কেন বিদায় নেব ক্রিনিটি? আমি কী মরে যাব?
না। মরে যাবে না। কিন্তু যখন কোনো মানুষ অন্যদের কাছ থেকে চলে যায় তখন বিদায় নেয়।
নিকির মুখটা হঠাৎ ব্যাথাতুর হয়ে ওঠে। সে নিচু গলায় বলল, আমি চলে যেতে চাই না। আমি এখানে থাকতে চাই।
ক্রিনিটি তার কপোট্রনে একধরনের চাপ অনুভব করে, সে চাপটি কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল তারপর ঘুরে নিকির দিকে তাকিয়ে বলল, নিকি, তুমি সারাজীবন এখানে থাকতে পারবে না। তোমাকে এখন যেতে হবে, অন্য মানুষকে খুঁজে বের করতে হবে।
আমি যেতে চাই না। আমি অন্য মানুষ খুঁজে বের করতে চাই না।
তোমার মা আমাকে বলেছে আমি যেন অন্য মানুষকে খুঁজে বের করে তোমাকে তাদের কাছে নিয়ে যাই। তোমাকে যেতে হবে নিকি।
মায়ের কথা বলা হলে নিকি কখনো অবাধ্য হয় না। এবারেও হলো না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে আমি যাব। কিন্তু আগে বল তুমি আমাকে আবার এখানে নিয়ে আসবে।
তুমি যদি চাও তাহলে আমি আবার তোমাকে এখানে নিয়ে আসব। কিন্তু কিছুদিনের মাঝেই তুমি নিজেই বড় মানুষের মতো হয়ে যাবে। তুমি তখন
একা একা এখানে ফিরে আসতে পারবে।
আমি বড় মানুষের মতো হতে চাই না। আমি ছোট থাকতে চাই।
ক্রিনিটি এই কথাটির উত্তর দিলো না–বলল, তুমি তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নাও, বাইভার্বাল চালু করা হলে তার ইঞ্জিনের শব্দে তারা ভয় পেয়ে চলে যেতে পারে।
নিকি তখন মাথা ঘুরিয়ে গাছের ওপর চুপ করে বসে থাকা পশুপাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, বলল, বিদায় কিকি। বিদায় মিকু। বিদায় সবাই
কিকি এবং মিক্কু নিচু স্বরে একধরনের শব্দ করল কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে বাইভার্বালের ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল এবং তার তীব্র শব্দে তাদের কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে গেল। বাইভার্বালটি একটি ঝাঁকুনি দিয়ে মাটি থেকে এক মিটারের মতো উপরে উঠে গেল এবং আবার একটি ঝাঁকুনি দিয়ে সেটি সামনের দিকে ছুটে যেতে শুরু করে। নিকি মাথা ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকাল, অনেকগুলো পাখি কর্কশ শব্দ করে উড়ছে, তার মাঝে কোনো একটি কিকি। দূরে একটি গাছে একধরনের উত্তেজনা দেখা যায় সেখানে নিশ্চয়ই মিক্কু এই মুহূর্তে গাছের একটি ডাল ধরে তার ভাষায় চিৎকার করছে। নিকি চাপা স্বরে বলল, আমি ফিরে আসব। আমি আবার ফিরে আসব। আসবই আসব।
নিকি অবাক হয়ে লক্ষ করল তার চোখে কেন জানি পানি চলে এসেছে। ব্যাপারটি সে বুঝতে পারল না।
ক্রিনিটি বলল, নিকি। তুমি প্রথমে লক্ষ কর আমি কেমন করে বাইভার্বালটি চালাই, তারপর আমি তোমাকে চালাতে দেব।
আমি লক্ষ করছি ক্রিনিটি। কিন্তু তুমি কিছুই করছ না।
তুমি ভুল বল নি। আমি আসলে কিছুই করছি না—এই বাইভার্বালগুলোর ভেতরে সে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি দেওয়া হয়েছে সেটি নিজে থেকেই সবকিছু করতে পারে। আমি শুধু কন্ট্রোল প্যানেলে চোখ রাখছি আর স্টিয়ারিং হুঁইলটা ধরে রেখেছি।
নিকি কন্ট্রোল প্যানেলটির দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, এখানে কী দেখা যায়?
