ধারণা থাকে সে জন্যে। মানুষ অসম্ভব বুদ্ধিমান। তারা কখন কোনো তথ্য কিভাবে কাজে লাগাবে সেটি আগে থেকে আমি অনুমান করতে পারি না।
ক্রিনিটি আবার ব্যাগের ভেতর থেকে একটি ছোট কৌটা বের করে কথা। বলতে শুরু করে। নিকি অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, ছোট একটি ব্যাগ যেটি কোমরে বেঁধে রাখা যায় সেখানে নানাধরনের ওষুধ রয়েছে, যোগাযোগ করার যন্ত্র আছে, আগুন জ্বালানোর রাসায়নিক আছে, উজ্জ্বল আলো জ্বালানোর টর্চ লাইট আছে, প্রচণ্ড শীতে শরীর গরম রাখার পাতলা ফিনফিনে কম্বল আছে, আগুনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাবার আগে শরীরে লাগানোর তাপ নিরোধক মলম আছে দূরে দেখার জন্যে শক্তিশালী বাইনোকুলার আছে, অন্ধকারে দেখার জন্যে গগলস আছে, নিজের অবস্থান জানার জন্যে রিসিভার আছে, নেটওয়ার্কে সংযুক্ত হবার জন্যে যোগাযোগ মডিউল আছে—এককথায় বেঁচে থাকার জন্যে যা যা প্রয়োজন তার সবই এখানে আছে।
সবকিছু দেখিয়ে ক্রিনিটি যখন আবার সবকিছু ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে রাখছিল তখন নিকি বলল, ক্রিনিটি।
বল।
আমি কখন এই ব্যাগটি ব্যবহার করতে পারব?
এই ব্যাগের নির্দেশিকাতে লেখা আছে আঠারো বছর বয়সের আগে এটি ব্যবহার করার অনুমতি নেই।
কিন্তু আমার বয়স মাত্র সাত।
কিন্তু তুমি যেহেতু একা একা আছ, তোমাকে অনেক কিছু নিজে নিজে করতে হয়। তুমি অনেক কিছু জান যেটি তোমার বয়সী পৃথিবীর বাচ্চা জানত না। তোমার মানসিক বয়স আসলে সাত থেকে অনেক বেশি।
নিকি বড় বড় চোখ করে বলল, তাহলে আমি কি এই ব্যাগটা ব্যবহার করতে পারব?
ক্রিনিটি বলল, আমি জেনে শুনে তোমাকে এটি ব্যবহার করতে দিতে পারি না। কারণ এর মাঝে এমন সব জিনিসপত্র আছে যেটি ব্যবহার করতে গিয়ে একটি ভুল করে ফেললে তুমি এবং তোমার আশপাশে অনেক কিছু ভস্মীভূত হয়ে যাবে।
কিন্তু তুমি যদি না জান?
তখন আমার কিছু করার নেই।
কাজেই পরের দিন নিকি ক্রিনিটিকে না জানিয়ে জীবনরক্ষাকারী ব্যাগটি নিয়ে হ্রদের তীরে হাজির হলো। হ্রদের পানিতে ড়ুব দিয়ে সে দেয়ালের ফুটো দিয়ে অন্যপাশে হাজির হয়। গতকাল যেখানে মেয়েটির সাথে দেখা হয়েছিল ঠিক সেখানে বসে সে অপেক্ষা করতে থাকে। মেয়েটি নিশ্চয়ই দেখা করতে আসবে।
কিন্তু মেয়েটি দেখা করতে এলো না। প্রথমে নিকির সেটি নিয়ে একধরনের ছেলেমানুষী রাগ হলো, তারপর হলো অভিমান। যখন আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে আসতে থাকে তখন তার ভেতরে একধরনের দুশ্চিন্তা দানা বাঁধে। নিকি তখন তার ব্যাগ থেকে বাইনোকুলারটা বের করে দূরের বিল্ডিংটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে, সে মোটেও ভাবে নি এতো বড় একটি বিল্ডিংএর ভেতর মেয়েটিকে দেখতে পাবে কিন্তু সে চার তলার একটি জানালায় মেয়েটিকে দেখতে পেল। মেয়েটি জানালার শিক ধরে এদিকে তাকিয়ে আছে। নিকি জানে এতা দূর থেকে মেয়েটি দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু তবুও তার মনে হলো মেয়েটি বুঝি সোজাসুজি তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটির মুখে এমন একটি বিষাদের ছায়া যে সেটি দেখে নিকি গভীর একধরনের দুঃখ অনুভব করল। তার চোখে পানি চলে আসে, সে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছে ফিসফিস করে বলল, তুমি মন খারাপ করো না, আমি এসে তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব।
বাইনোকুলারে মানুষটিকে অনেক কাছে দেখায় কিন্তু সত্যিকার মানুষটি কথা শোনার জন্যে কাছে চলে আসে না, তারপরেও নিকির কেন যেন মনে হলো, মেয়েটি তার কথা শুনতে পেয়েছে এবং একধরনের আশা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
নিকি বাইনোকুলারটা নামিয়ে কিভাবে মেয়েটির কাছে যাবে সেটি নিয়ে চিন্তা করার চেষ্টা করল, কিন্তু সে খুব ভালোভাবে কোনো পরিকল্পনা করতে পারল না। তাই সে সবসময় যা করে এবারেও সেটিই করল, কোনো কিছু পরিকল্পনা না করেই সাবধানে বিল্ডিং-এর দিকে এগুতে থাকল। তাকে যদি কেউ দেখে ফেলে তখন কী হবে সেটি নিয়ে সে খুব বেশি দুশ্চিন্তা করল না। খুব বড় ধরনের বিপদ হয়ে গেলে ক্রিনিটি এসে তাকে উদ্ধার করে ফেলবে এই ধরনের একটি ভাবনা সব সময় তার মাথায় খেলা করে।
মেয়েটাকে যেখানে দেখেছিল তার নীচে এসে দাঁড়িয়ে নিকি বিল্ডিংটি পরীক্ষা করে। অন্ধকারে ভালো দেখা যাচ্ছে না তাই সে তা চোখে নাইট গগলসটা পরে নেয়। সাথে সাথে চারদিক প্রায় দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল কিন্তু তারপরেও দৃশ্যটি কেমন যেন অবাস্তব দেখায়। খালি চোখে যে সব জিনিষ অস্পষ্ট এই গগলসে সেগুলো অনেক সময় স্পষ্ট। নিকি কিছুক্ষণ চোখে গগলস পরে এদিক-সেদিক তাকায় এবং ধীরে ধীরে একটু অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
বিল্ডিংটিতে অনেক ধরনের কারুকাজ এবং সে কারণে নানাধরনের ছোট বড় খাঁজ। নিকি ইচ্ছে করলে চোখ বন্ধ করে এই খাজগুলো ধরে ধরে উপরে উঠে যেতে পারবে। মিক্কুর সাথে প্রতিযোগিতা করে সে কতোবার মোটা মোটা গাছের প্রায় মসৃণ কাণ্ড ধরে গাছের উপরে উঠে গেছে। নিকি তাই দেরি করল না, সুদৃশ্য বিল্ডিংটির দেয়াল ধরে প্রায় খামচে খামচে উপরে উঠে গেল। যে জানালাটির শিক ধরে মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল তার কার্নিশে দাঁড়িয়ে সে ভেতরে। উঁকি দেয়। ঘরের মাঝে একটি বিছানা সেই বিছানায় মেয়েটি উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। মেয়েটি ঘুমিয়ে নেই, কারণ মাঝে মাঝেই মেয়েটির শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিকি বুঝতে পারল মেয়েটি আসলে ফুলে ফুলে কাঁদছে।
নিকি কী করবে ঠিক বুঝতে পারল না, খানিকক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে সে জানালার কাছে টোকা দেয়। মেয়েটি শুনতে পেল বলে মনে হলো না তখন নিকি দ্বিতীয়বার টোকা দিলো, আগের থেকে একটু জোরে। এবারে মেয়েটি শুনতে পেয়ে উঠে বসে এদিক-সেদিক তাকাল। নিকি তখন আবার জানালায় টোকা দিলো। এবার মেয়েটি জানালার দিকে তাকাল এবং নিকিকে দেখতে পেল এবং মনে হলো সে বুঝি সাথে সাথে পাথরের মতো জমে গেছে। তার নিচের ঠোঁট দুটি কয়েকবার নড়ে ওঠে কিন্তু গলা থেকে কোনো শব্দ বের হয় না।
নিকি চোখ থেকে তার বিদঘুটে গগলসটা খুলে নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, কেউ তার কথা শুনে ফেলতে পারে তাই সে মুখে কোনো শব্দ করল না। মেয়েটির কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে যে নিকি সত্যি সত্যি জানালার বাইরে কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে, যখন শেষ পর্যন্ত সে বুঝতে পারল তখন সে প্রায় ছুটে জানালার কাছে এসে হাজির হয় জানালার শিকগুলোর ভেতর থেকে হাত বের করে তাকে ধরার চেষ্টা করে। উত্তেজিত গলায় ফিসফিস করে বলল, তুমি? তুমি কিভাবে এখানে এসেছ? তুমি পড়ে যাবে এখান থেকে। সর্বনাশ!
নিকি বলল, আমি পড়ব না।
মেয়েটি বলল, কেমন করে উঠেছ এখানে?
দেয়াল বেয়ে বেয়ে।
দেয়াল বেয়ে বেয়ে কেমন করে উঠেছ? এটি হতে পারে না।
পারে। আমি পারি।
মেয়েটি কিছুক্ষন বিস্ফোরিত চোখে নিকির দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর ফিস্ফিস করে বলল, তুমি কেন এসেছ?
আমি ভেবেছিলাম তুমি হ্রদের পারে যাবে। আমি তোমার জন্যে করছিলাম।
আমি যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমাকে বের হতে দেয় নি। আমাকে ঘরে আটকে রেখেছে।
ঘরে আটকে রেখেছে?
হ্যাঁ।
কেন?
মেয়েটি নিচের দিকে তাকিয়ে একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি তোমার কথা বলিনি সেজন্যে।
নিকি অবাক হয়ে বলল, আমার কথা?
হ্যাঁ।
আমার কী কথা?
প্রত্যেকদিন ওরা আমার সাথে কথা বলে। সারাদিন কী হয়েছে জানতে চয়ি। কালকে আমার সাথে যখন কথা বলেছে তখন আমাকে জিজ্ঞেস করেছে আমি কী করেছি। তোমার সাথে দেখা হয়েছে আমি সেটি বলতে চাইনি-আমি চুপ থেকেছি।
তারপর।
তখন তারা সন্দেহ করেছে। আরো বেশি করে জানতে চেয়েছে। আমি তখন রেগে গিয়ে বলেছি আমি বলব না। তখন তারাও রেগে গিয়েছে।
নিকি অবাক হয়ে বলল, রেগে গিয়েছে? ক্রিনিটি কখনো রেগে যায় না। রোবটরা রাগতে পারেনা।
মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, পারে। আমি যাদের কথা বলছি তারা রেগে যেতে পারে। তারা যখন রেগে যায় তখন তারা আমাকে–আমাকে–মেয়েটি কথা বন্ধ করে হঠাৎ থেমে গেল।
তোমাকে কী?
মেয়েটি মাথা নিচু করে বলল, আমি সেটি বলতে চাই না।
নিকি জিজ্ঞেস করতে চাইল, কেন তুমি বলতে চাও না? কিন্তু কী ভেবে সে শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি আমার সাথে যাবে?
আমি?
হ্যাঁ।
কেমন করে?
তুমি বল যাবে কী না—তাহলে আমি তোমাকে নিয়ে যাব।
মেয়েটি জানালার বাইরে কার্নিশে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট এই শিশুটির দিকে তাকিয়ে রইল, তার সাথে এই ছেলেটির খুব বড় একটি পার্থক্য রয়েছে। সে কেমন যেন দুর্বল, তার মাঝে ভয়, অনিশ্চয়তা, সে একটি ছেলেমানুষের মতো, আর এই ছেলেটার মাঝে কী আশ্চর্য আত্মবিশ্বাস, কোনোকিছুতেই তার ভয় নেই, যেন সে একটা বড় মানুষ। মেয়েটি আস্তে আস্তে বলল, হ্যাঁ, যেতে তো চাই। কিন্তু–
কিন্তু কী?
কেমন করে যাব? যদি যেতে না পারি, যদি ধরে ফেলে—
সেটি নিয়ে তুমি কোনো চিন্তা করো না। চিন্তা করো না।
কেন? সবসময় সবকিছু নিয়ে চিন্তা করতে হয়। ভাবতে হয়। একটি সিদ্ধান্ত নেবার আগে তার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিগুলো বিবেচনা করতে হয়।
না। নিকি মাথা নেড়ে বলল, করতে হয় না। যেটি করার দরকার সেটি করে ফেলতে হয়। যদি খুব বেশি চিন্তা কর তাহলে তুমি কিছুই করতে পারবে না।
আর যদি বিপদ হয়?
নিকি মুখ শক্ত করে বলল, হবে না।
যদি হয়?
যদি হয় তাহলে ক্রিনিটি আমাদের উদ্ধার করবে।
ক্রিনিটি?
হ্যাঁ, ক্রিনিটি। ক্রিনিটি আমাকে খুব ভালোবাসে। সে যেভাবে সম্ভব সেভাবে আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করবে।
মেয়েটি কিছুক্ষণ নিকির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, রোবটরা ভালোবাসতে পারে না।
কিন্তু ক্রিনিটি পারে।
কেমন করে পারে?
আমি ক্রিনিটিকে ভালোবাসি তাই ক্রিনিটিও আমাকে ভালোবাসে।
মেয়েটি একটু অবাক হয়ে নিকির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, আমাকে তুমি কোনদিন নিয়ে যাবে?
নিকি অবাক হয়ে বলল, কোনদিন মানে? তোমাকে এক্ষুণি নিয়ে যাব।
মেয়েটা আরো বেশি অবাক হলো, বলল, এক্ষুণি?
হ্যাঁ।
কেমন করে? আমি কেমন করে বের হব? দরজায় রোবট পাহারা দিচ্ছে, সিঁড়িতে ইলেকট্রনিক সিকিউরিটি। গেটে বড় বড় তালা—
নিকি হাসল, বলল, কে বলেছে তুমি দরজা দিয়ে বের হবে?
তাহলে কোনদিক দিয়ে বের হব?
এই জানালা দিয়ে।
জানালা দিয়ে? এই জানালায় এই মোটা লোহার শিক—
আমি এক্ষুণি কেটে ফেলব। আমার কাছে ইনফ্রারেড লেজার আছে। নিকি কথা বলতে বলতে তার ব্যাগ থেকে ইনফ্রারেড লেজারটা বের করে বলল, এর মাঝে নিউক্লিয়ার ব্যাটারি। যতক্ষণ ব্যাটারির চার্জ থাকে ততক্ষণ পুরু ইস্পাত কেটে ফেলা যায়।
মেয়েটি জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকাল, তারপর শুকনো মুখে বলল, আমি নিচে নামব কেমন করে? আমি তো তোমার মতো দেয়াল বেয়ে উঠতে পারি না।
নিকি বলল, সেটি নিয়ে তুমি চিন্তা কর না। তোমাকে আমার মতো দেয়াল বেয়ে নামতে হবে না। আমার কাছে কার্বন ফাইবার আছে!
সেটি কী?
আমি তোমাকে দেখাব। এখন তুমি সামনে থেকে সরে যাও। আমি আগে কখনো এই ইনফ্রারেড লেজার ব্যবহার করি নি, উল্টাপাল্টা কিছু না হয়ে যায়।
মেয়েটি সামনে থেকে সরে গেল, নিকি তখন জানালার শিকটাকে স্পর্শ। করে লেজারের বোতামে চাপ দিল। সে একটি সূক্ষ্ম কম্পন অনুভব করে আর জানালার শিকটা দেখতে দেখতে কেটে যায়। যেখানে কাটা হয়েছে সেই অংশটা প্রচণ্ড উত্তাপে টকটকে লাল হয়ে রইল কিছুক্ষণ।
নিকি বলল, এখন উপরে কেটে ফেলব তাহলেই তুমি বের হয়ে আসতে পারবে।
নিকি এক হাতে লোহার রডটা ধরে রেখে অন্য হাতে উপরের অংশটা কেটে ফেলে, তারপর ভারি রড়টা কার্নিশে নামিয়ে রেখে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। মেয়েটি একটু বিস্ময় নিয়ে নিকির দিকে তাকিয়েছিল, আস্তে আস্তে বলল, সাত বছরের বাচ্চা হিসেবে তুমি অনেক কিছু করতে পার।
নিকি বলল, ক্রিনিটি বলেছে আমার মানসিক বয়স নাকি অনেক বেশি।
মেয়েটি বলল, আমার বয়স এগারো কিন্তু আমি কিছুই পারি না।
তুমি যখন আমাদের সাথে যাবে তখন তুমিও সবকিছু শিখে যাবে।
মেয়েটি জানালার কাটা অংশটি দিয়ে নিচে তাকাল, বলল, আমি কিছুতেই এদিক দিয়ে নামতে পারব না।
নিকি বলল, তোমাকে পারতে হবে না, তুমি চুপচাপ বসে থাকবে। আমি তোমাকে নামিয়ে দেব।
আমার ভয় করে। মেয়েটি ফ্যাকাশে মুখে বলল, আমার খুব ভয়। করে।
নিকি বলল, তোমার কোনো ভয় নেই।
আছে। আমার খুব ভয় করে, আমি বের হতে পারব না। কিছুতেই পারব।
নিকি একটু অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর নিচু গলায় বলল, তুমি একটি জিনিস জান?
কী?
আমি এখনও তোমার নাম জানি না।
নাম? আমার?
হ্যাঁ।
রোবটেরা আমাকে মানবশিশু ডাকে।
কিন্তু মানবশিশু তো কারো নাম হতে পারে না। তোমার সত্যি নামী কী?
