কুরোশিয়া কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল কী আশ্চর্য!
মানুষটি একটু অবাক হয়ে রবোট দলপতি কুরোশিয়ার দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না।
.
দুই সহস্র বছরে রবোনগরীর যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সেটি পরবর্তী কয়েক বছরে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল। আন্তঃগ্যালাক্টিক ইতিহাস জার্নালে তার কারণ হিসেবে রবোটের গভীর হীনমন্যতার কথা উল্লেখ করা হয়।
সন্তান
কিয়া তৃতীয়বারের মতো খাবার টেবিলটি পরিষ্কার করে আবার রান্নাঘরে ঢুকে গেল। ক্রল রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলল, কিয়া, তুমি আর কত রান্না করবে? বাকিটুকু ট্রনের হাতে ছেড়ে দাও।
ট্রন সংসারের সাহায্যকারী রবোট, কাজকর্মে কিয়া বা ক্রল দুজনের থেকেই অনেক বেশি পারদর্শী। কিয়া ক্ৰলের কথায় কান না দিয়ে বলল, কী বলছ তুমি? এতদিন পরে আমার ছেলে আসছে আর আমি নিজের হাতে কিছু রান্না করব না?
তোমার ছেলের বয়স আট, তার জন্যে তুমি আর কত রান্না করবে?
কিয়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, আমার ছেলে–আমি তাকে পেটে ধরেছি, তাকে আমি দেখি বছরে মাত্র একবার, তাও কয়েক ঘণ্টার জন্য! আমি জানি সে কিছু খাবে না, কিন্তু তবু তার জন্যে রান্না করতে আমার ভালো লাগে।
ক্রল হার মেনে বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। তাই যদি তোমার ভালো লাগে তাহলে সেটাই কর।
কিয়া কপালের উপর ঘামে ভেজা চুলগুলো সরিয়ে বলল, তুমি দেখ তার ঘরে যে নূতন খেলনাগুলো কিনেছি, সবগুলো ঠিক করে রাখা আছে কি না।
দেখছি।
ক্রল একটা নিশ্বাস ফেলে তাদের সন্তানের জন্যে আলাদা করে রাখা ঘরটিতে হাজির হল। কখনো সে এখানে রাতে ঘুমায় নি, কখনো ঘুমাবে না, কিন্তু তবু এখানে তার জন্যে একটা বিছানা আলাদা করে রাখা আছে, পাশে ছোট টেবিল, টেবিলের পাশে ছোট চেয়ার। দেয়ালে রঙিন ছবি, উপর থেকে ঝুলছে নানা ধরনের মোবাইল, ঘরের একপাশে খেলনার বাক্স, নানারকম খেলনায় উপচে পড়ছে। মেঝেতে নরম কার্পেট, জানালায় রঙিন পরদা। দেয়ালে ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক ছবি, ক্ষণে ক্ষণে সেইসব ছবি পাল্টে যাচ্ছে। ঘরের দেয়ালে লুকানো স্পিকার থেকে শোনা–যায়–না এ রকম নরম সুরে কোমল সঙ্গীতের সুর ভেসে আসছে। ঘরের ভিতরে একটি শিশুর আনন্দের জন্যে সবকিছু রয়েছে, যেটা নেই সেটা হচ্ছে শিশুটি।
ক্রল উবু হয়ে বসে নতুন খেলনার বাক্সগুলো খুলে ভিতর থেকে খেলনাগুলো বের করতে থাকল। তাদের ছেলে আসবে সকাল দশটায়, চলে যাবে তিন ঘণ্টা পর, তার মাঝে সে কি এই খেলনাগুলো স্পর্শ করার সময় পাবে? ক্রল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কী প্রয়োজন ছিল এই সভ্যতার যেখানে একটি শিশুকে কার্যক্ষম মানুষ হিসেবে বড় করবার দায়িত্বটুকু নিতে হয় রাষ্ট্রযন্ত্রকে? কেন তাকে সরিয়ে নিতে হয় মা–বাবার কাছে থেকে? কেন সে প্রাচীনকালের মানুষের মতো মা–বাবার স্নেহে, আদরে, আবদারে, শাসনে, ভালবাসায় বড় হতে পারে না? সত্যিই কি প্রাচীনকালের পদ্ধতি ছিল ত্রুটিপূর্ণ? কী প্রমাণ আছে পৃথিবীর মানুষের কাছে?