সামনে কী আছে সেটি দেখা যায়।
আমি তো কিছু বুঝি না। এখানে তো শুধু লাল নীল কিছু রং!
তোমাকে এটি শিখতে হবে। রংগুলো দেখাচ্ছে তাপমাত্রা। আকৃতিগুলো দেখে কী দিয়ে তৈরি সেটি বোঝা যায়। কতদূরে সেটি আছে সেটিও বোঝা যায়। ক্রিনিটি ছোট একটি বিন্দুকে দেখিয়ে বলল, যেমন এটি হচ্ছে একটি প্রাণী। সম্ভবত হরিণ।
কেমন করে বুঝলে?
অভিজ্ঞতা থেকে। আমি আগে বাইভার্বাল চালিয়েছি।
নিকি দেখল ক্রিনিটির অনুমান সত্যি, বাইভার্বালটি যখন কাছে এসেছে তখন দেখা গেল একটি গাছের কাছাকাছি একটি বড় হরিণ দাঁড়িয়ে আছে। হরিণটি বাইভার্বালটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, ইঞ্জিনটির শব্দ স্পষ্ট হওয়ার সাথে সাথে সেটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেল।
নিকি বাইভার্বালের রেলিংটি ধরে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বনভূমিটি পার হয়ে তারা বিশাল একটা জলাভূমিতে চলে এলো। জলাভূমিটি পার হওয়ার পর শুকনো পাহাড়ি এলাকা শুরু হল। এখানে তারা কিছু বিধ্বস্ত বাড়িঘর দেখতে পায়, গাছপালা এবং লাতগুল্ম সেই বাড়িগুলোকে ঢেকে ফেলছে, কোথাও কোনো প্রানীর চিহ্ন নেই। ক্রিনিটি তার বাইভার্বালটি নিয়ে খুব নীচে দিয়ে বাড়িঘরগুলোর উপর দিয়ে উড়ে গেল, বাইভার্বালের ইঞ্জিনিরে শব্দে সচকিত হয়ে কিছু পাখি কিছু বুনো প্রাণী এদিক-সেদিক ছুটে গিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে তাদের লক্ষ করতে থাকে।
সারাদিন তারা বাইভার্বালে করে মাটির কাছাকাছি দিয়ে উড়ে যেতে থাকে। যতদূর চোখ যায় ধ্বংসস্তুপের মতো ছোট ছোট বাড়িঘর। গাছপালা ঝোপঝাড় আর লতাগুল্মে ঢাকা। ঝড় বৃষ্টিতে বিধ্বস্ত। শ্যাওলায় ঢাকা। দেখে দেখে নিকি একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
সন্ধ্যেবেলা ক্রিনিটি একটি বাড়ির সামনে তার বাইভার্বালটি থামাল। নিকি জিজ্ঞেস করল, এখানে কেন থেমেছ ক্রিনিটি?
আমরা রাতে এখানে থামব। তুমি ঘুমাবে। আমি একটু কাজ করব।
কী কাজ?
আমি নেটওয়ার্কের ভেতর ঢুকতে চাইছি। মানুষের নেটওয়ার্ক যদি নাও থাকে রোবটদের একটি নেটওয়ার্ক থাকার কথা?
নিকি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, আমরা তাহলে মানুষদের খুঁজে পাব? শুধু রোবটদের খুঁজে পাব?
এখনো সেটি আমরা জানি না নিকি। যদি রোবটদের নেটওয়ার্কটি খুঁজে পাই তাহলে সেখানে সবরকম খোঁজ পাব। মানুষ আছে কী নেই সেটিও আমরা জানতে পারব।