- বইয়ের নামঃ রবোনগরী
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ কাকলী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
অপারেশান অপক্ষেপ
বিশাল একটা হলঘরে প্রায় এক হাজার তরুণ বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, গবেষক, শিল্পী সাহিত্যিক সংস্কৃতিকর্মী শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। হলঘরটি রাষ্ট্রীয় হলঘর, গ্রানাইটের কালো দেয়াল এবং উঁচু ছাদ। ভিতরে হালকা স্বচ্ছ এক ধরনের নরম আলো, বসার জন্যে মেরুন রঙের নরম চেয়ার, সামনে কাঁচে ঢাকা সিলিকনের সুদৃশ্য টেবিল। টেবিলে কাগজপত্র, মাইক্রো কম্পিউটার, কমিউনিকেশন মডিউলের মতো নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র। তরুণ বিজ্ঞানী গবেষক এবং শিল্পী সাহিত্যিকেরা নিজেদের ভিতরে নিচু গলায় কথা বলছে, তরল গলায় হাসছে। যদিও এটি রাষ্ট্রীয় হলঘর কিন্তু পরিবেশটি গুরুগম্ভীর রাষ্ট্রীয় পরিবেশ নয়, পরিবেশটি সহজ এবং স্বাভাবিক।
হলঘরে একটু উত্তেজনা দেখা গেল এবং প্রায় সাথে সাথে ভারি গলায় একটি ঘোষণা শোনা যায়। বিজ্ঞান একাডেমীর মহাপরিচালক থিরু হলঘরে এসে পৌঁছেছেন এবং তিনি এক্ষুনি এই এক সহস্র বিজ্ঞানী প্রযুক্তিবিদ এবং শিল্পী সাহিত্যিকের সাথে কথা বলবেন। মেরুন রঙের আরামদায়ক চেয়ারে বসে থাকা তরুণ–তরুণীরা নড়েচড়ে বসল এবং প্রায় সাথে সাথেই তাদের টেবিলের স্বচ্ছ কাঁচে থিরুকে দেখা গেল। শান্ত সৌম্য একহারা চেহারা, পরনে দৈনন্দিন সহজ পোশাক।
বিজ্ঞান একাডেমীর মহাপরিচালক তার আসনে বসে সাথে সাথেই কথা বলতে শুরু করে দিলেন। নরম গলায় বললেন, এটি রাষ্ট্রীয় হলঘর, নানা কাজে আমাকে এখানে আসতে হয়, আনুষ্ঠানিক পোশাক পরতে হয় এবং আনুষ্ঠানিক কথা বলতে হয়। আজ একটা বিশেষ দিন, আমি আগে থেকে ঠিক করেছি এই দিনে কোনো আনুষ্ঠানিকতা থাকবে না, আজ এখানে খোলাখুলি কথা বলা হবে।
উপস্থিত তরুণ–তরুণীরা মহামান্য থিরুর কথা শুনে এক ধরনের আনন্দের মতো শব্দ করল।
বিজ্ঞান একাডেমীর মহাপরিচালক থিরু কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বললেন, আজকে আমি একটু সময় নিয়ে এসেছি, আমি শুধু তোমাদের সাথে কথা বলব না, আমি তোমাদের কথা শুনব।
উপস্থিত তরুণ–তরুণীরা আবার একটা আনন্দধ্বনির মতো শব্দ করল, বিজ্ঞান একাডেমীর মহাপরিচালকের সাথে কথা বলা একটি দৈনন্দিন ব্যাপার নয়।
থিরু তার সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, তোমাদের সাথে কথা বলা আমার জন্যে একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা। তোমরা সারা পৃথিবী থেকে বেছে–নেয়া এক হাজার সেরা বিজ্ঞানী গবেষক শিল্পী এবং সাহিত্যিক। তোমাদের কাউকে এখানে জোর করে আনা হয় নি, তোমরা সবাই স্বেচ্ছায় এসেছ। তোমরা সবাই হচ্ছ অপারেশান অপক্ষেপের অংশ।
