রবোটটা খুশি খুশি গলায় বলল, সেটা আমিও লক্ষ করেছি।
তোমাকে এখন আমরা কাবাব বানিয়ে ছেড়ে দেব।
রবোটটি দীর্ঘশ্বাস ফেলার মতো এক ধরনের শব্দ করে বলল, তার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনারা ইতিমধ্যে আমার অস্ত্রটা নিয়ে নিয়েছেন, জ্যামিং ডিভাইস দিয়ে সবকিছু জ্যাম করে রেখেছেন এখন আমার মাঝে আর একটা কলাগাছের মাঝে বিশেষ পার্থক্য নেই।
না থাকুক–কাসেম এক হাতে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে খুব কায়দা করে ধরিয়ে লম্বা একটা টান দিয়ে বলল, ডাকাতি লাইনের প্রথম কথাই হচ্ছে সাবধানের মার নেই। তোমাকে এক্ষুনি কাবাব বানিয়ে ছেড়ে দেব।
রবোটটি করুণ গলায় বলল, ছেড়ে দেন স্যার। অনেকদিনের রবোট, অনেক স্মৃতি জমা আছে সব শেষ হয়ে যাবে।
বদি নিচু গলায় বলল, ছেড়ে দেন ওস্তাদ! এত করে বলছে–
চুপ ব্যাটা গর্দভ–কাসেম রেগে গিয়ে বলল, তোর মাথার ঘিলু আসলেই হাঁটুতে। এই রকম একটা রবোটের মাঝে কী পরিমাণ কমিউনিকেশানের ব্যবস্থা আছে জানিস? ইচ্ছা করলে সারা দুনিয়াতে খবর পাঠিয়ে দিতে পারে।
রবোটটা বলল, সত্যি কথা স্যার। কিন্তু আপনারা তো সেটা করতে দিচ্ছেন না। আপনারা তো আমার সবকিছু জ্যাম করেই রেখেছেন–
ঘ্যান ঘ্যান কোরো না, চুপ কর। কাসেম সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, তোমার সময় শেষ। যদি চাও তো খোদাকে ডাকতে পার।
রবোটটা অবশ্যি খোদাকে ডাকার কোনো চেষ্টা করল না, বেঢপ একটা ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে রইল
কাসেমের প্রথম গুলিতে রবোটের মাথাটা চূর্ণ হয়ে উড়ে গেল। সেটা কয়েকবার দুলে পড়তে পড়তে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মুণ্ডহীন একটা রবোটকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা খুব বিচিত্র–বদির খুব অস্বস্তি হতে থাকে। সে গলা নামিয়ে বলল, এই শালা কি এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে?
মনে হয়।
একেবারে শেষ কর দিলে হয় না?
শেষ তো হয়েই গেছে। ইচ্ছে হলে দে আরো বারটা বাজিয়ে।
বদি তার হাতের অস্ত্র নিয়ে আবার গুলি করল, রবোটের বুকের কাছাকাছি একটা অংশ প্রায় উড়ে বের হয়ে গেল। গুলির প্রচণ্ড আঘাতে রবোটটি তাল হারিয়ে নিচে পড়ে যেতে থাকে। বদি তার মাঝে আবার গুলি করল এবং এবারে শরীরের অংশগুলো প্রায় আলাদা আলাদা হয়ে ছিটকে পড়ল। রবোটটি কীভাবে তৈরি হয়েছে কে জানে। তার শরীরের নানা অংশ নিচে পড়েও থরথর করে কাঁপতে থাকে। শুধু তাই নয়, একটা পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক জায়গায় লাফাতে থাকে।
বদি দৃশ্যটি দেখে হাসি থামাতে পারে না, কাসেমকে ডেকে বলল, ওস্তাদ! দেখেন, পায়ের কারবারটা দেখেন!
কাসেম সিগারেটটা নিচে ফেলে জুতো দিয়ে পিষে বলল, টিকটিকির লেজের মতো! কাটার পরেও তড়পাতে থাকে।
বদি একটু এগিয়ে গিয়ে বিচ্ছিন্ন পা–টাকে কষে একটা লাথি দিল, পা–টা ছিটকে পড়ল দূরে এবং সেখানেও সেটা নড়তে লাগল। বদি সেদিকে তাকিয়ে আবার হাসতে শুরু করে। শুধু একটা পা হেঁটে বেড়াচ্ছে–দৃশ্যটি যে এত হাস্যকর সেটি নিজের চোখে দেখার আগে সে বুঝতে পারে নি।
ব্যাংকের শক্ত দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকতে তাদের এক ঘণ্টার মতো সময় লাগল। ভিতরে ভল্ট ভাঙতে আরো এক ঘণ্টা। টাকাগুলো বের করে যখন তারা তাদের ব্যাগে গুছিয়ে রাখছে তখন হঠাৎ করে টের পেল সমস্ত ব্যাংকটি পুলিশে ঘিরে ফেলেছে। উপরে। হেলিকপ্টার এবং দূরে সেনাবাহিনী তাদের দিকে মেশিনগান তাক করে রেখেছে। বদি ভাঙা গলায় বলল, কী হল ওস্তাদ?
