ক্রিটি একটু হেসে বলল, যখন মানুষেরা নানা দুঃখ কষ্ট হতাশায় ডুবে যায় তখন তারা এ রকম একটা যন্ত্রের কাছে আসে। এটা মাথায় লাগিয়ে বসে। তার ভিতরে তখন কোনোভাবে একটা ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি করা হয়। ছোট একটা আশার বাণী বলা হয়। সেটা থেকে তার ভিতরে জন্ম নেয় বিশাল এক উৎসাহ। সত্যিকারের একটা স্বপ্ন জেগে ওঠে তার বুকে। মনে হয় সে জন্যেই এর নাম দিয়েছে স্বপ্ন মেশিন।
জেনারেল রাউল থমথমে মুখে খানিকক্ষণ বসে রইলেন তারপর জিজ্ঞেস করলে আপনাদের এলাকায় এ রকম যন্ত্র কয়টা রয়েছে?
আমি ঠিক জানি না। কীভাবে তৈরি করা যায় সেটা গোপন কিছু নয়, আমি সবাইকেই বলে দিই। ছোটখাটো জঞ্জাল থেকে তৈরি হয় বলে অসংখ্য যন্ত্র রয়েছে। তার মাঝে কিছু কিছু কাজ করে, কিছু করে না। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস দিয়ে সেটা পুষিয়ে নেয়।
জেনারেল রাউল হাত দিয়ে টেবিলের উপরে রাখা বিচিত্র যন্ত্রটাকে দেখিয়ে বললেন, এটা কি সত্যিকারভাবে কাজ করে?
করে।
আমাকে দেখাতে পারবেন?
ক্রিটি একটু অবাক হয়ে জেনারেল রাউলের দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, আপনি সত্যি দেখতে চান?
হ্যাঁ, চাই।
ক্রিটি টেবিলের উপর থেকে হেলমেটের মতো একটা জিনিস তুলে জেনারেল রাউলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, প্রথমে এটা আপনার মাথায় পরতে হবে।
জেনারেল রাউল একটু ইতস্তত করে বললেন, না, প্রথমে আমি নিজে এটা পরতে চাই না। প্রথমে অন্য কাউকে দিয়ে পরীক্ষা করানো যাক।
রাউল ঘুরে নুবার দিকে তাকিয়ে বলল, কী বল নুবা?
নুবা মাথা নাড়ল, বলল, নিরাপত্তার দিক থেকে চিন্তা করে সেটা মনে হয় ঠিকই বলেছেন।
কাকে দিয়ে পরীক্ষা করানো যায়? 69
নুবা বলল, আপনার আপত্তি না থাকলে আমি এটা পরতে পারি। এটা সম্পর্কে এত চমৎকার সব রিপোর্ট এসেছে যে আমার এমনিতেই খুব কৌতূহল হচ্ছে।
জেনারেল রাউল নুবার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি পরতে চাও?
জি জেনারেল। আপনি যদি আপত্তি না করেন।
জেনারেল রাউল মাথা নাড়লেন, বললেন, না, কোনো আপত্তি নেই।
নুবা ক্রিটির কাছাকাছি একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। ক্রিটি তার মাথায় হেলমেটটি পরিয়ে দেয়। সেটা ঠিকভাবে লাগানো হয়েছে কি না পরীক্ষা করে যন্ত্রটার একটা সুইচ অন করে দেয়। সাথে সাথে যন্ত্রের ভিতর থেকে একটা মৃদু গুঞ্জনের মতো শব্দ শোনা যেতে থাকে। ক্রিটি যন্ত্রের প্যানেলে কিছু একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করে নুবার দিকে তাকিয়ে সহৃদয়ভাবে হেসে বলল, এখন তোমাকে মিষ্টি একটা ভাবনা ভাবতে হবে। সুখের বা আনন্দের কোনো স্মৃতি–
নুবা মাথা নাড়ল, ঠিক আছে।
বল, তোমার প্রিয় মানুষ কে?
