নিকি কিকির শরীরে হাত বুলিয়ে বলল, ক্রিনিটি বলেছে তুমি নাকি সামাজিক প্রাণী।
কিকি মাথা নেড়ে বলল, কঁ কঁ।
সামাজিক প্রাণী কথাটার মানে বুঝেছ? যারা দল বেঁধে থাকে তাদেরকে বলে সামাজিক প্রাণী। তুমিও কি দল বেঁধে থাক?
কিকি মাথা নেড়ে বলল, কঁ কঁ।
আমি তোমাকে কখনো দল বেঁধে থাকতে দেখি নি।
কিকি আবার মাথা নেড়ে বলল, কঁ কঁ।
বিকেলবেলা ক্রিনিটি যখন বাইভার্বালটির কাজ শেষ করে ইঞ্জিনটি প্রথমবার চালু করেছে তখন সে একটি অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখতে পেল। বনভূমির আকাশ কালো করে হাজার হাজার পাখি কর্কশ শব্দ করে উড়ে বেড়াচ্ছে। বনভূমির সামনে খোলা জায়গাটিতে নিকি দুই হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে আনন্দে চিৎকার করছে আর হাজার হাজার পাখি তাকে ঘিরে ঘুরছে আর ঘুরছে।
নিকি ঘুমিয়ে যাবার পর ক্রিনিটি তার শরীরটি একটি পাতলা চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়। তারপর তার গলার মাদুলিটি খুলে নিয়ে সে ক্রিস্টাল রিডারের সামনে বসে। মাইক্রোফোনটি টেনে নীচু গলায় দিনলিপিটি রেকর্ড করতে শুরু করে :
পৃথিবী থেকে সব মানুষের মৃত্যু হবার পর মূল তথ্য কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেছে, এই এলাকার যোগাযোগটিও বিচ্ছিন্ন। আমি তাই কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছি না। আমি বিচ্ছিন্ন ভাবে স্মরণ করতে পারি, কোনো একটি মানব শিশু যদি কোনো পশুপাখি দ্বারা লালিত পালিত হয়। তাহলে সে সেই পশুপাখির কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারে। নেকড়ে বাঘ। দিয়ে লালিত কিছু শিশু নেকড়ে বাঘের মতো চার পায়ে ছুটতে পারত, বুনো কুকুর দ্বারা লালিত শিশু কুকুরের কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিল। ওরাংওটাং দিয়ে পালিত শিশু গাছে ওরাংওটাং-এর মতো ছুটে বেড়াতে পারত।
নিকি খুব শৈশব থেকে এই বনের কিছু পশুপাখির সাথে বড় হয়েছে। আমি সতর্ক দৃষ্টি রেখেছি বলে পশু পাখির প্রবৃত্তি তার মাঝে গড়ে ওঠে নি, কিন্তু আমার বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে যে নিকি পশুপাখির সাথে কোনো একটি উপায়ে তথ্য বিনিময় করতে পারে।
আমি আজকে নিকিকে বলেছি কিকি কাক জাতীয় প্রাণী এবং কাক জাতীয় প্রাণীরা দল বেঁধে থাকে। নিকি বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে কিকিকে তার প্রমাণ দেখাতে বলেছে। কিকি তার প্রমাণ হিসেবে বনভূমির সকল পাখিকে তার সামনে হাজির করেছে। আমি দেখেছি হাজার হাজার পাখি নিকিকে ঘিরে ঘুরছে। নিকি পাখি বা অন্যান্য প্রাণীর সাথে কিভাবে তথ্য বিনিময় করে সেটি আমি এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি নি। তৃতীয় মাত্রার রোবট হিসেবে আমার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, আমি হয়তো কখনোই বিষয়টি বুঝতে পারব না।
