আপনি দেখবেন? ক্রিটি মৃদু হেসে বলল, এটা মাথায় পরবেন?
হ্যাঁ, পরব। জেনারেল রাউল তার চেয়ার ছেড়ে উঠে স্বপ্ন মেশিনের কাছাকাছি একটা চেয়ারে এসে বসলেন।
হেলমেটটি মাথায় পরে নেবার পর ক্রিটি ভালো করে সেটা একবার পরীক্ষা করে নিল। যন্ত্রটার উপর ঝুঁকে পড়ে সুইচটা অন করে দেবার সাথে সাথে আবার যন্ত্রের ভিতর থেকে একটা মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল। ক্রিটি জেনারেল রাউলের দিকে তাকিয়ে কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, যদি ভালো একটা পাওয়ার সাপ্লাই পেতাম তাহলে যন্ত্রটাকে একেবারে শব্দহীন করে দেয়া যেত।
রাউল কোনো কথা বললেন না, মুখ শক্ত করে বসে রইলেন। ক্রিটি বলল, যন্ত্রটি কাজ করতে শুরু করেছে, এখন আপনাকে মধুর একটা জিনিস ভাবতে হবে। মধুর এবং আনন্দের এবং সুখের
হ্যাঁ, চেষ্টা করছি। রাউল তার চেয়ারে নড়েচড়ে বসে বললেন, আমার বয়সে পৌঁছে গেলে স্মৃতি দুর্বল হয়ে যায়। সহজে কিছু মনে হতে চায় না।
ক্রিটি যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, সেটা নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। আপনার প্রিয়জনের কথা ভাবুন। আপনার সন্তান–আপনার স্ত্রী
স্ত্রী! জেনারেল রাউল চমকে উঠলেন–হঠাৎ করে তার স্ত্রীর কথা মনে পড়ে গেল। তার ভয়ঙ্কর স্ত্রী যে তার বিবাহিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কলুষিত করে রেখেছিল। ভয়ঙ্কর নিরানন্দ যন্ত্রণায় বিষাক্ত করে রেখেছিল। যে তাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করত আর যাকে তিনি সমস্ত চেতনা দিয়ে ঘৃণা করতেন। জেনারেল রাউল অনেকদিন পর হঠাৎ করে তার ভিতরে আবার সেই সুপ্ত ঘৃণা, ক্রোধ এবং বিতৃষ্ণা অনুভব করলেন।
চমৎকারভাবে শুরু করেছেন। ক্রিটি উত্তেজিত গলায় বলল, দেখা যাচ্ছে আপনার ভিতরে খুব সতেজ একটা অনুভূতির জন্ম হয়েছে। এক্ষুনি ফিডব্যাক শুরু হবে। আপনি অনুভূতিটা ধরে রাখুন।
জেনারেল রাউল তার ভিতরে রাগ, ঘৃণা, বিতৃষ্ণা, বিদ্বেষ এবং তার সাথে সাথে এক ধরনের অসহায় আতঙ্ক অনুভব করতে থাকেন। বুঝতে পারেন আস্তে আস্তে রাগ ঘৃণা আর আতঙ্ক বাড়তে শুরু করেছে, তার চেতনাকে ঐচ্ছিন্ন করতে শুরু করেছে। বিচিত্র এই ভয়ঙ্কর অনুভূতি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে কুৎসিত কালো ঘৃণায় তার সমস্ত শরীর শিউরে উঠতে থাকে, প্রচণ্ড ক্রোধে তার শরীরে রক্ত ফুটতে থাকে। মানুষের প্রতি, জগৎ সংসারের প্রতি ভয়ঙ্কর বিদ্বেষ জীবন্ত কোনো প্রাণীর মতো তার চামড়ার নিচে কিলবিল করতে থাকে। সাথে সাথে বিজাতীয় এক আতঙ্ক তাকে গ্রাস করতে থাকে, যে আতঙ্কের ভয়াবহতার কোনো তুলনা নেই। মহাসমুদ্রের প্লাবনের মতো তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করে–
