বনের কিছু পশুপাখির সাথে নিকির একধরনের গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক হয়েছে এবং আমার ধারণা নিকি ভালোবাসা গ্রহণ করতে এবং প্রদান। করতে শিখেছে। নিকির মা আমাকে প্রথম যে দায়িত্বটি দিয়েছিল আমি সেটি পালন করতে পেরেছি।
নিকির মায়ের দ্বিতীয় দায়িত্বটি অনেক কঠিন। সারা পৃথিবী খুঁজে আমার দেখতে হবে আর কোথাও কোনো মানুষ বেঁচে গিয়েছে কিনা। যদি বেঁচে থাকে তাহলে তার কাছে নিকিকে নিয়ে যেতে হবে। আমি সে জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। এখন তার বয়স মাত্র সাত বছর কিন্তু তার বুদ্ধিমত্তা দশ থেকে বারো বছরের বালকের মতো। তাই তাকে নিয়ে আমি বের হতে পারি। আমার ধারণা নিকি এখন এই ব্যাপারটির মুখোমুখি হতে পারবে।
ভূমিকা পর্ব শেষ হয়েছে। আমি এখন আজকের সারাদিনের সংক্ষিপ্ত দিনলিপি সংরক্ষণ করতে চাই। ভোরবেলা ঘুম ভাঙার পর নিকি শরীরে কাপড় রাখা নিয়ে একটি প্রতিবাদী ভূমিকা গ্রহণ করে। বিষয়টিকে আমার গুরুত্ব নিয়ে দেখতে হয়…
ক্রিনিটি তার একঘেয়ে যান্ত্রিক গলায় দিনলিপিটি সংরক্ষণ করে যায়। নিকির মা মারা যাবার পর থেকে প্রতিদিন সে এটি করে আসছে।
০৩. ক্রিনিটি তুমি কী করছ
নিকি জিজ্ঞেস করল, ক্রিনিটি তুমি কী করছ?
ক্রিনিটি টার্মিনালের সাথে একটি বড় তার জুড়ে দিয়ে উপরের স্কুটা লাগাতে লাগাতে বলল, আমি এই বাইভার্বালটি ঠিক করছি।
তুমি কেন এটি ঠিক করছ? আমরা ঘুরতে বের হব।
নিকির চোখে-মুখে আনন্দের ছাপ পড়ল, আমরা কোথায় ঘুরতে বের হব ক্রিনিটি?
নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় নয়। আমরা আসলে ঘুরে ঘুরে দেখব। কোথাও তোমার মতো মানুষ খুঁজে পাই কিনা।
এবারে নিকির মুখে দুশ্চিন্তার একটি ছাপ পড়ল, খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার মতো মানুষ?
হ্যাঁ, তোমার মতো মানুষ।
সেই মানুষের সাথে দেখা হলে আমি তাকে কী বলব ক্রিনিটি?
তোমার সেটি নিয়ে ভাবনা করতে হবে না। তোমার যেটি বলতে ইচ্ছে হয় সেটিই বলবে।
তখন সেই মানুষটি কী বলবে ক্রিনিটি?
সেই মানুষটিও তখন তার যেটি ইচ্ছে হয় সেটি বলবে।
আমি তোমার সাথে যেভাবে কথা বলি সেভাবে কথা বলব?
তার চাইতে অনেক সুন্দর করে কথা বলবে। আমি হচ্ছি মাত্র তৃতীয় মাত্রার রোবট আমি সত্যিকার মানুষের মতো কথা বলতে পারি না। আমি শুধু তোমার সাথে তথ্য বিনিময় করি।
সত্যিকার মানুষ কেমন করে কথা বলে ক্রিনিটি?
সেটি অনেক বিচিত্র। কথা বলার সময় তার হাত নাড়ে, মাথা নাড়ে। চোখ দিয়ে তাকায়, গলার স্বর কখনো উঁচু করে, কখনো নীচু করে। একটি সাধারণ কথা বলার জন্যেও অনেক কিছু করে। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা মুখ ফুটে বলে না। একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝে ফেলে।
নিকিকে এবারে খুব দুশ্চিন্তিত দেখায়। খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, ক্রিনিটি?
বল।
আমি তো চোখের দিকে তাকিয়ে কোনো কথা বুঝতে পারি না।
তোমার সেটি নিয়ে ভাবনা করতে হবে না। তুমি যদি কখনো কোনো মানুষের দেখা পাও তাহলে দেখবে তুমি বুঝতে পারছ।
আর যদি না পারি?
পারবে। যদি না পার তাহলে তুমি শিখে নেবে।
ক্রিনিটি।
বল?
আমি কিন্তু শিখতে পারি না। মিক্কু কী সুন্দর একটি গাছের ডাল ধরে লাফ দিয়ে আরেকটি ডাল ধরে ফেলে। আমি অনেকদিন থেকে চেষ্টা করছি, শিখতে পারছি না।
ক্রিনিটি ঘুরে নিকির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সেটি অনেক চেষ্টা করেও শিখতে পারবে না। মিক্কু হচ্ছে বানর, তুমি মানুষ। মানুষ চেষ্টা করলেও বানর হতে পারে না। মানুষের অন্য মানুষ থেকে শিখতে হয়, বানর থেকে শিখতে হয় না।
নিকি বলল, ও।
ক্রিনিটি বাইভার্বালের নীচে গিয়ে একটি গোলাকার ফুটোর ভিতরে উঁকি দেয়, সেখান থেকে জংধরা একটি রিং খুলে নতুন একটি রিং লাগাতে শুরু করে। ঠিক তখন তার মাথার উপর দিয়ে কিকি উড়ে এসে বাইভার্বালের একটি হ্যান্ডেলে বসে কর্কশ স্বরে কঁ কঁ করে ডাকল।
নিকি বলল, কিকি আমরা ঘুরতে বের হব। তুমি আমাদের সাথে যাবে?
কিকি কী বুঝল কে জানে, নীচু স্বরে আবার ক ক করে শব্দ করল। নিকি ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে বলল, ক্রিনিটি।
বল।
কিকি আমাদের সাথে ঘুরতে যেতে পারবে?
যেতে চাইলে যাবে। তবে—
তবে কী?
কিকি হচ্ছে কাক জাতীয় পাখি। পাখিদের মাঝে সবচেয়ে বুদ্ধিমান। এরা দল বেঁধে থাকে, আর দলের সবাইকে ছেড়ে সে আসলে যেতে পারবে না।
কেন যেতে পারবে না?
সব পশু-পাখিদের নিজেদের নিয়ম আছে। পাখিরা থাকে দল বেঁধে। বাঘ থাকে একা একা।
নিকি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কিকি তার দলের পাখি থেকে আমাকে বেশি ভালোবাসে। তাই না কিকি?
কিকি মাথা নেড়ে বলল, কঁ কঁ।
ক্রিনিটি নিকির কথা শুনে তার দিকে ঘুরে তাকালো, সে এই মাত্র তার কথায় ভালোবাসা শব্দটি ব্যবহার করেছে এবং মনে হয় ঠিকভাবেই ব্যবহার। করেছে। নিকির মা তাকে দায়িত্ব দিয়েছিল ভালোবাসা দিয়ে বড় করতে তার নিজের ভালোবাসা অনুভব করার ক্ষমতা নেই তারপরেও এই ছেলেটিকে সে মনে হয় ভালোবাসার ব্যাপারটি বোঝাতে পেরেছে। ক্রিনিটি দেখল নিকি কালো রঙের পাখিটিকে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিয়ে তাকে আদর করতে থাকে।
ক্রিনিটি যখন বাইভার্বালের সামনে বড় বড় দুটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র স্ক্রু দিয়ে লাগানো শুরু করেছে তখন নিকি জিজ্ঞেস করল, এগুলো কী ক্রিনিটি।
এগুলো হচ্ছে অস্ত্র।
অস্ত্র দিয়ে কী করে?
অস্ত্র দিয়ে ধ্বংস করে।