না বাবা, পারি না
আমরা পারি। শিশুটি উজ্জ্বল চোখে বলল, আমাদের যখন মন খারাপ হয় আমরা তখনো কাজ করতে পারি। আমাদের যখন অনেক আনন্দ হয় কিংবা রাগ হয় তখনো আমরা কাজ করতে পারি।
কেমন করে করিস, বাবা?
আমাদের মস্তিষ্কে স্টিমুলেশান দেয়া হয়। স্টিমুলেশান দিয়ে আমাদের মন খারাপ করানো হয়, যখন খুব মন খারাপ হয় তখন আমাদের কাজ করতে দেয়া হয়। সেটা আরেক রকম স্টিমুলেশান।
কী কাজ করিস তোরা?
নানারকম কাজ। আমাদের কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি পড়তে হয়, সুপার কন্ডাক্টিভিটি শিখতে হয়। নানা রকম মডেল থাকে, টেকনিক্যাল প্রজেক্ট করতে হয়–
তোরা সব করতে পারিস?
শিশুটি লাজুক হাসি হেসে বলল, পারি মা। আমি গত পরীক্ষায় সবগুলো বিষয়ে বেশি নম্বর পেয়েছি। ব্ল্যাকহোল কেমন করে এসেছে তার ওপর আমার একটা পেপার জার্নালে ছাপা হয়েছে।
পুত্রগর্বে গর্বিত মা তার আদরের শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
শিশুটি তার ঘরে ঘুরে বেড়াল, তার জন্যে আলাদা করে রাখা ঘরটিতে তার খেলনাগুলো নেড়েচেড়ে দেখল। তার বিছানায় পা দুলিয়ে বসে হলোগ্রাফিক ছবি দেখল। মায়ের পিছু পিছু হেঁটে হেঁটে টেবিলে খাবার এনে দিল। গৃহস্থালি রবোট ট্রনের সাথে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তর্ক–বিতর্ক করল, বাবার ঘাড়ে উঠে ঘরময় ছুটে বেড়াল।
দুপুরে কিয়া, ক্রল এবং শিশুটি একসাথে বসে খেল। শিশুটি খাওয়ার ব্যাপারে একটু খুঁতখুঁতে–অনেক রকম খাবার রান্না হয়েছে তবু কোনোটাই তৃপ্তি করে খেল না। সবগুলো থেকে একটু একটু করে খেয়ে হাতমুখ ধুয়ে উঠে পড়ল।
কিয়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলল, যে কয়েক ঘন্টা সময়ের জন্যে সে এক বছর থেকে অপেক্ষা করছে সেই সময়টা শেষ হয়ে আসছে। আবার এক বছর পর তার সন্তানটি কয়েক ঘণ্টার জন্যে আসবে। গভীর বেদনায় তার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে যেতে চায়।
শিশুটি কার্পেটে পা ছড়িয়ে বসে তার জুতোগুলো পরে নেয়। হাতের ছোট ব্যাগটি তুলে নিয়ে মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আসি মা?
মা চোখের অশ্রু ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে শেষবার আলিঙ্গন করে বলল, আয় বাবা।
শিশুটি ক্রলের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, আসি বাবা।
ক্রল শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আয় বাবা। ভালো হয়ে থাকিস।
শিশুটি মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে সাবধানে চোখের পানি হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছে নেয়। ভাসমান গাড়িটার কাছাকাছি যেতেই নিঃশব্দে দরজা খুলে গেল। শিশুটি মুখ ঘুরিয়ে একবার পিছনে তাকিয়ে গাড়ির ভিতরে ঢুকে যেতেই নিঃশব্দে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় সাথে সাথেই ভাসমান গাড়িটা ছোট একটা গর্জন করে উপরে উঠে যায়।
***
শিশুটি ম্লান মুখে একটা ছোট চেয়ারে বসে আছে। পাশে দাঁড়ানো মধ্যবয়স্ক একজন লোক নরম গলায় বলল, মন খারাপ লাগছে?
শিশুটি কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল।
এক্ষুনি তোমাকে আনন্দের স্টিমুলেশান দেয়া হবে তখন তোমার মন ভালো হয়ে যাবে। যাবে না?
শিশুটি আবার মাথা নাড়ল।
তার আগে তোমাকে ডাউনলোড করতে হবে, মনে আছে?
শিশুটি একটা নিশ্বাস ফেলে শোনা–যায়–না এ রকম গলায় বলল, মনে আছে।
তাহলে দেরি করে কাজ নেই। এস, শুয়ে পড়।
শিশুটি বাধ্য ছেলের মতো এসে পাশে রাখা বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। মৃদু গুঞ্জন করে। মাথার উপরে একটা চতুষ্কোণ যন্ত্র নেমে আসতে থাকে, লাল একটা বাতি জ্বলে ওঠে এবং উচ্চ কম্পনের একটা তীক্ষ্ণ শব্দের গুঞ্জন শোনা যেতে থাকে। শিশুটি ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
ভাসমান গাড়ির সামনে থেকে সোনালি চুলের একজন কমবয়সী মেয়ে এগিয়ে এসে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, ডাউনলোড শুরু হয়েছে?
মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, হ্যাঁ।
এখন কাকে ডাউনলোড করছ?
পরের জনকে। শহরতলিতে থাকে বাবা-মা, এক শ এগার তলা এপার্টমেন্ট বিল্ডিঙের ছিয়ানব্বই তলায়।
কতক্ষণের জন্যে পাবে বাচ্চাটাকে?
মধ্যবয়স্ক মানুষটি মনিটরের দিকে তাকিয়ে বলল, এই বাবা–মা পাবে দু ঘণ্টার জন্যে।
বাচ্চার চেহারার পরিবর্তন করতে হবে?
হ্যাঁ। চোখগুলো এখন হবে নীল, চুলটা হবে লালচে।
কাজ শুরু করে দেব?
হা দাও। বাবা–মা এক বছর থেকে অপেক্ষা করছে, তাদের আরো অপেক্ষা করানো ঠিক হবে না।
সোনালি রঙের চুলের মেয়েটি বলল, ঠিকই বলেছ।