তথ্যকেন্দ্রে দেখেছি আমার নাম ত্রিপি। কিন্তু কেউ কখনো আমাকে এই নামে ডাকে নি।
আমি ডাকব। নিকি ডাকল, ত্রিপি।
ত্রিপি একটু অবাক হয়ে নিকির দিকে তাকিয়ে রইল। নিকি তখন আবার ডাকল, ত্রিপি।
ত্রিপি এবারও কিছু বলল না, নিকির দিকে তাকিয়ে রইল।
নিকি হেসে বলল, ত্রিপি, কেউ ডাকলে উত্তর দিতে হয়। তুমি উত্তর দাও।
ত্রিপি থতমত খেয়ে বলল, ও আচ্ছা। হ্যাঁ।
নিকি বলল, ত্রিপি, তুমি বলছ তোমার ভয় করছে। কিন্তু আমি বলছি তোমার কোনো ভয় নেই।
ত্রিপি নিকির দিকে তাকিয়ে রইল। নিকি তার ব্যাগ থেকে কার্বন ফাইবারের রিলটা বের করে। একটি স্ট্র্যাপ দিয়ে সেটা ত্রিপির শরীরের সাথে বেঁধে নেয়, তারপর কার্বন ফাইবারের হুঁকটা স্ট্র্যাপের সাথে লাগিয়ে ত্রিপিকে বলল, এখন তুমি নাম।
নামব? আমি?
হ্যাঁ। আমি উপর থেকে তোমাকে আস্তে আস্তে নামাব।
সর্বনাশ! আমার ভয় করে।
ভয়ের কিছু নেই। আর যদি ভয় করে তাহলে তুমি চোখ বন্ধ করে থাক। যখন তোমার পায়ের নীচে তুমি মাটি পাবে তখন চোখ খুলবে! ঠিক আছে?
ত্রিপি রাজি হলো। নিকি কার্বন ফাইবারটা একটি রড়ে কয়েকবার পেঁচিয়ে নেয় তারপর আস্তে আস্তে ত্রিপিকে নীচে নামিয়ে আনে। যখন ত্রিপি শক্ত মাটিতে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তখন সে কার্বন ফাইবারের রিলটা গুটিয়ে নেয়। তারপর এদিক-সেদিক তাকিয়ে সাবধানে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। ত্রিপি নিঃশ্বাস বন্ধ করে উপরের দিকে তাকিয়েছিল তার চারপাশে যা ঘটছে সে এখনো সেটি বিশ্বাস করতে পারছে না।
নিকি নীচে নেমে এসে ত্রিপির হাত ধরে বলল, চল যাই।
ত্রিপি বলল, চল।
দুজন ছুটতে ছুটতে হ্রদের তীরে হাজির হয়। ছোটাছুটি করা ত্রিপির অভ্যেস নেই, সে বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে, নিচে নেমে বলল, এখন কী করব?
এই হ্রদে ড়ুব দিতে হবে।হদের নিচে একটি গর্ত আছে সেটি দিয়ে বের হতে হবে।
আমি–আমি পারব না।
পারবে। তোমার কিছুই করতে হবে না—আমি তোমাকে নিয়ে যাব। নিকি তার ব্যাগ থেকে অনেকগুলো ছোট ছোট স্বচ্ছ গোলক বের করে ত্রিপির হাতে দিয়ে বলল, এগুলো তোমার মুখে রাখ। যখনই নিঃশ্বাস নিতে হবে দাঁত দিয়ে একটি ভেঙে নেবে। সাথে সাথে নিঃশ্বাস নেবার বাতাস পেয়ে যাবে।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। শুধু নিঃশ্বাস নেবার সময় হাত দিয়ে নাকটা বন্ধ করে রাখবে।
ঠিক আছে।
হ্রদের পানিটা মনে হবে খুব ঠাণ্ডা কিন্তু দেখবে একটু পরেই অভ্যাস হয়ে যাবে।
ঠিক আছে।
গর্তটি একটু ছোট, কষ্ট করে বের হতে হবে। তুমি ভয় পেয়ো না আমি তোমাকে ঠেলে বের করে দেব।
ঠিক আছে।
হ্রদের নীচে দেয়ালের ছোট গর্তের ভেতর থেকে বের হওয়া নিয়ে নিকির একটু দুশ্চিন্তা ছিল, কিন্তু দেখা গেল দুজনে সহজেই বের হয়ে এলো। দুজন যখন পানির উপরে বের হয়ে এল ঠিক তখন শক্ত হাতে কেউ তাদের ধরে ফেলে, কিন্তু বোঝার আগেই তাদেরকে একটি বাইভার্বালে তুলে ফেলে এবং মৃদু গর্জন করে বাইভার্বালটা উড়ে যেতে শুরু করে।
ত্রিপি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, বলল, ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও আমাকে।
ত্রিপি শুনতে পেল রোবটটি তার ধাতব কণ্ঠস্বরে বলল, তোমার কোনো ভয় নেই মেয়ে, আমি ক্রিনিটি।
০৯. সাবধানে থেকো
ক্রিনিটি বলল, তোমরা দুজন সাবধানে থেকো। আমি বাইভার্বালটিকে দ্রুত উড়িয়ে নিয়ে সরে যাব।
নিকি জিজ্ঞেস করল, কেন?
আমরা তাড়াতাড়ি সরে যেতে চাই। যখন তারা বুঝতে পারবে তুমি এই মেয়েটাকে নিয়ে চলে এসেছ তখন তারা আমাদের খুঁজতে বের হবে।
আমার মনে হয় খুঁজতে বের হবে না।
কেন?
নিকি ইতস্তত করে বলল, মনে আছে তুমি যখন জীবনরক্ষাকারী ব্যাগটি আমাকে দেখাচ্ছিলে তখন–
তখন কী?।
তখন তুমি আমাকে একটি বিস্ফোরক দেখিয়েছিলে? যেটি আমার ছোঁয়াও নিষেধ?
হ্যাঁ। সেই বিস্ফোরকটার কী হয়েছে?
আমি সেটি ছুঁয়েছি। টাইমারটা সেট করে ত্রিপির ঘরে রেখে এসেছি।
ক্রিনিটি বলল, টাইমারটা কতোক্ষণের জন্যে সেট করেছ?
পনেরো মিনিট। আমার মনে হয় যে কোনো মুহূর্তে এটি বিস্ফোরিত হবে।
নিকির কথা শেষ হবার আগেই একটি আলোর ঝলকানি মুহূর্তের জন্যে চারদিক আলোকিত করে দেয়, প্রায় সাথে সাথেই দূর থেকে একটি বিকট বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে। নিকি শিষ দেবার মতো শব্দ করে বলল, দেখেছ? জাতীয় গবেষণাগারের অর্ধেকটা উড়ে গেছে!
ক্রিনিটি বলল, হ্যাঁ। সাত বছরের একটি মানবশিশু এটি ঘটিয়েছে সেটি মনে হয় সাধারণের কাছে কখনো বিশ্বাসযোগ্য হবে না।
ত্রিপি বলল, নিকির বয়স সাত হলেও তার কাজকর্ম বড় মানুষের মতো।
নিকি বিড় বিড় করে বলল, আমি বড় মানুষের মতো হতে চাই না। আমি ছোট মানুষ থাকতে চাই।
ক্রিনিটি সারারাত বাইভার্বালটি চালিয়ে নিয়ে গেল, ভোর রাতে সেটিকে একটি শহরতলীতে থামায়। পুরো শহরতলীটি পরিত্যক্ত, বাড়িঘর বিবর্ণ, গাছপালা ঝোপঝাড়ে ঢেকে আছে। তার মাঝামাঝি খানিকটা ফাঁকা জায়গার মাঝে সে বাইভার্বালটি নামিয়ে আনে। তারা দিনটা বিশ্রাম নিয়ে রাতে আবার রওনা দেবে।
ক্রিনিটি কিছু গাছের আড়ালে ঘাসের ওপর বিছানা তৈরি করে তাদের খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়ার কথা বলল কিন্তু নিকি আর ত্রিপি দুজনেই আবিষ্কার করল তাদের চোখে ঘুম আসছে না। তখন দুজনেই বুনো গাছগাছালিতে ঢেকে যাওয়া এই শহরতলীটি দেখতে বের হলো। একসময় এখানে মানুষ থাকত ছোট বাচ্চারা ছোটাছুটি করত এখন কেউ নেই, নির্জন গা ছমছমে একটি পরিবেশ, দেখে নিকি আর ত্রিপি দুজনেই বুকের ভেতর একধরনের হাহাকার অনুভব করে। হাঁটতে হাঁটতে ত্রিপি একটি ছোট বাসার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। নিকি জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
এই রকম একটি বাসায় আমি থাকতাম।
তোমার মনে আছে?
একটু একটু মনে আছে।
তোমার বাবা-মায়ের কথা মনে আছে?
ত্রিপি কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে চিন্তা করল, তারপর বলল, মাঝে মাঝে আমি একজন মহিলাকে স্বপ্নে দেখি, স্বপ্নে আমাকে আদর করে, মনে হয় সেই মহিলাটিই আমার মা।
তার কথা তোমার মনে নেই?
না। শুধু আবছাভাবে একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ে। আমি মায়ের হাঁটুর ওপর বসে আছি, মা তার চেয়ারে আস্তে আস্তে দুলছে আর গান গাইছে। এটি সত্যি না আমার কল্পনা আমি জানি না।
নিকি কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না, দুইজন পাশাপাশি কিছুদূর হেটে যায়। ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, তোমার মায়ের কথা তো তুমি জাননো?
আমার জানার কথা না। কিন্তু আমি জানি।
কিভাবে জান?
ক্রিনিটির কাছে আমার মায়ের হলোগ্রাফিক ভিডিও আছে, সে মাঝে মাঝে আমাকে সেটি দেখতে দেয়। সেখানে আমার মা-কে আমি দেখেছি। আমার মা সেখানে যখন কথা বলে তখন মনে হয় সত্যি সত্যি আমার মা আমার সাথে কথা বলছে।
ত্রিপি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমি তোমার সাথে কথা বলছি। একটি সত্যিকার মানুষ! তোমার হয় নিকি?
হয়। কেন জান?
কেন?
আমার মা মারা যাবার আগে ক্রিনিটিকে বলে গিয়েছিল যে মানুষেরা বেঁচে আছে সারা পৃথিবী খুঁজে খুঁজে তাদেরকে বের করতে হবে। আমাকে তাদের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
সত্যি?
হ্যাঁ। সে জন্যে আমি সবসময়ই জানতাম আমার অন্য মানুষের সাথে দেখা হবে। তাদের সাথে প্রথম দেখা হলে আমি তাদেরকে কী বলব সেটি অনেকবার মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম।
যখন আমার সাথে দেখা হয়েছিল তখন কী তুমি সেটি বলেছিলে?
নিকি মাথা নাড়ল। বলল, না। তোমার সাথে যখন আমার দেখা হয়েছে তখন আমার সবকিছু উলট-পালট হয়ে গিয়েছিল আমি কী বলব কী করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
ত্রিপি বলল, পৃথিবীতে কী আরো মানুষ আছে?
জানি না। মনে হয় আছে।
তাদের সবাইকে কী আমরা খুঁজে বের করতে পারব।
নিকি গম্ভীর সুরে বলল, মনে হয় পারব।
রোবটরা আমাদের করতে দেবে?
নিকিকে খানিকটা দুশ্চিন্তিত দেখায়। সে মাথা চুলকে বলল, সেটিই হচ্ছে মুশকিল। আমি ভেবেছিলাম রোবটরা আমাদের সাহায্য করে। এখন দেখি ঠিক তার উল্টো—রোবটরা আমাদেরকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে।
ত্রিপি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, যদি আমরা একজন বড় মানুষ পেতাম তাহলে ভালো হতো তাই না?
হ্যাঁ।
তাহলে বড় মানুষটি সবকিছু আরো ভালো করে করতে পারত। আমরা তো কখনো মানুষ দেখি নি, তারা কী করে কিভাবে চিন্তা করে কিভাবে কাজ করে কিছু জানি না।
ঠিকই বলেছ।
একটু পর দেখা গেল বিবর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি জনপদের একপ্রান্তে একটি গাছের গুড়িতে দুটি শিশু বসে আছে। তারা শিশুর মতো বড় হয় নি, তারা খুব আশ্চর্য একটি জগতের মানুষ। তাদের ভবিষ্যতে কী আছে তারা জানে না তাদের ভবিষ্যৎ আছে কী না সেটিও তারা জানে না।
অন্ধকার হয়ে যাবার পর বাইভার্বালে করে তারা আবার রওনা দেয়। ভোররাতে তারা বিশ্রাম নিতে থামে। পরদিন সূর্য ওঠার পর আবার তারা রওনা দেয়। বিস্তীর্ণ জনপদ পার হয়ে বিশাল জলাভূমির উপর দিয়ে উড়ে উড়ে শেষ পর্যন্ত তারা তাদের এলাকায় ফিরে আসে। বাইভার্বালটি যখন তাদের পরিচিত খোলা জায়গাটিতে থামল তখন নিকি বাইভার্বাল থেকে লাফ দিয়ে নেমে ত্রিপির দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এখানে থাকি।
ত্রিপি চারদিক দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক ভাবে মাথা নাড়ে। দীর্ঘ সতি বছর সে যেখানে বড় হয়েছে তার সাথে এই এলাকার কোনো মিল নেই। তার জীবনের বেশির ভাগ কেটেছে বদ্ধ চার দেয়ালের ভেতর। যখন বাইরে গিয়েছে। সেটাও ছিল দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এখানে চারদিক খোলামেলা। ত্রিপি সাবধানে বাইভার্বাল থেকে নেমে আসে। নিকি তার হাত ধরে টেনে নিয়ে পেছনের গাছগুলোকে দেখিয়ে বলল, ঐ যে বনটা দেখছ সেখানে আমার বন্ধুরা থাকে।
তোমার পশুপাখি বন্ধু?
হ্যাঁ।
তারা এখন কোথায়?
বনের ভেতর কোথাও আছে। আমরা গিয়ে খুঁজে বের করব।
ক্রিভনটি বলল, আমরা অনেক দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। তোমাদের খানিকটা বিশ্রাম নেয়া দরকার।
নিকি বলল, আমরা মোটেও ক্লান্ত নই নিকি।
আমি জানি তোমরা ক্লান্ত নও। কিন্তু আমি বহুদিন থেকে তোমাকে বড় করেছি তোমার শরীরের জৈব অংশটুকু সম্পর্কে আমি তোমার চাইতে বেশি জানি।
নিকি বলল, তুমি কী বলতে চাইছ ক্রিনিটি?।
আমি বলছি যে, তোমরা দুজন একটু বিশ্রাম নাও, সম্ভব হলে খানিকক্ষণ। ঘুমিয়ে নাও। ঘুম থেকে উঠে উষ্ণ পানিতে স্নান করে নতুন পরিচ্ছন্ন কাপড় পর। খাবার টেবিলে বসে গরম ধূমায়িত কিছু খাবার খাও তাহলে তোমাদের মনে হবে তোমরা একধরনের নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছ।
নিকি কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, ঠিক আছে ক্রিনিটি।
ক্রিনিটি বলল, তা ছাড়া তুমি এখন একা নও। তোমার সাথে আছে ত্রিপি। তুমি একভাবে বড় হয়েছ, ত্রিপি সম্পূর্ণ অন্যভাবে বড় হয়েছে। তুমি যদি জোর করে তোমার জীবনযাত্রার পদ্ধতি ত্রিপির ওপর চাপিয়ে দাও সেটি তার পছন্দ নাও হতে পারে।
তাহলে আমি কী করব?
যেটিই করতে চাও ধীরে ধীরে করো। নতুন পরিবেশে ত্রিপিকে মানিয়ে নিতে দাও।
নিকি কিছুক্ষণ চিন্তা করল তারপর বলল, ঠিক আছে ক্রিনিটি। আমার। মনে হয় তুমি ঠিকই বলেছ।
ক্রিনিটি বলল, আমি মানুষ না হতে পারি, কিন্তু মানুষ কিভাবে চিন্তা করে আমি সেটি অনেক সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেছি।
শেষ পর্যন্ত নিকি যখন ত্রিপিকে নিয়ে বের হতে গিয়েছে তখন ক্রিনিটি তাদের দুজনকে থামাল। বলল, তোমরা একটু দাঁড়াও।
নিকি জানতে চাইল, কেন ক্রিনিটি?
নিকি, তোমার গলায় একটি মাদুলি আছে, তাই না?
হ্যাঁ।
কেন আছে বল দেখি?
এটি আমার জন্যে সৌভাগ্য বয়ে আনে। আমাকে বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করে।
ক্রিনিটি বলল, ঠিক বলেছ। এখন যেহেতু ত্রিপিও তোমার সাথে থাকবে তার সৌভাগ্যের জন্যে তাকেও একটি মাদুলি দেওয়া দরকার। তাকেও যেন বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করে।
ত্রিপি একটু অবাক হয়ে বলল, প্রাচীনকালে মানুষ এগুলো বিশ্বাস করতো, তাদের শরীরে জাদুমন্ত্র দেওয়া মাদুলি থাকতো! তুমিও কী জাদুমন্ত্র জান ক্রিনিটি?
