আমি বৃদ্ধ রুককে থামিয়ে বললাম, সেটি কখনোই হবে না রুক। আমি মহাকাশযানটিকে দেখেছি, কী অপূর্ব তার গঠন, কী বিচিত্র তার উড়ে যাবার ভঙ্গি, কী চমৎকার তার গুমগুম শব্দ। যে মহাকাশচারীরা এত সুন্দর একটা মহাকাশযানে করে মহাকাশ পারাপার করতে পারে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে উড়ে যেতে পারে, তাদের অনুভূতি, মূল্যবোধ আমাদের থেকে ভিন্ন হতে পারে না।
উপস্থিত যারা ছিল তারা সবাই আবার সম্মতিসূচকভাবে একটা শব্দ করল। রুক কোমল গলায় বলল, ত্রিতুন ঠিকই বলেছে।
মা বললেন, চল আমরা সেই মহাকাশচারীদের দেখতে যাই।
রুক একটু ইতস্তত করে বলল, আমাদের কি একটু অপেক্ষা করা উচিত না? একটু খোঁজখবর নিয়ে–
কমবয়সী রুকু গলা উঁচিয়ে বলল, না রুক। আমরা এখনই যেতে চাই।
এখনই?
হ্যাঁ এখনই। একসাথে অনেকে বলল, আমরা এখনই যেতে চাই।
রুক হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে আমরা এখনই যাব। পাহাড়ের ওপাশে যাওয়া কিন্তু খুব সহজ নয়, তোমরা সবাই একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও। আমরা রুশকা গ্রহের আড়াল থেকে আলোতে বের হয়ে এলে রওনা দেব।
মা জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কি মহাকাশচারীদের জন্যে কোনো উপহার নিয়ে যাব রুক?
হ্যাঁ–রুক বলল, আমাদের উপহার নিতে হবে। পাহাড়ের নিচে যে আলোকিত স্ফটিকগুলো আছে আমরা সবাই সেগুলো একটা করে নিয়ে যাব। মনে থাকবে তো সবার?
আমরা সমস্বরে বললাম, মনে থাকবে।
.
অন্ধকার কেটে যখন আলো হয়ে গেল আমরা সবাই তখন পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকি। বড় গ্রহটি যখন আমাদের পিছনে সরে গেল তখন দৈনন্দিন চৌম্বক ঝড়টি শুরু হয়ে যায়, আমরা তখন পাহাড়ের পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রইলাম। ঝড়টা কেটে যাবার পর আবার আমরা যখন রওনা দিয়েছি তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। আমাদের মাঝে যারা কমবয়সী তারা আগে আগে চলে গিয়ে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আবার অধৈর্য হয়ে পিছনে ফিরে আসছিল। আমাদের মাঝে বয়স হয়ে যাওয়াতে রুক সবচেয়ে বেশি দুর্বল, তার জন্যেই আমাদের সবচেয়ে বেশি দেরি হতে থাকে।
পাহাড়ের উপরে উঠে আমরা সবাই নিচে উপত্যকায় মহাকাশযানটি দেখতে পেলাম। লালচে পাথরের পটভূমিতে সেটি দেখতে অপূর্ব দেখাচ্ছিল। মা মুগ্ধ গলায় বললেন, আহা কী সুন্দর!
রুতু বলল, রুক আমরা কেন মহাকাশযান তৈরি করে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে যেতে পারি না?
রুক নরম গলায় বলল, যাব, আমরাও যাব। সময় হলেই যাব। এই যে ভিন্ন গ্রহ থেকে মহাকাশচারীরা এসেছে, আমরা তাদের সাথে সম্পর্ক করব। তাদেরকে দেব আমাদের সম্পদ, তারা আমাদের দেবে তাদের সম্পদ, তাদের জ্ঞান বিজ্ঞান।
যদি তারা দিতে না চায়?
কেন দেবে না? অবশ্যি দেবে। জ্ঞান হচ্ছে সবার জন্যে। যে প্রথম সেটা অর্জন করে সে সবাইকে সেটা পৌঁছে দেয়। সেটাই নিয়ম।
মা বললেন, হ্যাঁ। সেটাই নিয়ম।
পাহাড় থেকে নিচে নেমে আসতে আমাদের আরো অনেকক্ষণ লেগে গেল, দ্বিতীয় চৌম্বক ঝড়টি শুরু হওয়ার আগেই আমরা নিচের উপত্যকায় নেমে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু সেটা সম্ভব হল না। পাহাড়ের এই এলাকায় ঝড়ের তীব্রতা অনেক বেশি, আমাদের সবাইকে পাথরের আড়ালে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকতে হল।
ঝড় সরে যাবার পর আমরা পাহাড়ের আড়াল থেকে বের হয়ে এসে আবার মহাকাশযানটির দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। আমরা যতই তার কাছে এগিয়ে যেতে থাকি সেটা যেন ততই তার সৌন্দর্য নিয়ে বিকশিত হয়ে উঠতে থাকে।
মহাকাশযানটির খুব কাছাকাছি এসে রুক বলল, এখন সবাই থাম। আমরা বেশ কাছাকাছি চলে এসেছি, মহাকাশযানের অভিযাত্রীরা এখন নিশ্চয়ই আমাদের দেখতে পেয়েছে।
রুকু বলল, আমরা উপহারটা কী করব?
এখন ধরে রাখ। যখন তারা আমাদের কাছাকাছি আসবে তখন আমরা তাদের দিকে এগিয়ে দেব।
রুকের কথা শেষ হবার আগেই মহাকাশযানের নিচের দিকে গোলাকার একটা অংশ হঠাৎ করে খুলে গেল। আমরা অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম, দেখতে পেলাম গোলাকার গর্ত থেকে কয়েকজন মহাকাশচারী বের হয়ে এল। আমি অবাক হয়ে দেখতে পেলাম তাদের গোলাকার মাথা, চতুষ্কোণ দেহ এবং সিলিন্ডারের মতো দুই পায়ের উপর। দাঁড়িয়ে আছে। দেহের দুই পাশে দুটি হাত, তার একটিতে কালো নলের মতো কিছু একটা ধরে রেখেছে।
মা ফিসফিস করে বললেন, কী বিচিত্র চেহারা দেখেছ?
রুক বলল, এটা তাদের সত্যিকার চেহারা নয়। এরা মহাকাশ অভিযানের পোশাক পরে আছে। সত্যিকার চেহারা পোশাকের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে।
রুতু উত্তেজিত গলায় বলল, আমি আবছা আবছা তাদের চেহারা দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে দেখার জন্যে তাদের একজোড়া চোখ রয়েছে।
মা বললেন, মাত্র একজোড়া?
মহাকাশের অভিযাত্রীরা আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে হাতের কালো মতন নলটি হঠাৎ উঁচু করে ধরে এবং কেন জানি না হঠাৎ আমি এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে শুরু করি। আমি মায়ের কাছে সরে গিয়ে ফিসফিস করে ডাকলাম, মা।
কী হয়েছে ত্ৰিতুন?
আমার ভয় করছে মা।
ভয় করছে?
কেন?
মহাকাশের অভিযাত্রীরা কালো মতন নলগুলো আমাদের দিকে তাক করে রেখেছে। কেন? কী সেগুলো?
ওগুলো কিছু নয়। মা তার গুঁড়গুলো দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ভয় কী আমার সোনা!
আমি মায়ের আড়ালে লুকিয়ে গিয়ে আমার সামনের চোখগুলো একটি একটি করে বন্ধ করতে শুরু করি, ঠিক তখন একটা তীক্ষ্ণ শিসের মতো শব্দ শুনতে পেলাম। আমি চমকে উঠে একসাথে আমার সবগুলো চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলাম মহাকাশচারীদের হাতের কালচে নল থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুটে আসছে। আমি আবার একটা তীক্ষ্ণ শিসের মতো শব্দ শুনতে পেলাম, সাথে সাথে কী একটা যেন আমার মাকে আঘাত করল। মা একটা কাতর আর্তনাদ করে হঠাৎ লুটিয়ে পড়লেন, আমি অবাক হয়ে দেখলাম তার কোমল দেহাবরণ ছিন্নভিন্ন হয়ে দেহের ভিতরের সবুজ সঞ্জীবনী তরল ছিটকে ছিটকে বের হয়ে আসছে।