আমার ছেলে। দু বছরের ছেলে।
কী করে তোমার ছেলে?
ছেলের কথা মনে করে নুবার মুখ হঠাৎ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে মৃদু হেসে কোমল গলায় বলল, এত দুষ্ট তুমি চিন্তা করতে পারবে না।
কী করে সে?
আমি যখন বাসায় যাই সাথে সাথে দরজার আড়ালে লুকিয়ে যায়। তখন আমাকে ভান করতে হয় তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। আমি তাকে ডাকাডাকি করি তখন হঠাৎ ছুটে বের হয়ে এসে পিছন থেকে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে–
তুমি কী কর?
আমি তাকে বলি ছাড় ছাড়, সে কিছুতেই ছাড়ে না, আমাকে ধরে ঝুলে থাকে–
ক্রিটি তার যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বলল, ফিডব্যাক শুরু হয়ে গেছে। তোমার বাচ্চার কথা মনে করে তোমার ভিতরে আনন্দের যে অনুভূতি জন্ম হয়েছিল এখন সেটা বাড়তে থাকবে।
নুবার সারা মুখ হঠাৎ এক ধরনের বিস্ময়কর আনন্দের আভায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে সোজা হয়ে বসে এবং তার চোখ দুটি জ্বলজ্বল করতে থাকে। সে ফিসফিস করে বলে, কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!
ক্রিটি আবার মৃদু গলায় বলল, ফিডব্যাকটা খুব চমৎকারভাবে শুরু হয়েছে। আমি বলতে পারি এটা একেবারে অনায়াসে দশ ডিবি চলে যাবে।
নুবার মুখে আনন্দ এবং ভালবাসার এমন একটি মধুর ছাপ পড়ল যে জেনারেল রাউল সেখান থেকে চোখ ফেরাতে পারলেন না। তিনি এক ধরনের ঈর্ষার দৃষ্টিতে নুবার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
নুবাকে প্রায় পনের মিনিট স্বপ্ন মেশিনে স্টিমুলেশান দেয়া হল। নব ঘুরিয়ে যখন ফিডব্যাক কমিয়ে নিয়ে এসে তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হল তখনো তার মুখে বিস্ময়ের ছাপ লেগে রয়েছে।
জেনারেল রাউল নুবার দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কেমন লাগছিল নুবা?
নুবা বুকের ভিতর থেকে একটা বড় নিশ্বাস বের করে বলল, আমি–আমি–আমি সেটা বোঝাতে পারব না। ভালবাসা আনন্দ আর সুখের এত তীব্র একটা অনুভূতি যে সেটা আমি কোনোদিন অনুভব করি নি। সাধারণ সুখ, আনন্দ ভালবাসা থেকে সেটা হাজার গুণ, লক্ষ গুণ বেশি। তীব্র। এত মধুর সেই অনুভূতি যে আমার মনে হচ্ছে আমি সারা জীবনের জন্যে পাল্টে গেছি।
মধুর অনুভূতি?
জি। আপনি যতক্ষণ নিজে এটা অনুভব না করছেন ততক্ষণ সেটা আপনাকে বোঝানো সম্ভব নয়। এই অনুভূতি এত তীব্র যে এটাকে বলা যায় সম্পূর্ণ নূতন একটা অনুভূতি। সেই অনুভূতি মানুষ এর আগে কোনোদিন অনুভব করে নি। যখন সেটা এসে ভর করে তখন মনে হবে আপনি বুঝি মানুষ নন, মানুষ থেকে উন্নত কোনো মহাজাগতিক প্রাণী, কিংবা স্বর্গের দূত বা সেরকম একটা কিছু। তাদের অনুভূতিও অন্য রকম–
জেনারেল রাউল হঠাৎ ঘুরে ক্রিটির দিকে তাকালেন, তারপর শক্ত গলায় বললেন, আমি নিজে এখন এটা পরীক্ষা করে দেখতে চাই।