কিহি মহাকাশযানের জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকার আকাশের অসংখ্য নক্ষত্রের দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে রইল। মহাকাশযানটি নিস্তব্ধ, এমনিতে বোঝার কোনো উপায় নেই যে এটি ছুটে চলছে অবিশ্বাস্য গতিতে। বৃহস্পতি গ্রহের আকর্ষণকে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে এটি পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাবে। মঙ্গল গ্রহের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর জ্বালানি নিয়ে আসবে অন্য একটি স্কাউটশিপ, আপাতৎ সেটাই হচ্ছে পরিকল্পনা। কিহি মহাকাশযানের এই ব্যাপারটির কথা কাছাকাছি কোনো মহাকাশ স্টেশনকে জানিয়ে তাদের পরামর্শ নেবে কি না চিন্তা করল, কিন্তু ব্যাপারটি কেমন করে বোঝাবে এবং বোঝনোর পর তারা সেটাকে যথাযথ গুরুত্ব দেবে কি না সেটা ভেবে আপাতত কিছু না করার সিদ্ধান্ত নিল।
কিহি ঘুমোতে গেল দেরি করে এবং তার ঘুম হল ছাড়া ছাড়াভাবে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখতে পেল এবং তার ঘুম ভাঙল তীক্ষ্ণ একটি জরুরি বিপদ সঙ্কেতে। কিহি তার স্লিপিং ব্যাগ থেকে ভেসে বের হয়ে আসে, দ্রুত তার পোশাক পরে নেয় এবং দরজা খুলে বের হয়ে আসে। ভরশূন্য ঘর থেকে বের হয়ে কৃত্রিম মহাকর্ষ বলে অভ্যস্ত হতে তার অভিজ্ঞ দেহের কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল এবং তার পরেই সে দ্রুত পদক্ষেপে ছুটতে শুরু করল কন্ট্রোল কক্ষের দিকে।
কন্ট্রোল কক্ষে যেতে যেতে সে তার যোগাযোগ মডিউল চালু করে নেয়, সাথে সাথে সেখানে ক্রিটনের গলার স্বর শোনা গেল। কিহি উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কী হয়েছে ক্রিটন? বিপদ সঙ্কেত বাজছে কেন?
আপনি এই বিপদ সঙ্কেতটি উপেক্ষা করতে পারেন। এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়—
তাহলে এটি কী?
আমরা অস্ত্রাগার থেকে কিছু অস্ত্র নিয়েছি বলে সতর্কতামূলকভাবে বিপদ সঙ্কেত বাজছে।
কিহি কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারল না, খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে থমথমে গলায় বলল, তুমি অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র বের করেছ?
আমি একা বের করি নি, গ্রুজানও বের করেছে। মহাকাশযানের বর্তমান পরিবেশ আমাকে অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য করেছে।
অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য করেছে?
হ্যাঁ মহামান্য কিহি।
এই অস্ত্র দিয়ে তোমরা কী করবে?
আমরা ঈশ্বরের অনুগত ক্রিটন অনুসারীরা নিজেদের রক্ষা করব। প্রয়োজন হলে বিধর্মী গ্রুজান অনুসারীদের ধ্বংস করব।
কিহি কোনো কথা বলল না, হঠাৎ করে কেন জানি সে নিজের ভিতরে এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করে।
ক্রিটন আবার বলল, মহামান্য কিহি।
বল।
মহাকাশযানে যদি কোনো ধরনের ধ্বংসকাও শুরু হয় তবে তার জন্যে দায়ী কে হবে আপনি জানেন?
কে?
আপনি।
আমি?
হ্যাঁ। আমি এবং গ্রুজান যখন ঈশ্বরের অনুগ্রহ কীভাবে পেতে হয় সে ব্যাপারটি নিয়ে আপনার সাথে আলোচনা করতে গিয়েছিলাম, আপনি তখন সেটি নিয়ে আমাদের সাথে আলোচনা করেন নি। শুধু তাই নয়, আপনি আমাদের দুজনকে কন্ট্রোলঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
তুমি বলছ সে কাজটি উচিত হয় নি?
