- বইয়ের নামঃ যারা বায়োবট
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ তাম্রলিপি
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. কিরীণা
আমার নাম কুনিল। আমার বয়স আমি ঠিক জানি না কিন্তু আমি সব সময়েই ভান করি যে আমি নিঃসন্দেহে জানি আমার বয়স পনেরো। কিরীণার সাথে যখন কথা হয় সে অবশ্য সেটা স্বীকার করতে চায় না। তার সাথে আমি এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে চাই না, কিন্তু সুযোগ পেলেই কিরীণা এই ব্যাপারটি নিয়ে আমার সাথে তর্ক শুরু করে দেয়। বড় বড় চোখগুলো আরো বড় করে বলে, না কুনিল, তোমার বয়স তেরো বছরের একদিনও বেশি হতে পারে না, এই দেখ তুমি আমার থেকে অন্তত তিন সেন্টিমিটার ছোট।
আমি গম্ভীর হয়ে বলি, এই সময়টাতে মেয়েরা ছেলেদের থেকে দ্রুত বড় হয়।
কোন সময়টাতে? বয়ঃসন্ধির সময় যখন মেয়েদের ভেতরে নানারকম শারীরিক পরিবর্তন হয়। কী রকম শারীরিক পরিবর্তন?
আমি কিরীণার বুকের দিকে তাকিয়ে তার একটি শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ করলেও সেটা মুখ ফুটে বলতে পারি না। কিরীণা তরও চোখ পাকিয়ে বলে, অসত্য।
আমি মোটেও অসভ্য নই। আমি সব বই পড়ে শিখেছি।
অসভ্য বই।
বই কখনো অসভ্য হতে পারে না। মনে আছে পীতরোগের মহামারীর সময় কী হয়েছিল?
কিরীণা চুপ করে রইল! দুই বছর আগে পীতরোগের মহামারীতে প্রত্যেকটা পরিবার থেকে অন্তত এক জন করে শিশু মারা গিয়েছিল। তখন মধ্য অঞ্চল থেকে অনেক কষ্ট করে একটি বই এই অঞ্চলে আনা হয়েছিল। সেই বইটিতে পীতরোগের প্রতিষেধক প্রস্তুত-প্রণালী বর্ণনা করা ছিল। পাথরকুচি গাছের পাতার রসে লিলিয়াক ফুলের পরাগ এবং চার বিন্দু পটাশ। দিনে তিনবার। দুই সপ্তাহের মাঝে পীতরোগের মহামারী বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
কিরীণা তখন জিজ্ঞেস করে, তুমি অনেক বই পড়েছ কুনিল?
আমি গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লাম।
তোমার ভয় করে না? যখন ট্রনেরা আসবে তখন কী হবে?
এলে আসবে। আমি ট্রনেদের ভয় পাই না।
কিরীণা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ট্রনেদের ভয় পায় না সেরকম মানুষ আর কয়জন আছে? আমার খুব ভালো লাগে। আমি কিরীণার হাত ছুঁয়ে বলি, তুমি ভয় পেয়ো না। আমার কিছু হবে না। যখন ট্রনেরা আসবে তখন আমি পালিয়ে যাব।
কোথায় পালিয়ে যাবে?
পাহাড়ে আমার গোপন জায়গা আছে। কেউ খুঁজে পাবে না।
কিন্তু ট্রনেদের যে অনুসন্ধানী রবোট আছে?
আমি গলা নামিয়ে বলি, অনুসন্ধানী রবোটও খুঁজে পাবে না।
সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি।
কিরীণা খানিকক্ষণ পর আস্তে আস্তে বলে, তুমি একদিন আমাকে একটা বই এনে দেবে?
আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি পড়বে?
হ্যাঁ।
সত্যি?
সত্যি। দেবে এনে?
আমি খুশি হয়ে বললাম, কেন দেব না। এক শ’ বার এনে দেব। কিন্তু তুমি পড়বে কেমন করে? তোমার কম্পিউটারে কি ক্রিস্টাল রিডার আছে?
