আমি হতবাক হয়ে সামনে তাকিয়ে রইলাম। দেখতে পেলাম মহাকাশচারীরা অগ্নিবৃষ্টি করতে করতে আমাদের সবাইকে ধ্বংস করতে করতে এগিয়ে আসছে। এগিয়ে আসছে ….. এগিয়ে আসছে …।
***
মহাকাশযানের দ্বিতীয় অফিসার মৃত থলথলে প্রাণীগুলোর দিকে বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, কী কুৎসিত প্রাণী!
ক্যাপ্টেন তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি ভাজ করতে করতে বলল, বেশি থেঁতলে যায় নি। এ রকম একটা দুইটা প্রাণী আলাদা কর দেখি পৃথিবীতে নিয়ে যাই দেখাতে।
মহাকাশচারীরা মুখ কুঁচকে মোটামুটি অক্ষত একটা প্রাণী খুঁজতে থাকে।
ঈশ্বর
কিহি মহাকাশযানে তার নিজের ভরশূন্য ঘরে কৃত্রিম মহাকর্ষ বল তৈরি করে কালো ক্যাপসুলে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ঘুমিয়েছিল, তাই বিপদ সঙ্কেতের প্রাথমিক এলার্মের শব্দটি শুনতে পায় নি। এলার্মের দ্বিতীয় পর্যায়ের শব্দটি প্রথম পর্যায় থেকে অন্তত দশ ডি. বি. বেশি তীক্ষ্ণ, তার বিকট শব্দে সে ধড়মড় করে উঠে বসল। মহাকাশযাত্রীদের স্নায়ু সাধারণ মানুষের স্নায়ু থেকে শক্ত, তাই ঘুম থেকে উঠে হতচকিত হয়ে বসে রইল না, দ্রুত নিও পলিমারের স্পেস–সুটটা গায়ে গলিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল। এই বিশাল মহাকাশযানটিতে সে একমাত্র মানুষ, ঘর থেকে সম্পূর্ণ নিরাভরণ অবস্থায় বের হয়ে এলেও তাকে কারো কুটি দেখতে হবে না, কিন্তু দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ মহাকাশচারী হিসেবে সে জানে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পূর্ণাঙ্গ মহাকাশচারীর পোশাক অনেক সমস্যার দ্রুত সমাধান বের করে দিতে পারে।
পোশাকের সুফলটি সে প্রায় সাথে সাথে টের পেল। করিডোর ধরে ছুটতে ছুটতে সে মহাকাশযানের বিভিন্ন স্টেশনে কর্মরত রবোটগুলোকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে নিকটবর্তী মহাকাশ স্টেশনে যোগাযোগ করে ফেলল। মূল লিফটে করে কন্ট্রোল স্টেশনে যেতে যেতে সে মহাকাশযানের বিপদ সঙ্কেতটি কী কারণে তীক্ষ্ণ স্বরে বাজতে শুরু করেছে সেটা আন্দাজ করতে শুরু করে। মহাকাশযানের মূল জ্বালানি নিয়ে কোনো একটা সমস্যা হয়েছে, কী ধরনের সমস্যা সেটি কন্ট্রোলরুমে পৌঁছানোর আগে সে জানতে পারবে না।
কিহি কন্ট্রোলরুমে পৌঁছানোর আগেই সমস্যার গুরুত্বটা বুঝে ফেলল, কারণ ততক্ষণে সারা মহাকাশযানে তৃতীয় মাত্রার বিপদ সঙ্কেত বেজে উঠতে শুরু করেছে। তৃতীয় মাত্রার বিপদ সঙ্কেত বাজতে শুরু করে যখন সমস্ত মহাকাশযানের নিরাপত্তা নিয়ে বিপজ্জনক একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মহাকাশযানের মূল জ্বালানির কেন্দ্রস্থলে সম্ভবত কোনোভাবে আঘাত এসেছে–কোনো ছোট গ্রহকণা, কোনো মহাজাগতিক প্রস্তর, কোনো ছোট ধূমকেতুর সাথে হয়তো একটা বিপজ্জনক সংঘর্ষ ঘটে গেছে।
কিহি কন্ট্রোলরুমে এসে আবিষ্কার করল সপ্তম স্তরের দায়িত্বাধীন রবোট ক্রিটন কন্ট্রোলরুমে এসে উপস্থিত হয়েছে। কিহিকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, কিহি, মহাকাশযানটি সম্ভবত ধ্বংস হয়ে যাবে, এই মাত্র তৃতীয় মাত্রার বিপদ সঙ্কেত বাজতে শুরু করেছে।
কিহি ক্রিটনের দিকে তাকাল, তার কণ্ঠস্বরে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ বা আশঙ্কার চিহ্ন নেই– থাকার কথাও নয়। ধাতব মূর্খ সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন। ক্রিটন আবার নিরুত্তাপ গলায় বলল, জ্বালানি কেন্দ্র বিধ্বস্ত হয়েছে।
কতটুকু?