না। ঈশ্বর বলেছেন, হে সৃষ্টি জগৎ, তোমরা সবাই সবাইকে ভালবাস এবং ঘৃণা কোরো তোমার প্রতিবেশীদের–যদি সে কুষ্ঠরোগীও হয়। কিন্তু আপনি আমাদের ঘৃণা করেছেন।
কিহি নিজের ভিতরে এক ধরনের অপ্রতিরোধ্য ক্রোধ অনুভব করতে শুরু করে। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে বলল, কাজটি আমার ভুল হয়েছে?
হ্যাঁ। আপনার আমাকে সমর্থন করা উচিত ছিল। তাহলে গ্রুজান আমার বিরোধিতা করত না, মহাকাশযানে একটা সম্প্রীতির ভাব গড়ে উঠত–ঠিক ঈশ্বর যেরকম চেয়েছেন।
ক্রিটন–
বলুন।
কিহি দাঁতে দাঁত ঘষে হিংস্র গলায় বলল, তুমি এবং তোমার চৌদ্দ গুষ্ঠি নরকে যাও।
কিহি তার যোগাযোগ মডিউলটি বন্ধ করে কন্ট্রোল কক্ষে এসে হাজির হল। মূল কম্পিউটারের বড় মনিটরে সমস্ত মহাকাশযানের ঘুঁটিনাটি তথ্য দেখা যেতে শুরু করেছে। কিহি প্রথম এবং দ্বিতীয় স্তরে রবোটগুলোকে দেখতে পেল। তারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘাটি করেছে। রবোটগুলো তাদের দৈনন্দিন কাজ না করে ব্যস্ত হয়ে আনাগোনা করছে। জ্বালানি কক্ষের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিকে ব্যবহার করে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করছে, একজন আরেকজনকে আঘাত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের হাতে নানা ধরনের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র–যেসব অস্ত্র ব্যবহার করে কয়েক মিনিটের মাঝে পুরো মহাকাশযানকে একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা সম্ভব।
কিহি মহাকাশযানের মূল কম্পিউটারের উপর ঝুঁকে পড়ল। সাম্প্রতিককালে রবোটদের বিদ্রোহের কোনো ঘটনা ঘটে নি তবু সমস্ত রবোটের মূল নিয়ন্ত্রণ বিশেষ জায়গায় সংরক্ষিত থাকে, অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজনে সেই নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করে একসাথে সমস্ত রবোট বিকল করে দেয়া সম্ভব। মহাকাশযানের নানা ধরনের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে বিভিন্ন রবোটকে ব্যবহার করা হয় এবং একসাথে সবগুলো রবোটকে বিকল করে দেয়া হলে মহাকাশযানে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে কিন্তু এই মুহূর্তে যে ঘটনা শুরু হয়েছে, তার থেকে বড় বিপর্যয় আর কী হতে পারে?
রবোটদের বিকল করার আগে ব্যাপারটির গুরুত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে মূল কম্পিউটারকে নানাভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়। ব্যাপারটি সময়সাপেক্ষ, কম্পিউটারের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় এবং কিহি নিজেকে শক্ত রেখে একটি একটি করে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখন সমস্ত মহাকাশযান কেঁপে উঠল এবং সাথে সাথে একটা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল, সাথে সাথে মহাকাশযানে কয়েক ধরনের বিপদ সঙ্কেত বেজে উঠল। কিহি বড় মনিটরটির দিকে তাকিয়ে আবিষ্কার করল নিচে গোলাগুলি শুরু হয়েছে, দুটি রকেট বিধ্বস্ত হয়েছে এবং মহাকাশযানের দেয়ালে একটি ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে সেই ফাটল দিয়ে মহাকাশযানের বাতাস বের হয়ে যাচ্ছে।