না। আমি জাদুমন্ত্র জানি না। ক্রিনিটি একটি মাদুলি ত্রিপির গলায় ঝুলিয়ে দিতে দিতে বলল, এই মাদুলিটির মাঝে কোনো জাদুমন্ত্র নেই। কিন্তু কিছু জটিল ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি আছে। পথেঘাটে তোমাদের কোনো বিপদ আপদ হলে আমি খবর পাব। তোমাদের রক্ষা করার জন্যে ব্যবস্থা নিতে পারব।
নিকি বলল, সেটিই হচ্ছে জাদুমন্ত্র।
ক্রিনিটি বলল, তুমি ইচ্ছে করলে বিষয়টিকে সেভাবে দেখতে পার। তারপর সে ত্রিপিকে লক্ষ করে বলল, ত্রিপি, তুমি এই মাদুলিটি গলা থেকে খুলবে না।
ত্রিপি মাদুলিটি ভালো করে দেখে বলল, এটি কী সুন্দর। আমি কখনো এটি গলা থেকে খুলব না।
আর নিকি, তুমি মনে রেখো ত্রিপি এখানে নতুন এসেছে। এখানকার সবকিছু তার অপরিচিত। তাকে তুমি দেখে শুনে রাখবে। তাকে কোনো অপরিচিত পরিবেশে ঠেলে দেবে না।
ঠিক আছে ক্রিনিটি।
তাকে নিয়ে কোনোরকম বিপজ্জনক কাজ করবে না।
করব না।
কোনোরকম ঝুঁকি নেবে না।
নেব না ক্রিনিটি।
তাহলে যাও, আর অন্ধকার হবার আগে ফিরে এস।
নিকি বলল, ফিরে আসব। তুমি কোনো দুশ্চিন্তা করো না।
বনের ভেতর ঢোকার সাথে সাথেই একটি গাছের ডালে হঠাৎ করে প্রচণ্ড হুঁটোপুটি শুরু হয়ে গেল। ত্রিপি ভয় পেয়ে নিকিকে আঁকড়ে ধরে বলল, ওটা কী?
নিকি হেসে বলল, মিক্কু! আমার বন্ধু।
নিকির সাথে ত্রিপিকে দেখে মিক্কু বিশেষ উত্তেজিত হয়ে পড়ল, সে কাছে এসে গাছের ডালে বসে সেটি আঁকাতে লাগল। নিকি বলল, মিক্কু, তোমার কোনো ভয় নেই। এটি হচ্ছে ত্রিপি। ত্রিপি আমার মতো একজন মানুষ। আমার বন্ধু।
মিক্কু ডাল আঁকানো বন্ধ করে এবারে একটু কাছে এসে খুব মনোযোগ দিয়ে ত্রিপিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। নিকি হাত বাড়িয়ে বলল, এসো। আমার কাছে এসো।
মিক্কু এবারে লাফ দিয়ে গাছের ডাল থেকে নিকির ঘাড়ে এসে বসে। ত্রিপি অবাক হয়ে বলল, তুমি বানরে সাথে কথা বলতে পার?
নিকি একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, একটু একটু পারি।
কেমন করে পার?
আমি জানি না। অনেক ছোট থাকতে আমি তো এদের সাথে সাথে বড় হয়েছি, তাই আমি ওদের বুঝতে পারি ওরাও আমাকে বুঝতে পারে।
কী আশ্চর্য!
মোটেও আশ্চর্য না। তুমি পারবে।
ত্রিপি মাথা নাড়ল, বলল, উঁহু। পারব না। পারবে।
চেষ্টা করলেই পারবে।
ত্রিপি নিকির ঘাড়ে বসে থাকা মিকূকে দেখল, তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, আমার কাছে এসো মিকু।
মিকু মাথা ঝাঁকিয়ে কিছু একটি শব্দ করল। নিকি মাথা নেড়ে বলল, না মি, নিকি মোটেও তোমাকে মারবে না! ত্রিপি তোমাকে আদর করবে। যাও, ত্রিপির কাছে যাও।
মিক্কু আরো একবার আপত্তি করল। নিকি তখন মুখ কঠিন করে বলল, যাও বলছি, না হলে আমি তোমার সাথে খেলব না।
মিক্কু এবারে খুব অনিচ্ছার সাথে এবং খুব সতর্কভাবে ত্রিপির কাছে গেল। ত্রিপির ঘাড়ে বসে সে তার চুলগুলো একবার শুকে দেখল। গলায় ঝোলানো মাদুলিটি নাড়াচাড়া করল তারপর একটু কামড় দিয়ে পরীক্ষা করল। তারপর তার কানটা ধরে নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করল, ত্রিপির শুড়শুড়ি লাগছিল, সে হি। হি করে হাসতে শুরু করে।
নিকি বলল, ব্রিপি, তোমার কোনো ভয় নেই। মিক্কু সবাইকে এভাবে পরীক্ষা করে দেখে।
আমি মোটেও ভয় পাচ্ছি না, আমার শুড়শুড়ি লাগছে। সে হাত বাড়িয়ে মিক্কুকে ঘাড় থেকে নামিয়ে কোলে নেয় তারপর আদর করে বুকে চিপে ধরে, মিক্কু আদরটা উপভোগ করে তার মাথাটা ত্রিপির বুকে লাগিয়ে রাখল।
নিকি বলল, এই দেখো! মিক্কুর সাথে তোমার ভাব হয়ে গেছে।
ত্রিপি মিকুর মুখে হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, আমি সবসময় ভাবতাম বনের পশুপাখি অনেক হিংস্র হয়।
নিকি বলল, তুমি যদি হিংস্র হও তাহলে তারাও হিংস্র হবে।
আমি মোটেও হিংস্র হব না।
মিক্কুকে কোলে নিয়ে দুজনে হাঁটতে থাকে। হঠাৎ কাছাকাছি একটি গাছের উপর থেকে হুঁটোপুটির একটা শব্দ শোনা গেল, মিক্কু উত্তেজিতভাবে মুখ তুলে তাকায় তারপর বিচিত্র ভঙ্গিতে চিৎকার করতে করতে ত্রিপির কোল থেকে নেমে ছুটতে ছুটতে গাছের উপর উঠে বনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যায়!
ত্রিপি অবাক হয়ে বলল, কী হল? কী হল ওর?
নিকি হি হি করে হেসে বলল, ওদের একদল আরেকদলের গাছ দখল করবে। সে জন্যে সবাই মিলে মারামারি করতে যাচ্ছে।
মারামারি? এই ছোট বানরের বাচ্চা মারামারি করবে?
ওটা ওদের একধরনের খেলা।
কী বিচিত্র খেলা!
হ্যাঁ। নিকি গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। খুবই বিচিত্র। কিন্তু খুবই সোজা।
নিকি ত্রিপিকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হ্রদের তীরে বালুবেলায় হাজির হয়। সামনে নীল হ্রদের পানিতে সূর্যের আলো পড়ে চিক চিক করছে। খোল আকাশ সেখানে সাদা মেঘ। ত্রিপি সেদিকে তাকিয়ে বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে বলল, কী সুন্দর!
নিকি কিছু বলল না। ত্রিপি বলল, নিকি! তোমার কাছে এটা সুন্দর লাগছে না?
নিকি মাথা নাড়ল, লাগছে আসলে আমি তো সবসময় এটা দেখি তাই। এখন আলাদা করে চোখে পড়ে না।
আমি তো বেশিরভাগ সময় থাকতাম একটা ঘরের ভেতর। আমার চারপাশে ছিল ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর রোবট আর যন্ত্রপাতি। শুধু বিকেলবেলা আমি কিছুক্ষণের জন্যে বের হতাম। সারাদিন অপেক্ষা করতাম কখন বিকেল হবে!
নিকি বলল, এখন তোমার আর অপেক্ষা করতে হবে না। তোমার ইচ্ছে করলে দিন-রাত বাইরে থাকতে পারবে। তোমার ঘরের ভেতরেই ঢুকতে হবে না।
হ্যাঁ। কী মজা!
ঠিক তখন গাছের উপর দিয়ে একটা কালো পাখি ক ক করে ডাকতে ডাকতে উড়ে এল। নিকি উপরে তাকায়, তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে, হাত নেড়ে বলে, কিকি!
পাখিটা তার মাথার উপর দিয়ে উড়তে থাকে, নীচে নেমে আসে না। নিকি ডাকল, এসো কিকি। এসো।
কিকি উড়তে উড়তে ডাকল, কঁ কঁ।
নিকি বলল, তোমার কোনো ভয় নেই। এ হচ্ছে ত্রিপি। ত্রিপি আমার বন্ধু।
কিকি আবার ডাকল, কঁ। কঁ।
নিকি বলল, এসো কিকি। এসো।
কালো পাখিটা তখন উড়ে এসে নিকির হাতে বসল। গায়ের রং কুচকুচে কালো, লাল চোখ। ঠোঁটগুলো শক্ত এবং ধারালো। ত্রিপি একধরনের বিস্ময়। নিয়ে পাখিটার দিকে তাকিয়ে থাকে, ফিসফিস করে বলে, আমি কখনো এতো কাছ থেকে কোনো পাখি দেখি নি!
সত্যি?
হ্যাঁ। দেখে মনে হচ্ছে এটা খুব শক্তিশালী পাখি। ঠোঁট দিয়ে ঠোকর দিয়ে লোহার পাতকে ফুটো করে ফেলতে পারবে?
হ্যাঁ। কিকি খুবই শক্তিশালি পাখি।
আমি কি কিকিকে ছুঁয়ে দেখতে পারি?
দেখো।
ত্রিপি হাত বাড়াতেই কিকি ডানা ঝাঁপটিয়ে উড়ে যেতে চেষ্টা করল, নিকি তখন তার গায়ে হাত দিয়ে বলল, তোমার কোনো ভয় নেই কিকি। ক্রিপি তোমাকে একটু আদর করবে।
নিকির কথায় আশ্বস্ত হয়ে কিকি একটু শান্ত হলো, ত্রিপি যখন তার গায়ে হাত দিল তখন সে সতর্কভাবে একটু ডানা ঝাপ্টালো কিন্তু উড়ে গেল না। ত্রিপি বলল, ইশ কী মসৃণ এর শরীরটা?
হ্যাঁ। আকাশে উড়তে হয় তো সেজন্যে পাখিদের পালক খুব মসৃণ থাকে।
কিকি বলল, কঁ কঁ।
ত্রিপি নিকিকে জিজ্ঞেস করল, তুমি সবসময় পাখিদের সাথে কথা বলতে পার?
না। সব পাখিদের সাথে পারি না। কিকির সাথে একটু একটু পারি।
ইস! কী মজা!
তুমি আরেকটা মজার জিনিস দেখতে চাও?
দেখাও।
নিকি তখন কিকির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল। কিকি তার লাল চোখটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একবার নিকিকে দেখে বলল, ক কঁ। তারপর ডানা ঝাঁপটিয়ে উড়ে গেল।
ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বলেছ কিকিকে?
নিকি উত্তর না দিয়ে একটু হেসে বলল, এক্ষুণি দেখবে।
কিছুক্ষণের মাঝে বনের গাছ থেকে কালো পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে আসতে থাকে। দেখতে দেখতে হাজার হাজার পাখি ক ক করে ডাকতে। ডাকতে তাদের মাথার উপর দিয়ে উড়তে থাকে। ত্রিপি অবাক হয়ে পাখিগুলোকে দেখতে থাকে, নিকিকে জিজ্ঞেস করে, কী হচ্ছে নিকি? কী হচ্ছে?
সব পাখি এসেছে তোমাকে তাদের দেশে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য!
আমাকে?
হ্যাঁ, তোমাকে।
ত্রিপি তখন ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে উঠল, দুই হাত তুলে নাড়তে নাড়তে বলল, তোমাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ; অনেক অনেক ধন্যবাদ।
পাখিগুলো কী বুঝল কে জানে, তাদের দুজনকে ঘিরে উড়তে থাকে। উড়তে উড়তে নিচে নেমে আসে তারপর আবার উপরে উঠে যায়। নিকি আর ত্রিপি দুই হাত তুলে পাখিদের সাথে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে। অর্থহীন নাচ-কিন্তু তার মাঝে আনন্দের এতটুকু ঘাটতি নেই।
১০. ভোরবেলা নিকি আর ত্রিপি
ভোরবেলা নিকি আর ত্রিপি খুব ব্যস্তভাবে বের হয়ে যাচ্ছিল, অনেকগুলো টারমিনালের সামনে ক্রিনিটিকে বসে থাকতে দেখে তারা থেমে গেল। নিকি জিজ্ঞেস করল, ক্রিনিটি তুমি কী করছ?
নেটওয়ার্কে যে সব তথ্য ব্রডকাস্ট করা হচ্ছে সেগুলো দেখছি।
ত্রিপি বলল, এই কাজটার মাঝে কোনো আনন্দ নেই, তাই না?
ক্রিনিটি মনিটরের উপর থেকে চোখ না তুলে বলল, আমার মাঝে আনন্দ অনুভব করার কোনো ক্ষমতা নেই, তাই আমি জানি না।
আমাদের সাথে চল, আজকে আমরা অনেক মজা করব।
ক্রিনিটি এবারে চোখ তুলে তাকাল, তারপর বলল, তোমরা কী মজা করবে?
আমরা একটা ভেলা তৈরি করব, তারপর হ্রদের মাঝে সেই ভেলা ভাসাব।
আমার যদি দুশ্চিন্তা করার ক্ষমতা থাকতো তাহলে এখন নিশ্চয়ই তোমাদের ভেলা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতাম।
ত্রিপি হি হি করে হাসল, বলল, এটা খুব ভালো যে তুমি দুশ্চিন্তা করতে পার না।
নিকি বলল, তুমি চল আমাদের সাথে। আমরা কী করি দেখবে।
তোমরা কী করে সেটা দেখার জন্যে আমায় তোমাদের সাথে যেতে হয়। না। তোমাদের গলায় যে মাদুলি ঝুলিয়ে রেখেছি সেগুলো পঞ্চম প্রজন্মের ট্রাকিওশান। সেগুলো দিয়ে আমি যেখানে ইচ্ছে সেখানে বসে তোমাদের ওপর নজর রাখতে পারি।
ত্রিপি বলল, কিন্তু আমরা তো তোমার ওপর নজর রাখতে পারি না। তুমি আমাদের সাথে চল, তাহলে আমরাও তোমার ওপর নজর রাখতে পারব।
ক্রিনিটি বলল, আমি এখন যেতে চাই না। নেটওয়ার্কে আমি একটা তথ্যকে ব্রডকাস্ট হতে দেখছি। তথ্যটা সত্যি হলে গুরুত্বপূর্ণ। আমি তথ্যটাকে বিশ্লেষণ করতে চাই।
এটি কী তথ্য?
আমি তথ্যটা সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হতে পারছি না তাই এই মুহূর্তে তোমাদের কিছু বলছি না। যখন নিশ্চিত হব তখন তোমাদের বলব।
ঠিক আছে। বলে নিকি আর ত্রিপি বের হয়ে গেল। তারা আজ খুব ব্যস্ত।
রাত্রিবেলা খেতে বসে নিকি বলল, ক্রিনিটি আজকে আমার যে খিদে পেয়েছে যে, মনে হচ্ছে আস্ত একটা ঘোড়া খেয়ে ফেলব।
ক্রিনিটি বলল, তুমি কখনো ঘোড়া দেখ নি। তাই একটা আস্ত ঘোড়া খেয়ে ফেলার অর্থ কী তোমার জানার কথা নয়।
নিকি বলল, আমি প্রাচীন সাহিত্যে দেখেছি, সেখানকার চরিত্রগুলো বেশি খিদে লাগলে বলে আমি আস্ত ঘোড়া খেয়ে ফেল।
ক্রিনিটি বলল, এটি একটি অযৌক্তিক কথা। একজন মানুষ কখনোই একটা আস্ত ঘোড়া খেতে পারবে না।
না পারলে নাই। কিন্তু আমি বলব। বলতে খুব মজা হয়।
ত্রিপি খেতে খেতে ছোট একটা বিষম খেল, এক ঢোক পানি খেয়ে ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে রলল, তুমি সকালে বলেছিলে যে তুমি একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেখেছ। সেটা কী আমাদের বলবে?
হ্যাঁ বলব।
বল।
আমার মনে হয় তোমরা খাওয়া শেষ করে আমার কাছে আস। আমি মনিটরে সরাসরি দেখাই, তোমরা তাহলে বিষয়টা ভালো বুঝতে পারবে।
দুজনেই তাড়াতাড়ি খেয়ে ক্রিনিটির সাথে মনিটরের সামনে গিয়ে বসে। ক্রিনিটি কয়েকটা সুইচ স্পর্শ করতেই হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে একটা ত্রিমাত্রিক ছবি ভেসে ওঠে। সাথে নীচু স্বরে একটি কোমল সুর। ক্রিনিটি বলল, এই নির্দিষ্ট চ্যানেলে কিছুক্ষণ পরপর একটা বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছে?
কে প্রচার করছে?
একজন মানুষ।
মানুষ? নির্কি ও ত্রিপি দুজনে একসাথে চমকে চিৎকার করে ওঠে।
হ্যাঁ, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে একজন মানুষ।
কী বলছে মানুষটি?
তোমরা এক্ষুণি নিজেরাই সেটা শুনতে পাবে।
নিকি দুই হাত উপরে তুলে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, তুমি এতো বড় একটা খবর আমাকে এতো পরে দিচ্ছ?
পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে আমি খবরটি তোমাদের দিতে চাচ্ছিলাম না। যদি এটি কোনো একটি রোবটের ষড়যন্ত্র হয়?
রোবটের ষড়যন্ত্র? নিকি অবাক হয়ে বলল, রোবটের ষড়যন্ত্র?
হ্যাঁ। সে জন্যে আমাকে নিশ্চিত হতে হয়েছে যে এটি কোনো রোবট নয়।
তুমি কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছ? কী বলেছে মানুষটা?
ক্রিনিটি উত্তর দেবার আগেই ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, মানুষটা কতো বড়? কী বলেছে মানুষটা?
ছেলে না মেয়ে? কোথায় থাকে?
