নিউরন ম্যাপিং শুরু করার জন্যে প্রফেসর খোরাসানী এবং লিলি আরো মাসখানেক সময় নিলেন। জসিম এবং সুলতানার দৈনন্দিন কাজকর্ম তারা ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন, নূতন পরিবেশে দুজনেই চমৎকারভাবে মানিয়ে নিয়েছে। খোরাসানী এবং লিলি একা একা জীবন কাটিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন, কাজেই জসিম এবং সুলতানার কাছে তাদের দাবি ছিল খুব কম।
নিউরন ম্যাপিঙের জন্যে শেষ পর্যন্ত যে দিনটি বেছে নেয়া হল সেটি ছিল একটি বর্ষণমুখর রাত, আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে, বিজলি চমকে চমকে উঠছে, বাতাসের ঝাঁপটায় জানালা কেঁপে কেঁপে উঠছে। জসিম আর সুলতানার রাতের খাবারের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়া হয়েছে, তারা ঘুমে অচেতন হয়ে থাকলে দীর্ঘ সময়।
খোরাসানী আর লিলি নিউরন ম্যাপিং যন্ত্রটি চালু করে জসিম এবং সুলতানাকে আনতে গেলেন। জসিমের ঘরে উঁকি দিয়ে তারা আবিষ্কার করলেন ঘরটি শূন্য। ঘুমের ওষুধের প্রতিক্রিয়া শুরু হবার আগেই নিশ্চয়ই কোথাও গিয়েছে। দুজনে সুলতানার ঘরে এসে আবিষ্কার করলেন সেখানে জসিম এবং সুলতানা আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে ঘুমোচ্ছে। নিসঃঙ্গ দুজন তরুণ–তরুণীর মাঝে যে এক ধরনের ঘনিষ্ঠতার সৃষ্টি হয়েছে তারা সেটি আঁচ করতে পেরেছিলেন কিন্তু সেই ঘনিষ্ঠতা কোন পর্যায়ে গিয়েছে তারা বুঝতে পারেন নি। খোরাসানী এবং লিলি দুজনে মিলে সুলতানাকে আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে ধরাধরি করে উপরে নিয়ে এলেন। নিউরন ম্যাপিং যন্ত্রের নিচে রাখা বড় ট্রলিতে শুইয়ে রেখে তাকে স্ট্র্যাপ দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিলেন। পাশাপাশি অন্য একটি ট্রলিতে লিলি শুয়ে পড়লেন। খোরাসানী তাকেও স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধতে গেলেন, লিলি আপত্তি করে বললেন, আমাকে বাধছ কেন?
খোরাসানী মৃদু হেসে বললেন, তুমি যদি সবসময় তুমিই থাকতে আমার বাঁধার দরকার ছিল না। কিন্তু খানিকক্ষণ পর তোমার শরীরে ওই মেয়েটি এসে হাজির হবে–তখন সে এটা মেনে নেবে না, ছটফট করবে, চিৎকার করে বাধা দেবে
লিলি মাথা নাড়লেন, বললেন, তা ঠিক। বাধ, আমাকেই তাহলে শক্ত করে বাঁধ!
খোরাসানী শক্ত করে বাঁধতে বাঁধতে বললেন, তোমাকে আমি অনেকবার দেখিয়েছি কী করতে হবে, আমার নিজের বেলায় পুরো ব্যাপারটা করতে হবে তোমার। মনে আছে তো?
মনে আছে।
তখন তোমার অবশ্যি থাকবে নূতন শরীর!
