থিরু খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে মানুষটির দিকে তাকালেন। কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন, মানুষটি হাত তুলে হঠাৎ তাকে থামিয়ে দিয়ে সামনে তাকাল। থিরু তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখতে পেলেন একটা মোটাসোটা ইঁদুর মাথা নাড়াতে নাড়াতে এগিয়ে আসছে। মানুষটি সাবধানে তার পাশে রাখা মুগুরের মতো একটা গাছের গুঁড়ি তুলে নিয়ে অতর্কিতে ইঁদুরটিকে মেরে বসে। ইঁদুরটির মাথা থেঁতলে রক্ত ছিটকে এসে মানুষটির মুখে পড়ল কিন্তু মানুষটির সেটা নিয়ে কোনো ভাবান্তর হল না। সে মৃত ইঁদুরটির লেজ ধরে নিজের কাছে টেনে এনে চোখের সামনে ঝুলিয়ে সেটিকে পর্যবেক্ষণ করে, থিরু দেখতে পেলেন মানুষটির চোখেমুখে একটা আনন্দের আভা হাজির হয়েছে। সে ইঁদুরটা নিজের পাশে রেখে আমার কথার সূত্র ধরে বলল, একটা সঙ্গীত সৃষ্টি করতে
থিরু বাধা দিয়ে বললেন, তুমি–তুমি ইঁদুরটা দিয়ে কী করবে?
মানুষটি থিরুর দিকে তাকিয়ে সকৌতুকে বলল, এটা আমার আজ রাতের ডিনার।
থিরু চমকে উঠলেন, ডিনার?
হ্যাঁ। মাস্কিট্রন আমাদের আনন্দ সুখ উল্লাসের অনুভূতি দিতে পারে। কিন্তু আমাদের খেতে হয়
থিরু হতচকিত হয়ে বললেন, এই– এই ইঁদুরটা খাবে?
হা। মাস্কিট্রনটা সেট করব অত্যন্ত উপাদেয় খাবারের অনুভূতির জন্যে। তখন আমি যেটাই খাব সেটাকেই মনে হবে উপাদেয় খাবার। ইঁদুরটা এমনিতেই কচমচ করে খাব–
কাঁচা?
মানুষটা সহৃদয় মানুষের মতো হাসল, রান্না করে জ্বালানি নষ্ট করে লাভ আছে?
থিরুর সারা শরীর গুলিয়ে উঠল। মানুষটি থিরুর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার মাথায় যেহেতু মাস্কিট্রন লাগানো নেই, তোমার হয়তে পুরো ব্যাপারটা একটু অস্বস্তিকর মনে হতে পারে।
থিরু দুর্বলভাবে মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়। কাঁচা ইঁদুরকে উপাদেয় খাবার মনে করে, খাওয়ার জন্যে তোমরা মাথার খুলি ফুটো করে স্ক্রু দিয়ে যন্ত্র লাগাচ্ছ? এর সত্যিই দরকার ছিল?
মানুষটি তার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, কিন্তু এটা তো সত্যিকারের ব্যবহার নয়। এর সত্যিকার ব্যবহার অন্য জায়গায়। এই তো কয়দিন আগে একটি মেয়ের একমাত্র বাচ্চা সাত তালা থেকে পড়ে মারা গেল। যদি মাস্কিট্রন না থাকত সেই মায়ের কী ভয়ানক কষ্ট হত বলতে পার? কিন্তু এখন কোনো সমস্যাই নেই, মাস্কিট্রন সেট করে শিশুর মৃতদেহটি রেখে চলে গেল একটা পার্টিতে আনন্দ করতে!
থিরু হঠাৎ করে শিউরে উঠলেন, প্রথমবার তিনি একটু আতঙ্ক অনুভব করতে শুরু করেন। ইতস্তত করে বললেন, কিন্তু যেখানে দুঃখ পাওয়ার কথা সেখানে তো দুঃখ পেতে হয়—
মানুষটি মাথা নাড়ল, বলল, না আর পেতে হয় না। আমাদের মাঝে এখন আর দুঃখ নেই। এই দ্বীপের প্রতিটি মানুষ এখন গভীর সুখের মাঝে ডুবে আছে। তাদের ভিতরে দুঃখ বেদনা কষ্ট কিছু নেই।
থিরু খানিকক্ষণ মানুষটির দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন, তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, এখানে রাস্তাঘাটে মানুষ নেই কেন?
প্রয়োজন নেই তাই। মানুষ রাস্তাঘাটে যেত কারণ কাজকর্ম করার প্রয়োজন ছিল। এখন শুধু খাওয়া জোগাড় করার জন্যে মাঝে মাঝে বের হতে হয়। বাকি সময়টুকু মানুষ তার ঘরে চুপচাপ শুয়ে মাস্কিট্রন দিয়ে জীবন উপভোগ করতে পারে।
মানুষটি আড়মোড়া ভেঙে ইঁদুরটার লেজ ধরে টেনে তুলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যাই। বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিই। তুমি কি যাবে আমার সাথে?
থিরু মাথা নেড়ে বললেন, তুমি যাও। আমি আরো খানিকক্ষণ বসে যাই। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে আমার একটু সময় লাগবে।
ঠিকই বলেছ। যত তাড়াতাড়ি পার একটা মাস্কিট্রন লাগিয়ে নাও, দেখবে জীবনের মাঝে কত আনন্দ লুকানো!
মানুষটি হেঁটে চলে গেল, থিরু সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। গম্ভীর হতাশায় তিনি একটি নিশ্বাস ফেললেন। অপারেশান অপক্ষেপ যেভাবে কাজ করার কথা ছিল সেভাবে কাজ করে নি। এটি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। শুধু ব্যর্থ হয় নি এটি পুরোপুরি উল্টোদিকে কাজ করেছে। মানুষকে নূতন জীবন না দিয়ে যে জীবনটি দেয়া হয়েছিল সেটি ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে।
থিরু দীর্ঘসময় একা একা সমুদ্রের বালুবেলায় বসে রইলেন। ধীরে ধীরে শীতের বাতাস বইতে লাগল, যখন শীতটুকু অসহ্য মনে হল তখন হঠাৎ তিনি কয়েকজন মেয়ের গলা শুনতে পেলেন। কথা বলতে বলতে তারা এদিকে এগিয়ে আসছে। থিরু উঠে দাঁড়ালেন, মেয়েগুলো তাকে দেখতে পেয়ে কথা বন্ধ করে তার দিকে এগিয়ে এল। কাছে এলে থিরু দেখতে পেলেন তাদের সবার মাথায় একটি করে মাস্কিট্রন লাগানো।
মেয়েদের ভিতরে একজন জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? এখানে কী করছ?
থিরু শান্ত গলায় বললেন, আমাকে তোমরা চিনবে না। আমি এই এলাকার নই। সত্যি কথা বলতে এই সময়েরও না!
মেয়েগুলো মাথা নেড়ে বলল, তাই তো দেখছি, তোমার মাথায় মাস্ক্রিট্রন নেই।
না নেই। তোমরা এত রাতে কেন এসেছ?
আমরা এসেছি খাবারের জন্যে। এখানে মাঝে মাঝে বড় ইঁদুর পাওয়া যায়।
থিরুর শরীর আবার কাঁটা দিয়ে ওঠে। তিনি দেখতে পেলেন তাদের একজনের হাতে একটা লোহার রডের মতো জিনিস।
অন্য একটি মেয়ে বড় হাতের মেয়েটিকে বলল, তুমি এটা দিয়ে ইঁদুর মারতে পারবে না। ইঁদুর খুব চতুর প্রাণী, এত সহজে তাকে মারা যায় না।