যদি মহাকাশযানের মূল কম্পিউটার সত্যি সত্যি জ্বালানিটুকু এই তরল অক্সিজেনের ভিতর দিয়ে টেনে বের করে নিতে পারে তবে এই মহাকাশযানটি এ যাত্রা বেঁচে যাবে। কিহি নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে, তার মনে হতে থাকে যদি সে নিশ্বাস ফেলে তাহলেই জ্বালানির টিউবটি ফেটে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মহাকাশযানটি ধ্বংস হয়ে যাবে।
কিহির ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে ক্রিটন শান্ত গলায় বলল, মহাকাশযানটি যে কোনো মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাবে। এটি রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা দশমিক শূন্য শূন্য নয় তিন।
কিহি ক্রিটনের কথার উত্তর দিল না। ক্রিটন আবার বলল, যখন বিস্ফোরণ হবে তখন মূল শকওয়েভ প্রথম আঘাত করবে কন্ট্রোলরুমকে। আমরা তখন ছিটকে মহাকাশে গিয়ে পড়ব—
কিহি দাঁতে দাঁত চেপে বসে থেকে তীক্ষ্ণ চোখে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে রইল। জ্বালানিটি ধীরে ধীরে টিউবের মাঝে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, যে–কোনো মুহূর্তে টিউবটি ফেটে যেতে পারে, এখনো যে ফেটে যায় নি সেটি একটি বিস্ময়। জ্বালানির চাপ ক্রমশ বাড়ছে, মনিটরটির ডান দিকে যেখানে চাপের পরিমাণ সংখ্যায় লেখা রয়েছে সেদিকে তাকাতে কিহির এক ধরনের আতঙ্ক হতে থাকে। সে নিজের অজান্তে দুই হাত বুকের কাছে এনে ফিসফিস করে বলল, হে ঈশ্বর! তুমি রফর–তুমি রক্ষা কর!
ক্রিটন একটু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কী বলছেন মহামান্য কিহি?
কিহি ক্রিটনকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে দু হাত আরো জোরে বুকের কাছে চেপে ধরে আবার ফিসফিস করে বলল, হে ঈশ্বর! হে সর্বশক্তিমান। তুমি রক্ষা কর। রক্ষা কর।
ক্রিটন আরো ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কী বলছেন মহামান্য কিহি? ঈশ্বর কে? সে কোথায়? আপনি তার সাথে কেমন করে কথা বলছেন?
কিহি ক্রিটনকে উপেক্ষা করে চোখ বন্ধ করে আবার ফিসফিস করে বলল, হে ঈশ্বর। দয়া কর দয়া কর
প্রায় তিরিশ মিনিট পর যখন সত্যি সত্যি অবশিষ্ট জ্বালানিটুকু তরল অক্সিজেনের ভিতর দিয়ে টেনে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হল তখনো কিহি সেটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিল না, সে রুদ্ধশ্বাসে মনিটরটির দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। যখন শেষ পর্যন্ত মনিটরটির বিপদ কেটে যাওয়ার সবুজ সঙ্কেত জ্বলে উঠল, কিহি তার বুকের ভিতর থেকে আটকে থাকা একটি নিশ্বাস সাবধানে বের করে দিল। সত্যি সত্যি যে মহাকাশযানটি রক্ষা পেয়েছে এবং জিরকনিয়ামের আকরিকসহ সেটি যে ছিন্নভিন্ন হয়ে মহাকাশে উড়ে যায়। নি সেই ব্যাপারটি এখনো তার বিশ্বাস হতে চাইছে না। কিহি কপাল থেকে ঘাম মুছে খুব সাবধানে তার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করল।
ক্রিটন কিহির খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল। এবারে মাথা নিচু করে বলল, মহাকাশযানটির রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল খুব কম কিন্তু তবু সেটা রক্ষা পেয়েছে।
কিহি কোনো কথা না বলে এবং চোখ না খুলেই সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ল।
ক্রিটন জিজ্ঞেস করল, তুমি কীভাবে সেটা করলে?
কিহি চোখ খুলে বলল, আমি কীভাবে কী করেছি?
তুমি কীভাবে মহাকাশযানটি রক্ষা করলে?
আমি মহাকাশযানটি রক্ষা করি নি।
তাহলে কেমন করে এটি রক্ষা পেল?
কিহি মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি না।
ক্রিটন তার ভাবলেশহীন ধাতব মুখ উপরে তুলে বলল, তুমি নিশ্চয়ই জান। কারণ আমি দেখেছি তুমি হাত বুকের কাছে নিয়ে ঈশ্বর নামের কোনো একজনের কাছে মহাকাশযানটিকে রক্ষা করতে বলেছ।
কিহি আবার মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, তা বলেছি।
ঈশ্বর কি মূল কম্পিউটারের নূতন কোনো প্রোগ্রাম?
কিহি সাধারণত রবোটদের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না, কিন্তু এইমাত্র এত বড় অবশ্যম্ভাবী একটা বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে তার হঠাৎ কথা বলার ইচ্ছে করছে। সে ক্রিটনের কথায় হেসে ফেলে বলল, না, ঈশ্বর কোনো কম্পিউটার প্রোগ্রাম নয়।
তাহলে সেটি কী? তুমি কেমন করে তার সাথে যোগাযোগ করলে? সে কেমন করে মহাকাশযানটি রক্ষা করল?
কিহি নরম গলায় বলল, ঠিক কী কারণ কেউ জানে না, কিন্তু মানুষ সব সময় বিশ্বাস করে এসেছে এই পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছে। সেই সৃষ্টিকর্তাকে মানুষ নাম দিয়েছে ঈশ্বর। মানুষ বিশ্বাস করে সেই ঈশ্বর সব মানুষকে ভালবাসে, বিপদে রক্ষা করে, দুঃখে সান্ত্বনা দেয়।
ক্রিটনের বিস্মিত হবার ক্ষমতা নেই বলে সে কোনো বিস্ময় প্রকাশ করল না, শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, এই বিশ্বাসের পিছনে কি কোনো যুক্তি আছে?
না যুক্তি নেই। এটি পুরোপুরি বিশ্বাস।
মানুষের মতো একটি উন্নত প্রাণী যুক্তিহীন একটি ব্যাপার কেমন করে বিশ্বাস করে?
সত্যিকারের বিশ্বাস যুক্তির জন্যে অপেক্ষা করে না। মানুষ ঈশ্বর নামে একজনকে বিশ্বাস করে, কারণ যখন তার আর অন্য কিছু করার থাকে না তখন সে ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিতে পারে, তার কাছে প্রার্থনা করতে পারে।
ক্রিটন হঠাৎ কিহির দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস কর?
কিহি হেসে মাথা নাড়ল, বলল, সাধারণত আমি ঈশ্বর নিয়ে মাথা ঘামাই না। তবে যখন খুব বড় বিপদ হয় তখন তাকে ডাকাডাকি করি।
ক্রিটন কন্ট্রোলরুমের মাঝামাঝি খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর তার বিশেষ ধরনের যান্ত্রিক গলায় বলল, আমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি।