খোরাসানী নিচু হয়ে তার স্ত্রীর শীর্ণ হাত ধরে বললেন, তুমি আমার জন্যে তোমার সারা জীবন নষ্ট করেছ লিলি। আমি তোমাকে সব ফিরিয়ে দেব। তোমার জীবন যৌবন সবকিছু।
লিলি জ্বলজ্বলে চোখে তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, সত্যি?
সত্যি লিলি। এস আমার সাথে, আমি তোমাকে দেখাই।
প্রফেসর খোরাসানী স্ত্রীর হাত ধরে তাকে নিউরন ম্যাপিং মডিউলের সামনে নিয়ে গেলেন। কোথায় মাথাটি স্ক্যানারের নিচে রাখতে হয়, স্ক্যানার কীভাবে মস্তিষ্কের নিউরন স্ক্যান করে, কীভাবে তার ভিতরের সুষম সামঞ্জস্য খুঁজে বিশাল সম্ভাব্য সূত্রকে কমিয়ে আনে, কীভাবে সেটা কম্পিউটারের মেমোরিতে সাজিয়ে রাখা হয় এবং কীভাবে একজন মানুষের পুরো স্মৃতি, তার চিন্তাভাবনা, কল্পনা, স্বপ্ন–সাধ সবকিছু সরিয়ে যন্ত্রের মাঝে এনে বন্দি করে। রাখা যায় বুঝিয়ে দিলেন। মানুষের সেই স্মৃতি, সেই স্বপ্ন–সাধ, কল্পনা, ভালবাসা সবকিছু তখন বিপরীত একটা প্রক্রিয়ায় নূতন একজন মানুষের মস্তিষ্কে অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয়া যায়। লিলি বিজ্ঞানী নন, খোরাসানীর সব কথা তিনি বুঝতে পারলেন না, কিন্তু তবু ভাসা ভাসা ভাবে কীভাবে একজন মানুষের শরীরে অন্য একজন মানুষকে প্রবেশ করিয়ে দেয়া যায় তার মূল ভাবটা ধরে ফেললেন। তিনি কাঁপা গলায় বললেন, তুমি সুন্দরী একজন যুবতী মেয়েকে এনে তার শরীরে আমাকে ঢুকিয়ে দেবে?
হ্যাঁ। খোরাসানী মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, তোমার মস্তিষ্কের নিউরন কীভাবে সাজানো আছে সেটা রেকর্ড করা থাকবে এই মেগা কম্পিউটারের বিশাল মেমোরিতে। সেই সাজানো নিউরনের সমস্ত তথ্য একটু একটু করে পৌঁছে দেয়া হবে সুন্দরী কমবয়সী একটা মেয়ের মাথায়। সেই মেয়েটা তখন একটু একটু করে হয়ে যাবে তুমি।
আর সেই মেয়েটা?
প্রফেসর খোরাসানী দুর্বল গলায় বললেন, মেয়েটা পাবে তোমার শরীর।
আমার শরীর? এই শরীর!
হ্যাঁ–তবে বেশিক্ষণের জন্যে নয়।
লিলি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বেশিক্ষণের জন্যে নয় কেন?
প্রফেসর খোরাসানী কঠোর মুখ করে বললেন, কেন এসব নিয়ে তুমি মাথা ঘামাচ্ছ লিলি? মহৎ কিছুর জন্যে সব সময় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আমার আর তোমার জীবনের জন্যে সাধারণ দুজন মানুষ ত্যাগ স্বীকার করবে। আমি আর তুমি একজন সুদর্শন মানুষ আর একজন সুন্দরী মেয়ের শরীর নিয়ে নেব। যন্ত্রটা যেভাবে কাজ করে তার ফল হিসেবে সেই মানুষ আর মেয়েটি পাবে আমাদের শরীর। তারা চাইলেও পাবে, না চাইলেও পাবে! কিন্তু সেই শরীরে তাদের আটকে রেখে কী লাভ? সেটা হবে তাদের জন্যে একটা যন্ত্রণা
লিলির চোখ হঠাৎ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করতে থাকে, তার মানে তাদেরকে তুমি মেরে ফেলবে?