আমি বাইভার্বালটি প্রস্তুত করেছি। খুব দ্রুত আমি নিকিকে নিয়ে বের হব। মানুষ যখন বেঁচেছিল আমি তখন তাদের মুখে এই বনভূমিটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা যোগাযোগের নেটওয়ার্কের বাইরে। পৃথিবীতে কোনো মানুষ জীবিত আছে কিনা সেটি বের করতে হলে আমাকে সভ্যতার আরো কেন্দ্রবিন্দুতে উপস্থিত হতে হবে।
নিকির দৈনন্দিন কার্যাবলির মাঝে আজকের উল্লেখযোগ্য ঘটনা বাইভার্বালের গঠন প্রকৃতি সম্পর্কে তার প্রথম বাস্তব ধারণা। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে…
ক্রিনিটি তার নিখুঁত ইলেক্ট্রনিক মেমোরি থেকে নিকির সারাদিনের প্রতিটি ঘটনার খুঁটিনাটি ক্রিস্টাল রিডারে লিপিবদ্ধ করতে শুরু করে।
০৪. ক্রিনিটি নিকির কোমরে বেল্ট বেঁধে
ক্রিনিটি নিকির কোমরে বেল্ট বেঁধে সেটি বাইভার্বালের কন্ট্রোল প্যানেলের একটি হুঁকের সাথে লাগিয়ে দিলো। নিকি জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন বেল্ট দিয়ে বেঁধে নিলে?
তোমার নিরাপত্তার জন্যে। তুমি তো আগে কখনো বাইভার্বালে ওঠ নি। তাই হঠাৎ করে যদি পড়ে যাও সে জন্যে।
আমি মোটেও পড়ে যাব না।
আমি জানি তুমি পড়ে যাবে না। কিন্তু তুমি জান তোমার ব্যাপারে আমি কখনো কোনো ঝুঁকি নেব না। তুমি যখন বাইভার্বাল চালানো শিখে যাবে তখন নিরাপত্তার এই ব্যাপারগুলো দরকার হবে না।
আমি কী এটি চালাতে পারব?
অবশ্যই পারবে। পৃথিবীতে যখন মানুষ বেঁচে ছিল তখন অবশ্যি কখনোই তোমার বয়সী একটি শিশুকে কেউ বাইভার্বাল চালাতে দিত না।
কেন দিত না?
প্রয়োজন হতো না। সেজন্যে দিত না। তখন ছোট শিশুদের কোনোরকম দায়িত্ব ছিল না। তারা শুধু মজা করত।
আমারও কোনো দায়িত্ব নাই। নিকি গম্ভীর হয়ে বলল, আমিও শুধু মজা করি।
না। ক্রিনিটি তার গলার স্বরে খানিকটা কৃত্রিম গাম্ভীর্য এনে বলল, তোমার অনেক দায়িত্ব। তুমি এর মাঝে কাপড় পরা শিখে গেছ। এখন তোমাকে এই বাইভার্বাল চালানো শিখতে হবে। তোমাকে যোগাযোগ মডিউল ব্যবহার করা শিখতে হবে। তোমাকে মনে হয় একটু-আধটু অস্ত্র ব্যবহার করা শিখতে হবে। তাছাড়া–
তা ছাড়া কী?
আমরা যদি সত্যি সত্যি কোনো মানুষের দেখা পেয়ে যাই তাহলে আমি সেখানে কোনো কথা বলতে পারব না। আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট, মানুষের সাথে কথা বলার যোগ্যতা আমার নেই। তোমাকে তার সাথে কথা বলতে হবে।
আমি তার সাথে কী কথা বলব?
সেটা যখন সময় হবে তখন তুমি ভেবে বের করে ফেলতে পারবে। এখন চল সকাল থাকতে থাকতে আমরা রওনা দিই।
বাইভার্বালটির কাছাকাছি একটি গাছে কিছু পাখি বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের লক্ষ করছে। কাছাকাছি আরেকটি গাছে নানাবয়সী বানর। ক্রিনিটি বলল, নিকি, তুমি তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নাও।