রবোনগরীর জন্যে সেটি ছিল একটি খুব বড় ঘটনা, তার কারণ রবোনগরী হচ্ছে রবোটদের নগর, এখানে সবাই রবোট। তাদের অনেকে শুধু মানুষের নাম শুনেছে, কখনো নিজের চোখে কোনো মানুষ দেখে নি। ক্যাপসুলের মানুষটিকে তারা খুব অবাক হয়ে দেখল। তারা জানত মানুষ অত্যন্ত কোমল প্রাণী, তাপ চাপ বা শক্তির অত্যন্ত ক্ষুদ্র তারতম্যেই তাদের শরীর বিধ্বস্ত হয়ে যায়। কিন্তু মানুষ যে প্রকৃত অর্থে কী পরিমাণ অসহায় সেটা তারা আবিষ্কার করল জীবন রক্ষাকারী প্রক্রিয়ায় বেঁচে থাকা এই অসহায় মানুষটিকে দেখে।
মানুষটির কী হয়েছে তারা জানত না এবং তাকে নিয়ে কী করবে সেটাও তারা বুঝতে পারল না। নিজেদের কপোট্রন, রবোনগরীর মূল তথ্যকেন্দ্র হাতড়ে নানারকম তথ্য জড়ো করে তারা মানুষটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করল, কিন্তু দেখা গেল সেটি সম্ভব নয় :
রবোনগরীর সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় দলপতি কুরোশিয়া। কুরোশিয়ার মূল কপোট্রন যদিও প্রাচীন পি–৪৬ ধরনের কিন্তু নূতন প্রজন্মের মডিউলগুলো তার কপোট্রনে জুড়ে দেয়া আছে। তার কার্যকর স্মৃতির পরিমাণ বিশাল এবং মূল তথ্যকেন্দ্রে তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকায় রোশিয়া অন্য যে–কোনো রবোট থেকে ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সে তার বিশাল যান্ত্রিক মাথা নেড়ে সবুজ ফটোসেলের চোখ পিটপিট করে কয়েকবার বন্ধ করে এবং খুলে বলল, আমার মনে হয় মানুষটিকে আর কষ্ট দেয়া ঠিক নয়।
প্রতিরক্ষার দায়িত্বে থাকা একজন রবোট জিজ্ঞেস করল, কষ্ট মানে কী?
কুরোশিয়া বলল, কষ্ট এক ধরনের মানবিক প্রক্রিয়া। মানুষের মূল মানবিক প্রক্রিয়া দুই ধরনের। একটির নাম কষ্ট অন্যটির নাম আনন্দ। আনন্দ নামের প্রক্রিয়াটি তারা পেতে চায়, কষ্টটি পেতে চায় না।
তার কারণ কী?
কুরোশিয়া মূল তথ্যকেন্দ্রের সাথে খানিকক্ষণ তথ্য বিনিময় করে বলল, কারণটি সম্ভবত তাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কম্পনের সাথে জড়িত। কষ্ট প্রক্রিয়াটি তাদের স্বাভাবিক কম্পনকে ব্যাহত করে।
নগরীর উন্নয়নের দায়িত্বে থাকা অন্য একটি রবোট বলল, মানুষটি কি এখন কষ্ট পাচ্ছে?
কুরোশিয়া তার মাথা নেড়ে বলল, আমি নিশ্চিত। কষ্ট পাওয়া মানুষের মুখভঙ্গির সাথে আমি পরিচিত। তখন তাদের ভুরু কুঞ্চিত থাকে, মুখমণ্ডল অল্প খোলা রাখে এবং তুলনামূলকভাবে দ্রুত নিশ্বাস নেয়। এই মানুষটি তাই করছে। আমি নিশ্চিত সে কষ্ট পাচ্ছে।
আমরা কীভাবে তাকে কষ্ট থেকে মুক্তি দেব?
তার মৃত্যুর ব্যবস্থা করতে হবে।
মৃত্যু? তুলনামূলকভাবে নূতন প্রজাতির একটি রবোট বলল, সেটি কী?
কুরোশিয়া উত্তর দেয়ার আগেই আরেকটি প্রাচীন রবোট বলল, মৃত্যু হচ্ছে চূড়ান্ত ধ্বংস প্রক্রিয়া। একজন মানুষের মৃত্যু হলে সে আর জীবনে ফিরে আসতে পারে না।
নূতন প্রজন্মের আরেকটি রবোট বলল, কী আশ্চর্য!
কুরেশিয়া মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, এটি খুব আশ্চর্য। মানুষ মাত্রই আশ্চর্য। মৃত্যু থেকে ফিরে আসা যায় না বলে মানুষ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে খুব সাবধানে, শুধু যখন তাদের অন্য কোনো উপায় থাকে না তখন।
রবোটগুলো কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে স্থির হয়ে বসে রইল। যান্ত্রিক অনুভূতিতে বিষণ্ণতা একটি দুঃসাধ্য প্রক্রিয়া, সে কারণে তারা সত্যিকার অর্থে বিষণ্ণ হতে পারল না।
পরদিন মানুষটির জীবন রক্ষাকারী যন্ত্রটি ব্যবহার করে মানুষটির জ্ঞান ফিরিয়ে আনা হল। মানুষটি তার খোলা চোখ মেলে বলল, আমি কোথায়?
কুরোশিয়া বলল, তুমি রবোনগরীতে
রবোনগরী? এখানে মানুষ নেইঃ
না, আমরা সবাই রবোট। কিন্ধু আমরা তোমাকে সাহায্য করতে চাই।
মানুষটি যন্ত্রণাকাতর মুখে খানিকক্ষণ কুরোশিয়ার ধাতব মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর দুর্বল গলায় বলল, তুমি সত্যিই আমাকে সাহায্য করতে চাও?
হ্যাঁ।
তাহলে মৃত্যুর আগে একবার আমাকে সত্যিকার একজন মানুষের সাথে কথা বলতে দাও।
কুরোশিয়া দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, আমরা যেখানে থাকি–গ্যালাক্সির এই কোনায় কোনো মানুষ নেই।
মানুষটি কোনো কথা না বলে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কুরোশিয়ার মাঝে সত্যিকার মানবিক আবেগ নেই কিন্তু তবু সে মানুষের দুঃখটুকু অনুভব করতে পারল।
ধীরে ধীরে মানুষটির শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। তার গায়ের বর্ণ বিবর্ণ হয়ে আসে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতে থাকে, হৃৎস্পন্দন কমে আসে, শরীরের তাপমাত্রা নিচে নেমে যায়। কুরোশিয়া মাথা নেড়ে অন্য রবোটদের বলল, আর কিছুদিনের মাঝেই মানুষটির মৃত্যু হবে।
নতুন প্রজন্মের একটি রবোট বলল, আমরা কি তার মৃত্যু ত্বরান্বিত করতে পারি না? জীবন রক্ষাকারী প্রক্রিয়াটিতে কি হাত দেয়া যায় না?
কুরোশিয়া মাথা নেড়ে বলল, মানুষের মৃত্যু একটি চূড়ান্ত প্রক্রিয়া, এর থেকে ফিরে আসার কোনো উপায় নেই। আমি সেখানে হাত দেয়া পছন্দ করি না
কাজেই রুগণ মানুষটি কালো ক্যাপসুলে শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতে থাকে। কুরোশিয়া আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করে বলল, মানুষের জীবনীশক্তি অপরিসীম। এই মানুষটি মৃত্যুকে গ্রহণ করে নি বলে তার মৃত্যু হচ্ছে না।
নিরাপত্তা কেন্দ্রের চতুর্থ মাত্রার একটি রবোট বলল, কেন সে মৃত্যুকে গ্রহণ করে নি?