মানুষটি খুব সহজ ভঙ্গিতে তার সামনের চেয়ারটিতে বসল।
জেনারেল রাউল একটু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এই মেশিন তৈরি করেছেন?
হ্যাঁ।
এর জন্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আপনাকে কে দিয়েছে?
কেউ দেয় নি। আমি জোগাড় করেছি।
আপনি জানেন এটা বেআইনি?
ক্রিটি হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল, না, এটা বেআইনি নয়। আমাদের এলাকায় আপনাদের এলাকার সমস্ত জঞ্জাল ফেলা হয়। সেইসব জঞ্জালে নানা ধরনের ভাঙাচোরা যন্ত্রপাতি রয়েছে আমি সেইসব ঘেঁটে ঘেঁটে বের করে এটা তৈরি করেছি।
এটা কীভাবে কাজ করে?
ক্রিটি একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, আপনি জানতে চাইলে আপনাকে বলতে পারি, কিন্তু আপনি বুঝতে পারবেন কি না আমি জানি না। মানুক্ষের মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে, নিউরনের মাঝে দিয়ে কীভাবে তথ্য–সঙ্কেত আদানপ্রদান করে সেসব সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান না থাকলে আপনি কিছু বুঝতে পারবেন না
জেনারেল রাউল নিজের ভিতরে অপমানের একটা সূক্ষ্ম খোঁচা অনুভব করলেন, অনেক কষ্টে সেটা সহ্য করে শান্ত গলায় বললেন, আপনি বলুন, আমি বুঝতে চেষ্টা করব।
মানুষের মস্তিষ্কে তথ্যের আদান–প্রদান করা হয় অত্যন্ত সূক্ষ্ম বৈদ্যুতিক সঙ্কেত দিয়ে, এই সঙ্কেত অনেকদিন থেকেই যন্ত্রপাতি দিয়ে মাপা হয়ে আসছে। আমি পদ্ধতিটি একটু উন্নত করেছি। পরিত্যক্ত জঞ্জালে আমি কমিউনিকেশানের কিছু মডিউল থেকে অত্যন্ত সূক্ষ্ম বৈদ্যুতিক সিগনাল গ্রহণ করতে পারে এ রকম কিছু যন্ত্র নিয়ে এসেছি। তার জন্যে প্রয়োজনীয় কিছু এমপ্লিফায়ার এনেছি পরিত্যক্ত কিছু ভিডিও সেট থেকে। দুটো বসিয়ে একটা সার্কিট তৈরি করেছি। যদি কোনো মানুষের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কম্পনের সাথে সেটা টিউন করা যায় তাহলে তার মস্তিষ্কে কী ধরনের তথ্য আদান–প্রদান হচ্ছে সেটা সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা করার একটা উপায় বের করেছি।
জেনারেল রাউল একটু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, তার মানে একটা মানুষ কী নিয়ে চিন্তা করছে সেটা এই যন্ত্র বলতে পারে?
ক্রিটি আবার হেসে ফেলল। হাসি থামিয়ে বলল, খুব সোজা করে যদি বলতে চান তাহলে বলতে পারেন। কিন্তু আপনি তো জানেন চিন্তার ঘুঁটিনাটি কী অসম্ভব জটিল ব্যাপার। সেই পর্যায়ে এখনো যেতে পারি নি–আমরা যে পরিবেশে থাকি সেখানে কোনোদিন যেতে পারব বলে মনে হয় না। তবে মোটামুটিভাবে বলা যায় চিন্তাটা কি আনন্দের না দুঃখের, রাগের না অভিমানের।
জেনারেল রাউলকে একটু বিভ্রান্ত দেখাল, ইতস্তত করে বললেন, তাহলে এটাকে স্বপ্ন মেশিন বলে কেন?
ক্রিটি মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি না এটাকে কেন স্বপ্ন মেশিন বলে–এর মাঝে স্বপ্নের কিছু নেই। তবে আমার মনে হয় এই যন্ত্রটাতে যখন ফিডব্যাক সার্কিট লাগানো হল তখন হঠাৎ করে এটার সত্যিকারের একটা ব্যবহার শুরু হয়েছে।
কী ব্যবহার?
