ও।
বাইভার্বালটি থামার পর নিকি লাফিয়ে সেটি থেকে নেমে এল। বড় বাসাটির দিকে তাকিয়ে সে যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেল ক্রিনিটি তখন তাকে থামাল, বলল, নিকি, দাঁড়াও।
কী হল?
তুমি একা একা এখানে ঢুকো না।
কেন ক্রিনিটি?
বহু বছর এখানে কেউ থাকে না। ভেতরে কী আছে আমরা জানি না। হয়তো এমন কিছু আছে যেটি দেখে তোমার খারাপ লাগবে। হয়তো কোনো বুনো পশু, বিষাক্ত সাপ–
আমি বুনো পশু আর বিষাক্ত সাপকে ভয় পাই না।
কিন্তু তারা তোমাকে দেখে ভয় পেতে পারে। কেউ যখন ভয় পায় তখন তারা খুব অদ্ভুত কাজ করে ফেলতে পারে।
ক্রিনিটি বাইভার্বাল থেকে কিছু যন্ত্রপাতি আর একটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নামিয়ে নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকল। ঘরের ভেতর আলো জ্বালিয়ে এদিক-সেদিক দেখল। ঘরের মাঝখানে একটি আলট্রাসনিক বীপার বসিয়ে অপেক্ষা করল। নিকি লক্ষ করল ঘরের ভেতর থেকে কিছু পোকামাকড়, ছোট ছোট প্রাণী ছুটে বেরিয়ে যেতে থাকে। ক্রিনিটি তার ফটোসেলের চোখ দিয়ে চারদিকে দেখে নিশ্চিত হয়ে নিয়ে বলল, নিকি, তুমি এখন ভেতরে আসতে পার।
নিকি বাসাটির ভেতরে ঢুকল। বহুবছর এখানে কোনো মানুষের পা পড়ে নি, তারপরেও বাসাটি সাজানো গোছানো। ক্রিনিটির সাথে সে বাসাটির ভেতর ঘুরে দেখে, উপর তলায় দুটি ছোট ঘরে দুটি ছোট বিছানা। এখানে নিশ্চয়ই দুটি ছোট শিশু ঘুমাতো। ঘরের দেয়ালে শিশুগুলোর ছবি টানানো, হাসিখুশি দুটি বাচ্চা।
নিকি বাচ্চাগুলোর ছবি দেখে বুকের ভেতর একধরনের ব্যথা অনুভব করে। সারা পৃথিবীর এরকম লক্ষ লক্ষ শিশু বেঁচেছিল,এখন কেউ নেই। সে একা এখন এই নির্জন পৃথিবীতে মানুষ খোঁজ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে জানে না যদি একসাথে অনেকগুলো মানুষ থাকে তাহলে কিভাবে কথা বলতে হয়। কী করতে হয়। সত্যি সত্যি যদি কোনো মানুষের সাথে দেখা হয়ে যায় তাহলে সে কী করবে? তার সাথে কী কথা বলবে?