নিকি এবং ত্রিপির আরো প্রশ্ন ছিল কিন্তু ঠিক তখন হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটা এক মুহূর্তের জন্যে অন্ধকার হয়ে আবার আলোকিত হয়ে ওঠে এবং কিছু বোঝার আগেই তারা দেখতে পেল ঠিক তাদের সামনে একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটি হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের একটা ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবি কিন্তু সেটি এতো জীবন্ত যে নিকি এবং ত্রিপির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
মানুষটির সোনালি চুল এবং নীল চোখ। নিকি আর ত্রিপি আগে সত্যিকারের মানুষ দেখে নি, তারপরও তারা বুঝতে পারল মানুষটি খুব সুদর্শন। মানুষটি চারদিক একবার মাথা ঘুরিয়ে দেখল, তারপর ভরাট গলায় বলল, আমার নাম। ফ্লিকাস। আমি একজন মানুষ আমার বয়স চৌত্রিশ। ভয়ঙ্কর ভাইরাস আক্রমণে। পৃথিবীর সব মানুষ মারা গিয়েছে কিন্তু প্রকৃতির কোনো এক বিচিত্র খেয়ালে আমি মারা যাই নি। আমি বেঁচে গিয়েছি, যেহেতু আমি বেঁচে গিয়েছি আমি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত আমার মতো আরও কিছু মানুষ বেঁচে গিয়েছে। তাদের সংখ্যা হয়তো খুবই কম, কিন্তু তারা নিশ্চয়ই আছে।
মানুষটি একটি নিঃশ্বাস নেয় এবং হঠাৎ করে তার মুখে বিষাদের ছায়া পড়ে। সে নীচু গলায় বলে, আমি ভেবেছিলাম যারা বেঁচে আছে তারা নিশ্চয়ই আমাদের খুঁজে বের করবে, আমি সেজন্যে অপেক্ষা করছিলাম কিন্তু কেউ আমাদের খুঁজে বের করতে এলো না। তখন আমার মনে হলো তাহলে সত্যিই কী সারা পৃথিবীতে শুধু আমি একা বেঁচে আছি? আর কেউ বেঁচে নেই? কেউ বেঁচে নেই?
তখন আমি ঠিক করেছি যে আমি নিজেই সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে খুঁজব। খুঁজে দেখব আর কোথাও বেঁচে থাকা মানুষকে খুঁজে পাই কি-না। আমি প্রযুক্তির মানুষ নই। নিবিড় একটি গ্রামের একটি কফি হাউজে আমি গান গাইতাম, প্রযুক্তির কিছু আমি জানি না। তারপরেও আমি একটু একটু করে শিখেছি, পৃথিবীর পরিত্যক্ত নেটওয়ার্কে প্রবেশ করেছি এবং সারা পৃথিবীতে এই তথ্যটি ব্রডকাস্ট করছি।
যদি কোনো মানুষ এই মুহূর্তে আমার কথাগুলো শুনছে আমি তাকে শুভেচ্ছা জানাই, ভালোবাসা জানাই। ফ্লিকাস হাসি মুখে বলল, আমি তাকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই যে পৃথিবীতে আমরা পুরোপুরি একা নই, নিঃসঙ্গ নই। তোমরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাক আমার সাথে যোগাযোগ করো। আমরা সবাই মিলে আবার নতুন পৃথিবীর জন্ম দেব। মানুষের কলকাকলীতে এই পৃথিবী আবার মুখরিত হয়ে উঠবে।
হলোগ্রাফিক স্ক্রিন থেকে মানুষের ছবিটি হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যায়। নিকি আর ত্রিপি লাফিয়ে উঠে আনন্দে চিৎকার করে ক্রিনিটিকে জড়িয়ে ধরে লাফাতে থাকে। ক্রিনিটি তাদের প্রাথমিক উচ্ছসিটি একটু কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর বলল, আশা করছি ফ্লিকাস সত্যিকারের মানুষ, এটি কোনো কাল্পনিক প্রতিচ্ছবি নয়।
নিকি বলল, কী বলছ ক্রিনিটিঃ ফ্লিকাস কেন কাল্পনিক প্রতিচ্ছবি হবে? তুমি দেখছ না সে আমাদের মতো মানুষ? কী সুন্দর করে হাসতে পারে তুমি দেখ নি?
ক্রিনিটি বলল, আমি সত্যিকার বা কৃত্রিম কোনো হাসিই বুঝতে পারি না, তাই আমি ফ্লিকাসের বক্তব্যটি টুরিন টেস্ট করেছি।
সেটি কী?
কোনো বক্তব্য সত্যিকারের মানুষের না কৃত্রিম রোবটের সেটি বোঝার একটি পরীক্ষা।
তুমি পরীক্ষা করে কী দেখেছ?
আমি দেখেছি যে ফ্লিকাস সত্যিকারের মানুষ। কিংবা—
কিংবা কী?
মানুষ থেকেও বুদ্ধিমান কোনো প্রাণী।
ত্রিপি হেসে বলল, মানুষ থেকে বুদ্ধিমান হতে পারে শুধু একটি মাত্র প্রাণী।
সেটি কী?
সেটি হচ্ছে আরেকজন মানুষ! বলে ত্রিপি হি হি করে হাসতে থাকে।
নিকি বুক থেকে আটকে থাকা একটা বড় নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, ক্রিনিটি, আমরা কখন ফ্লিকাসের কাছে যাব?
তার সাথে আগে যোগাযোগ করে নিই। তারপর রওনা দেব।
সে কতদূর থাকে ক্রিনিটি?
বেশ অনেক দূর। আমাদের ভালো একটা বাইভার্বাল দরকার তা না হলে যেতে অনেকদিন লাগবে।
তুমি তাহলে আরেকটা বাইভার্বাল ঠিক কর ক্রিনিটি।
করব।
ঠিক করলেই আমরা যাব।
ঠিক আছে।
নিকি ত্রিপির দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা যখন যাব তখন আমাদের মতো পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে হয়তো আরো অনেক বাচ্চা চলে আসবে।
হ্যাঁ। নিশ্চয়ই আসবে। রোবটেরা যদি আটকে না রাখে তাহলে নিশ্চয়ই চলে আসবে।
নিকি ভুরু কুঁচকে বলল, তোমার কী মনে হয় ত্রিপি, রোবটেরা কী সত্যিই আরো বাচ্চাদের আটকে রেখেছে?
রাখতেও তো পারে। আমাকে যেরকম রেখেছিল।
তাহলে তো অনেক ঝামেলা হবে। তাই না ত্রিপি?
হলে হবে। ফ্লিকাস সব ঝামেলা দূর করে দেবে।
নিকি মাথা দুলিয়ে হাসল, বলল, ঠিকই বলেছ। ফ্লিকাস সব ঝামেলা দূর করে দেবে।
ত্রিপি বলল, ফ্লিকাস দেখতে কী সুন্দর, তাই না?
হ্যাঁ।
আরো যে সব বাচ্চারাও আসবে, তারাও নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর হবে, তাই না নিকি?
নিকি মাথা নাড়ল, তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, অন্য বাচ্চারা আরো সুন্দর হোক আর যাই হোক তুমি কিন্তু অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। আমি আর তুমিই কিন্তু বিয়ে করব। ঠিক আছে?
ত্রিপি গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে।
ক্রিনিটি বাইভার্বালটি ঠিক করল, ফ্লিকাসের সাথে যোগাযোগ করল তারপর তার সাথে দেখা করার জন্যে রওনা দিল। নিকি আর ত্রিপি বাইভার্বালের রেলিং ধরে আনন্দে চিৎকার করে গান গাইতে লাগল। দুজন আগে কখনো গান গায় নি, গান গাওয়া বলে যে একটা ব্যাপার থাকতে পারে সেটাও তারা জানত না, কিন্তু তারপরও তাদের গান গাইতে কোনো সমস্যা। হল না।
সারাদিন সারারাত তারা বাইভার্বাল চালিয়ে গেল। ফ্লিকাস ক্রিনিটিকে যে। ঠিকানা দিয়েছে সেখানে তারা যখন পৌঁছাল তখন দুপুর হয়ে গেছে। গাছগাছালি ঢাকা ছোট একটা বাসা। বাসার বাইরে দুইজন রোবট পাহারা দিচ্ছে, তারা হাত তুলে বাইভার্বালটিকে থামাল। একজন রোবট জিজ্ঞেস করল, কী চাই?
ক্রিনিটি বলল, আমরা মহামান্য ফ্লিকাসের সাথে দেখা করতে এসেছি।
তোমরা কারা?
আমি একজন তৃতীয় মাত্রার রোবট। আমাকে ক্রিনিটি নামে পরিচয় দেওয়া হয়। আমার সাথে দুজন মানবশিশু আছে।
একটি রোবট অন্য রোবটের দিকে তাকিয়ে বলল, পৃথিবীতে মানবশিশু বলে কিছু নেই। সব মরে গেছে।
নিকি কঠিন মুখে বলল, সবাই মরে নি। আমরা বেঁচে আছি।
তোমরা সূত্যিকারের মানবশিশু?
হ্যাঁ। ফ্লিকাস আমাদের সবাইকে ডেকে পাঠিয়েছে আমরা তার সাথে দেখা করতে এসেছি।
রোবটটি একধরনের ঘোলা চোখে তাদের দুজনকে দেখল তারপর বলল, ঠিক আছে, তোমরা গেটে অপেক্ষা কর। আমরা খোঁজ নিই।
নিকি ভাবছিল একটা রোবট ভেতর গিয়ে খোঁজ নেবে কিন্তু তার দরকার হলো না। গেটে দাঁড়িয়ে থেকেই কোনো একভাবে খোঁজ নিয়ে নিল তারপর ওদের বলল, তোমরা ভেতরে যাও, মহামান্য ফ্লিকাস তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।
ক্রিনিটি মাটির কাছাকাছি রেখে বাইভার্বালটি বাসার সামনে হাজির করল এবং প্রায় সাথে সাথেই দরজা খুলে ফ্লিকাস বের হয়ে এলো। হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে তাকে যেটুকু সুদর্শন দেখা গিয়েছিল সে তার থেকে অনেক বেশি সুদর্শন। দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে নিকি আর ত্রিপির দিকে ছুটে যায়, দুজনকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে বলল, মানুষের পৃথিবীতে তোমাদের আমন্ত্রণ। নিকি আর ত্রিপি তোমাদের জন্যে আমার ভালোবাসা আর ভালোবাসা।
এভাবে কেউ আমন্ত্রণ জানালে কী বলতে হয় নিকি আর ত্রিপি কেউই জানে না। জানে না। তাই দুজনেই হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। ফ্লিকাস বলল, তোমরা অনেক দূর থেকে এসেছ। এখন দ্রুতগামী ট্রেন নেই, জেষ্ট নেই মহাকাশযানও নেই, তোমরা এসেছ সেই আদিম বাইভার্বালে করে। তোমাদের নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হয়েছে?
এবারে নিকি বলল, না আমাদের কোনো কষ্ট হয় নি।
ত্রিপি বলল, আমরা গান গাইতে গাইতে এসেছি।
কী মজা! পৃথিবীর সব মানুষকে যখন আমরা একত্র করব তখন প্রথম কাজটি হবে একটা গানের কনসার্ট। কী বল?
ত্রিপি হাত তালি দিয়ে বলল, কী মজা হবে তখন!
ফ্লিকাস বলল, তোমরা হাত মুখ ধুয়ে কিছু একটা খেয়ে নাও। তোমাদের জন্য আমি কিছু জৈবিক খাবার তৈরি করে রেখেছি।
নিকি জিজ্ঞেস করল, অন্য মানবশিশুরা কী এসে পৌঁছেছে?
না, তারা এখনো পৌঁছায় নি। কেউ কেউ রওনা দিয়েছে, কেউ কেউ রওনা দেবে।
ত্রিপি জানতে চাইল, সব মিলিয়ে কতোজন মানবশিশু আছে পৃথিবীতে?
কমপক্ষে দুইশ। আরো বেশিও হতে পারে।
আমরা সবাই মিলে এক জায়গায় থাকব?
ফ্লিকাস হাসল, বলল, অবশ্যই। সারা পৃথিবী খুঁজে আমরা সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটা খুঁজে বের করব। একপাশে পাহাড় অন্যপাশে হ্রদ, মাঝখানে থাকবে সবুজ বন। আমরা বাচ্চাদের জন্যে চমৎকার একটা স্কুল বানাব–সেখানে বাচ্চারা হইচই করে পড়বে। ছোটাছুটি করবে, খেলবে, হ্রদে সাঁতার কাটবে। যখন অন্ধকার হয়ে আসবে আমরা তখন কোথাও একটা আগুন জ্বালাব, সেটাকে ঘিরে আমরা বসব। একজন গিটার বাজাতে বাজাতে গান গাইবে— কথা বলতে বলতে ফ্লিকাসের চোখে যেন স্বপ্নের ছোঁয়া লাগে। দেখে মনে হয় সে যেন তার চোখের সামনে পুরো দৃশ্যটি দেখতে পাচ্ছে।
নিকি দাঁত বের করে হাসল। বলল, কী মজা হবে? তাই না?
হ্যাঁ অনেক মজা হবে। হঠাৎ ফ্লিকাসের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। সে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমরা যে শুধু মজা করব তা কিন্তু নয়। আমাদের ওপর তখন থাকবে অনেক বড় দায়িত্ব। অনেক অনেক বড় দায়িত্ব।
ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, কী দায়িত্ব?
মানুষের দায়িত্ব। পৃথিবীর দায়িত্ব। আমাদের সারা পৃথিবীর দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা যে কয়জন মানুষ আছি তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাদের। দিয়েই আস্তে আস্তে সারা পৃথিবীতে একসময় মানুষে ভরে উঠবে। ভবিষ্যতের যে পৃথিবী হবে আমরাই হব তার স্থপতি। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে যে মানুষ থাকবে আমরা হব তার পূর্বপুরুষ!
ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, আর রোবট? রোবটদের কী হবে?
রোবটেরাও থাকবে। মানুষকে সাহায্য করার জন্যে রোবটেরা আগেও ছিল, এখনো থাকবে।
লিপি ভুরু কুঁচকে বলল, কিন্তু অনেক জায়গায় রোবটেরা সবাই মিলে মানবশিশুকে আটকে রেখেছে।
একটা-দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ফ্লিকাস কঠিন গলায় বলল, রোবটরা কখনো মানবশিশুকে আটকে রাখতে পারবে না। আমরা সবাই যখন একত্র হব তখন রোবটরা কখনো মানুষের সাথে প্রতিযোগিতা করতে সাহস পাবে না। মানুষের বুদ্ধিমত্তা রোবটদের বুদ্ধিমত্তা থেকে অনেক বেশি, রোবটেরা কখনোই মানুষের সাথে পারবে না।
নিকি জিজ্ঞেস করল, কিন্তু যদি তারা পঞ্চম মাত্রার রোবট তৈরি করে?
পঞ্চম মাত্রার রোবট? ফ্লিকাসকে একটু চিন্তিত দেখায়, সে ভুরু কুঁচকে বলল, পঞ্চম মাত্রার রোবট তৈরি করলে আমাদের একটু সতর্ক হতে হবে, তার কারণ পঞ্চম মাত্রার রোবট মানুষ থেকে বেশি বুদ্ধিমান। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা— ফ্লিকাস কথা শেষ না করে থেমে গেল।
নিকি জিজ্ঞেস করল, তার চেয়ে বড় কথা কী?
তার চেয়ে বড় কথা পঞ্চম মাত্রার রোবটদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার একটা জগৎ আছে। তারা তাদের মতো করে ভাবে। তাদের যদি মনে হয় পৃথিবীতে মানুষের প্রয়োজন নেই, তারাই পৃথিবীকে এগিয়ে নেবে তাহলে তারা পৃথিবী থেকে সব মানুষকে সরিয়ে দিতে পারে।
নির্কির মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ল, বলল, সর্বনাশ! তাহলে কী হবে?
ফ্লিকাস সহৃদয়ভাবে হাসল, বলল, তুমি কেন ধরে নিচ্ছ পঞ্চম মাত্রার রোবট তৈরি হয়ে যাচ্ছে। সেটা কী সহজ কাজ নাকি?
ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, পঞ্চম মাত্রার রোবট দেখতে কেমন হবে?
ফ্লিকাস মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি না। এখন পর্যন্ত সব রোবট তৈরি হয়েছে মানুষের অনুকরণে, তাদের হাত আছে, পা আছে, মাথা আছে, চোখ আছে। যেহেতু মানুষ অনেক উন্নত তাই শরীরের ডিজাইনটা হয়েছে। মানুষের মতো। কিন্তু–
কিন্তু কী?
যখন পঞ্চম মাত্রার রোবট তৈরি হবে তখন তারা হবে মানুষ থেকেও উন্নত। তাই তখন তাদের শরীর মানুষের মতো হওয়ার প্রয়োজন নেই। তাদের কাছে যে ডিজাইনটা বেশি কাজের মনে হবে সেভাবে তৈরি করবে। হয়তো–হয়তো–
হয়তো কী?
মানুষের মতো সামনে দুটি চোখ না থেকে সামনে-পেছনে, ডানে-বামে চোখ থাকবে। দুইপা না থেকে তিনটি কিংবা চারটি পা থাকবে–
নিকি বলল, হয়তো মাকড়শার মতো আটটি পা থাকবে–
ফ্লিকাস আবার মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, হয়তো আটটি পা থাকবে। শুড়ের মতো আঙুল, মস্তিষ্কটি হয়তো শুধু মাথায় না থেকে সারা শরীরে থাকবে। পৃথিবীর নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হবার জন্যে এন্টেনা থাকবে। হয়তো অন্ধকারে দেখতে পারবে হয়তো আঙুলের ডগা দিয়ে তীব্র রেডিয়েশন বের হবে। হয়তো—
ত্রিপি বলল, থাক থাক! পঞ্চম মাত্রার রোবটের চেহারার কথা শুনেই আমার গা কেমন কেমন করছে।
ফ্লিকাস বলল, ঠিকই বলেছ। শুধু শুধু পঞ্চম মাত্রার রোবটের চেহারা কল্পনা করে লাভ নেই। পঞ্চম মাত্রার রোবট খুব সোজা ব্যাপার নয়। সত্যিই যদি তৈরি হয় তখন দুশ্চিন্তা করা যাবে।
নিকি বলল, আমরা এতো দুশ্চিন্তা করতে পারব না। যদি দুশ্চিন্তা করতে হয় সেটা করবে তুমি।
ফ্লিকাস হাসার ভঙ্গি করে বলল, ঠিক আছে। তোমাকে আর কোনো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। সব দুশ্চিন্তা করব আমি।
১১. ফ্লিকাস নিকি আর ত্রিপিকে ঘুম থেকে তুলল
ফ্লিকাস নিকি আর ত্রিপিকে ঘুম থেকে তুলল, উত্তেজিত গলায় বলল, এক্ষুণি উঠে যাও। সাংঘাতিক একটা ব্যাপার ঘটেছে।
কী ব্যাপার? নিকি চোখ কচলে বলল, আরো মানুষ চলে এসেছে?