.
ঠিক দশটার সময় ক্রল এবং কিয়ার বাসার সামনে একটা ভাসমান গাড়ি এসে থামল। নিঃশব্দে গাড়ির পিছনে একটা দরজা খুলে গেল এবং ভিতর থেকে বের হয়ে এল কোমল চেহারার একটি শিশু। সাত–আট বছরের শিশুটি একবার চারদিকে তাকিয়ে বাসার দরজার দিকে হেঁটে আসতে থাকে। সাথে সাথে দরজা খুলে কিয়া প্রায় ছুটে বের হয়ে এসে শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরল। শিশুটি তার মায়ের বুকে মুখ গুঁজে বলল, মা তুমি ভালো আছ?
কিয়া শিশুটিকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে রেখে বলল, হ্যাঁ বাবা। তুই ভালো আছিস?
আছি মা। বাবা কোথায়?
ওই যে দাঁড়িয়ে আছে।
ক্রল তখন সামনে এগিয়ে এল। শিশুটি তার মাকে ছেড়ে বাবার দিকে এগিয়ে যায়, কাছে গেলে বাবা গভীর ভালবাসায় তার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে।
শিশুটিকে ঘরের ভিতরে নিয়ে এল বাবা-মা। তাকে একটি চেয়ারে বসিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল দুজন। মুগ্ধ বিস্ময়ে তারা তাদের সন্তানের দিকে তাকিয়ে থাকে, গভীর ভালবাসায় স্পর্শ করে, চুলে হাত বুলায়। শিশুটি মুখে একটু লাজুক হাসি নিয়ে বসে থাকে, এতদিন পরে বাবা–মাকে দেখে যেন ঠিক বুঝতে পারে না কী করবে।
কিয়া হঠাৎ আরো একবার গভীর ভালবাসায় শিশুটিকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমাদের কথা তোর মনে আছে বাবা?
আছে মা
কেমন করে মনে আছে? এক বছর পর পর তুই মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্যে আমাদের কাছে আসিস
কিন্তু মা, আমাদের মস্তিষ্কে তোমাদের নিয়ে স্টিমুলেশান দেয়া হয়। আমরা রাতে যখন ঘুমাতে যাই তোমাদের দেখি, তোমাদের কথা শুনি–
কিন্তু সেটা কি সত্যি দেখা হল?
হ্যাঁ মা, সেটা সত্যির মতো।
তুই যখন আমাকে দেখিস তোর ভালো লাগে?
হ্যাঁ মা, ভালো লাগে। আমার যখন মন খারাপ হয় তখন আমি তোমার কথা ভাবি।
কিয়ার চোখে হঠাৎ এক ধরনের আশঙ্কার ছাপ পড়ে, তোর মন খারাপ হয় বাবা?
শিশুটি একটু হেসে বলল, কেন হবে না মা? সবার মন খারাপ হয়। এমনিতেই মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়, তাছাড়া আমাদের মাঝে মাঝে মন খারাপ করিয়ে দেয়া হয়।
ক্ৰল উদ্বিগ্ন মুখে বলল, কেন বাবা? কেন তোদের মন খারাপ করিয়ে দেয়া হয়?
শিশুটি হেসে বলল, বাবা, আমাদের শুধু মন খারাপ নয়; আমাদের রাগ, দুঃখ, আনন্দ, হিংসা–সবকিছু শেখানো হয়। যখন তোমাদের খুব মন খারাপ থাকে তোমরা কোনো কাজ করতে পার?