মনে করা যাক, কারো মনে একটা আনন্দের অনুভূতি হয়েছে এবং এই যন্ত্র সেটি ধরতে পেরেছে। তখন বাইরে থেকে মস্তিষ্কের ভিতরে খুব ছোট একটা স্টিমুলেশান দেয়া হয়। দেখা হয় এই স্টিমুলেশান দেয়ার ফলে মস্তিষ্কে আনন্দের অনুভূতি কি বাড়ছে না কমছে। যদি বাড়তে থাকে তাহলে সেটা আরো বেশি করে দেয়া হয়, তখন আনন্দের অনুভূতিটা আরো বেড়ে যায়, তখন আরো বেশি স্টিমুলেশান দেয়া হয়। কাজেই মনের ভিতরের ছোট একটা আনন্দের অনুভূতি থেকে শুরু করে তীব্র একটা আনন্দ সৃষ্টি করা যায়। ভয়ঙ্কর তীব্র একটা আনন্দ যারা সেটা অনুভব করেছে শুধু তারাই জানে কী অসাধারণ সেই অনুভূতি!
জেনারেল রাউল তীক্ষ্ণ চোখে ক্রিটির দিকে তাকিয়ে রইলেন, একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বললেন, ড্রাগসের মতো?
ক্রিটি থতমত খেয়ে বলল, কিসের মতো?
ড্রাগস। মাদকদ্রব্য। মানুষ যখন তার শিরার মাঝে সিরিঞ্জ দিয়ে ভিচুবিয়াস ঢুকিয়ে দেয় তখন তাদের যেরকম তীব্র আনন্দ হয় সেরকম?
ক্রিটি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, অনেকটা সেরকম। তবে মাদকদ্রব্যের সাথে এর একটা খুব বড় পার্থক্য রয়েছে, এতে কোনো নেশা হয় না। একবার স্বপ্ন মেশিন ব্যবহার করলে বার বার সেটা ব্যবহার করার জন্যে কেউ খেপে ওঠে না।
কেন?
কারণ এই তীব্র অনুভূতি সাময়িক নয়। এই অনুভূতি মস্তিষ্কে আনন্দের একটা পাকাঁপাকি ছাপ রেখে যায়। তাছাড়া মাদকদ্রব্যের মতো এই অনুভূতি শুধু এক ধরনের নয়। এই যন্ত্র দিয়ে আপনি যেকোনো ধরনের অনুভূতি পেতে পারেন। যদি মনের ভিতরে অল্প একটু পবিত্র ভাব জন্ম নেয় সেটা থেকে তীব্র গভীর একটা পবিত্র ভাব আসে। যদি এক ধরনের সুখের অনুভূতি হয় সেটা থেকে তীব্র একটা সুখের অনুভূতির জন্ম হয়। যদি কোনোভাবে মনের মাঝে অল্প একটু প্রশান্তির জন্ম হয় সেখান থেকে গভীর প্রশান্তির জন্ম দেয়া যায়। মনের ভিতরে যদি অল্প একটু আত্মবিশ্বাস তৈরি করে দেয়া যায় সেটা থেকে তৈরি হয় গভীর প্রচণ্ড একটা আত্মবিশ্বাস। অল্প একটু আশা থেকে বুকের ভিতরে নূতন। আশার বান ডেকে যায়। সেইসব অনুভূতি এত তীব্র যে তাকে বলা যায় সম্পূর্ণ নূতন এক ধরনের অনুভূতি। পৃথিবীর মানুষের সেই অনুভূতির সাথে পরিচয় নেই।
জেনারেল রাউল মাথা নেড়ে বললেন, বুঝেছি। এটা একটা অনুভূতি তীব্র করার যন্ত্র। কিন্তু এখনো বুঝতে পারলাম না কেন এর নাম স্বপ্ন মেশিন?