না। তার থেকেও সাংঘাতিক ব্যাপার।
নিকি আর ত্রিপি তাদের বিছানায় উঠে বসল, কী সাংঘাতিক ব্যাপার?
বলছি, শোনো। ফ্লিকাস একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, তোমরা তো জান আমি পৃথিবীর সব মানুষকে একত্র করার চেষ্টা করছি। সে জন্যে আমি সারাক্ষণ নেটওয়ার্ক বলো, ডাটাবেস বলো, অর্কাইত বলো সবকিছু ঘেঁটে ঘেঁটে দেখছি। ঘাটতে ঘাটতে আমি কী পেয়েছি জানো?
কী?
তোমরা শুনলে বিশ্বাস করবে না।
নিকি আর ত্রিপি উত্তেজিত মুখে বলল, আমাদের বলো দেখি বিশ্বাস করি কী না!
মানুষের খনি!
মানুষের খনি?
হ্যাঁ।
মানুষের খনি কেমন করে হয়?
ফ্লিকাস চোখ বড় বড় করে বলল, পৃথিবীর মানুষ অসম্ভব বুদ্ধিমান। এরকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে সেটা তারা অনুমান করেছিল। তাই তারা মাটির নীচে দুর্ভেদ্য একটা গহ্বরের মাঝে হিমঘরে অনেক মানুষকে শীতল করে রেখে দিয়েছে। যদি কখনো এরকম হয় যে পৃথিবীর সব মানুষ মরে গেছে তাহলে তাদের বাঁচিয়ে তোলা হবে।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। ফ্লিকাস সুন্দর করে হাসল।
অমিরা এখন এই মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে তুলব?
হ্যাঁ।
ত্রিপি ভয়ে ভয়ে বলল, তারা অন্যদের মতো মরে যাবে না তো?
ফ্লিকাস মাথা নাড়ল, না, মারা যাবে না। যে ভাইরাসের কারণে এটা ঘটেছে সেটা শেষ হয়ে গেছে। আর আসতে পারবে না। আমি খোঁজ নিয়েছি।
নিকি চোখ বড় বড় করে বলল, তাহলে আমরা একসাথে অনেক মানুষ পাব?
হ্যাঁ পাব?
সব কী বড় মানুষ?
না। তোমাদের মতো ছোট ছোট ছেলে মেয়েরাও আছে।
সত্যি? নিকি আনন্দে চিৎকার করে উঠল, সত্যি?
হুঁ, সত্যি।
আমরা কখন তাদের জাগিয়ে তুলব?
ফ্লিকাস বলল, আমার আর দেরি করার ইচ্ছে করছে না। আমরা এক্ষুণি যাব, এক্ষুণি জাগিয়ে তুলতে শুরু করব।
ত্রিপি হাত তালি দিয়ে বলল, কী মজা! কী মজা!
কিছুক্ষণের ভেতর তারা রওনা দিয়ে দেয়। ফ্লিকাস নিকি আর ত্রিপিকে তার নিজের বাইভার্বালে তুলে নিতে চাইছিল কিন্তু ক্রিনিটি তাদের আলাদা যেতে দিল না। ফ্লিকার প্রথমে একটু আপত্তি করতে চাইছিল তৃতীয় মাত্রার একটি রোবট দুজন মানবশিশুর দায়িত্ব নিচ্ছে সেটা সে ঠিক মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু নিকি আর ত্রিপি তাকে আশ্বস্ত করল, ক্রিনিটি তৃতীয় মাত্রার একটি রোবট হতে পারে কিন্তু তাদের কাছে ক্রিনিটি একটা আপনজনের মতো।
বাইভার্বালে করে তাদের দীর্ঘসময় যেতে হল। শেষ পর্যন্ত তারা একটা পাহাড়ের কাছাকাছি হাজির হল। বাইভার্বাল বেশ কিছু ঘোরাপথে উড়ে উপরে একটা পাথুরে জায়গায় হাজির হয় ফ্লিকাস বাইভার্বাল থেকে নেমে তার মনিটর পরীক্ষা করে হেঁটে হেঁটে একটা খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে। সে নিচু হয়ে জায়গাটা পরীক্ষা করে, তারপর মাথা নেড়ে বলল, এটাই সেই জায়গা।
নিকি অবাক হয়ে বলল, কোথায়? কিছু তো নাই।
এখানে একটি গোপন দরজা আছে, এটি খুলতে হবে।
কোথায় গোপন দরজা?
এসো খুঁজে দেখি।
সবাই মিলে খুঁজতে খুঁজতে সত্যি তারা একটি ধাতব রিং খুঁজে পেয়ে যায়। উপর থেকে ধুলোবালি সরিয়ে রিংটা ধরে টান দিতেই ঘরঘর শব্দ করে চৌকোণা একটা জায়গা খুলে গেল। সেখানে আবছা অন্ধকার, দেখা যাচ্ছে। একটা সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে।
ফ্লিকাস বলল, আমাদের এখন নিচে নামতে হবে। সাবধানে নেমো সবাই। আগে আমি নেমে যাই।
ফ্লিকাসের পিছু পিছু নিকি, নিকির পেছনে ত্রিপি আর সবার শেষে ক্রিনিটি সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। সিঁড়িটা ঘুরে ঘুরে অনেক নীচে নেমে গেছে। আস্তে আস্তে জায়গাটা অন্ধকার এবং শীতল হয়ে আসে। যখন মনে হচ্ছিল নীচে নামা বুঝি কখনো শেষ হবে না তখন হঠাৎ করে তারা একটা ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে গেল। নিচে পাথরের মেঝে এবং নিচু ছাদ। কান পেতে থাকলে একটা কম্পন অনুভব করা যায়, বোঝা যায় আশপাশে কোথাও গুমগুম করে একটি ইঞ্জিন চলছে।
ওরা কিছুক্ষণ নিঃশব্দে পঁড়িয়ে থাকে, তখন খুব ধীরে ধীরে সেখানে একটি ঘোলাটে আলো জ্বলে ওঠে। ভেতরে পাথরের কারুকাজ করা দেয়াল এবং সামনে মেঝে থেকে খানিকটা উঁচুতে একটি গোলাকার বেদী। হঠাৎ করে দেখা গেল সেখানে সাদা কাপড় পরা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সবাই প্রথমে। চমকে ওঠে তারপর বুঝতে পারে মেয়েটি সত্যি নয় একটি হলোগ্রাফিক ছবি।
মেয়েটি চারদিকে একবার তাকাল, তারপর বলল, আমাদের এই ব্যালকনিতে কিছু দর্শকের উপস্থিতি অনুভব করে আমি তাদের কিছু তথ্য দেওয়ার জন্যে উপস্থিত হয়েছি। এটি একটি অত্যন্ত গোপন স্থাপনা, এখানে কোনোভাবেই কারো উপস্থিত হওয়ার কথা নয়। এটি অত্যন্ত দুর্ভেদ্য একটি স্থাপনা। নিউক্লিয়ার বোমা দিয়েও এটা ভেদ করা সম্ভব নয়। এখানে যে মানুষদের হিমঘরে শীতল করে রাখা হয়েছে তারা ঠিক সময়মতো হিমঘর থেকে বের হয়ে পৃথিবীতে আসবেন। বাইরের কোনো মানুষ প্রাণী বা যন্ত্রের এখানে এসে সেই প্রক্রিয়াটি প্রভাবান্বিত করার কথা নয়। তারপরও যারা নিজের দায়িত্বে এখানে উপস্থিত হয়েছে আমি তাদের বক্তব্য শুনতে আগ্রহী।
ফ্লিকাস বলল, পৃথিবীতে প্রায় সব মানুষ একটা ভাইরাসের কারণে মৃত্যুবরণ করেছে। যে অল্প কয়জন বেঁচে আছে তাদের বড় সংখ্যক হচ্ছে শিশু। তাদের যথাযথভাবে লালন করার জন্যে আমাদের এই মুহূর্তে কিছু বড় মানুষ প্রয়োজন।
এখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত সিস্টেম পৃথিবীর এই দুর্ভাগ্যজনিত পরিণতি সম্পর্কে অবহিত। হিমঘরের মানুষকে দ্রুত জাগিয়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
ফ্লিকাস জানতে চাইল, তারা কবে জেগে উঠবে? কবে বের হয়ে আসবে?
এখন থেকে তেত্রিশ দিন পর। তার পরের ব্যাচটি বাহান্ন দিন পর।
কোনোভাবেই কী জাগিয়ে তোলার প্রক্রিয়াটি আরেকটু ত্বরান্বিত করা। যায় না। আমাদের মানুষের খুব প্রয়োজন।
স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে করা সম্ভব নয়। যদি এর চাইতে তাড়াতাড়ি জাগিয়ে তুলতে হয় তাহলে সেটি ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে করতে হবে।
আমরা ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে এটি করতে প্রস্তুত।
এটি করতে পারবে শুধুমাত্র সত্যিকারের মানুষ। কোনো রোবট বা কোনো যন্ত্রকে এটি করতে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে না।
আমি তোমাকে আশ্বস্ত করে বলতে পারি আমাদের সাথে রোবট থাকলেও যারা মানুষ তারাই দায়িত্ব নেবে।
চমৎকার। মেয়েটি হাসি মুখে বলল, আমি এখন এখান থেকে চলে। যাচ্ছি। যে বা যারা ভেতরে যেতে চায় তাদের একে একে এখানে উপস্থিত হতে অনুরোধ করছি। বিদায়।
সাদা কাপড় পরা মেয়েটি যেভাবে এখানে হঠাৎ করে উপস্থিত হয়েছিল ঠিক সেভাবে সে অদৃশ্য হয়ে গেল।
নিকি ফ্লিকাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ফ্লিকাস, তুমি এখন যাও।
ফ্লিকাস মাথা নাড়ল, বলল, না। তোমরা দুজন ভেতরে যাও।
নিকি অবাক হয়ে বলল, আমরা দুজন?
হ্যাঁ।
কেন?
বাইরে একজন পাহারা দেয়া দরকার।
বাইরে ক্রিনিটি পাহারা দিতে পারবে।
ফ্লিকাস কঠোর মুখে বলল, আমি কোনো রোবটকে বিশ্বাস করি না। আমি বাইরে পাহারা দিচ্ছি। তুমি আর ত্রিপি ভেতরে গিয়ে ভেতরের মানুষগুলোকে জাগিয়ে তুলো। মানুষগুলো জেগে উঠে আমাকে দেখে যতটুকু আনন্দ পাবে, তার চাইতে অনেক বেশি আনন্দ পাবে তোমাদের মতো দুজন ফুটফুটে শিশুকে দেখে।
নিকি অবাক হয়ে বলল, কিন্তু–কিন্তু—
কিন্তু কী?
ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে কিভাবে শীতল মানুষগুলোকে জাগিয়ে তুলতে হবে আমরা তার কিছুই জানি না।
ফ্লিকাস বলল, জানার প্রয়োজনও নেই। আমি কাজটি সহজ করার জন্যে কয়েকশ মাইক্রো মডিউল এনেছি। মডিউলগুলো প্রোগ্রাম করা আছে। মানুষগুলো একেকটা ক্যাপসুলের ভেতরে আছে। তোমরা এই মাইক্রো মডিউলগুলো একেকটা ক্যাপসুলের গায়ে লাগিয়ে দেবে। আর কিছু করতে হবে না?
আর কিছু করতে হবে না?
না। মাইক্রো মডিউলগুলো নিজে নিজে ক্যাপসুলগুলোকে ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে জাগিয়ে তুলবে।
সত্যি?
হ্যাঁ।
তার মানে আমরা শুধু মাইক্রো মডিউলগুলো একটা একটা করে ক্যাপসুলের গায়ে লাগিয়ে দেব? আর কিছু না?
ফ্লিকাস হেসে বলল, হ্যাঁ, আর কিছু না।
এই মাইক্রো মডিউলগুলো ক্যাপসুলগুলোকে নিজে নিজে প্রোগ্রাম করে নেবে?
হ্যাঁ।
নিকি মাথা নেড়ে বলল, তাহলে ঠিক আছে। তাহলে আমরাই পারব। তাই না ত্রিপি?
ত্রিপি বলল, হ্যাঁ। অনেক মজা হবে। একটা একটা ক্যাপসুল থেকে যখন মানুষগুলো বের হয়ে আসবে তখন তারা আমাদের দেখে অবাক হয়ে যাবে।
নিকি বলল, আমরা বলব, আমাদের পথিবীতে স্বা-গ-ত-ম।
কিংবা সু-স্বা-গ-ত-ম!
ফ্লিকাস বলল, দেরি করো না। বেদীর ওপর দাঁড়িয়ে যাও। এই যে মাইক্রো মডিউলের প্যাকেট। সাথে রাখো।
নিকি আর ত্রিপি ফ্লিকাসের হাত থেকে মাইক্রো মডিউলের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বেদীর ওপর দাঁড়াল, প্রায় সাথে সাথেই উপর থেকে দুটি হেলমেট নেমে আসে। দুজনে হেলমেট দুটি মাথায় পরল প্রায় সাথে সাথেই তারা একটি ভেঁতী শব্দ শুনতে পায়। হঠাৎ করে তারা একধরনের কম্পন অনুভব করে এবং চোখের সামনে বিচিত্র একধরনের আলো খেলা করতে থাকে। নিকি অবাক হয়ে আবিষ্কার করে সেই শৈশবের কিছু স্মৃতি তার মনে পড়ে যায়, স্মৃতিগুলো আবার মিলিয়ে গিয়ে নতুন স্মৃতি ভেসে আসে। এভাবে কিছুক্ষণ চলতে থাকে তখন তারা হঠাৎ কেমন জানি বিষণ অনুভব করে। বিষণ্ণ অনুভূতিটি আস্তে আস্তে আনন্দে রূপ নেয় তারপর হঠাৎ করে তাদের মনটি ফাঁকা হয়ে যায়।
তখন দুজনেই স্পষ্ট শুনতে পেল কেউ তাদের বলছে, ট্রাইকিনিওলাল ইন্টারফেস দিয়ে তোমাদের মস্তিষ্ক স্ক্যান করা হয়েছে। তোমরা মানব শিশু। তোমাদের মস্তিষ্কে মানবসমাজ নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্রমূলক বা ক্ষতিকর। পরিকল্পনা নেই। তোমাদের ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হল। দেয়ালের সবুজ বাতিটি স্পর্শ কর।
নিকি সবুজবাতিটি স্পর্শ করার সাথে সাথে ঘরঘর করে ভারি দেয়ালটি খুলে গেল। নিকি আর ত্রিপি সাবধানে ভেতরে পা দেয়, কয়েক পা অগ্রসর। হতেই পেছনের দরজাটি শব্দ করে বন্ধ হয়ে সামনের দরজাটি খুলে গেল। এভাবে কয়েকটি দরজা পার হয়ে তারা ভেতরে এসে ঢুকল। ভেতরে খুব ঠাণ্ডা, দুজনে হাত ঘষে একটু উষ্ণ হওয়ার চেষ্টা করে। সামনে বিশাল একটি হলঘর, সেখানে সারি সারি ক্যাপসুল সাজানো। ক্যাপসুলগুলোর ওপর বাতি জ্বলছে। মাথার কাছে ডায়াল সেখানে কিছু সংখ্যার পরিবর্তন হচ্ছে। ভেতরে একধরনের চাপা যান্ত্রিক গুঞ্জন।
নিকি ফিসফিস করে বলল, প্রত্যেকটির ভেতরে একজন মানুষ!
জীবন্ত মানুষ।
হ্যাঁ। নিকি ফিসফিস করে বলল, মানুষগুলো এক্ষুণি জেগে উঠবে, কী মজা।
ত্রিপি বলল, মাইক্রো মডিউলগুলো বের কর।
হ্যাঁ বের করছি। নিকি ব্যাগ খুলে ভেতরে হাত দিয়ে কয়েকটা মাইক্রো মডিউল বের করে নিয়ে সেগুলোর দিকে তাকায় এবং হঠাৎ করে তার সারা শরীর আতঙ্কে জমে যায়। ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে নিকি?
নিকি বিস্ফারিত চোখে মাইক্রো মডিউলটির দিকে তাকিয়ে থাকে—এটি আসলে একটি বিস্ফোরক। জীবনরক্ষাকারী ব্যাগে অন্য অনেক যন্ত্রের সাথে ঠিক এরকম বিস্ফোরক ছিল, ক্রিনিটি তাকে এর ব্যবহার শেখাতে চায় নি। সে জোর করে শিখেছিল। জাতীয় গবেষণাগারে ত্রিপির ঘরে সে এরকম একটি বিস্ফোরক রেখে এসেছিল।
ত্রিপি আবার জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে নিকি? কথা বলছ না কেন?
নিকি ত্রিপির দিকে তাকিয়ে বলল, এগুলো মাইক্রো মডিউল নয়। এগুলো টাইমার দেওয়া বিস্ফোরক।
বিস্ফোরক? বিস্ফোরক কেন?
ফ্লিকাস আসলে সবগুলো মানুষকে মারতে চায়।
সবগুলো মানুষকে মারতে চায়? ফ্লিকাস?
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। দেখছ না সব ক্যাপসুলে একটা করে বিস্ফোরক লাগাতে বলেছে। বিস্ফোরকগুলো এক সাথে ফাটবে। একসাথে প্রত্যেকটা মানুষ মারা যাবে।
সর্বনাশ! ফ্লিকাস কেন সবগুলো মানুষকে মারতে চায়? মানুষ হয়ে। মানুষকে কেন মারতে চায়?