রাতে ঘুমানোর সময় ক্রিনিটি উপর তলায় ছোট একটি বাচ্চার বিছানা গুছিয়ে নিকিকে শেয়ার ব্যবস্থা করে দিলো। কিছুক্ষণ পর সে তাকে একবার দেখতে এসে আবিষ্কার করল নিকি বিছানা থেকে চাদরটা নিয়ে মেঝেতে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। যে বিছানাটি অন্য একজন শিশুর সেখানে সে শুতে চাইছে না। কেন নিকি বিছানায় শুতে চাইছে না ক্রিনিটি সে বিষয়টা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করল না। মানুষের অনেক বিষয় সে বুঝতে পারে না, সে বোঝার চেষ্টাও করে না, বিষয়টি মেনে নেয়।
ক্রিনিটি নিকির শরীরটি চাদর দিয়ে ভালো করে ঢেকে দিয়ে তার গলার মাদুলিটি খুলে নীচে নেমে আসে। ক্রিস্টাল রিডারে দিনলিপি রেকর্ড করে সে তার যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে বসল। যখন পৃথিবীতে মানুষ বেঁচে ছিল তখন বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের পুরো স্পেকট্রামটা ব্যস্ত ছিল, অসংখ্য সিগনাল আনাগোনা করত। এখন পুরো স্পেকট্রামটি আশ্চর্যরকম নীরব। ক্রিনিটি একটু একটু করে বিশ্লেষণ করতে করতে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যে অত্যন্ত দুর্বল একটি সিগনাল আবিষ্কার করল। সে দীর্ঘ সময় সেটিকে বিশ্লেষণ করে, এখান থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে শখানেক কিলোমিটার দূর থেকে সেটি আসছে। কাছাকাছি গেলে হয়তো উৎসটা খুঁজে বের করা যাবে।
ক্রিনিটি বাকি রাতটুকু বাইভার্বালকে আরেকটি দীর্ঘ যাত্রার জন্যে প্রস্তুত করে কাটিয়ে দিল। মানুষের মতো রোবটকে ঘুমাতে হয় না,রোবটকে বিশ্রমিও নিতে হয় না। ক্রিনিটি তাই দিনরাত একটানা কাজ করতে পারে। যখন পৃথিবীর মূল তথ্যকেন্দ্র চালু ছিল তখন সে ব্যাপারটি বোঝার জন্যে নানারকম তথ্য সংগ্রহ করেছে, ব্যাপারটি সে বুঝতে পারে নি। ঘুম বিষয়টি তার বোঝার ক্ষমতার বাইরে। স্বপ্ন বলে মানুষের ঘুম সম্পর্কিত আরো একটি বিষয়ের কথা সে শুনেছে, সেটি কী ক্রিনিটি তা অনুমান পর্যন্ত করতে পারে না।
ভোরবেলা নিকিকে নিয়ে ক্রিনিটি আবার রওনা দিয়ে দেয়। কোনদিকে যেতে হবে সেটি মোটামুটিভাবে জানে তাই ক্রিনিটি নিকিকে মাঝে মাঝেই বাইভার্বালটি চালাতে দিচ্ছে। আগে হোক পরে হোক নিকিকে এই ধরনের কাজগুলো শিখতেই হবে। যে শিশুটি পৃথিবীর একমাত্র জীবিত মানুষ তার দায়িত্ব অনেক বড়, তাকে সেভাবে গড়ে নিতে হবে।
উত্তর-পশ্চিমে যেতে যেতে হঠাৎ করে তারা একটি রাস্তা আবিষ্কার করল, কংক্রিটের রাস্তা অব্যবহারের কারণে জঞ্জালে ঢাকা পড়ে আছে। নিকি এই রাস্তা ধরে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে নিল। ডানপাশে একটি নীল, হ্রদ আবিষ্কার করে নিকি অকারণেই পুরো হ্রদটি একবার ঘুরে এলো। ক্রিনিটি নিকিকে বাধা দিল না, বাইভার্বালটি আবার যখন পথের উপর উঠে এলো তখন ক্রিনিটি বলল, নিকি, তুমি বাইভার্বালটি ডান দিকে ঘুরিয়ে নাও।
কেন?
সামনে আমি একধরনের সিগন্যাল দেখেছি।
কোথা থেকে আসছে সিগন্যালটি?
আমি এখনও জানি না। কাছে গেলে বুঝতে পারব।
নিকি বাইভার্বালটিকে ডান দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে অল্প কিছুদূর এগিয়ে যেতেই কন্ট্রোল প্যানেলে দুটি ছোট ছোট বিন্দু ফুটে ওঠে। নিকি বলল, ক্রিনিটি, এই দেখ সামনে আরো দুটি হরিণ।
ক্রিনিটি মাথা নাড়ল, বলল, না এগুলো হরিণ না।
এগুলো তাহলে কী?
আমার মনে হয়, এগুলো রোবট।
রোবট?
হ্যাঁ। এটির শরীর ধাতব। এটি নড়ছে।
কী মজা! নিকির মুখে হাসি ফুটে উঠল, তোমার সাথে তোমার রোবট বন্ধুদের দেখা হবে।