কাসেম পিচিক করে থুতু ফেলে চাপা স্বরে একটা গালি দিয়ে বলল, খেল খতম।
.
কাসেম আর বদিকে যখন হাতকড়া পরানো হচ্ছে তখন হঠাৎ করে তারা রবোটের সেই ভাঙা পা–টিকে আবার দেখতে পেল। সেটা লাফিয়ে লাফিয়ে পুলিশ অফিসারের কাছে এসে বলল, এই যে মোটা মতন মানুষটাকে দেখছেন এটা হচ্ছে পালের গোদা। আর ওই যে শুটকো মতন মানুষটা তার নাম বদি, সে হচ্ছে চামচা
বদি হতচকিত হয়ে বিচ্ছিন্ন পা–টির দিকে তাকিয়ে রইল, তোতলাতে তোতলাতে বলল, আরে! আরে! তাজ্জবের ব্যাপার–পা দেখি কথা বলে।
পা–টা আবার লাফিয়ে লাফিয়ে পুলিশ অফিসারকে বলল, মোটা মানুষটাকে যে দেখছেন তার মুখ খুব খারাপ। সারাক্ষণ এই চামচাকে গালিগালাজ করে–
বদি নিজেকে সামলাতে পারল না, প্রায় চিৎকার করে বলল, এই এই তুমি কথা বলছ কেমন করে?
পা–টা এবারে লাফিয়ে লাফিয়ে বদির কাছে এসে বলল, কেন সমস্যা কোথায়?
তু–তু–তুমি তো শুধু পা।
তাতে কী হয়েছে? আমি তো আর মানুষ না যে আমার মস্তিষ্ক থাকবে মাথায়। আমি হচ্ছি রবোট। আমার মস্তিষ্ক যেখানে জায়গা হয় সেখানেই রাখা যায়। আমার বেলায় রেখেছে পায়ে।
পায়ে?
শুদ্ধ করে বলতে পার হাঁটুতে। চোখও আছে আমার হাঁটুতে। শোনার জন্যে আছে মাইক্রোফোন আর কথা বলার জন্যে ছোট পিজিও স্পিকার। এই দেখ–
এই বলে পা–টি বদির সামনে ছোট ছোট লাফ দেয়া শুরু করে।
বদি চমকৃত হয়ে বলল, ওস্তাদ! দেখেছেন কী তাজ্জবের ব্যাপার? দেখেছেন। কারবারটা? দেখেছেন?
চুপ কর–কাসেম গর্জে উঠে বলল, চুপ কর গাধার বাচ্চা গাধা। মাথায় কি ঘিলু আছে? নাকি ঘিলুটা রয়েছে–
কাসেম কথাটা শেষ না করে হঠাৎ থেমে গেল। ফোঁস করে বড় একটা নিশ্বাস ফেলল সে।
রবোনগরী
রবোনগরীতে একদিন একটা কালো ক্যাপসুল এসে হাজির হল। প্রথমে সেটি চোখে পড়েছিল যোগাযোগ কেন্দ্রের একজন শৌখিন জ্যোতির্বিদের। অবসর সময়ে সে টেলিস্কোপ চোখে মহাকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, এভাবে তাকিয়ে থাকার সময় সে প্রথম একটি মহাকাশযানকে দেখতে পায়। মহাকাশযানটি ছিল একটি বিধ্বস্ত মহাকাশযান এবং শৌখিন জ্যোতির্বিদ সেটিকে প্রথমে শক্র মহাকাশযান হিসেবে ভুল করেছিল। তারা মহাজাগতিক ইতিহাসের একটি ক্রান্তিলগ্নে বাস করছে, গ্রহে গ্রহে হানাহানি, ধ্বংসযজ্ঞ, শক্তি প্রয়োগ হচ্ছে–সবাইকেই তাই সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। রবোনগরীর সবাই তাই তাদের অস্ত্র উদ্যত করে সতর্ক হয়ে থাকল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা দেখতে পেল মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত এবং তার মাঝে কারগো বলতে একটি কালো ক্যাপসুল। ক্যাপসুলটি খুলে দেখা গেল তার মাঝে জীবন রক্ষাকারী প্রক্রিয়া ব্যবহার করে কোনোভাবে একজন মানুষের জীবনকে বাচিয়ে রাখা হয়েছে।