প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে দুই শ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটা দ্বীপ আলাদা করে রাখা আছে তোমাদের জন্যে। সেই দ্বীপের দশ হাজার কিলোমিটারের ভিতর থেকে সমস্ত মানুষকে অপসারিত করা হয়েছে। সেই নির্জন দ্বীপে তোমাদের জন্যে ঘর তৈরি হয়েছে, সর্বশ্রেষ্ঠ ল্যাবরেটরি তৈরি করা হয়েছে, সর্বশ্রেষ্ঠ ওয়ার্কশপ, হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে। সর্বশ্রেষ্ঠ বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, বিদ্যুৎ পানি গ্যাস তাপের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু এই সর্বশ্রেষ্ঠ জিনিসগুলো তৈরি হয়েছে সাময়িকভাবে। তোমাদের ঘর এক বছরের মাথায় জীর্ণ হয়ে আসবে, দুই বছরের মাঝে ধ্বংস হয়ে যাবে। ওয়ার্কশপের যন্ত্রপাতিতে জং ধরবে, ছাদ ভেঙে পড়বে। হাসপাতালের ওষুধ ফুরিয়ে যাবে, ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি ভেঙে যাবে। তোমাদের খাবার ফুরিয়ে যাবে, রসদ থাকবে না। পানি গ্যাস বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, এই দ্বীপটি বেছে নেয়া হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিকূল এলাকায়। এখানে টাইফুন এসে আঘাত হানে, সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসে সব ভেসে যায়, আগ্নেয়গিরির লাভা এসে ডুবিয়ে দেয়, ভূমিকম্পে কেঁপে কেঁপে ওঠে। শুধু তাই নয়, এই যে তোমরা হাসিখুশি তরুণ–তরুণীরা আছ তার মাঝে রয়েছে কিছু টাইম–বম্ব। তোমরা নিজেরাও জান না যারা হঠাৎ করে পাল্টে যাবে ভয়ঙ্কর ক্রিমিনালে। যাদের সহজ সরল হাসির পিছনে জন্ম নেবে লোত, নিষ্ঠুরতা, ক্ষমতার মোহ।
তোমরা এই এক হাজার তরুণ–তরুণী সেই দ্বীপটিতে বাস করবে। পৃথিবীর সাথে তোমাদের কোনো যোগাযোগ থাকবে না। সবাই তোমাদের কথা ভুলে যাবে। তোমাদের উপর দিয়ে কোনো প্লেন উড়বে না, কোনো উপগ্রহ তোমাদের ছবি তুলবে না। তোমাদের সাথে কেউ কথা বলবে না, তোমরাও কারো সাথে কথা বলবে না।
তোমাদের কেউ বিদায় জানাবে না, পৃথিবীর সব মানুষের অগোচরে তোমরা সেই দ্বীপে আশ্রয় নেবে। পৃথিবীর এক ভয়ঙ্কর প্রতিকূলতায় তোমরা বেঁচে থাকবে। আমরা সভ্য জগতের মানুষেরা যে সহজ আরামে অভ্যস্ত হয়েছি তোমাদের সেটা থাকবে না। তোমাদের জীবন হবে কঠোর। সেই কঠোর জীবনে তোমরা নিশ্চয়ই জন্ম দেবে একটি নূতন সভ্যতা। পৃথিবীর মানুষ যখন জন্ম দেবে অলস অকর্মণ্য প্রজাতি, তখন তোমরা সৃষ্টি করবে এক তেজস্বী শক্তিশালী জাতি। তোমাদের হাতে জন্ম নেবে নূতন জ্ঞান, নূতন আবিষ্কার, নূতন সমাজব্যবস্থা।
