রিগা নিচু গলায় হেসে ফেলল, বলল, ছিঃ শুনু, ছেলেমানুষি কোরো না! আর কয়দিনে কী এসে যায়? কিছু আসে যায় না। তুমি সেই প্রাচীনকালের মানুষের মতো কথা বলছ! আমি কতবার তোমাকে বলেছি প্রাচীনকালের মানুষের জীবন নিয়ে এত ভেবো না। সেই জীবন শেষ হয়ে গেছে।
শুনু চোখ মুছে নিশ্বাস ফেলে বলল, জানি। কিন্তু কিন্তু আমার কী ভয়ঙ্কর লোভ হয়–
রিগা বিস্ফারিত চোখে শুনুর দিকে তাকাল, অবাক হয়ে বলল, কিসের লোভ হয়?
আমার–আমার একটি সন্তান হবে। ছোট একটা শিশু–আঁকুপাকু করবে–আর আমি বুকে চেপে ধরব।
রিগা হতচকিত দৃষ্টিতে শুনুর দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ সে কোনো কথা বলতে পারল না, তারপর একরকম জোর করে বলল, সন্তান?
হ্যাঁ
কিন্তু–কিন্তু তুমি তো জান সন্তানের প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে। এক সময় সন্তানের প্রয়োজন হত কারণ মানুষ বুড়ো হয়ে মারা যেত। তাদের স্থান নেবার জন্যে নূতন মানুষের প্রয়োজন হত! এখন আমরা মৃত্যুকে জয় করেছি, প্রকৃতির নিয়মে বার্ধক্য আমাদের স্পর্শ করে না। আমরা মারা যাই না। আমাদের আর সন্তানের প্রয়োজন নেই।
শুনু নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি।
এক সময় মানুষের আয়ু ছিল ষাট–সত্তর বছর! এখন আমি আর তুমি একসাথে ঘর করেছি সাড়ে ছয় শ বছর! তার আগে আমি যে মেয়েটির সাথে ছিলাম সেখানে ঘর করেছি চার শ বছর। তার আগে
আমি জানি। শুনু নিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা সেই কতকাল থেকে বেঁচে আছি আর আমরা বেঁচে থাকব আরো কত মহাকাল! কিন্তু তবু আমার মনে হয় আমি যদি ছোট একটা শিশু পেতাম—
.
রিগা বিস্ফারিত চোখে এই সম্পূর্ণ যুক্তিতর্কবর্জিত প্রায় উন্মাদিনী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই ধরনের অর্থহীন হাস্যকর কথা কেউ বলতে পারে সে নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করত না।
মানুষ সত্যিই বড় বিচিত্র।
দ্বিতীয় অনুভূতি
প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী জেনারেল রাউলের মনমেজাজ বেশি ভালো নয়। যে ব্যাপারটি সবার কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হবার কথা সেটি কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সবার কাছে গোধূলিলগ্নের মতো অস্পষ্ট। পৃথিবীর ইতিহাসে একবার চোখ বুলালেই স্পষ্ট দেখা যায় এর সভ্যতা গড়ে উঠেছে ছাড়া–ছাড়াভাবে–গুটিকতক মানুষ দিয়ে। প্রাচীন মিসরে ফারাওরা ছিল সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী, দেশের সাধারণ মানুষেরা ছিল প্রায় ক্রীতদাসের মতো। ফারাও আর পুরোহিতেরা মিলে নীলনদের অববাহিকায় বিশাল সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। দক্ষিণ আমেরিকার মায়া–ইনকা সভ্যতাও সেরকম। ক্ষমতাবান রাজপুরুষেরা গুটিকতক মানুষ নিয়ে সভ্যতা গড়ে তুলেছে, ঠিক তখন সাধারণ মানুষের বুক কেটে হৃৎপিণ্ড বের করে রুটিনমতো সূর্যদেবতার উপাসনা করা হয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে ব্যাপারটা আরো সুসংহত করা হল। বিশ্বের বেশিরভাগ অংশকে নাম দেয়া হল তৃতীয় বিশ্ব। সেখান থেকে বেছে বেছে যারা প্রতিভাবান তাদের ধনসম্পদের লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হল উন্নত বিশ্বে। সেখানে গুটিকতক মানুষ মিলে নূতন সত্যতার জন্ম দিল। জ্ঞান বিজ্ঞান শিল্প সাহিত্য নূতন করে জন্ম নিল এই নূতন বিশ্বে।