তার মানে ফ্লিকাস আসলে মানুষ না।
ক্লিকাস তাহলে কী?
মনে হয় পঞ্চম মাত্রার রোবট।
রোবট? ত্রিপি চোখ বড় বড় করে বলল, ফ্লিকাস একজন রোবট?
হ্যাঁ। দেখ নি সে নিজে ভেতরে ঢোকে নি। আমাদের পাঠিয়েছে। রোবটদের এখানে ঢোকা নিষিদ্ধ।।
ত্রিপি মাথা নাড়ল, বলল, কী সর্বনাশ! এখন কী করব?
প্রথমে এই বিস্ফোরকগুলোর টাইমার রিসেট করতে হবে যেন কিছুক্ষণ পর নিজে থেকে ফেটে না যায়।
ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, তুমি জান কেমন করে করতে হয়?
জানি, খুব সোজা। পেছনে সবুজ বোতামটা টিপে ধর দেখবে সামনের সময়টা অদৃশ্য হয়ে যাবে। তার মানে টাইমার আর কাজ করছে না।
ঠিক আছে। তাহলে দাও একটা একটা করে সবগুলো টাইমার রিসেট করে ফেলি।
দুজনে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে প্রত্যেকটা বিস্ফোরকের টাইমার রিসেট করে নিল। একটিও যদি রিসেট করতে ভুলে যায়, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ওরা কয়েকবার করে দেখে নিশ্চিত হয়ে নেয়। সবগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে নিকি উঠে দাঁড়ায়। ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, এখন কী করব?
বের হয়ে যাই।
ফ্লিকাসকে কী বলব?
আমি জানি না।
আমার মনে হয় মিথ্যে কথা বলতে হবে। সত্যি কথা বললে আমাদের বিপদ হবে।
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। সত্যি কথা বলা যাবে না। কিন্তু কী বলব?
আমরা বলব যে আমরা ক্যাপসুলে মাইক্রো মডিউলগুলো লাগিয়ে দিয়েছি।
হ্যাঁ। ভাব দেখাব আমরা যেন বুঝতে পারি নি এগুলো মাইক্রো মডিউল, এগুলো আসলে বিস্ফোরক।।
হ্যাঁ। ত্রিপি মাথা নেড়ে বলল, আমরা বের হয়ে কোনো কথা না বলে সোজা বাইভার্বালে উঠে চলে যাব।
হ্যাঁ। আমরা ফ্লিকাসের সাথে কোনো কথা বলব না। নিকি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এখন কী বের হব?
হ্যাঁ। ত্রিপি বলল, চল বের হই।
নিকি ফ্যাকাসে মুখে বলল, আমার ভয় করছে। ফ্লিকাস যদি এখানকার সব মানুষকে মেরে ফেলতে চায় তাহলে সে তো আমাদেরও মেরে ফেলতে চেষ্টা করবে।
ঠিকই বলেছ।
কিন্তু আমরা তো ভেতরে বসে থাকতে পারব না। আমাদের তো বের হতে হবে।
হ্যাঁ বের হতে হবে। নিকি কিছুক্ষণ চিন্তা করল তারপর নিচু হয়ে পকেট থেকে কয়েকটা বিস্ফোরক নিয়ে নিল।
ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, তুমি কী করছ?
কয়েকটা বিস্ফোরক নিচ্ছি।
কেন?
জানি না। যদি কোনো কাজে লাগে সেজন্যে।
ত্রিপি ভীত চোখে নিকির দিকে তাকিয়ে রইল। নিকি কঠিন মুখে বলল, ফ্লিকাসকে আমি এমনি এমনি ছেড়ে দেব না।
নিকি আর ত্রিপি দরজা ঠেলে বের হয়ে দেখল, দরজার ঠিক সামনে ফ্লিকাস দাঁড়িয়ে আছে। তারা ভয়ে ভয়ে তার মুখের দিকে তাকাল। ফ্লিকাস ভুরু কুঁচকে বলল, তোমরা বের হয়ে এসেছ কেন?
নিকি কী বলবে বুঝতে পারল না, ইতস্তুত করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল হঠাৎ করে সে চমৎকার একটা উত্তর পেয়ে গেল, বলল, ভেতরে খুব ঠাণ্ডা। জমে যাচ্ছিলাম।
ফ্লিকাস বলল, হিমঘর তো ঠাণ্ডা হবেই।
সেজন্যে বাইরে এসেছি।
ত্রিপিও মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। সেজন্যে বাইরে চলে এসেছি।
সগুলো মাইক্রো মডিউল ক্যাপসুলগুলোতে লাগিয়েছ?
হ্যাঁ লাগিয়েছি।
সবগুলোতে?
হ্যাঁ।
ফ্লিকার্সের মুখে একধরনের হাসি ফুটে ওঠে, নিকির মনে হলো হাসিটা খুব ভয়ঙ্কর। সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি হাসছ কেন?
আনন্দে।
কিসের আনন্দে?
মানুষের নাকি খুব বুদ্ধি! কেউ নাকি তাদের হারাতে পারে না। আমি হারিয়েছি।
ফ্লিকাস কী বলতে চাইছে দুজনেই বুঝে গেল, তারা দুজনেই হতবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্লিকাস বলল, তোমরা হচ্ছ নিম্পাপ শিশু! আমি এই নিস্পাপ শিশুদের ব্যবহার করে মানুষের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য ঘাটির প্রত্যেকটি মানুষকে হত্যা করার ব্যবস্থা করেছি।
ফ্লিকাস বলল, আমি জানি তোমরা বিষয়টি বুঝতে চাইছ। বিষয়টি খুবই সোজা। তোমরা ক্যাপসুলে যে মাইক্রো মডিউলগুলো লাগিয়ে আসলে তার প্রত্যেকটা হচ্ছে একটা করে টাইমার লাগানো বিস্ফোরক।
নিকি আর ত্রিপি একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, কোনো কথা বলল না। ফ্লিকাস বলল, টাইমারে তিরিশ মিনিট সময় সেট করা আছে। আর ত্রিশ মিনিট পর ভেতরের প্রতিটি ক্যাপসুলে একটা করে বিস্ফোরণ হবে। একটি করে বিস্ফোরণের অর্থ একটি করে মানুষ। ফ্লিকাস হঠাৎ হা হা করে হেসে উঠল। নিষ্ঠুর ভয়ঙ্কর একধরনের হাসি।
ফ্লিকাস একটু এগিয়ে এসে অনেকটা আদরের ভঙ্গিতে নিকির চিবুক স্পর্শ। করে বলল, এখন রয়ে গেলে তোমরা দুজন। যাদের আমার খুঁজে বের করতে হয় নি যারা নিজেরা এসে আমার হাতে ধরা দিয়েছে। তোমরা মনে হয় এখন আমাকে আর বিশ্বাস করবে না কিন্তু আসলেই তোমাদের জন্য আমার একধরনের মায়া হয়েছে।
ত্রিপি জিজ্ঞেস করুল, তুমি আমাদের কী করবে?
অবশ্যই মেরে ফেলব। কিন্তু এখানে নয়। বাইরে। ফ্লিকস বলল, এই জায়গাটি আমার পছন্দ নয়। এখানে মানুষ মানুষ গন্ধ, মানুষের গন্ধ আমার একেবারে ভালো লাগে না।
একপাশে ক্রিনিটি দাঁড়িয়ে ছিল, সে এবারে এগিয়ে এসে বলল, আমি এদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছি। তুমি কিছুতেই এদের ক্ষতি করতে পারবে না। আমি কিছুতেই–
ক্রিনিটি কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে থেমে গেল, নিকি আর ত্রিপি দেখল, ক্রিনিটির সারা শরীরে অদম্য একটা খিচুনির মতো শুরু হয়েছে, সে কথা বলতে পারছে না এবং থরথর করে কাঁপছে। ফ্লিকাস হা হা করে হেসে বলল, তিন মাত্রার রোবট এসে আমাকে বলছে আমি কী করতে পারব আর কী করতে পারব না! এর চাইতে বড় রসিকতা কী হতে পারে? আমি মুহূর্তের মাঝে তার পুরো সিস্টেম ওভারলোড করে দিতে পারি। দেখেছ?
নিকি আর ত্রিপি কিছু বলল না। ফ্লিকাস বলল, চল আমরা বাইরে যাই। এই বন্ধ ঘর আর ভালো লাগছে না। আমি মানুষ নই, কিন্তু আমার অনেক কিছু মানুষের মতো। যখন আমরা পৃথিবীর শেষ মানুষটিকেও শেষ করে দেব তখন। আমাদের আর এই হাস্যকর মানুষের রূপ নিয়ে থাকতে হবে না। মানুষের। মতো ভাবতে হবে না। মানুষের মতো কথা বলতে হবে না।
নিকি অনেকক্ষণ পর এবারে কথা বলল, তুমি মানুষ না, তুমি পঞ্চম মাত্রার রোবট। তাই না?
সেটা তুমি এতোক্ষণে বুঝতে পেরেছ?
না। আমি আগেই বুঝেছি।
যথেষ্ট আগে বোঝো নি। তাহলে এতো সহজে আমার পরিকল্পনার অংশ হতে না। যাই হোক বাইরে চল। ভেতরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে নিকি পকেটে হাত দিয়ে পকেটের টাইমারটিতে সময় সেট করে নিল। বিস্ফোরকটি এখন মিনিট পনেরোর মাঝে বিস্ফোরিত হবে। এই বিস্ফোরকটি এখন ফ্লিকাসের শরীরের কোথাও লাগিয়ে দিতে হবে। ফ্লিকাস ঢিলেঢালা একটি পোশাক পরেছে, সেখানে অনেকগুলো পকেট, কোনো একটি পকেটে রেখে দিতে পারলেই আর কোনো চিন্তা নেই। কাজটি সহজ নয় কিন্তু নিকি চেষ্টা করবে।
প্যাঁচানো সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সে হঠাৎ ইচ্ছে করে পা পিছলে পড়ে গেল, সিঁড়ি দিয়ে যখন নীচে পড়ে যাচ্ছে তখন ফ্লিকাস তাকে থামাল। নিচু হয়ে তাকে ধরে যখন টেনে সোজা করছিল তখন সে হাত-পা ছুড়ে মুক্ত হবার অভিনয় করার সময় হাঁটুর কাছে পকেটে বিস্ফোরকটি রেখে দিল। নিকি ভেবেছিল ফ্লিকাস বুঝে ফেলবে কিন্তু ফ্লিকাস বুঝতে পারল না।
উপরে এসে ফ্লিকাস অলস পায়ে হেঁটে হেঁটে পাহাড়ের এক কিনারায় এসে দাঁড়িয়ে সামনে নীলাভ পাহাড়ের মাথায় সাদা বরফের চূড়োর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, আমার আসলে সত্যিকার একটা প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করার ইচ্ছে করছে। তোমাদের মতোন অবুঝ দুটি শিশুকে খুন করার মাঝে কোনো গৌরব নেই, কোনো আনন্দ নেই। আমার মনে হচ্ছে আমি পা দিয়ে মাড়িয়ে দুটো ফড়িংকে পিষে ফেলছি।
নিকি বলল, তুমি আমাদের কখন মারবে?
ফ্লিকাস একটু অবাক হয়ে নিকির দিকে তাকাল, বলল, তোমার কণ্ঠস্বরে ভয় নেই কেন? কণ্ঠস্বরে একধরনের উপহাস। কেন?
নিকি ঠোঁট উল্টে বলল, তোমার বুদ্ধি মানুষ থেকে অনেক বেশি, তুমি বলো।
ফ্লিকাস বিড়বিড় করে বলল, একটু আগেও তোমার ভেতরে ভয় ছিল, আতঙ্ক ছিল, এখন নেই। কেন নেই? কী হয়েছে? বলো আমাকে?
নিকি বলল, ঠিক আছে, আমি বলব, কিন্তু তার আগে আমি ত্রিপির সাথে একটু কথা বলতে চাই।
ফ্লিকাস কিছুক্ষণ শীতল চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, ঠিক আছে বলো।
আমি লুকিয়ে কথা বলতে চাই, তুমি যেন শুনতে না পার। দেখতে না
পার।
ঠিক আছে।
আমি আর ত্রিপি ঐ পাথরটার আড়ালে গিয়ে কথা বলতে পারি?
ফ্লিকাস কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, ঠিক আছে যাও।
নিকি ত্রিপির হাত ধরে বড় একটা পাথরের আড়ালে নিয়ে গেল। ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাকে কী বলবে?
আমি কিছুই বলব না।
তাহলে এখানে কেন এনেছ?
আমি ফ্লিকাসের পকেটে একটি বিস্ফোরক রেখে এসেছি, সেটি এক্ষুণি ফাটবে। সেটি যখন ফাটবে তখন যে বিস্ফোরণ হবে সেটির ঝাঁপটা থেকে বাঁচার জন্যে এর পেছনে দাঁড়িয়েছি।
ত্রিপি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে নিকির দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, সত্যি?
সত্যি।
এন্ড্রোমিডার কসম?
এন্ড্রোমিডার কসম।
মহাকালের কসম?
মহাকালের কসম।
আমরা আসলে মরব না?
আমরা আসলে মরব না। ফ্লিকাস এক্ষুণি উড়ে যাবে। ধ্বংস হয়ে যাবে।
নিকি আর ত্রিপি হঠাৎ করে ফ্লিকাসের গলার স্বর শুনতে পেল, তোমাদের কথা শেষ হয়েছে?
নিকি মাথা তুলে দাঁড়াল, পাথরের আড়াল থেকে বলল, হ্যাঁ শেষ হয়েছে।
এখন আমাকে বলবে, তোমার কণ্ঠস্বরে কোনো ভয় নেই কেন? মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে তোমার এতো সাহস কেন?
বলব?
ফ্লিকাস বলল, বল।
দুটি কারণ আছে। প্রথম কারণ হচ্ছে মাইক্রো মডিউল সে আসলে টাইমার লাগানো বিস্ফোরক আমরা সেটি জানতাম। তাই আমরা ভেতরে বসে। সবগুলো বিস্ফোরককে বিকল করে এসেছি। কোনো ক্যাপসুলে সেগুলো। লাগাই নি।
ফ্লিকাসের চোখ দুটি ধ্বক করে জ্বলে উঠল, বলল, কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ। সত্যি বলছি। আমরা বিস্ফোরকগুলো ভেতরে রেখে এসেছি। সেগুলো নিজে থেকে ফাটবে না, তাই কোনো ভয় নেই। কিন্তু–
কিন্তু কী?
আমরা দুটি বিস্ফোরক নিয়ে এসেছি। একটিতে টাইম সেট করে সেটি তোমার পকেটে রাখা হয়েছে। মনে আছে একটু আগে আমি সিড়িতে গড়িয়ে পড়েছিলাম? আসলে সেটি ছিল অভিনয়। যখন হাত-পা ছুড়ছিলাম তখন এক ফাঁকে সেটি তোমার কোনো একটি পকেটে রাখা হয়েছে। তুমি ইচ্ছে করলে সেটি খুঁজে বের করতে পার। তুমি এটি খুঁজে বের করার আগেই সেটি ফাটবে। বিশ্বাস কর।
ফ্লিকাস অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে নিকির দিকে তাকিয়ে রইল। নিকি বলল, তুমি বল? পৃথিবীতে কে বেশি বুদ্ধিমান? মানুষ নাকি পঞ্চম মাত্রার রোবট? নিকি নাকি ফ্লিকাস? কে ফড়িংকে পিষে মারছে? তুমি নাকি আমি?
নিকির কথা শেষ হবার আগে একটি ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে ফ্লিকাস ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তার আগেই নিকি পাথরের আড়ালে লুকিয়ে গেছে, সে অনুভব করল একটি বাতাসের ঝাঁপটা ফ্লিকাসের ছিন্নভিন্ন দেহ তাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেছে। একমুহূর্ত পরে নিকি সাবধানে মাথা বের করল, এদিক-সেদিক তাকাল তারপর পাথরের আড়াল থেকে বের হয়ে এলো। বাতাসে। পোড়া একটা গন্ধ, যেখানে ফ্লিকাস দাঁড়িয়েছিল সেখানে কালো পোড়া বিস্ফোরণের চিহ্ন। চারদিকে ছিন্নভিন্ন যন্ত্রপাতির চিহ্ন—ফ্লিকাসের শরীরের অংশ।
হঠাৎ ত্রিপি চিৎকার করে উঠল, নিকি!
কী হয়েছ?
দেখ! ত্রিপি হাত তুলে দেখাল, নিকি সেদিকে তাকায়। ফ্লিকাসের পোড়া মাথাটি একটা পাথরে আটকে পড়ে আছে, সেটি এখনো নড়ছে। নিকি এগিয়ে গেল, পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সেটিকে নীচে ফেলে দিতেই ফ্লিকাস চোখ খুলে তাকাল। নিকি ভয় পেয়ে এক পা পিছিয়ে আসে। গলা থেকে কিছু তার টিউব বের হয়ে এসেছে। সেখান থেকে সাদা কষের মতো কিছু একটা ফোটা ফোটা করে পড়ছে। তার সোনালি চুল জায়গায় জায়গায় পুড়ে গেছে। মুখের চামড়া উঠে ভেতর থেকে ধাতব কাঠামো বের হয়ে আসছে। নিকি আর ত্রিপিকে দেখে সেই ছিন্ন মাথাটি খলখল করে হাসল, খসখসে গলায় বলল, তুই ভেবেছিস তুই আমার কাছ থেকে মুক্তি পাবি? পাবি না।।
নিকি সাবধানে এগিয়ে গেল। উবু হয়ে নিচে পড়ে থাকা মাখাটির দিকে তাকাল, বলল, কী বললে?
তোকে হত্যা করার জন্যে যদি আমার নরকেও যেতে হয়, আমি যাব!
তুমি? তোমার এই কাটা মাখা?
আমি পঞ্চম মাত্রার রোবট! তুই আমাকে এখনো চিনিস নি। তুই এখনো আমার ক্ষমতার পরিচয় পাস নি?
নিকি ত্রিপির মুখের দিকে তাকাল, বলল, ত্রিপি এই কাটা মাথাটা কী বলছে? সে আমাকে কেমন করে হত্যা করবে?
ত্রিপি মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি না।
নিকি বলল, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না। কিন্তু সত্যি সত্যি যেন। এই কাটা মাথা হয়েই তুমি আমাকে কামড়ে ধরতে না পার আমি তার ব্যবস্থা। করছি। নিকি তার পকেট থেকে দ্বিতীয় বিস্ফোরকটি বের করে বলল, এই যে বিস্ফোরকটি দেখছ আমি সেটি তোমার মুখের মাঝে ছেড়ে দেব। তিরিশ সেকেন্ডের মাঝে সেটি বিস্ফোরিত হবে। তোমার এই কাটা মাথাটা আর থাকবে না, সেটাও তখন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। আমি দেখি তখন তুমি কেমন করে। আমাকে ধরতে আস!
ফ্লিকাসের কাটা মাথাটি আবার খলখল করে হাসতে থাকে! নিকি তার মাঝে বিস্ফোরকটি তার মুখে গুঁজে দিয়ে ত্রিপিকে নিয়ে বড় একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে গেল। কিছুক্ষণের মাঝে প্রচণ্ড একটি বিস্ফোরণে পুরো এলাকাটি কেঁপে ওঠে। ফ্লিকাসের খলখল করে হাসির শব্দ হঠাৎ করে থেমে। গেল। চারপাশে তখন অত্যন্ত বিচিত্র একটা নৈঃশব্দ।
নিকি ত্রিপির হাত ধরে বলল, চল এখন ক্রিনিটিকে নিয়ে আসি। এতোক্ষণে সে নিশ্চয়ই স্বাভাবিক হয়েছে।
ত্রিপি বলল, চল।
১২. হ্রদের তীরে
হ্রদের তীরে অনেকগুলো ছোট বড় পাথর সাজানো। নিকি আর ত্রিপি পাথরগুলোর পাশ দিয়ে গুনতে গুনতে হেঁটে যায়। নিকি গোনা শেষ করে বলল, আঠারটা।
নিকির কথা শুনে ত্রিপি হি হি করে হাসল। নিকি বলল, কী হলো তুমি হাসছ কেন?
তুমি এমন করে বলছ যেন তুমি জান না যে এখানে আঠারটি পাথর। আছে। যেন তুমি গুনে আবিস্কার করেছ এখানে আঠারটি পাথর!
জানি তাতে কী হয়েছে? জানা থাকলে কী গোনা যায় না? একবার গোনা যায়!
ত্রিপি মাথা নাড়ল, বলল, সেটা ঠিক। জানা থাকলেও একশবরি গোনা যায়।
এখন আমরা আঠার নম্বর পাথরটি হ্রদের পানিতে ফেলে দেব, তখন। এখানে পাথর হবে সতেরটি! তার মানে–
তার মানে আর সতেরদিন পর পাহাড়ের গহ্বর থেকে ঘুম ভেঙে মানুষেরা বের হয়ে আসবে?
নিকি হাত কঁকুনি দিয়ে বলল, ঠিক বলেছ! তারপর সে নিচু হয়ে ভারি পাথরটা গড়িয়ে গড়িয়ে হ্রদের দিকে নিয়ে যায়। হ্রদের তীর থেকে সেটাকে ধাক্কা দিতেই পাথরটা ঝপাং করে পানিতে পড়ে হারিয়ে গেল।
ফ্লিকাসের সাথে তারা যখন পাহাড়ের গহ্বরে গিয়েছিল তখন তারা জেনে এসেছিল যে সেখান থেকে তেত্রিশদিন পর মানুষদের প্রথম ব্যাচটি জেগে উঠবে। তারা তাদের এলাকায় ফিরে এসে তেত্রিশটা নানা আকারের ছোট-বড় পাথর সাজিয়ে রেখেছে। প্রত্যেক দিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙার পর দুজন হেঁটে হেঁটে হ্রদের তীরে আসে, তারপর একটা পাথরকে গড়িয়ে গড়িয়ে হ্রদের পানিতে ফেলে দিয়ে আসে। যার অর্থ তাদের অপেক্ষার দিন আরো একটি কমেছে।
নিকি পাথরগুলোর চারপাশে ঘুরে এসে বলল, আর মাত্র সতের দিন। তারপর আমাদের সাথে থাকবে আরো শত শত মানুষ।
ত্রিপি মাথা নাড়ল, শত শত সত্যিকার মানুষ।
আমাদের দেখে তারা কী বলবে বলে মনে হয়?
মনে হয় একটু অবাক হবে।
নিকি বলল, আমাদের সেদিন সুন্দর কাপড় পরে থাকা উচিত। ক্রিনিটি বলেছে সভ্য মানুষেরা সুন্দর কাপড় পরে।
আমরা কোথায় পাব সুন্দর কাপড়?
ক্রিনিটিকে বলব তৈরি করে দিতে।
ত্রিপি মাথা নাড়ল, বলল, শুধু সুন্দর করে কাপড় পরলেই হবে না। আমাদের সুন্দর করে কথাও বলতে হবে। সুন্দর করে ব্যবহার করতে হবে।
হ্যাঁ। ক্রিনিটি বলেছে আমরা যখন তাদের সাথে খেতে বসব তখন গপগপ করে খেলে হবে না। একটু একটু করে খেতে হবে। সভ্য মানুষেরা একটু একটু করে খায়।
ত্রিপি বলল, আমাদের নক কেটে ছোট করতে হবে। শুধু অসভ্য মানুষের। বড় বড় নখ হয়।
হ্যাঁ। চুলগুলো ভালো করে ধুয়ে আঁচড়াতে হবে। সভ্য মানুষের কখনো উশখো-খুশকো চুল থাকে না।
নিকি আর ত্রিপি সভ্য মানুষের আর কী কী থাকতে হয় কী কী থাকতে হয় সেগুলো আলোচনা করতে করতে দের বালুবেলায় হাঁটতে থাকে। একটা গাছের উঁচু ডালে তখন মিক্কু বসে নিকি আর ত্রিপির দিকে তাকিয়েছিল। তার হাতে একটা রসালো ফল, সেটা কামড়ে কামড়ে খেতে খেতে অস্পষ্ট একটা শব্দ করল। নিকি আর ত্রিপি তখনো শুনতে পায় নি, কিন্তু মিক্কু শুনতে পেয়েছে। অনেক দূর থেকে একটা বাইভার্বাল আসছে।
নিকি আর ত্রিপি যখন হ্রদের এককোণায় একটা বড় গাছের গুঁড়ির কাছে এসে পৌঁচেছে তখন তারা বাইভার্বালের চাপা গর্জনটি শুনতে পেল, তারা অবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকায় আর ঠিক তখন দেখতে পায় কুচকুচে কালো একটা বাইভার্বাল আকাশ দিয়ে উড়ে আসছে। বাইভার্বালটি অতিকায়। একটা পাখির মতো তাদের মাথার উপর দিয়ে একবার উড়ে যায় তারপর গর্জন করে ধূলো উড়িয়ে কাছাকাছি নেমে আসে।
নিকি আর ত্রিপি বিস্ফারিত চোখে বাইভার্বালটির দিকে তাকিয়ে থাকে, অবাক হয়ে দেখে তার দরজা খুলে সোনালি চুল আর নীল চোখের একজন। মানুষ নেমে আসছে। মানুষটি সুদর্শন এবং হাতে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। মানুষটি তাদের দিকে কয়েকপা হেঁটে এসে থেমে গেল, জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ নিকি? ত্রিপি?
নিকি আর ত্রিপি দুজনেই মানুষটিকে চিনতে পারল, মানুষটি ফ্লিকস। যে মানুষটিকে তারা বিস্ফোরক দিয়ে মাত্র কিছুদিন আগে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল।
ফ্লিকাস হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি অবহেলার ভঙ্গিতে হাত বদল করে বলল, মনে আছে নিকি তোমাকে বলেছিলাম, তোমাকে খুঁজে বের করতে যদি আমাকে নরকেও যেতে হয় আমি সেখানে যাব? আমি এসেছি।
নিকি বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, কিন্তু-কিন্তু–
আমি বুঝতে পারছি, তুমি কী জানতে চাইছ! তুমি জানতে চাইছ আমাকে বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেবার পরেও আমি কিভাবে ফিরে এসেছি। তাই না?
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।
তুমি ভুলে গিয়েছিলে আমি হচ্ছি পঞ্চম মাত্রার রোবট। পঞ্চম মাত্রার রোবট পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যান্ত্রিক আবিষ্কার। প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় উদাহরণ। কেউ এতো বড় একটা জিনিস মাত্র একটি তৈরি করে না। কমপক্ষে দুটি তৈরি করে। তাই পৃথিবীতে ফ্লিকাস একজন ছিল না, ছিল দুজন। তুমি যখন প্রথমজনকে বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলে তখন তার কপোট্রনের সকল তথ্য দ্বিতীয় ফ্লিকাসের কপোট্রনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই ফ্লিকাসের শরীরটা ধ্বংস হয়েছে কিন্তু ফ্লিকাস ধ্বংস হয় নি। বুঝেছ?
নিকি হতচকিতের ভাবে মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি।
ফ্লিকাস হ্রদের নরম বালুবেলায় অন্যমনস্কভাবে কয়েক পা হেঁটে গাছের বড় একটা খুঁড়িতে বসে। একধরনের বিষঃ গলায় বলে, বুঝলে নিকি আর ত্রিপি। আমি খুব নিঃসঙ্গ প্রাণী। আমি জানি তোমরা আমাকে প্রাণী হিসেবে মেনে নেবে না, তোমরা বলবে আমি একটা যন্ত্র। কিন্তু আমি আসলে একটা প্রাণী। সত্যিকারের প্রাণী থেকেও আমি বেশি প্রাণী বুঝেছ?
ফ্লিকাস অস্ত্রটি হাত বদল করে বলল, আমাকে ডিজাইন করতে পাঁচ বছর সময় লেগেছে। যখন দেখেছে পৃথিবীতে আর মানুষ নেই, তখন পৃথিবীর দায়িত্ব নেবার জন্যে আমাদের প্রজন্মকে ডিজাইন করা হয়েছে। মানুষের যে সীমাবদ্ধতা ছিল আমাদের সেই সীমাবদ্ধতা নেই। সেই সীমাবদ্ধতা কি জান?
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, না।
মানুষের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে তাদের অযৌক্তিক ভালোবাসা। যেখানে ভালোবাসার কারণে তাদের ক্ষতি হতে পারে সেখানেও তারা ভালোবাসে। মানুষ মানুষকে ভালোবাসে, যন্ত্রকে ভালোবাসে। বনের পশুকে ভালোবাসে, কীট পতঙ্গকে ভালোবাসে এমনকি গাছের পাতাকেও ভালোবাসে।
নিকি জিজ্ঞেস করল, তোমরা কাউকে ভালোবাস না?
ফ্লিকাস কঠিন চোখে নির্কির দিকে তাকাল, বলল, অবশ্যই ভালোবাসি। আমাদের কপোট্রনের তুলনায় তোমাদের মস্তিষ্ক হচ্ছে একটা ছেলেমানুষি খেলনা। তোমাদের যেটুকু ভালোবাসার ক্ষমতা, আমাদের ভালোবাসা তার থেকে হাজার গুণ বেশি। কিন্তু আমাদের ভেতর অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর ভালোবাসা নেই।
নিকি কোনো কথা বলল না। ফ্লিকাস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, শুধু ভালোবাসা নয়—আমাদের কপোট্রনে অনেক নতুন নতুন অনুভূতি আছে যেটা তোমাদের নেই।
নিকি জিজ্ঞেস করল, সেগুলো কী?
তোমাদের বললে তোমরা সেগুলো বুঝবে না।
কেন বুঝব না?
তুমি কী একটা পিঁপড়াকে বিশুদ্ধ সিম্ফোনিশুনতে কেমন লাগে সেটি বোঝাতে পারবে?
নিকি মাথা নাড়ল।বলল, না।
এটাও সেরকম।
নিকি বলল, ও।
আমি জানি তোমরা বাচ্চা মানুষ, আমার কথা বুঝবে না। তবু বলি-আমার কেন জানি কথা বলতে ইচ্ছে করছে। যেমন মনে করো ভালবাসা এবং ঘৃণা। তোমাদের কাছে দুটি ভিন্ন ব্যাপার তাই না?
নিকি অনিশ্চিতের মতো বলল, হ্যাঁ।
যেটাকে তুমি ভালোবাম সেটাকে তুমি ঘৃণা করতে পার না। কিন্তু আমরা পারি। আমরা কোনোকিছুকে ভালোবাসতে পারি। কোনোকিছুকে ঘৃণা করতে পারি। আবার কোনোকিছুকে একই সাথে ঘৃণা করতে পারি ভালোবাসতে পারি। দুটিই সমান সমান। দুটিই তিব্র।
ত্রিপি জানতে চাইল, সেটার নাম কী?
তোমাদের ভাষায় এর কোনো নাম নেই, আমরা বলি রিভাল। রিভালের মতো আরেকটা অনুভুতির নাম হচ্ছে যিগ্ধা।
যিগ্ধা সেটা কী?
কোনো কোনো মানুষের মাঝে সেটা থাকে। মানুষ সেটাকে মনে করে অপরাধ। আমাদের কাছে সেটা অপরাধ না। এটা আমাদের জন্যে খুবই স্বাভাবিক একটা অনুভূতি।
নিকি কিংবা ত্রিপি কোনো কথা বলল না। ফিকামএকটু চুপ করে থেকে বলল, এই অনুভূতিটা হচ্ছে অন্য কাউকে যন্ত্রণা দিয়ে আনন্দ পাওয়া। আমাদের ভেতর সেটা আছে। আমাদের যখন প্রয়োজন হয় তখন আমরা অন্যকে যন্ত্রণা দিতে পারি, দিয়ে তীব্র আনন্দ পেতে পারি। আমি এখানে এসেছি যিগ্ধা উপভোগ করতে।
নিকি এবং ত্রিপি শিউরে উঠল, কিন্তু কিছু বলল না, ফ্লিকাসের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ফ্লিকাস কাঠের গুঁড়ি থেকে এসে কয়েক পাহদের দিকে এগিয়ে যায় কিছুক্ষণ হ্রদের পানির দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর আবার নিকি আর ত্রিপির দিকে ফিরে আসে। কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে, আস্তে আস্তে নরম, প্রায় বিষণ্ণ গলায় বলল, নিকি তুমি একজন অসাধারণ মানবশিশু। আমার মনে একজন পঞ্চম মাত্রার রোবটকে তুমি হত্যা করেছ! আমাদের ইতিহাসে সবসময় তোমার নাম লেখা থাকবে। তুমি যে নিষ্ঠুরতায় আমাকে হত্যা করেছ আমাকে তার সমান নিষ্ঠুরতায় তোমাকে হত্যা করতে হবে। যতোক্ষণ সেটা না করব পঞ্চম মাত্রার রোবটদের সম্মান ফিরে আসবে না। ফ্লিকাস নিকির দিকে তাকিয়ে বলল, নিকি! সারা পৃথিবীতে কী কেউ আছে যে তোমাকে আর তোমার এই বান্ধবীকে এখন রক্ষা করতে পারবে?
নিকি কোনো কথা বলল না। ফ্লিকাস বলল, নেই! পাহাড়ের গহরের মানুষগুলো জেগে উঠবে সতের দিন পর। আমি তাদের ঘুমন্ত অবস্থায় ধ্বংস। করতে পারি নি, কিন্তু জেগে ওঠার পর ধ্বংস করব! সেই মানুষগুলো তোমাদের রক্ষা করতে আসতে পারবে না। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে মানুষগুলো আছে তাদের মতো অসহায় জীব এই সৃষ্টিজগতে নেই! তাদের। অনেকে বড় হয়েছে বনের পশুর মতো, তাদের কোনো অনুভূতি নেই, কোনো ভাষা নেই। আমি খুঁজে বের করে তাদের একজন একজন করে হত্যা করব। এখন তারা হয়তো কেউ কেউ বেঁচে আছে কিন্তু তারা তোমাদের বাঁচানোর জন্যে আসতে পারবে না। তাহলে এই মুহূর্তে তোমাদের কে বাঁচাতে আসবে? কে?
ক্রিনিটি।
হ্যাঁ। ক্রিনিটি। ফ্লিকাস মাথা নাড়ল। তোমাদের গলায় যে মাদুলি ঝোলানো আছে সেটি আসলে একটি পঞ্চম মাত্রার ট্রাকিওশান। সে যেই মুহূর্তে জানতে পেরেছে আমি এসেছি সেই মুহূর্তে কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে ছুটে আসছে। তার ভেতরে কোনো অনুভূতি নেই। সে তৃতীয় মাত্রায় তুচ্ছ একটা রোবট। তার ভেতরে ভালোবাসা নেই, স্নেহ মমতা নেই, রিভাল নেই যিগ্ধা নেই। আছে শুধু কিছু বাঁধাধরা নিয়ম। সেই নিয়ম পালন করার জন্যে সে ছুটে আসছে। আমি ইচ্ছে করলে এই মুহূর্তে তাকে বিকল করে বনের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারি। কিন্তু আমি তাকে আসতে দিয়েছি। কেন তাকে আমি আসতে দিয়েছি তোমরা জান?
নিকি আর ত্রিপি মাথা নাড়ল, বলল, না জানি না।
আমি তাকে আসতে দিয়েছি কারণ, আমি চাই সে এখানে থাকুক। যখন আমি তোমাদের হত্যা করি তখন সে এই পুরো দৃশ্যটা দেখুক। তার কপোট্রনে সেটা জমা থাকুক, সেখান থেকে পৃথিবীর সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ুক। বুঝেছ?
নিকি আর ত্রিপি মাথা নেড়ে বলল, তারা বুঝেছে।
ফ্লিকাস তার হাতের স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটির ম্যাগাজিনটা একবার খুলে আবার লাগিয়ে পরীক্ষা করল। তার লেজার সংঙ্কেতটি একবার জ্বালিয়ে দেখল তারপর বলল, বুঝেছ নিকি, তুমি আমাদের অনেক বড় ক্ষতি করেছ। এতোটুকু একজন মানুষ হয়ে পঞ্চম মাত্রার রোবটের এতো বড় ক্ষতি করা সম্ভব আমি বিশ্বাস করি নি। কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করতে হয়েছে। পাহাড়ের গহ্বরের মানুষগুলো জেগে ওঠার আগেই আমার মেরে ফেলার কথা ছিলতোমার জন্য পারি নি। এতো ছোট বাচ্চা মাইক্রো মডিউল আর বিস্ফোরকের পার্থক্যটুকু জানে সেটি আমাদের জানা ছিল না।
এখন মানুষগুলোকে মারতে হবে গহ্বর থেকে বের হবার সময়। কাজটি কঠিন নয় কিন্তু কাজটি পরিচ্ছনও নয়। আমরা অপরিচ্ছন্ন কাজ করতে চাই না–তোমার জন্যে করতে হচ্ছে। শুধুমাত্র তোমার জন্যে।
ফ্লিকাস একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, শুধু যে গহবরের ভেতরের মানুষগুলোকে মারতে দাও নি তা নয়, তুমি আমাকেও ধ্বংস করেছ! ওরে মূখ। মানবশিশু, তুমি জান তুমি কত বড় ক্ষতি করেছ? জানার কথা নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান প্রযুক্তির আবিষ্কারটি তুমি এভাবে ধ্বংস করে দিলে? কেন?
নিকি বলল, তুমি কেন সব মানুষকে হত্যা কর?
বিবর্তনের কারণে একসময় মানুষ পৃথিবীর দায়িত্ব নিয়েছিল। এখন মানুষ নেই, এখন আমাদের পৃথিবীর দায়িত্ব নিতে হবে। যে দুই চারজন মানুষ আছে তারা একধরনের যন্ত্রণা—তাই আমরা তাদের হত্যা করছি। এটা হচ্ছে। প্রকৃতির নিয়ম। যে সবল সে টিকে থাকবে, তার টিকে থাকার জন্যে অন্যদের। সরে যেতে হবে। এটাই বিবর্তন।
ঠিক এরকম সময় বনের ভেতর থেকে ছুটতে ছুটতে ক্ৰিনিটি এসে হাজির হলো, তার হাতের অস্ত্রটি দোলাতে দোলাতে বলল, না, না তুমি কিছুতেই নিকি আর ত্রিপির ক্ষতি করতে পারবে না।
ফ্লিকাস একধরনের কৌতুকের ভঙ্গি করে বলল, আমি তাদের ক্ষতি করব, তাদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেব।
ক্রিনিটি দুই হাত বিস্তৃত করে বলল, না, তুমি সেটা করতে পারবে না। আমি তোমাকে সেটা করতে দেব না।
ফ্লিকাস হা হা করে হাসল, বলল, তৃতীয় মাত্রার একটি রোবট পঞ্চম মাত্রার একটি রবোটকে হুমকি দিচ্ছে? পৃথিবীতে এর চাইতে বড় রসিকতা কি কিছু হতে পারে?
ক্রিনিটি বলল, নিকির মা আমার হাতে নিকিকে তুলে দিয়েছিল, আমাকে বলেছিল তাকে দেখে শুনে রাখতে–
ফ্লিকাস তার হাতের অস্ত্রটি ক্রিনিটির দিকে তাক করে ট্রিগার টেনে ধরে, প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দে ক্রিনিটির যন্ত্রসহ হাতটি ভস্মিভূত হয়ে উড়ে যায়। বিস্ফোরণের ঝাঁপটায় ক্রিনিটি বালুবেলায় হুঁমড়ি খেয়ে পড়ল। নিকি আর ত্রিপি ক্রিনিটির কাছে ছুটে যাচ্ছিল তখন ফ্লিকাসের যন্ত্রটি আবার গর্জে উঠে এবং সাথে সাথে ক্রিনিটি মাটিতে আছড়ে পড়ল। তার পায়ের পাতা উড়ে গিয়ে সেখান থেকে পোড় তার টিউব আর যন্ত্রপাতি বের হয়ে এসেছে। ক্রিনিটি মাটি থেকে ওঠার চেষ্টা করতে করতে একবার নিকির দিকে তাকাল, বলল, নিকি, আমি মনে হয় তোমাকে উদ্ধার করতে পারব না।
ফ্লিকাস মাথা নাড়ল, বলল, না। তুমি পারবে না। আমি ইচ্ছে করলেই তোমার পুরো সিস্টেম বিকল করে দিতে পারি কিন্তু করি নি। আমি চাই তুমি পরের দৃশ্যটি দেখ।
নিকি ক্রিনিটির কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমার ব্যথা লাগছে ক্রিনিটি?
না আমার ব্যথা লাগছে না। আমার ব্যথা লাগার ক্ষমতা নেই। শুধু আমার সার্কিটে চাপ পড়ছে তাই সেটা জোর করে চালু করে রাখতে হচ্ছে। কতোক্ষণ রাখতে পারব আমি জানি না।
নিকির চোখে হঠাৎ পানি এসে গেল, সে ক্রিনিটির শরীরে হাত বুলিয়ে বলল, আমি দুঃখিত ক্রিনিটি। আমি খুবই দুঃখিত। আমার জন্যে তোমার এতো কষ্ট হচ্ছে—
ঠিক তখন কঁ কঁ করে ডাকতে ডাকতে কিকি মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়। নিকি উপরে তাকাল বলল, কিকি আমাদের খুব বিপদ। খুব বড় বিপদ। এই লোকটা ক্রিনিটিকে মেরে ফেলছে।
কিকি কঁ কঁ করে ডাকতে ডাকতে বনভূমির দিকে উড়ে গেল।
ফ্লিকাস মুখে একধরনের কৌতুকের হাসি নিয়ে পুরো দৃশ্যটি দেখছিল, সে এবারে হা হা করে হেসে বলল, চমৎকার একটি নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে! তৃতীয়। মাত্রার একটি রোবট আহত এবং তার জন্যে সমবেদনায় মানবশিশুর চোখে অশ্রুজল! শুধু তাই নয়, সে এই দুঃখের কাহিনীটা বলছে কালো কুৎসিত একটা পাখিকে। ফ্লিকাস হাসতে হাসতে হঠাৎ হাসি থামিয়ে ফেলে, দেখতে দেখতে তার মুখ কঠিন হয়ে ওঠে, সে হিংস্র চোখে নিকির দিকে তাকিয়ে বলল, নিকি, বলো এই পৃথিবীটা কার? রোবটের না মানুষের? তোমার না আমার?
আমার।
যদি তোমার হয় তাহলে কে তোমাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে?
নিকি কোনো কথা বলল না, স্থির চোখে ফ্লিকাসের দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্লিকাস খুব ধীরে ধীরে তার অস্ত্রটি উপরে তুলে ধরে সেটি নিকির বুকের দিকে তাক করে হিস হিস করে বলল, কে তোমাকে রক্ষা করবে নিকি? ত্রিপি? কে তোমাদের রক্ষা করবে?
নিকি কোনো কথা বলল না। ফ্লিকাস শীতল গলায় বলল, আমার কথার উত্তর দাও, যদি এই পৃথিবীটা তোমার হয় তাহলে এই পৃথিবীর কে তোমাকে রক্ষা করতে আসবে? কে?
খুব ধীরে ধীরে নিকির মুখে হাসি ফুটে উঠল, সে নিচু গলায় বলল, আমার বন্ধুরা।
ফ্লিকাস অবাক হয়ে বলল, তোমার বন্ধুরা? তারা কোথায়?
আসছে। তারা আসছে।
কোথা থেকে আসছে?
তাকিয়ে দেখ।
ফ্লিকাস তাকাল, দেখল বনভূমির উপর থেকে পাখি উড়ে আসছে। একটি দুটি পাখি নয়, হাজার হাজার পাখি লক্ষ লক্ষ পাখি। তাদের লাল চোখ। ধারালো ঠোঁট। তারা তাদের শক্তিশালী পাখা বাতাসে ঝাঁপটা দিতে দিতে উড়ে আসছে। তারা স্থির নিশ্চিত জানে তাদের কী করতে হবে। তাদের ভেতরে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই।
ফ্লিকাস হতবুদ্ধির মতো তার অস্ত্রটি পাখিদের দিকে তুলে ধরল, একবার ট্রিগার টেনে ধরার জন্যে দুর্বল ভাবে চেষ্টা করল, কিন্তু তার আগেই লক্ষ লক্ষ পাখি ফ্লিকাসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের তীক্ষ্ণ ধারালো ঠোঁট দিয়ে তারা ফ্লিকাসের চোখে, মুখে, দেহে আঘাতের পর আঘাত করতে শুরু করেছে।
ফ্লিকাস একটা আর্তনাদ করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল হাজার, হাজার, লক্ষ, লক্ষ পাখি তাকে ঘিরে রইল, আঘাতের পর আঘাত করে তাকে মাটি থেকে উঠতে দিল না। ফ্লিকাসের কাতর আর্তনাদ পাখিদের তীক্ষ্ণ চিৎকারে চাপা পড়ে গেল।
পাখিগুলো যখন উড়ে গেল তখন নিকি আর ত্রিপি এগিয়ে যায়। ছিন্নভিন্ন কিছু দুমড়ে মুচড়ে থাকা ধাতব যন্ত্রপাতির অবশিষ্টাংশ ছাড়া আর কিছু নেই। নিকি ভয়ে ভয়ে এদিক-সেদিক তাকাল, তার মনে হলো হঠাৎ করে ফ্লিকাসের ছিন্ন মাথা বুঝি খলখল করে হেসে উঠবে। কিন্তু কেউ খলখল করে হেসে উঠল না।
নিকি ত্রিপির দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। ত্রিপি তাকে জাপটে ধরে বলল, নিকি আমরা বেঁচে গেছি।
হ্যাঁ। পৃথিবীতে আমরা থাকব।
তাদের মাথার উপর দিয়ে কিকি ক ক শব্দ করে উড়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে তার ঘাড়ের ওপর বসল। নিকি আদর করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কিকি যখন সব মানুষেরা আসবে তখন আমি তাদের বলব তোমাকে আর তোমার পাখির দলকে মেডেল দিতে।
কিকি বলল, কঁ কঁ। নিকি মাথা নাড়ল, বলল, না বোকা। মেডেল খাবার জিনিস না।
কিকি উড়ে যাবার পর নিকি ক্রিনিটির কাছে গিয়ে বসে, তার দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে যাওয়া হাত পায়ে হাত বুলিয়ে বলল, ক্রিনিটি তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি আর ত্রিপি গিয়ে বাইভার্বালটি নিয়ে আসছি। তোমাকে নিয়ে যাব। তোমাকে আবার আমরা নতুনের মতো করে ফেলব।
১৩. শেষ কথা
বিশাল কালো টেবিলের একপাশে মাঝবয়সী একজন মহিলা বসে আছেন, তার। সামনে একটা ক্রিস্টাল রিডার। তার কাছাকাছি আরো বেশ কিছু নানাবয়সী মানুষ। টেবিলের অন্যপাশে নিকি চুপ করে বসে আছে।
মাঝবয়সী মহিলা হাত দিয়ে তার চুলগুলোকে পেছনে সরিয়ে বলল, নিকি। ক্রিনিটি নামে যে রোবটটি তোমার দেখাশোনা করতে সে তার দিনলিপি আমাদের দিয়েছে। তোমাকে কিভাবে বড় করা হয়েছে তার সব। খুঁটিনাটি সেখানে আছে। বিশেষ করে পঞ্চম মাত্রার রোবটের ষড়যন্ত্র তুমি যেভাবে বানচাল করেছ, যেভাবে তাদের ধ্বংস করে পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করেছ সেই বিষয়গুলো আমরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। তোমার চিন্তাভাবনার ধরন, কাজের প্রকৃতি, বাস্তব বুদ্ধি ধৈর্য এবং সাহস দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছি।
নিকি চুপ করে কথাগুলো শুনল, কোনো উত্তর দিল না। মাঝবয়সী মহিলা চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, তুমি নিশ্চয়ই জান পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় হিমঘরে লুকিয়ে রাখা মানুষদের জাগিয়ে তোলা শুরু হয়েছে। দেখতে দেখতে আমরা কয়েক হাজার মানুষের একটা সম্প্রদায় হয়ে যাব। এই মানুষদের জীবন পদ্ধতি পরিচালনার জন্যে আমাদের একটা সুপ্রিম কাউন্সিল গঠন করা প্রয়োজন। সেখানে এগারজ সদস্য থাকবে, আমরা তোমাকে তার একজন সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিতে চাই। যদিও তোমার বয়স মাত্র সাত কিন্তু আমরা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছি যে তোমার মানসিক পরিপক্কতা আমাদের সমান সমান। আশা করছি তুমি আমাদের জন্যে এই দায়িত্বটি পালন করবে।
নিকি বলল, আমি?
মহিলাটি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, হ্যাঁ তুমি। পৃথিবীতে মানুষকে ঠিকভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আমাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা কী নিউক্লিয়ার শক্তি ব্যবহার করব না নবায়নশীল শক্তির দিকে যাব। মহাকাশ গবেষণায় কতোটুকু শক্তি দেব, শিক্ষা কিভাবে হবে, পরিবেশের। সাথে সম্পর্ক কেমন হবে—সব ব্যাপারে তোমার মতামত নিতে হবে। তোমাকে পূর্ণ সদস্যের মর্যাদা দেওয়া হবে। তুমি সব ধরনের সহযোগিতা, বাসভবন–
নিকি মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল, তোমাদের সাহায্য করতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু–
কিন্তু কী?
আমি তো খুব ব্যস্ত, তাই তোমাদের সময় দিতে পারব না।
মধ্যবয়স্কা মহিলাটি ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কী নিয়ে ব্যস্ত?
হ্রদের উপরে একটা গাছ থেকে আমরা একটা মোটা দড়ি ঝুলিয়েছি, সেই দড়ি ধরে ঝুল খেয়ে আমরা পানিতে লাফ দিই। ভারি মজা হয় এখন। আগে তো শুধু আমি আর ত্রিপি ছিলাম—এখন আমাদের সাথে কুশ, লিবান, রিহা, ক্রন, নুশা, রিশ, ক্রিপাল এরা সবাই আছে। এখন আরো অনেক বেশি মজা হয়। সে জন্যে খুব ব্যস্ত।
মধ্যবয়স্কা মহিলাটি বিস্ফারিত চোখে নিকির দিকে তাকিয়ে রইল, আস্তে আস্তে বলল, গাছ থেকে দড়ি।
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। মাঝে মাঝে খুব ঝামেলা হয়। কুশ হচ্ছে অসম্ভব দুষ্টু, সেদিন রিহাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিয়েছে। অনেক রকম সমস্যা।
অনেক রকম সমস্যা?
হ্যাঁ। সবাই আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।
মধ্যবয়স্কা মহিলা আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ নিকি, আমি বুঝতে পারছি তুমি খুবই ব্যস্ত। এবং তোমাকে অনেক ধরনের সমস্যার সমাধান করতে হয়। আমরা তাহলে তোমাকে আটকে রাখব না।
নিকি লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে বলল, আমি কি তাহলে যেতে পারি?
হ্যাঁ। তুমি যেতে পার।
নিকি বলল, তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। তারপর কেউ কিছু বোঝার আগে দরজা খুলে ছুটে বের হয়ে গেল। ঘরের সবাই জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, দেখল সাত বছরের একটা শিশু মাঠের ভেতর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। ছুটতে ছুটতে সে তার সার্ট খুলে হাতে ধরে মাথার উপর ঘোরাতে ঘোরাতে চিৎকার করে করে নাড়ছে, তার সজীব দেহ সূর্যের আলোতে চকচক করছে।
ঘরের ভেতর বসে থাকা মানুষগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে অপরাধীর মতো একটু হাসল। কমবয়সী একজন বলল, আমরা মনে হয় এখনো বেঁচে থাকার অর্থ কী সেটা বুঝে উঠতে পারি নি।
মধ্যবয়স্কা মহিলাটি বলল, না। পারি নি।
এই ছেলেটা পেরেছে।
হ্যাঁ। এই ছেলেটা পেরেছে।
ক্রিনিটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে একটা উঁচু ঢিবির উপর দাঁড়িয়ে দূরে তাকিয়ে থাকে। হ্রদের উপর একটা গাছ থেকে মোটা একটা দড়ি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে ঝুলে ঝুলে অনেকগুলো শিশু পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এতো দূর থেকেও তাদের আনন্দ ধ্বনি স্পষ্ট শোনা যায়।
ক্রিনিটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শিশুগুলোকে দেখে। একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখার কোনো অর্থ নেই। কিন্তু ক্রিনিটি সরে যেতে পারে না, সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে। বিশেষ করে যখন নিকির একটা উল্লাস ধ্বনি শুনতে পায় তার ভেতরে কোনো একটা কিছু ঘটে যায়।
কী ঘটে সে বুঝতে পারে না। সম্ভবত তার কপোট্রনে কোনো এক ধরনের টি ঘটেছে।
নিকি বলে এই ত্রুটির নাম হচ্ছে ভালোবাসা। নিকি নেহায়েত ছেলেমানুষ, শুধু তার মুখ থেকেই এরকম পুরোপুরি যুক্তিহীন, অর্থহীন, হাস্যকর এবং ছেলেমানুষী কথা শোনা সম্ভব।
শুধু তার মুখ থেকেই।
———-