সেই নির্জন দ্বীপে তোমাদের কথা কোনো মানুষ জানবে না। শক্তিবলয় দিয়ে তোমাদের ঘিরে রাখা হবে, সেই বলয় কেউ ভেদ করে আসতে পারবে না। পৃথিবীর ভিতরেই তোমরা জন্ম দেবে নূতন পৃথিবীর। আজ থেকে কয়েক শতাব্দী পরে, হয়তো তোমরা শক্তিবলয় ভেদ করে ফিরে আসবে এই পৃথিবীতে। মানব–জগৎ পাল্টে যাবে চিরদিনের মতো। সভ্যতার নূতন যুগের সৃষ্টি হবে এই পৃথিবীতে।
গ্রানাইট পাথরের বিশাল হলঘরে এক হাজার তরুণ–তরুণী মন্ত্রমুগ্ধের মতো চুপ করে বসে থেকে থিরুর কথা শুনতে থাকে। তাদের বুকের মাঝে একই সাথে আশা এবং আশঙ্কা। স্বপ্ন এবং আতঙ্ক। জীবন এবং মৃত্যু।
***
খুব ধীরে ধীরে বিরু ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। অপারেশন অপক্ষেপের তিনি হচ্ছেন একমাত্র দর্শক। নির্জন দ্বীপের এক হাজার তরুণ–তরুণীর সাথে তিনিও এসেছিলেন দ্বীপে। দ্বীপের শক্ত পাথরের গভীরে এক শ মিটার নিচে গোপন ভল্টে তার শরীরকে শীতল করে রাখা হয়েছিল গোপনে। পৃথিবীতে তার মৃত্যুর যে খবর প্রচার করা হয়েছিল সেটি সত্যি ছিল না। যে দেহটি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয়েছিল সেটিও তার শরীর ছিল না।
বিজ্ঞান একাডেমীর মহাপরিচালক থিরু নিজের হাতে এই অপারেশান অপক্ষেপ দাঁড়া করিয়েছিলেন। এক শ বছর পর এই অপারেশান অপক্ষেপ কোন স্তরে এসে পৌঁছেছে জানার জন্যে তিনি গত এক শতাব্দী পাথরের আড়ালে ঘুমিয়েছিলেন। এখন তার ঘুম ভেঙেছে, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে তার শরীরকে পুনর্জীবিত করা হয়েছে। তিনি এখন পাথরের আড়াল থেকে বাইরে যাবেন, নির্জন দ্বীপে জন্ম নেয়া এক নূতন সভ্যতাকে নিজের চোখে দেখবেন।
থিরু নিজের বুকের ভিতরে এক ধরনের কম্পন অনুভব করেন। বের হয়ে কী দেখবেন তিনি? উৎসাহী মানুষের কলকাকলিতে মুখরিত জনপদ, বিশাল সুরম্য অট্টালিকা, জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির স্পর্শে সৃষ্ট নূতন ধরনের পরিবহন পদ্ধতি? নাকি দেখবেন জনমানবশূন্য এক বিশাল ধু–ধু প্রান্তর? প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি জনপদ?
থিরু একটা নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। কী দেখবেন তিনি জানেন না, কিন্তু তাকে এখন বাইরে যেতে হবে, দেখতে হবে এই নূতন সভ্যতা কিংবা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। এক শতাব্দী তিনি এই মুহূর্তটির জন্যে অপেক্ষা করে আছেন।
শক্ত পাথরের গভীরে এক শ মিটার নিচের গোপন ভল্ট থেকে একটা অর্ধলোকিত সুড়ঙ্গ দিয়ে তিনি উপরে উঠে এলেন। বাইরে বের হতেই শীতল একটি বাতাস তার শরীরকে স্পর্শ করল, তিনি বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে বাইরে তাকালেন। সামনে অপূর্ব কিছু অট্টালিকা, শক্ত গাঁথুনি, অপূর্ব নকশা–কাটা। সন্ধ্যার আবছা আলোতে চিকচিক করছে। দুইপাশ দিয়ে সরু পথ নেমে গিয়েছে। উঁচুতে কাঁচে ঢাকা গোলাকার স্টেশন। রাস্তার পাশে সবুজ দেবদারু গাছ।