একটা ছোট গ্রহকণা আঘাত করেছিল, তার গতিবেগ ছিল–
কিহি অধৈর্য গলায় বলল, কীভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে আমি জিজ্ঞেস করি নি, কতটুকু বিধ্বস্ত হয়েছে জিজ্ঞেস করেছি।
কিন্তু কীভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে না বলা হলে কতটুকু বিধ্বস্ত হয়েছে সেটা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। একটির সাথে আরেকটি সম্পর্কযুক্ত–
কিহি অনেক কষ্টে নিজের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে না দিয়ে শান্ত গলায় বলল, আমি যা প্রশ্ন করব তার বাইরে কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই। জ্বালানি কেন্দ্র কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে?
বড় রিজারভয়ারটি উড়ে গেছে, মাঝারি রিজারভয়ার থেকে জ্বালানি ফেটে যাওয়া সংযোগ টিউব দিয়ে মহাকাশে উড়ে যাচ্ছে মিনিটে এক শতাংশ হিসেবে। এভাবে চলতে থাকলে এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট পরে এই মহাকাশযানটি বৃহস্পতির আরো একটি উপগ্রহ হয়ে যাবে–
কী হবে আমি সেটা তোমার কাছে জানতে চাই নি। কিহি বিরক্ত হয়ে বলল, আমি যেটা জানতে চাইছি শুধু সেটা বলবে। মূল কম্পিউটার এখন কী করছে?
সেফটি বালবগুলো বন্ধ করে দিয়েছে।
অক্সিলারি টিউবগুলো?
সেগুলো এখনো খোলা। একসাথে সবগুলো বন্ধ করা সম্ভব নয়। সবগুলো একসাথে বন্ধ করা হলে—
কিহি ক্রিটনের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে কন্ট্রোলরুমের প্যানেলের সামনে ঝুঁকে পড়ল। মূল কম্পিউটার চতুষ্কোণ প্যানেলে জ্বালানি কেন্দ্রের অবস্থানটি দেখাচ্ছে, মূল অংশটি বিধ্বস্ত, অন্যান্য অংশগুলো থেকে জ্বালানি রক্ষা করার জন্যে সরবরাহ টিউবগুলো বন্ধ করা হচ্ছে। ডান পাশে প্রতি সেকেন্ডে কী পরিমাণ জ্বালানি মহাকাশে উড়ে যাচ্ছে তার একটি গ্রাফ আঁকা। আছে। গ্রাফটি ভীতিকর।
কিহি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা রাখে, ভয়ঙ্কর বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে বলে তার সুনাম রয়েছে কিন্তু এই পরিবেশে হঠাৎ করে সে আবিষ্কার করল ব্যাপারটি তার জন্যেও কঠিন। বিস্ফোরণটি পুরো মহাকাশযানটিকে এক ভয়াবহ দুর্যোগের মাঝে এনে হাজির করেছে। তরল বিস্ফোরকের কাছাকাছি তরল অক্সিজেনের একটি ট্যাংক রয়েছে, একটি আরেকটির সংস্পর্শে হাজির হলে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সমস্ত মহাকাশযানটি ধ্বংস হয়ে যাবে। কিহি মনিটরে দেখতে পায় একটি সরু টিউব করে তরল জ্বালানিকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে, সেটি প্রবাহিত হচ্ছে তরল অক্সিজেনের মাঝে দিয়ে। সেফটি ভালবগুলো বন্ধ করে রাখায় তরল জ্বালানিকে সরিয়ে নেয়ার এই একটি মাত্র উপায়। টিউবটি ক্ষতিগ্রস্ত, যেটুকু চাপ সহ্য করার কথা ইতিমধ্যে চাপ তার থেকে অনেক বেশি, যে–কোনো মুহূর্তে সেটা ফেটে যেতে পারে। যদি ফেটে যায় সাথে সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মহাকাশযানটি ধ্বংস হয়ে যাবে।