অপারেশান অপক্ষেপের ধারণাটি নূতন নয়, যারা পৃথিবী নিয়ে ভাবেন তারা অনেকবার এ ধরনের একটা কথা বলেছেন কিন্তু কেউ কখনো সেটি পরীক্ষা করে দেখেন নি। সেই পরীক্ষাটি সহজ নয়। এই প্রথম তোমাদের ব্যবহার করে অপারেশান অপক্ষেপের পরীক্ষা করা হবে।
তোমরা জান অপারেশন অপক্ষেপটি কী এবং কেন সেটা আমরা করছি। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে এর জ্ঞান–বিজ্ঞানের উন্নয়ন হয়েছে প্রয়োজনে। ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে বিজ্ঞানীরা, প্রযুক্তিবিদেরা আবিষ্কার করেছেন নূতন শক্তিবলয়। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় আবিষ্কৃত হয়েছে কৃত্রিম খাদ্য। পৃথিবীর সঞ্চিত শক্তি নিঃশেষ হবার পর আবিষ্কৃত হয়েছে নূতন শক্তিভাণ্ডার। পারমাণবিক যুদ্ধে জনারণ্য ধ্বংস হওয়ার পর মহামারীতে দুঃসময়ে আবিষ্কৃত হয়েছে নূতন জীবন সম্ভাবনা, নূতন ওষুধ, নূতন প্রতিষেধক।
কিন্তু আমরা আমাদের অতীতকে আজ পিছনে ফেলে এসেছি। এখন পৃথিবীতে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা নেই, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, খাদ্যাভাব নেই। প্রকৃতিকে আমরা জয় করেছি, ভূমিকম্প ঝড় বৃষ্টি বন্যার ভয় নেই। আমরা প্রকৃতি থেকে নূতন শক্তি ভাণ্ডার আহরণ করছি, আমাদের শক্তি ফুরিয়ে যাবার আশঙ্কা নেই। কৃত্রিম খাদ্য তৈরি। হয়েছে, পৃথিবীর মানুষকে আর ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করতে হবে না। আমাদের রোগ শোক নেই, দুঃখ কষ্ট নেই, খাদ্যের কষ্ট নেই, পরিবেশকে রক্ষা করা হয়েছে, পরিবেশ দূষণের ভয় নেই। সুস্থ সবল বুদ্ধিমান আবেগপ্রবণ মানবশিশুর জন্ম হচ্ছে, ভালবাসায় তারা বড় হচ্ছে, জ্ঞানে বিজ্ঞানে উন্নত হচ্ছে, শিল্পে সাহিত্যে সমৃদ্ধ হচ্ছে। এক কথায় পৃথিবীতে মানবসমাজের চাইবার আর কিছু বাকি নেই।
থিরু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, আর সেটি হচ্ছে আমাদের পতনের শুরু। আমরা আবিষ্কার করেছি আমাদের মাঝে আর কোনো প্রেরণা নেই। যে প্রেরণা মানুষকে গুহামানব থেকে তাড়না করে এখানে নিয়ে এসেছে, হঠাৎ করে সেই প্রেরণাটুকু হারিয়ে গেছে। আমরা দৈনন্দিন জীবন যাপন করি, নিজেদের বেঁধে দেয়া দায়িত্ব পালন করি, আমরা আনন্দ করি, জীবন উপভোগ করি কিন্তু জীবনকে নূতন কিছু দিই না। আমাদের জীবন গতানুগতিক। গত এক শ বছরে পৃথিবীতে মানবসমাজ নূতন কিছু দেয় নি। মনে হচ্ছে আগামী এক শ বছরেও কিছু দেবে না। আমরা এখন অলস পচনশীল একটা সমাজ।
এই অলস পচনশীল সমাজকে রক্ষা করার জন্যে তৈরি হয়েছে অপারেশান অপক্ষেপ। তোমরা সেই অপারেশান অপক্ষেপের প্রথম পরীক্ষার্থী।