কারণ সে মৃত্যুর আগে একজন মানুষের সাথে কথা বলতে চেয়েছে। যতক্ষণ সে একজন মানুষের সাথে কথা বলবে না ততক্ষণ সে নিজে থেকে মৃত্যুকে গ্রহণ করবে না। মৃত্যুকে জোর করে তার ভিতরে প্রবেশ করতে হবে। যতক্ষণ সেটি না ঘটবে ততক্ষণ মানুষটি তার কালো ক্যাপসুলে শুয়ে কষ্ট ভোগ করবে।
চতুর্থ মাত্রার রবোটটি জিজ্ঞেস করল, মানুষটি কী নিয়ে কথা বলবে বলে তোমার মনে হয়?
কুরেশিয়া আবার মূল তথ্যকেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ করে নানারকম তথ্য পর্যালোচনা করে বলল, আমি ঠিক জানি না। কিন্তু কথাটি হবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানব সভ্যতার গূঢ় তথ্যটি তার মাঝে লুকিয়ে থাকবে।
নূতন প্রজন্মের একটি রবোট তার কপোট্রনে উত্তেজনার টার্বো চ্যানেল চালু করে বলল, আমরা কি একজন মানুষকে খুঁজে আনতে পারি না? তাহলে অসুস্থ মানুষটির শেষ কথাটি শুনতে পেতাম। মানুষের সভ্যতার প্রকৃত অর্থ খুঁজে পেতাম।
উৎসাহী আরেকটি রবোট বলল, আমরাও তাহলে আমাদের সভ্যতা মানুষের সভ্যতার অনুকরণে তৈরি করতে পারতাম।
কুরোশিয়া খানিকক্ষণ নূতন প্রজন্মের এই উৎসাহী রবোটটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। আমারও খুব জানার কৌতূহল হচ্ছে এই মানুষটি কী কথা বলবে।
আমরা কি আন্তঃগ্যালাক্টিক বুলেটিন বোর্ডে ছোট একটি বিজ্ঞাপন বা খবর পাঠাতে পারি না?
ব্যাপারটি কষ্টসাধ্য, কিন্তু আমি চেষ্টা করব।
কয়েকদিন পর কুরোশিয়া এবং রবোনগরীর অন্য প্রবীণ রবোটেরা আন্তঃগ্যালাক্টিক বুলেটিন বোর্ডে এ রকম একটি খবর প্রচারের ব্যবস্থা করল :
রবোনগরীতে একজন মানুষ মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি অন্য একজন মানুষের সাথে কথা বলতে চান। কোনো দয়ার্দ্র মানুষ কি এই উদ্দেশ্যে অল্প সময়ের জন্যে রবোনগরীতে পদার্পণ করবেন?
বুলেটিন বোর্ডে খবর প্রচারিত হওয়ার পর দীর্ঘদিন কেটে গেল, কিন্তু কোনো মানুষ রবোনগরীতে দেখা করতে এল না। রুগ্ণ মানুষটির অবস্থা ধীরে ধীরে আরো খারাপ হয়ে গেল, তার নিশ্বাস প্রায় শোনা যায় না, হৃৎস্পন্দন কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে এসেছে। কুরোশিয়া মাথা নেড়ে তার সবুজ ফটোসেলের চোখ পিটপিট করে বলল, আমার মনে হচ্ছে এই মানুষটি সত্যিকার অর্থে দুর্ভাগা। সম্ভবত তাকে তার শেষ ইচ্ছা অপূর্ণ রেখেই মৃত্যুবরণ করতে হবে।
অন্য রবোটরাও মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, কেউ কোনো কথা বলল না।
যখন রবোনগরীর সবাই আন্তঃগ্যালাক্টিক গ্রহাণুপুঞ্জ থেকে কোনো মানুষের এখানে। পদার্পণ করার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল ঠিক তখন তারা মহাকাশে একটি মহাকাশযান আবিষ্কার করল। হাইপার ডাইভ দিয়ে কাছাকাছি চলে আসার পর রবোনগরীর রবোটেরা মহাকাশযানের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারল সত্যি সত্যি বুলেটিন বোর্ডের তথ্য পড়ে একজন পরিব্রাজক মানুষ রুগ্ণ মানুষটির সাথে দেখা করতে আসছে।
পরদিন অপরাহ্নে মহাকাশযানটি রবোনগরীতে পৌঁছল এবং সেখান থেকে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ নেমে এল। তার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ কিন্তু চোখ দুটি আশ্চর্য রকম সজীব। কুরেশিয়া মানুষটিকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল, আমাদের আহ্বানে সাড়া দেয়ার জন্যে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। মধ্যবয়স্ক পরিব্রাজক মানুষটি বলল, একজন মানুষের অন্য মানুষের প্রতি একটি দায়িত্ব থাকে। আমি সেই দায়িত্ববোধ থেকে এসেছি। কোথায় আছে সেই রুগ্ণ মানুষটি?
চল আমার সাথে, আমি তোমাকে নিয়ে যাই। কুরোশিয়া মানুষটির পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, তুমি যখন এই রুগ্ণ মানুষটির সাথে কথা বলবে তখন আমি কি তোমার পাশে থাকতে পারি?
মধ্যবয়স্ক পরিব্রাজক মানুষটি একটু অবাক হয়ে কুরোশিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি যদি চাও অবশ্যি থাকতে পার।
রুগণ মানুষটির জীবন রক্ষাকারী প্রক্রিয়া চালু করে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনা হল। মানুষটি চোখ খুলে কুরোশিয়ার পাশে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক মানুষটিকে দেখতে পায় এবং তার নিষ্প্রভ চোখ হঠাৎ জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠে। সে তার দুর্বল ডান হাতটি উঁচু করে বাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করল। মধ্যবয়স্ক মানুষটি রুগণ মানুষটির দুর্বল হাতটি দুই হাতের মাঝে নিয়ে নরম গলায় বলল, আমি সুদূর গ্যালাক্টিক গ্রহাণুপুঞ্জ থেকে তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।
রুগ্ণ মানুষটি তার চোখের পাতা ফেলে শোনা–যায়–না এ রকম গলায় বলল, তোমাকে ধন্যবাদ।
তুমি আমাকে কিছু বলবে?
রুগ্ণ মানুষটি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, বলব।
কী বলবে?
আমি–আমি তোমাদের ভালবাসি।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি ঝুঁকে পড়ে নরম গলায় বলল, আমি জানি। একজন মানুষ সবসময় অন্য একজন মানুষকে ভালবাসে।
রুণ মানুষটি তার চোখ বন্ধ করল এবং তার চোখের কোনা দিয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। মানুষটি তার দুর্বল হাত দিয়ে মধ্যবয়স্ক মানুষটির হাত ধরে রাখে, তার মুখে এক ধরনের প্রশান্তির ছাপ ফুটে ওঠে। কিছুক্ষণের মাঝেই তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে হৃৎস্পন্দন থেমে যায়।
কুরোশিয়া রুগণ মানুষটির দিকে ঝুঁকে পড়ে তাকে একবার স্পর্শ করে বলল, মানুষটি কি মৃত্যুবরণ করেছে?
হ্যাঁ কুরোশিয়া।
এই একটি কথা বলার জন্যে সে এতদিন অপেক্ষা করেছিল?
হ্যাঁ।
তুমি কি জানতে সে এই কথা বলবে?
মধ্যবয়স্ক মানুষটি একটি নিশ্বাস ফেলে বলল, জানতাম।