কিহি শূন্য দৃষ্টিতে চারদিকে একবার তাকাল, তার দুই হাত বুকের কাছে উঠে এল, সে ফিসফিস করে বলল, হে ঈশ্বর তুমি এই নির্বোধ যন্ত্রদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা কর। রক্ষা কর–রক্ষা কর–
ঈশ্বর তাকে রক্ষা করলেন না, ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের শব্দে মহাকাশযান প্রকম্পিত হল।
***
নেপচুনের একটি উপগ্রহ থেকে জিরকোনিয়ামের আকরিক নিয়ে যে মহাকাশযানটি পৃথিবীতে আসছিল সেটিকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বৃহস্পতি গ্রহের কাছে উপবৃত্তাকারে ঘুরতে দেখা যায়। কারণ অনুসন্ধান করার জন্য কাছাকাছি আরেকটি মহাকাশযান থেকে একটা স্কাউটশিপ পাঠানো হয়েছিল। তারা ভিতরে একমাত্র মহাকাশচারীর মৃতদেহটি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আবিষ্কৃত করে। মহাকাশযানের রবোটগুলো এবং পুরো মহাকাশযানটি এত খারাপভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিল যে প্রকৃত কারণটি অনুসন্ধান করে বের করার কোনো উপায়ই ছিল না।
মহাকাশযানের দেয়ালে এক জায়গায় লেখা ছিল “হে ঈশ্বর অবিশ্বাসীদের ধ্বংস কর”। মহাকাশযানের বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে এর নিশ্চয়ই কোনো সম্পর্ক নেই। যে লাল রং দিয়ে লেখা হয়েছিল, রাসায়নিক পরীক্ষায় সেটিকে মানুষের রক্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে।
কী কারণে মানুষের রক্ত দিয়ে মহাকাশযানের দেয়ালে এ ধরনের একটি কথা লেখা হয়েছে তার কোনো যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নি।
জনৈকা যুক্তিহীনা নারী
রিগা বিশাল একটি ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল। ঘরের একটি বড় অংশে স্বচ্ছ সিলঝিনিয়ামের ঝকঝকে আয়না। সেই আয়নায় রিগার প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে। রিগা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে আছে, সে অত্যন্ত সুপুরুষ। তার কুচকুচে কালো চুল, দীর্ঘ পেশিবহুল দেহ। মসৃণ ত্বক এবং ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। তার শরীরের উপর আলগাভাবে একটি অর্ধস্বচ্ছ নিও পলিমারের কাপড় জড়ানো রয়েছে। নিজের দিকে তাকিয়ে থেকে সে তার মুখে একটা সন্তুষ্টির মতো শব্দ করে জানালার দিকে ঘুরে এল। ঠিক এ রকম সময় দরজা খুলে তার দীর্ঘদিনের সঙ্গিনী শুনু ঘরে প্রবেশ করে। রিগাকে দেখে শুনু হঠাৎ থমকে দাঁড়াল, তার চোখেমুখে একই সাথে বিস্ময় এবং শঙ্কার এক ধরনের ছায়া পড়ে। রিগা মুখে হাসি টেনে এনে বলল, কেমন দেখছ শুনু?
শুনু কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারে না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, তুমি– তুমি পুনরুজ্জীবন ঘরে গিয়েছ?
হ্যাঁ শুনু।
কেন? তোমার তো সময় হয় নি।
একটু আগেই গেলাম। কেমন কাজ করেছে মনে হয়?
শুনু একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ভালো। খুব ভালো
দেখতে যেমন ভালো দেখাচ্ছে আমার ভিতরে লাগছেও সেরকম চমৎকার। তুমি বিশ্বাস করবে না আমি ভিতরে কী রকম একটা শক্তি অনুভব করছি।
সত্যি?
হ্যাঁ–আমি জানতাম না, পুনরুজ্জীবন ঘরের এত উন্নতি হয়েছে। শরীরের সব জীর্ণ কোষ বদলে দিয়েছে। শুধু তাই না, মনে হয় মস্তিষ্কে নিউরন–সেলেও কিছু কাজ করেছে, খুব ভালো চিন্তা করতে পারছি।
সত্যি?
হ্যাঁ, ছয় মাত্রার একটা অনুপৌণিক সমীকরণ ছিল, কখনো আমি সমাধান করতে পারি নি। পুনরুজ্জীবন ঘর থেকে বের হবার পর মস্তিষ্কটা এমন সতেজ লাগতে লাগল যে ভাবলাম সমীকরণটা একটু ভেবে দেখি। তুমি বিশ্বাস করবে না শুনু, সাথে সাথে সমাধানটা বের হয়ে গেল।
শুনু রিগার উচ্ছাসে অংশ নিতে পারল না। কপাল থকে চুলগুলো সরিয়ে নিচু গলায় বলল, ও।
শুধু তাই না, খাওয়ার রুচি বেড়ে গিয়েছে দশ গুণ। আগে যেটা খেতে পানসে লাগত হঠাৎ করে তার স্বাদ বেড়ে গেছে। স্নায়ুর মাঝেও কিছু একটা হয়েছে। রিগা শব্দ করে হাসতে হাসতে বলল, আনন্দের অন্য জিনিসগুলো তো এখনো চেষ্টা করে দেখিই নি!
শুনু রিগার হাসিমুখের দিকে এক ধরনের বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে। তার হাসি থেমে যাবার পর নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, রিগা, তুমি এখন কেন পুনরুজ্জীবন ঘরে গেলে? এখন তো সময় হয় নি।
রিগা খানিকক্ষণ শুনুর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি তো জান শুনু কেন আমি পুনরুজ্জীবন ঘরে গেছি। আমরা সবাই তো যাই। যেতে হয়। তুমিও যাবে।
শুনুর কোমল চেহারায় হঠাৎ এক ধরনের তীব্র ব্যথার ছায়া এসে পড়ে। রিগা তার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে নরম গলায় বলল, আমি দুঃখিত শুনু। তুমি তো জান একদিন আমাদের একজনের কাছে থেকে সরে যেতে হবে। আমরা তো আর সবসময় একসাথে থাকতে পারি না–
শুনু কোনো কথা বলল না, হঠাৎ করে তার চোখে পানি এসে যায়, সে প্রাণপণে তার চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করে।
রিগা একটু এগিয়ে এসে শুনুর মাথায় হাত রেখে বলল, ছিঃ শুনু, কাঁদে না। এর মাঝে কাদার কিছু নেই। এটা হচ্ছে জীবন। মনে নেই তোমার আর স্রুরার যখন ছাড়াছাড়ি হল তখন তুমি কেমন ভেঙে পড়েছিলে? মনে আছে?
শুনু মাথা নাড়ল। রিগা নরম গলায় বলল, তারপর আমার সাথে তোমার পরিচয় হল। আমরা ঘর বাধলাম–কী চমৎকার একটা জীবন হয়েছিল আমাদের। ঠিক সেরকম আবার আমাদের চমৎকার জীবন হবে। তোমার সাথে দেখা হবে অসম্ভব হৃদয়বান কোনো পুরুষের–সব দুঃখ মুছে নেবে তোমার। আমার কথা ভুলে যাবে তখন।
শুনু হাতের উল্টো পৃষ্ঠা দিয়ে চোখ মুছে মৃদু গলায় বলল, রিগা, আর কয়দিন আমরা একসাথে থাকতে পারি না? আর মাত্র কয়দিন?