প্রফেসর খোরাসানী বিরক্ত হয়ে বললেন, আহ লিলি, তুমি ঘুঁটিনাটি জিনিস নিয়ে বড় বেশি মাথা ঘামাও। সেই মানুষ দুটিকে নিয়ে কী করা হবে সেটা তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও। যদি তুমি নূতন দেহ নিয়ে নূতন জীবন শুরু করতে চাও তাহলে আমার আর তোমার এই জীর্ণ দেহ নিয়ে অন্য কোনো মানুষকে ঘোরাঘুরি করতে দেয়া যাবে না লিলি। তাছাড়া
তাছাড়া কী?
তাছাড়া আমরা যদি কোনো দেহকে হত্যা করি সেটা হবে আমাদের নিজেদের দেহ। আত্মহত্যা করতে পারলে সেটা অপরাধ নয় লিলি। প্রচলিত আইনে এটা খুন নয়, এটা আত্মহত্যা!
লিলির চোখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করতে থাকে। তিনি তার বুকের ভিতরে এক ধরনের শিহরন অনুভব করেন। একই সাথে আনন্দ এবং ভয়ের শিহরন!
.
প্রফেসর খোরাসানী এবং লিলি তাদের জন্যে যে দুজন মানুষকে বেছে নিলেন তাদের নাম যথাক্রমে জসিম এবং সুলতানা। জসিম চাকরিচ্যুত একজন যুবক, যে ওষুধের ফ্যাক্টরিতে কাজ করত, কয়দিন আগে সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। সুলতানা মফস্বলের মেয়ে, চাকরির সন্ধানে শহরে এসেছে। খবরের কাগজে খোরাসানী এবং লিলি যে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন সেটা পড়ে সে দেখা করতে এসেছিল। বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল :
শহরের উপকণ্ঠে বৃদ্ধ দম্পতির দেখাশোনা করার জন্যে ২০–২৫ বছরের পুরুষ সাহায্যকারী এবং মহিলা পরিচারিকা প্রয়োজন। থাকা, খাওয়া, সাপ্তাহিক ছুটি এবং আকর্ষণীয় মাসিক ভাতা দেয়া হবে। পড়াশোনা অথবা অন্য কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলে ক্ষতি নেই তবে শারীরিক সুস্থতাকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। পাসপোর্ট সাইজের ছবি এবং পারিবারিক তথ্যসহ যোগাযোগ করুন।
বিজ্ঞাপন দেখে জসিম এবং সুলতানার মতো আরো অনেকেই যোগাযোগ করেছিল। খোরাসানী আর লিলি সেখান থেকে বেছে সুদর্শন এবং সুন্দরীদের আলাদা করে ডেকে পাঠালেন। যদিও তাদের সাথে গৃহ পরিচর্যা, রান্না–বান্না, স্বাস্থ্যবিধি এই ধরনের বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হল কিন্তু তাদের প্রকৃত নজর ছিল এই যুবক এবং যুবতীদের শরীরের দিকে। অন্য সময় হলে কমবয়সী এই যুবক–যুবতীর সুন্দর সুঠাম দেহ দেখে তারা এক ধরনের ঈর্ষা অনুভব করতেন, কিন্তু এখন ঈর্ষার বদলে তাদের ভিতরে সূক্ষ্ম আত্মপ্রসাদের বোধ জেগে উঠছিল। আর কয়দিনের মাঝেই এই দেহগুলোর কোনো–কোনোটি হবে তাদের। ব্যাপারটা এখনো তারা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
প্রফেসর খোরাসানী এবং লিলি অন্য অনেকের মাঝে থেকে জসিম এবং সুলতানাকে বেছে নিলেন তাদের পারিবারিক অবস্থার জন্যে। তারা দুজনেই আত্মীয়–পরিজনহীন, দুজনেই নিঃসঙ্গ এবং পরিচিত জগৎ থেকে এই দুজন হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেলে খুব বেশি মানুষ তাদের জন্যে বিচলিত হবে না। জসিম এবং সুলতানাকে ডাক্তার দিয়ে ভালো করে পরীক্ষা করিয়ে খোরাসানী এবং লিলি তাদের নিজেদের বাসায় উঠে আসতে বললেন।