মেয়েটি বলল, অবশ্যি পারব। আমি কত সহজে এটা দিয়ে আঘাত করতে পারি।
এত সোজা নয়।
তোমরা দেখতে চাও?
দেখাও দেখি।
তাহলে মাস্কিট্রনটা এগার পয়েন্টে সেট কর।
মেয়েগুলো তাদের মাথায় লাগানো মাস্কিট্রন হাত দিয়ে ঠিক করতে শুরু করে, থিরু জিজ্ঞেস করলেন, মাস্কিট্রন এগার পয়েন্ট সেট করলে কী হয়?
বীভৎস রক্তারক্তি বা হিংস্র কাজকর্মগুলোকে পবিত্র কাজ বলে মনে হয়।
থিরু জিজ্ঞেস করলেন, এখন কি বীভৎস কোনো কাজ করা হবে?
যে মেয়েটির হাতে লোহার রড, সে দুই হাতে শক্ত করে রডটি ধরে থিরুর দিকে এগিয়ে এল। থিরু আতঙ্কে শিউরে উঠে দেখলেন মেয়েটির মুখে সত্যিই কোমল স্নিগ্ধ একটি পবিত্র ভাব।
.
সমুদ্রের বালুবেলায় একটি বৃদ্ধের রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখে প্রাতঃভ্রমণকারী একজন মানুষ দ্রুত মাস্কিট্রনটি চৌদ্দ পয়েন্টে সেট করে নিল। মাস্কিট্রন চৌদ্দ পয়েন্টে সেট করা হলে ভীতিকর একটা দৃশ্যকে কৌতুককর বলে মনে হয়।
আগন্তুক
ব্যাপারটি যখন ঘটল আমি তখন পাহাড়ের বড় পাথরের উপর থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি।
পাহাড়ের উপর ঘুরে বেড়াতে আমার খুব ভালো লাগে। যখন রুশনী নামের আমাদের এই গ্রহটা রুশকা নামের গ্রহের আড়ালে চলে যায় তখন হঠাৎ চারপাশে অন্ধকার নেমে আসে। আবছা অন্ধকারে একটি আলোকিত স্ফটিক পাথর ফুটে বের হয়ে আসতে শুরু করে, চারদিকে একটা নরম আলো ছড়িয়ে পড়ে, তখন কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে নক্ষত্রপুঞ্জকে দেখতে আমার এক ধরনের রোমাঞ্চ হয়। ওই অসংখ্য নক্ষত্রপুঞ্জের নানা গ্রহ উপগ্রহে আমাদের মতো আরো জীবিত প্রাণী রয়েছে ভাবতেই আমার সারা শরীরে এক ধরনের শিহরন বয়ে যায়। সেই জীবিত প্রাণীদের সাথে যদি সত্যি কোনোদিন আমাদের যোগাযোগ ঘটে যায়, কী বিচিত্র ব্যাপারটাই না ঘটবে। এই ধরনের কথা ভাবতে ভাবতে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলাম ঠিক তখন আমি আকাশ চিরে একটা আলোর ঝলকানি ছুটে যেতে দেখলাম।
এটি আয়োনিত বিদ্যুতের বিচ্ছুরণ নয়, এটি কোনো ধূমকেতু নয়, উল্কাপাত নয়, অসম তাপের বিস্ফোরণও নয়, এটি সম্পূর্ণ নূতন একটি ব্যাপার। আমি আগে কখনো এ রকম কিছু ঘটতে দেখি নি। তাই অবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আলোর ঝলকানিটি নিচে নেমে এসে দিগন্তের অন্যপাশে মিলিয়ে গেল।
যখন আকাশে অন্ধকার আরো গাঢ় হয়ে এল, আমি তখন দ্বিতীয়বার আলোর ঝলকানিটি দেখতে পেলাম। এবারে ঝলকানিটি দিগন্তে অদৃশ্য হয়ে গেল না, সেটি বৃত্তাকারে ঘুরে এল। আমি অবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম, দেখতে পেলাম আলোর ঝলকানিটি তার বৃত্তাকার পথ ছোট করতে করতে নিচে নেমে আসছে।
কিছুক্ষণের মাঝেই আমি আলোর ঝলকানির উৎসটি পরিষ্কার দেখতে পেলাম। সাদা সুচালো একটি জিনিস, তার পিছন থেকে লালাত আগুনের শিখা বের হয়ে আসছে। আমি আমার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতেই এক ধরনের চাপা গুমগুম শব্দ শুনতে পেলাম। জিনিসটি কী হতে পারে সেটি নিয়ে চিন্তা করার আগেই হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম এটি নিশ্চয়ই একটি মহাকাশযান। আমাদের এই ছোট উপগ্রহটিতে ভিন্ন গ্রহ থেকে মহাকাশচারীরা নেমে আসছে।
ভালো করে দেখার জন্যে আমি পাহাড়ের আরো উপরে উঠে গেলাম। অন্ধকার নেমে আসার পর ধূলিঝড়টি শুরু হতে থাকে। একটু পরেই সেটা চারদিক আরো অন্ধকার করে ফেলবে তখন আমি আর ভালো করে দেখতে পাব না। আমি পাহাড়ের উপর থেকে দেখতে পেলাম মহাকাশযানটি প্রচণ্ড শব্দ করতে করতে নেমে আসছে, নামার জন্যে সেটি যে জায়গাটা বেছে নিয়েছে সেটি এই উপগ্রহের সবচেয়ে সমতল জায়গাগুলোর একটি।
আমি দীর্ঘ সময় হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। আমার চোখের সামনে এই উপগ্রহে একটি নূতন ইতিহাস সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, কী আশ্চর্য!
.
আমি যখন পাহাড় থেকে নিচে নেমে এলাম, আমার মা নরম গলায় বললেন, কোথায় ছিলি তুই ত্ৰিতুন?
পাহাড়ের উপর।
কখন অন্ধকার হয়ে গেছে! এতক্ষণ কী করছিলি?
দেখছিলাম মা। আকাশ থেকে একটা মহাকাশযান নেমে এসেছে।
কী বলছিস তুই? মা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন, কী বলছিস?
সত্যি মা। সাদা রঙের মহাকাশযান। মাথাটা সুচালো, নিচে চারদিকে পাখার মতো। যখন নিচে নেমে আসছিল কী ভয়ানক গর্জন করছিল গুমগুম করে! পিছন থেকে কমলা রঙের আগুন বের হয়ে আসছিল। সেটা একটা দেখার মতো দৃশ্য ছিল মা।
কোথায় নেমেছে ওই মহাকাশযান?
পাহাড়ের ওই পাশে যে উপত্যকা আছে, সেখানে।
মা তখনো আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। খানিকক্ষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, খবরটা সবাইকে দিতে হবে ত্রিভুন। তুই যা, রুককে গিয়ে বল, এখনই সবাইকে একসাথে হতে হবে। যে যেখানে আছে সবাইকে চলে আসতে বল।
কিছুক্ষণের মাঝেই সবাই চলে এল। বাইরে স্বচ্ছ একটা স্ফটিককে ঘিরে আমরা সবাই গোল হয়ে বসেছি। বৃদ্ধ রুক কাঁপা গলায় বলল, তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছ, ত্ৰিতুন খবর এনেছে পাহাড়ের ওই পাশে উপত্যকায় একটা মহাকাশযান নেমেছে।
উপস্থিত সবাই সম্মতিসূচক একটা শব্দ করল। রুক বলল, এটা আমাদের জন্যে ভালো হতে পারে আবার খারাপও হতে পারে। ভালো হতে পারে কারণ আমরা এদের কাছ থেকে বাইরের জগতের খোঁজ পেতে পারি। কোথায় কী আছে জানতে পারি। সৃষ্টি জগতের বিস্ময়, রহস্য, বৈচিত্র্যের কথা তারা আমাদের জানাতে পারবে। আবার খারাপও হতে পারে যদি এই মহাকাশচারীরা আমাদের থেকে ভিন্ন ধরনের হয়, যদি আমাদের অনুভূতির সাথে পরিচিত না হয়, যদি এদের মূল্যবোধ আমাদের মূল্যবোধ থেকে আলাদা হয়—