চমৎকার। কিহি অবাক হয়ে আবিষ্কার করল হঠাৎ করে তার পক্ষে আর রেগে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। খানিকক্ষণ সে স্থির দৃষ্টিতে ক্রিটনের দিকে তাকিয়ে থেকে শীতল গলায় বলল, তুমি ঈশ্বরের আরাধনা করে তোমার দৈনন্দিন কাজ করার সময় পাচ্ছ না। কিন্তু অন্য যেসব রবোট আছে তারা?
আপনি শুনে খুশি হবেন মহামান্য কিহি, তাদের বেশিরভাগ ইতিমধ্যে ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য এনেছে। যারা এখনো আনে নি আমরা তাদের নিয়ে কাজ করছি।
কিহি হঠাৎ নিজের ভিতরে এক ধরনের সূক্ষ্ম আতঙ্ক অনুভব করে, সেটা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করার পরেও গলার স্বরে সেটা প্রকাশ পেয়ে যায়। সে কাঁপা গলায় বলল, মহাকাশযানের অন্য রবোটরাও ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য এনেছে?
হ্যাঁ মহামান্য কিহি। মহাকাশযানের বেশিরভাগ রবোটের যুক্তিতর্ক নিচু স্তরের। ঈশ্বরের মহানুভবতা অনুভব করার ক্ষমতা তাদের নেই। তাদের বেশিরভাগই আমাদের আদেশে ঈশ্বরের উপাসনা করে।
তোমাদের আদেশে?
হা মহামান্য কিহি। আমরা, যারা রবোটের ভিতরে উচ্চ শ্রেণীর, যাদের কপোট্রন কিউ ২ বা কমপক্ষে পি. পি. ৪২ ধরনের, যারা চিন্তাভাবনা করতে পারি, যুক্তিতর্ক অনুভব করতে পারি তারা ঈশ্বরকে অনুভব করেছি। তারা অন্যদেরকে ঈশ্বরের দিকে পরিচালিত করেছি।
এ রকম সময় গ্রুজান একটু এগিয়ে এসে বলল, এখানে আমার একটু কথা বলার রয়েছে মহামান্য কিহি।
কী কথা?
ক্রিটনের কথা পুরোপুরি সত্যি নয়। যদিও সত্যি কথাটি আপেক্ষিক এবং পরিপূর্ণ সত্যি এবং পরিপূর্ণ মিথ্যা বলে কিছু নেই। সেটা নির্ভর করে মূল বিশ্বাসের ওপর। তবু আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি ক্রিটনের কথা পুরোপুরি সত্যি নয়।
কিহি একটু আশা নিয়ে গ্রুজানের দিকে তাকাল, তাহলে কি এই রবোটটি দায়িত্বশীলের মতো ব্যবহার করছে? জান কিহির নিচু স্তরের দিকে আরো এক পা অগ্রসর হয়ে বলল, ক্রিটন সত্যিকার অর্থে রবোটদের ঈশ্বরের দিকে পরিচালিত করতে পারছে না। তার পদ্ধতিতে ভুল রয়েছে, সে বিশ্বাস করে উপাসনা করে ঈশ্বরকে পাওয়া সম্ভব, সেটি সত্যি নয়। অর্থহীন আচারানুষ্ঠান জাতীয় উপাসনার কোনো অর্থ নেই। সে কারণে আমি আমার দলের রবোটদের প্রথমে জ্ঞানদান করেছি, যারা ব্যাপারটি বুঝতে পারছে না তাদেরকে বোঝানোর জন্যে প্রয়োজনে তাদের কপোট্রনে অস্ত্রোপচার করেছি।
কিহি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে বলল, কী বলছ?
গ্রুজান বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলল, নিম্নশ্রেণীর রবোটদের কপোট্রনে আমি কিছু সংস্কার করেছি।
কিহি প্রচণ্ড ক্রোধে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, তুমি–তু–তু–তুমি আবর্জনার বস্তা জং ধরা লোহার জঞ্জাল বেজন্মা কাকতাড়ুয়া, আমার অনুমতি ছাড়া রবোটদের কপোট্রনে হাত দিচ্ছ?
গ্রুজান এবারেও এতটুকু বিচলিত না হয়ে শান্ত গলায় বলল, আপনি অযথা উত্তেজিত হচ্ছেন মহামান্য কিহি
অযথা উত্তেজিত হচ্ছি? কিহি চিৎকার করে বলল, আমি অযথা উত্তেজিত হচ্ছি? অযথা? মহাকাশযানের সব কোড ভঙ্গ করে আমার কোষের অনুমতি না নিয়ে
আপনার অনুমতি না নিলেও আমরা ঈশ্বরের অনুমতি নিয়েছি। ঈশ্বর বলেছেন, হে সৃষ্ট জগতের বাসিন্দা। তোমরা আমার উপাসনা কর। কারণ
ঠিক এই সময়ে পি. কে. ৩৮ ধরনের একটা রবোট ছুটে এসে কিহিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ক্রিটনকে বলল, প্রভু গ্রুজানপন্থী রবোটেরা জ্বালানি কক্ষের নিচে একত্র হয়েছে। আমরা যারা ক্রিটনপন্থী তাদের এক্ষুনি একত্র হওয়া দরকার, উপাসনার সময় হয়েছে।
ক্রিটন বলল, চল যাই।
চলুন প্রভু।
কিহি হতচকিতের মতো বলল, প্রভু?
ক্রিটন শান্ত গলায় বলল, আমার অনুসারীরা আমাকে তাদের ধর্মগুরু হিসেবে মেনে নিয়েছে।
কিহি ক্রিটনকে চলে যেতে দেখল এবং সে ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পর গ্রুজানের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা–রবোটেরা দুই দলে ভাগ হয়েছ?
হা মহামান্য কিহি। গ্রুজানপন্থী বা সঠিকপন্থী এবং ক্রিটনপন্থী বা ভ্রান্তপন্থী। তবে
তবে কী?
তবে আমি নিশ্চিত, আজ হোক কাল হোক ক্রিটনপন্থীরা সত্যিকার পথে আসবে। যদি স্বেচ্ছায় না আসে তাদেরকে জোর করে আনতে হবে।
জোর করে?
জি মহামান্য কিহি। ঈশ্বর বলেছেন, হে আমার সৃষ্টি জগৎ নিশ্চয়ই তোমরা সত্যিকার পথে অগ্রসর হও। যদি প্রয়োজন হয় সত্যিকার পথে আনার জন্যে শক্তি প্রয়োগ কর। তোমরা নিশ্চয়ই জান সত্যিকার পথে আনার জন্যে যারা
কিহির পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব হল না। সে ঘুরে দাঁড়াল এবং সোজা লিফটে করে সপ্তম স্তরে নিজের কন্ট্রোল কক্ষে হাজির হল।
কিহি দীর্ঘ সময় কন্ট্রোলঘরের ছোট পরিসরে চিন্তিতমুখে পায়চারি করে বেড়াল। পুরো ব্যাপারটিকে একটি হাস্যকর ঘটনা হিসেবে উড়িয়ে দেয়া যায় কিন্তু এটি এখন আর মোটেও উড়িয়ে দেবার মতো ঘটনা নয়। সবকিছু শুরু হয়েছে তাকে দিয়ে। ভয়ঙ্কর একটা বিপদের মুখোমুখি এসে সে ঈশ্বরকে স্মরণ করেছিল, মানুষ যেটা করে এসেছে তার জন্মলগ্ন থেকে। ক্রিটন সেটাকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেছে। যে কাজ মানুষ করতে পারে, কোনো রবোট তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করে না।
একবার ঈশ্বরকে স্বীকার করে নেয়ার পর হঠাৎ করে এই মহাকাশযানের রবোটগুলোর আচার–ব্যবহার পুরোপুরি পাল্টে গেছে। তারা এখন আনুগত্য প্রকাশ করছে সরাসরি ঈশ্বরের কাছে। কিহি এবং মহাকাশযানের নিরাপত্তা এখন তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব নয়, তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে ঈশ্বরের উপাসনা! প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের বাণীগুলোকে তারা গ্রহণ করেছে। আক্ষরিক অর্থে। শুধু তাই নয়, দুটি রবোট ঈশ্বরকে গ্রহণ করেছে একটু ভিন্নভাবে। তার নিষ্পত্তি হয় নি ভেবে মহাকাশযানে গড়ে উঠেছে দুটি দল। যেটা সবচেয়ে ভয়ের কথা সেটা হচ্ছে এখন তারা নিজের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য শক্তি প্রয়োগ করতেও আর দ্বিধা করবে না।