জেনারেল রাউল ভয়ঙ্কর চোখে ক্রিটির দিকে তাকালেন–ক্রিটি মাথা নিচু করে তার যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই সাবধানে নবটি স্পর্শ করে বলল, দেখতে পাচ্ছি আপনার ফিডব্যাক শুরু হয়ে গেছে। বাড়িয়ে দিচ্ছি আমি, আপনার অনুভূতির তীব্রতা এখন বেড়ে যাবে বহুগুণ। হাজার লক্ষ বা আরো বেশি
ক্রিটি যন্ত্রের নবটাকে ঘুরিয়ে দিতেই জেনারেল রাউল এক ভয়ঙ্কর রক্ত–শীতল–করা আর্তনাদ করে জান্তব ক্ষিপ্রতায় চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন। পশুর মতো চিৎকার করতে করতে মাথা কুটতে কুটতে তিনি দুই হাতে নিজের মুখের চামড়া খামচে ধরে নিজেকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলার চেষ্টা করতে লাগলেন। জান্তব স্বরে গোঙাতে লাগলেন, বীভৎস ভঙ্গিতে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে গড়িয়ে পড়লেন…
***
কয়েকদিন পর জেনারেল রাউলকে তার প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রীর পদ থেকে অবসর দেয়ার খবরটি সংবাদপত্রে ছোট করে ছাপা হল।
কেন তাকে অবসর দেয়া হল সেটি কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কোথাও ছাপা হল না।
নিউরন ম্যাপিং
লিলি, আমি জানি তুমি বিশ্বাস করবে না প্রফেসর খোরাসানী তার মাথার সাদা চুলকে হাত দিয়ে পিছনে ঠেলে দিয়ে উত্তেজিত গলায় বললেন, কিন্তু আমার নিউরন ম্যাপিং যন্ত্র শেষ হয়েছে।
হৃতযৌবনা লিলি ক্লান্ত চোখে তার খ্যাপাটে এবং প্রায় বাতিকগ্রস্ত স্বামীর দিকে তাকালেন, তিনি আগেও অনেকবার তার মুখে এই কথা শুনেছেন, কাজেই কথাটি বিশ্বাস করবেন কি না বুঝতে পারলেন না। প্রফেসর খোরাসানী দুই পা এগিয়ে এসে তার স্ত্রীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উত্তেজিত গলায় বললেন, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না?
না। লিলি নিচু গলায় বললেন, আমি একবার তোমার কথা বিশ্বাস করে তোমাকে বিয়ে করেছিলাম, আজ দেখ আমার কী অবস্থা!
তোমার এই অবস্থা দূর হয়ে যাবে লিলি।
আমি বিশ্বাস করি না–লিলি গলায় বিষ ঢেলে বললেন, তোমার কোনো কথা আমি বিশ্বাস করি না।
প্রফেসর খোরাসানী কাতর গলায় বললেন, বিশ্বাস কর লিলি, সত্যি আমার কাজ শেষ হয়েছে। যার জন্যে আমি আমার সারা জীবন নষ্ট করেছি, অপেক্ষা করে করে তুমি তোমার সারা জীবন শেষ করে এনেছ, সেই কাজ শেষ হয়েছে।
লিলি স্থির চোখে তার বৃদ্ধ স্বামীর দিকে তাকালেন, মুখের কুঞ্চিত চামড়া, নিষ্প্রভ চোখ, সাদা শণের মতো চুল– এই কি তার যৌবনের স্বপ্নরাজ্যের সেই রাজপুত্র? তার এখন আর বিশ্বাস হয় না। কিন্তু সত্যিই যদি এই অথর্ব বৃদ্ধ তার কাজ শেষ করে থাকে তাহলে কি তার সেই যৌবনের রাজপুত্র আবার তার কাছে ফিরে আসবে না? তিনি নিজেও ফিরে পাবেন তার হৃত যৌবন? লিলি বয়সের ভারে ন্যুব্জ দেহে হঠাৎ করে অনভ্যস্ত এক ধরনের উত্তেজনার শিহরন অনুভব করলেন।