তা ঠিক–লিলি লোভাতুর দৃষ্টিতে ট্রলিতে শুইয়ে রাখা সুলতানার শরীরের দিকে তাকালেন, একটু পরেই সেটা তিনি পেয়ে যাবেন সেটা এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।
খোরাসানী তার যন্ত্রপাতির প্যানেলে ঝুঁকে পড়লেন, মনিটরের দিকে তাকিয়ে সুইচ স্পর্শ করতেই নিউরন ম্যাপিঙের যন্ত্রটা একটা ভোতা শব্দ করে কাজ করতে লাগল। তিনি তার স্ত্রীর দিকে তাকালেন, চোখ বন্ধ করে নিশ্চল হয়ে শুয়ে আছে, সেখানে নিশ্চয়ই এখন সুলতানা এসে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। মেয়েটি যখন সেটা বুঝতে পারবে কী করবে কে জানে? খোরাসানী জোর করে চিন্তাটা তার মাথা থেকে সরিয়ে দিয়ে সুলতানার দেহের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। আর কিছুক্ষণেই এই শরীরটি হবে তার স্ত্রীর। খোরাসানী জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকেন, অনভ্যস্ত উত্তেজনায় তার শরীরে শিহরন বয়ে যেতে থাকে।
পুরো ব্যাপারটি শেষ হতে হতে প্রায় ভোররাত হয়ে গেল। খোরাসানী এবং লিলি কোনোরকম সমস্যা ছাড়াই জসিম আর সুলতানার শরীরে স্থানান্তরিত হয়েছেন, ব্যাপারটিতে অভ্যস্ত হওয়া দূরে থাকুক তারা এখনো সেটা বিশ্বাসই করতে পারছেন না। তারা অবাক বিস্ময়ে নিজেদের দেখছেন, কিছুক্ষণ আগেও যখন দু পা যেতেই তারা হাঁপিয়ে উঠতেন এখন হঠাৎ করে সমস্ত শরীরে এসে ভর করেছে এক বিস্ময়কর সজীবতা, অচিন্তনীয় শক্তি। নির্জীব দেহের বদলে প্রাণশক্তিতে ভরপুর তাজা তরুণ দেহ, তার মাঝে হঠাৎ করে আবিষ্কার করছেন এক ধরনের শারীরিক কামনা। তারা একজন আরেকজনকে দেখে একটু পরে পরে চমকে উঠছেন, তারপর ভুল বুঝতে পেরে নিজেরাই খিলখিল করে হেসে উঠছেন।
জ্ঞান ফিরে পাবার পর খোরাসানী এবং লিলির দেহে জসিম আর সুলতানা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সুলতানার দেহে লিলিকে দেখে জসিম খোরাসানীর শরীরের ভিতর থেকে কাতর গলায় ডেকে বলল, সুলতানা, আমার কী হয়েছে? আমাকে বেঁধে রেখেছে কেন?
লিলি সুলতানার দেহ নিয়ে এগিয়ে এসে বললেন, আমি তোমার সুলতানা নই!
তাহলে সুলতানা কই?
লিলি তার এককালীন শীর্ণ দেহটি দেখিয়ে বললেন, ওই যে তোমার সুলতানা! তোমার ভালবাসার মেয়ে।
খোরাসানীর দেহটি লিলির শীর্ণ দেহটি দেখে চমকে উঠে মাথা নেড়ে বলল, কী বলছ তুমি?
ঠিক এ রকম সময় খোরাসানী একটা সিরিঞ্জে করে খানিকটা বিষ নিয়ে এলেন। তীব্র বিষ, রক্তের সাথে মিশে গেলে কিছুক্ষণের মাঝেই শরীরের স্নায়ু বিকল হয়ে দেহ অসাড় হয়ে যাবে, হৃৎপিণ্ড থেমে যাবে। খোরাসানীকে দেখে জসিম ভয়ানক চমকে উঠল, আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, কারণ সেটি তার নিজের শরীর। সে হতচকিত চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দুর্বল গলায় বলল, তুমি কে?
খোরাসানী মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, আমি হচ্ছি তুমি। কিংবা যদি ইচ্ছে কর তাহলে বলতে পার তুমি হচ্ছ আমি।
জসিম খোরাসানীর দেহ থেকে বিভ্রান্ত শূন্য দৃষ্টিতে নিজের দেহের দিকে তাকিয়ে রইল। খোরাসানী বললেন, পুরো ব্যাপারটা তোমার পক্ষে বোঝা কঠিন। কাজেই ধরে নাও এটা হচ্ছে একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। আমি তোমাকে একটা ইনজেকশান দিচ্ছি, তুমি তাহলে দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে।