অফিসে বসে জেনারেল রাউল দীর্ঘ সময় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন, তারপর একটা বড় নিশ্বাস ফেলে টেবিলের কাগজপত্রের দিকে তাকালেন, সেগুলো এক নজর দেখে তিনি তার সেক্রেটারি নুবাকে ডেকে পাঠালেন। নুবা কমবয়সী হাসিখুশি একজন অত্যন্ত চৌকস মেয়ে, জেনারেল রাউল নানাভাবে নুবার ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।
নুবা ঘরে ঢুকে অভিবাদন করে কোমল গলায় বলল, আমাকে ডেকেছেন?
হ্যাঁ। জেনারেল রাউল টেবিলের উপরে রাখা কাগজগুলো সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন, টাউনশিপগুলোতে আবার নূতন করে হাঙ্গামা হচ্ছে?
জি। নুবা মাথা নেড়ে বলল, হাঙ্গামা হচ্ছে।
আমি যে শক্ত হাতে থামানোর কথা বলছিলাম তার কী হল?
সেটাও করা হচ্ছে জেনারেল। তারপরেও হচ্ছে। মানুষজনের ভয়ভীতি আজকাল কমে গিয়েছে।
প্রজেক্টগুলোর কী খবর?
ভালোই। প্রজেক্ট এক্স শেষ হবার দিকে। টাউনশিপগুলোতে খাবারের চালান আটকে দেয়া হয়েছে। খবরে প্রকাশ করা হয়েছে তাদের নিজেদের মাঝে গোলমালের জন্যে এটা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সংবাদ মিডিয়াগুলো আমাদের খুব চমৎকারভাবে সাহায্য করছে। পুরো ব্যাপারটাই অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে
প্রজেক্ট লুন?
সেটা মাত্র শুরু করা হয়েছে। জেলখানা থেকে এখন পর্যন্ত দশ হাজার ঘাঘু অপরাধী ছাড়া হয়েছে, তাদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করা হচ্ছে। নানারকম অপরাধে পুরো এলাকাটা মোটামুটিভাবে বিষাক্ত করে দেয়া হয়েছে। সংবাদ মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে আমরা প্রচার শুরু করেছি যে সাধারণ মানুষ আসলে নিম্নশ্রেণীর মানুষ। তারা অসম্পূর্ণ মানুষ এবং তারা অপরাধপ্রবণ।
বিশ্ব কনফারেন্সের কী খবর?
ভালোভাবে চলছে জেনারেল। আগামীকাল বিজ্ঞানীদের প্যানেলে মূল পেপারটা পড়া হবে। সেখানে বলা হবে ড়ন সম্প্রদায় সাধারণ মানুষ থেকে অন্তত এক শ গুণ উন্নত। তার নানারকম বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দেয়া হবে। পেপারটার একটি কপি এর মাঝে গোপনে তথ্যকেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
জেনাবেল রাউল চিন্তিত মুখে গাল চুলকাতে চুলকাতে বললেন, সবকিছু পরিকল্পনামতো হচ্ছে কিন্তু তবু এই তুচ্ছ সাধারণ মানুষদের মনোবল ভেঙে দেয়া যাচ্ছে না কেন? এরা দুর্বল হচ্ছে না কেন?
নুবা ইতস্তত করে বলল, আমার মনে হয় এর সাথে এদের স্বপ্ন মেশিনের একটা সম্পর্ক রয়েছে।
স্বপ্ন মেশিন?
জি।
সেটা কী?
অল্প কিছুদিন হল একটা রিপোর্টে এটার খোঁজ পাওয়া গেছে। অত্যন্ত হাস্যকর একটা যন্ত্র। যেটা করা হয় সেটা হচ্ছে মস্তিষ্কের মাঝে বাইরে থেকে এক ধরনের স্টিমুলেশান দেয়া হয়। পুরো জিনিসটা একটা হেলমেটের মতো। সেটা যখন মাথায় লাগানো হয় তখন মানুষ নাকি স্বপ্ন দেখে। ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
ভবিষ্যতের স্বপ্ন?
জি।
জেনারেল রাউলের ভুরু কুঞ্চিত হল, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এই যন্ত্র তাদের হাতে কেমন করে গেল?