জেনারেল রাউল একটা নিশ্বাস ফেললেন, সব সময়েই তাই হয়েছে তবু কেন সবাই এই সত্যিটা স্বীকার করতে চায় না কে জানে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই এবং ইতিহাসে পরিষ্কারভাবে লেখা আছে যে পৃথিবীতে সবসময় গুটিকতক মানুষ–যারা জ্ঞানী, বুদ্ধিমান এবং সুদর্শন তারা সভ্যতার দিকনির্দেশ করে। অন্য সবাই তুচ্ছ এবং সাধারণ। ব্যাপারটির গুরুত্ব প্রথমে বুঝতে পেরেছিলেন একজন সত্যিকারের কালজয়ী পুরুষ, দিকদ্রষ্টা, তার নাম ছিল এডলফ হিটলার। তিনিই প্রথমে আঁচ করেছিলেন যে শ্রেষ্ঠ প্রজাতি বলে একটা প্রজাতি থাকা সম্ভব। কিন্তু এই কালজয়ী পুরুষের জন্ম হয়েছিল সময়ের অনেক আগে। পৃথিবীর মূর্খ অর্বাচীন আর প্রাচীনপন্থী সমাজব্যবস্থার কারণে এই ক্ষণজন্মা পুরুষকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল, তাকে অপমান আর কলঙ্ক নিয়ে পৃথিবীর ইতিহাস থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
আজ পঞ্চবিংশ শতাব্দীতে এডলফ হিটলারের স্বপ্ন আবার সফল হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তার যে সমস্যা ছিল এখন আর সেই সমস্যা নেই। সমস্ত পৃথিবীর মানচিত্র অপসারিত হয়ে সারা পৃথিবীতে এখন একটিমাত্র রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের ক্ষমতা এখন সারা বিশ্বে, যারা এই রাষ্ট্রের ক্ষমতায় আছেন তারা আক্ষরিক অর্থে সারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এই রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী হচ্ছেন জেনারেল রাউল, তার দায়িত্ব যেরকম বিশাল, ক্ষমতাও সেরকম আকাশছোঁয়া। দায়িত্ব হচ্ছে নেশার মতো আর ক্ষমতাটি হচ্ছে সেই নেশার মাদক। দায়িত্বের এই প্রচণ্ড নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে রাউল সাধারণ একজন জেনারেল থেকে আজ বিশ্বরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী। ব্যাপারটি ছেলেখেলা নয়। কিন্তু এই প্রচও ক্ষমতাশালী জেনারেল রাউলের মনটি বেশি ভালো নয়, ঠিক যেভাবে সবকিছু কাজ করার কথা সেভাবে কাজ করছে না। মানুষকে ইতিমধ্যে দু ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যারা সর্বশ্রেষ্ঠ তাদেরকে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়েছে, সব রকম সুযোগ সুবিধে এবং ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যারা সাধারণ, যারা তুচ্ছ যারা, অসুন্দর অমার্জিত তাদেরকে এর মাঝে পৃথিবীর অনুন্নত এলাকায় আটকে রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, মানুষের মাঝে এই পার্থক্যটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্যে উন্নত শ্রেণীর মানুষের জিনেটিক কোডকে আইন করে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে, এই মানুষদের নাম দেয়া হয়েছে ডন সম্প্রদায়। জিনেটিকভাবে তুচ্ছ এবং সাধারণ মানুষদের পৃথিবীর অনুন্নত জায়গায় আটকে রেখে ডুন সম্প্রদায়কে তাদের যোগ্য। স্থানে নিয়ে আসা; জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প সাহিত্য প্রযুক্তির সুযোগ করে দেয়াই হচ্ছে এই শতাব্দীর মূল লক্ষ্য। পৃথিবীর সম্পদ কমে আসছে, সবাইকে সবকিছু দেয়া সম্ভব নয়, যার যেটুকু প্রয়োজন তাকে ঠিক ততটুকু দেয়া হবে। ড়ন সম্প্রদায় উচ্চতর মানব সম্প্রদায়, তারা বেশি পাবে–সেটি অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক সত্য, কিন্তু এটি একটি বিচিত্র কারণে সবার কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট নয়। সাধারণ এবং তুচ্ছ মানুষেরা কিছুতেই সেটা মেনে নিতে চাইছে না, তারা সমান অধিকারের কথা বলছে, সারা পৃথিবীতে সেটা নিয়ে বিশৃঙ্খলা। জেনারেল রাউল শক্ত হাতে সেটাকে দমন করে যাচ্ছেন কিন্তু কাজটি দিনে দিনে সহজ না হয়ে আরো কঠিন হয়ে আসছে।