থিরু নিশ্বাস বন্ধ করে একবার চারদিকে তাকালেন, না, এটি ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি সভ্যতা নয়। চারদিকে গড়ে ওঠা নূতন একটি সভ্যতার চিহ্ন। তিনি আবার তাকালেন এবং হঠাৎ করে তার মনে হল এখানে কোথাও কিছু একটা সমস্যা রয়েছে। সমস্যাটা কী তিনি হঠাৎ করে ধরতে পারলেন না। ইতস্ততভাবে তিনি আরো কয়েক পা এগিয়ে এলেন এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারলেন চারপাশে কোথাও কোনো মানুষ নেই! কোথায় গিয়েছে সব মানুষ?
থিরু জনশূন্য রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলেন। চারপাশে নগরীর সুস্পষ্ট চিহ্ন, রাস্তাঘাট উঁচু অট্টালিকা প্রযুক্তির সুস্পষ্ট ব্যবহার, সবই নিশ্চয়ই মানুষের জন্যে কিন্তু সেই মানুষেরা চোখের আড়ালে। বড় কোনো অট্টালিকায় ঢুকে দেখলে হয় কিন্তু থিরু হঠাৎ করে সেটি সাহস করলেন না। রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলেন, শীতল বাতাস বইছে, এই দ্বীপটির অবস্থান থেকে তিনি জানেন সোজা সামনে হেঁটে গেলে তিনি সমুদ্রতীরে পৌঁছাবেন। এই দ্বীপটির সবচেয়ে সুন্দর জায়গা ছিল বালুকাবেলা, সেখানে কি এক–দুজন সান্ধ্যকালীন পদব্রাজক পাওয়া যাবে না?
থিরু সমুদ্রতীরে এসে অবাক হলেন, বালুকাবেলার সামনে বিশাল সমুদ্র, তাদের ফেনায়িত তরঙ্গ এসে আছড়ে পড়ছে, ঝাউগাছে বাতাসের এক ধরনের করুণ সুর কিন্তু এই অপার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করার কেউ নেই। থিরু একাকী বালুকাবেলায় ঘুরে বেড়ালেন, যখন একটি মানুষকেও না পেয়ে ফিরে আসছিলেন ঠিক তখন একটা ঝাউগাছের নিচে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা একজন মানুষকে আবিষ্কার করলেন। মানুষটি এক ধরনের উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, তার পোশাক জীর্ণ, চেহারায় এক ধরনের খাপছাড়া উদ্ভান্ত ভাব। থিরু সাবধানে এগিয়ে গিয়ে তার কাছাকাছি দাঁড়ালেন, মানুষটি চোখের কোনা দিয়ে তাকে লক্ষ্য করে আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। থিরু ইতস্তত করে বললেন, আমি তোমার সাথে একটু কথা বলতে পারি?
মানুষটি তার দিকে না তাকিয়ে বলল, বল।
আমি এক শ বছর আগে থেকে এসেছি, এক সময় আমি পৃথিবীর বিজ্ঞান একাডেমীর মহাপরিচালক ছিলাম।
আমি সেটা আন্দাজ করছিলাম। তুমি এ সময়ের মানুষ হলে তোমার মাথায় নিশ্চয়ই মাস্কিট্রন থাকত।
কী থাকত?
মাস্কিট্রন। মানুষটি তার মাথা ঘুরিয়ে দেখাল বাম কানের একটু উপরে গোলাকার একটি জিনিস লাগানো।
থিরু একটু ঝুঁকে পড়ে সন্ধ্যার আবছা আলোতে মাস্কিট্রন নামের জিনিসটা একটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করলেন। জিনিসটা কেমন করে মাথার পাশে লেগে আছে তিনি বুঝতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, এটা কেমন করে লাগিয়েছ?
খুব সোজা। মাথার খুলিতে চারটা তিন শতাংশ ছিদ্র করে স্ক্রু দিয়ে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।
থিরু একটু শিউরে উঠলেন, কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মাথার খুলিতে ফুটো করে?
হ্যাঁ। মস্তিষ্কের মাঝে যে ইমপালস দেয়া হয় সেটা যত কাছে থেকে সম্ভব দেয়ার কথা।
থিরু মানুষটির কাছে উবু হয়ে বসে বললেন, দেখ, আমি এক শতাব্দী আগে থেকে এসেছি, তোমাদের সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে এখানে কী হচ্ছে?
মানুষটি এবারে প্রথমবার থিরুর দিকে ঘুরে তাকাল। খানিকক্ষণ এক ধরনের কৌতুকের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, সত্যি শুনতে চাও?
হ্যাঁ।
বলছি তোমাকে। বস এখানে।
থি মানুষটির পাশে বসলেন, ঠিক জানেন না কেন কিন্তু ভিতরে ভিতরে হঠাৎ তিনি এক ধরনের অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছেন। মানুষটি তার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি নিশ্চয়ই জান এই দ্বীপে এক হাজার খুব উৎসাহী তরুণ–তরুণীকে পাঠানো হয়েছিল, তারা আমাদের তিন পুরুষ আগের মানুষ।
থিরু মাথা নাড়লেন, তিনি জানেন, মানুষগুলোকে তিনিই পাঠিয়েছিলেন।
অসম্ভব কষ্ট করে সেই মানুষগুলো নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছিল। তাদের সন্তানেরা এই দ্বীপটিকে গড়ে তুলেছে। যারা এই দ্বীপটিকে গড়ে তুলেছে আমরা তাদের সন্তান। আমাদের মাঝে অসংখ্য প্রতিভাবান বিজ্ঞানীর প্রযুক্তিবিদের জন্ম হয়েছিল। তাদের সবার চেষ্টা দিয়ে তৈরি হয়েছে মাস্কিট্রন।
সেটা কী করে?
জীবনকে সহজ করে দেয়। আমরা প্রতিনিয়ত শুধু ছুটে বেড়াতাম, আমাদের জীবন ছিল শুধু কাজ আর পরিশ্রম। চেষ্টা ও খাটাখাটুনি। কিন্তু প্রশ্ন হল কেন এই পরিশ্রম? কেন এই কাজ? জীবনকে আনন্দময় করার জন্যে। সেই জীবন যদি সহজে আনন্দময় করে দিতে পারি তাহলে কেন আমরা কষ্ট করে খাটাখাটুনি করব? পরিশ্রম করে নিজের জীবনকে শেষ করব?
থিরু জিজ্ঞেস করলেন, মাস্কিট্রন পরিশ্রম ছাড়াই আনন্দ এনে দিতে পারে?
হ্যাঁ। কারণ মাস্কিট্রন সোজাসুজি মস্তিষ্কের সাথে লাগানো। মস্তিষ্কে এটি ইমপালস দিয়ে আনন্দের অনুভূতি দিতে পারে। আমরা অনেক পরিশ্রম করে আমাদের জীবনে আনন্দের যে অনুভূতি সৃষ্টি করব, সেই অনুভূতিটি সোজাসুজি মস্তিস্কে এসে যাচ্ছে। তাহলে পরিশ্রম কেন করব? চমৎকার একটা কবিতা পড়লে যেরকম আনন্দ হয়, সুন্দর একটি ছবি দেখলে যেরকম ভালো লাগে, অপূর্ব সঙ্গীত শুনে বুকের ভিতরে যেরকম আবেগের জন্ম হয় তার সবকিছু আমরা করতে পারি মাস্কিট্রন দিয়ে। আমাদের কবিতা লেখার প্রয়োজন নেই, ছবি আঁকার প্রয়োজন নেই, সঙ্গীত সৃষ্টিরও প্রয়োজন নেই।