খোরাসানী সিরিঞ্জ নিয়ে এগিয়ে এলেন, জসিম তার রুগণ দুর্বল দেহে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল কিন্তু লাভ হল না, তার শিরার মাঝে ভয়ঙ্কর একটি বিষ প্রবেশ করিয়ে দেয়া হল।
সিরিঞ্জে বিষ ভরে খোরাসানী যখন লিলির শীর্ণ দেহে আটকে থাকা সুলতানার দিকে এগিয়ে গেলেন সে কাতর গলায় বলল, এটা কি সত্যি? নাকি মিথ্যা?
লিলি বললেন, তোমার কী মনে হয়?
মিথ্যা! নিশ্চয়ই মিথ্যা!
লিলি খিলখিল করে হেসে উঠলেন, বললেন, নাগো ঘাগী বুড়ি,! এটা মিথ্যা না! এটা সত্যি
খোরাসানী যখন লিলির শীর্ণ হাতের একটি শিরায় বিষ প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছিলেন সেই দেহে আটকে থাকা সুলতানা বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে ছিল আতঙ্ক, অবিশ্বাস এবং গম্ভীর হতাশা।
.
খোরাসানী এবং লিলির দেহ–যে দেহ দুটিতে জসিম এবং সুলতানার মৃত্যু ঘটেছে, খোরাসানী এবং লিলি তাদের নিজেদের বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিলেন। পুরো ব্যাপারটিকে জোড়া আত্মহত্যা হিসেবে দেখাতে হবে, আগে থেকে তার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। আত্মহত্যার আগে লিখে যাওয়া চিঠিটা অনেক আগেই লিখে রাখা হয়েছে, গুছিয়ে লেখা চিঠি, মৃত্যুর পরে সেটা প্রকাশ করার কথা। সুদীর্ঘ চিঠি, সেটা শুরু হয়েছে এভাবে : “আমি এবং আমার স্ত্রী জীবনের ভারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের শরীর দুর্বল, জীবনীশক্তি তার শেষ বিন্দুতে এসে পৌঁছেছে। দৈনন্দিন কাজও আমরা আর নিজেরা করতে পারি না, এক একটি দিন এখন আমাদের জন্যে এক একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। আমাদের জীবনকে এভাবে টেনে নিতে নিতে আমরা আজ সত্যিই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তাই অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করেছি পৃথিবী থেকে আমরা বিদায় নেব সম্মানের সাথে। আমরা দুজন একজন আরেকজনের জীবনসঙ্গী এবং জীবনসঙ্গিনী হিসেবে কাটিয়ে এসেছি, পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার সময়েও আমরা একজন আরেকজনের হাত ধরে বিদায় নেব।….”
চিঠির পরের অংশে কীভাবে আত্মহত্যা করবে তার বর্ণনা দেয়া আছে। মৃত্যু নিয়ে দার্শনিক কথাবার্তা আছে, ব্যাপারটিকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করা আছে। সুন্দর করে লেখা হয়েছে, পড়তে গিয়ে চোখের কোনায় পানি এসে যেতে পারে। চিঠির শেষ অংশে জসিম আর সুলতানার কথা লেখা এভাবে :
“মৃত্যুর আগে আগে আমরা জসিম আর সুলতানাকে এনেছিলাম আমাদের দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করার জন্যে। তারা দুজন আমাদের দুই অথর্ব বৃদ্ধ–বৃদ্ধার দিকে ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। বেশিদিন আমরা তাদের ভালবাসার স্পর্শ নিতে পারি নি কিন্তু যেটুকু নিয়েছি তাতে মুগ্ধ হয়েছি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তাদের জীবন সুন্দর হোক। আমাদের যৎকিঞ্চিত সম্পত্তি, বাড়িঘর তাদের দান করে গেলাম– দুজনে এটি দিয়ে যেন তাদের জীবন শুরু করতে পারে। পৃথিবী থেকে বিদায়। সবার জন্যে রইল প্রাণভরা ভালবাসা।….”
চিঠির নিচে প্রফেসর খোরাসানী এবং লিলি পরিষ্কার করে স্বাক্ষর দিয়েছেন, আজকের তারিখ লিখে দিয়েছেন।
চিঠিটা ভাঁজ করে টেবিলের পাশে রাখা হল, তার কাছে রাখা হল, বিষ–মাখানো ইনজেকশানের সিরিঞ্জ। খোরাসানী এবং লিলির দেহ শুইয়ে রেখে চাদর দিয়ে বুক পর্যন্ত ঢেকে দেয়া হল, হাতগুলো বুকের উপর ভাজ করে রাখা, চোখ দুটি বন্ধ।
সবকিছু শেষ করে জসিম এবং সুলতানার দেহে খোরাসানী এবং লিলি মাত্র অভ্যস্ত হতে শুরু করেছেন ঠিক সেই মুহূর্তে নিচে দরজায় শব্দ হল, সাথে সাথে দুজনেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলেন। রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে, এই সময়ে কে আসতে পারে?
খোরাসানী এবং লিলি একজন আরেকজনের দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকালেন এবং ঠিক তখন দরজায় আবার শব্দ হল, এবারে আগের থেকেও জোরে। খোরাসানী পা টিপে টিপে নিচে এসে উঁকি দিলেন, বাইরে বেশ কয়জন পুলিশ শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। খোরাসানী আবার চমকে উঠলেন, এত রাতে পুলিশ কেন এসেছে? দরজায় আবার শব্দ হল, খোরাসানী নিজেকে সামলে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।
দরজা খোলার আগে খোরাসানী একবার লিলির দিকে তাকালেন, লিলি দরজা ধরে পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন, দুর্বলভাবে হেসে খোরাসানীকে একটু সাহস দেবার চেষ্টা করলেন।
দরজা খোলার সাথে সাথে প্রায় হুড়মুড় করে ভিতরে পুলিশগুলো ঢুকে পড়ল, অফিসার ধরনের একজন খোরাসানীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি জসিম?
খোরাসানীর প্রথম প্রতিক্রিয়া হল অপমান এবং ক্রোধ, তিনি একজন সম্মানী, বিজ্ঞানী, এর আগে কেউ তাকে এভাবে হেয় করে সম্বোধন করে নি। কিন্তু তিনি দ্রুত তার অপমান এবং ক্রোধকে নিবৃত্ত করে নিলেন কারণ তিনি আর প্রফেসর খোরাসানী নন, সত্যিই তিনি জসিম, একজন পরিচারক। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ আমি জসিম।
সাথে সাথে একজন কনস্টেবল তাকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল, তিনি আর্তনাদ করে বললেন, কী হয়েছে? কী হয়েছে?
কী হয়েছে জান না? পুলিশ অফিসার ধমক দিয়ে বললেন, ফাজলামোর আর জায়গা পাও না?
আরেকজন কনস্টেবল বলল, স্যার মেয়েছেলেটাকেও বাঁধব?
হ্যাঁ, হ্যাঁ বেঁধে ফেল, ছেড়ে দিও না যেন।
কিছু বোঝার আগেই লিলিকে, যে সুলতানার দেহে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, হাতকড়া দিয়ে বেঁধে ফেলা হল। লিলি ভয়ার্ত গলায় বললেন, কী হয়েছে? কী করেছি আমরা?