কিরীণা মুখ কালো করে বলল, না, নেই।
আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি তোমাকে আমারটা দেব। খুব সাবধান কিন্তু। কেউ যেন জানতে না পারে।
জানবে না, সবাই যখন ঘুমিয়ে যাবে তখন পড়ব।
কিরীণা একটু পরে জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাকে কী বই এনে দেবে কুনিল?
আমার কাছে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক থিওরির বই আছে, নিউক্লিয়ার ফিউসান, সুপার লেজার, আন্তঃগ্রহ যোগাযোগ, ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়া–
কিরীণা একটু লাল হয়ে বলল, ঐ অসভ্য বইটা–
ও। মানব জন্মরহস্য? ঐটা আমার কাছে নেই, ইলির কাছ থেকে আনতে হবে।
থাক তাহলে।
আমি তোমাকে আরেকটা খুব ভালো বই এনে দেব। পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ, খুব চমৎকার বই।
ঠিক আছে।
নাকি সহজ ইলেকট্রনিক্স? সহজ ইলেকট্রনিক্স যদি তুমি ঠিক করে পড়, তা হলে ঘরে বসে তুমি উপগ্রহ স্টেশন তৈরি করতে পারবে। ট্রনদের অনুষ্ঠান দেখতে পারবে।
তুমি দেখেছ?
একবার।
কেমন দেখতে? কিরীণা চোখ বড় বড় করে বলল, ট্রনেদের মেয়েরা নাকি সব সময় নিও পলিমারের কাপড় পরে?
আমি জানি না। কাপড় তো কাপড়ই! পলিমারও কাপড়, নিও পলিমারও কাপড়।
ইস! আমাকে যদি কেউ একটা নিও পলিমারের পোশাক দিত।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ছিঃ, এসব বলে না কিরীণা। কেউ শুনলে কী ভাববে?
কিরীণা বিষণ্ণ মুখে বলল, আমার আর পশুদের মতো থাকতে ভালো লাগে না। কেন সব আনন্দ ট্রনেদের জন্যে হবে, আর সব দুঃখ-কষ্ট হবে আমাদের? কেন?
আমি কিরীণার হাত ধরে বললাম, ছিঃ কিরীণা! এইসব বলে না। ছিঃ! তুমি বললে, তুমি কোন বই চাও? পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ, নাকি সহজ ইলেকট্রনিক্স?
কিরণা অন্যমনস্কভাবে বলল, তোমার যেটা ইচ্ছা।
আমি আরো কিছুক্ষণ কিরীণার সাথে বসে থাকলাম। তারপর কিরীণা তার জীর্ণ আইসোটোপ আইসোলেটর নিয়ে সমুদ্রতীরের দিকে চলে গেল। সমুদ্রের বালুতে খুব অল্প প্রটোনিয়াম রয়েছে, ছেকে আলাদা করলে আমাদের একমাত্র নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরে বিক্রি করা যায়। কমবয়সী মেয়েরা তাই করে সারাদিন। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত কাজ করলে যেটুকু প্রটোনিয়াম আলাদা করতে পারে, সেটা দিয়ে একদিনের খাবারও কেনা যায় কি না সন্দেহ। তবু ঘরে বসে না থেকে তাই করে মেয়েরা।
আমি বসে বসে দেখলাম, কিরীণা তার জীর্ণ আইসোটোপ আইসোলেটর দুলিয়ে দুলিয়ে সমুদ্রের তীরে হেঁটে যাচ্ছে। মাথায় একটা লাল স্কার্ফ বাঁধা। বাতাসে উড়ছে সেটি। সমুদ্রের কাছাকাছি গিয়ে ঘুরে তাকাল আবার, তারপর হাত নাড়ল আমার দিকে তাকিয়ে। আমিও হাত নাড়লাম। কিরীণাকে আমার বড় ভালো লাগে।