নুবা ইতস্তত করে বলল, তাদের হাতে যায় নি। তারা নিজেরাই তৈরি করেছে।
জেনারেল রাউল সোজা হয়ে বসে বললেন, তারা নিজেরা তৈরি করেছে? অশিক্ষিত মূর্খ অমার্জিত মানুষেরা একটা যন্ত্র তৈরি করেছে?
জি জেনারেল। তাদের মাঝে নাকি একজন বিজ্ঞানী রয়েছে। তার নাম ক্রিটি। সে–ই তৈরি করেছে।
ক্রিটি? সে বিজ্ঞান শিখেছে কেমন করে? তার তো বিজ্ঞান শেখার কথা নয়।
নিজে নিজে শিখেছে।
নিজে নিজে? নিজে নিজে বিজ্ঞান শেখা যায়?
তাই তো দেখছি।
জেনারেল রাউলের মুখ থমথমে হয়ে উঠল। তিনি দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বললেন, নুবা, আমি এই মানুষটির সাথে কথা বলতে চাই। একটা স্বপ্ন মেশিনসহ তাকে এখানে হাজির কর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
***
ক্রিটি বিশাল হলঘরে সোজা হয়ে বসে আছে। তার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখের নিচে কালি, পোশাক জীর্ণ এবং মলিন। এই বিশাল হলঘরের অপরিচিত ঐশ্বর্যের মাঝে সে সম্পূর্ণ বেমানান এবং সে নিজেও এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। তার সামনে টেবিলের উপর একটা স্বপ্ন মেশিন এবং সেটাকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ বুঝি মিউজিয়াম থেকে প্রাচীনকালের হাস্যকর একটা যন্ত্র তুলে এনেছে। বিশাল হলঘরের মাঝ দিয়ে যারা যাচ্ছে এবং আসছে, সবাই ভুরু কুঁচকে ক্রিটির দিকে তাকাচ্ছে এবং তার এই বিচিত্র যন্ত্রটিকে দেখছে। মানুষটি জেনারেল রাউলের আহ্বানে এসেছে, না হয় অনেক আগেই তাকে এখান থেকে বের করে দেয়া হত।
জেনারেল রাউল নিজের ঘরে বসে থেকে মনিটরে তীক্ষ্ণ চোখে ক্রিটিকে লক্ষ করছিলেন। এই মানুষটি সমাজের সবচেয়ে নিচু এলাকায় মানুষ হয়েছে, অনাহারে–অর্ধাহারে শৈশব কাটিয়েছে, সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে পড়তে শিখেছে, সবরকম প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে বিজ্ঞান শিখেছে এবং জঞ্জাল ঘেঁটে পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি দিয়ে একটা স্বপ্ন মেশিন তৈরি করেছে। সেই স্বপ্ন মেশিন যে মানুষ একবার মাথায় পরে স্বপ্ন দেখেছে তাকে আর কোনোদিন ধ্বংস করা যায় না। কী বিচিত্র একটি ব্যাপার! জেনারেল রাউল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নুবাকে ডেকে বললেন, মানুষটাকে তার যন্ত্রটা নিয়ে আসতে বল।
কয়েক মিনিটের মাঝেই নুবা ক্রিটিকে নিয়ে জেনারেল রাউলের ঘরে হাজির হল। মনিটরে মানুষটিকে যেরকম মলিন দেখা যাচ্ছিল সামনাসামনি সে মোটেও সেরকম নয়। তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি, উষ্কখুষ্ক চুল এবং জীর্ণ পোশাকের মাঝেও কেমন জানি এক ধরনের তেজস্বিতা রয়েছে। জেনারেল রাউল সাধারণ মানুষের মাঝে তেজস্বিতা পছন্দ করেন না– সাধারণ মানুষ হবে ভীত এবং নম্র। তাদের মাঝে থাকবে দ্বিধা এবং সংশয়। তারা হবে কাপুরুষ। কিন্তু এই মানুষটির মাঝে সেরকম কিছু নেই এবং তার মুখের দিকে তাকিয়ে জেনারেল রাউল নিজের অজান্তেই বলে ফেললেন, বসুন।