ঠিক তখন নিঃশব্দে একটি চিতাবাঘ হেঁটে হেঁটে আসে। হ্রদের পানিতে পা ভিজিয়ে সে চুক চুক করে পানি খায়। তাকে দেখে হরিণের পাল সরে গেল, বুনো পাখিরা কর্কশ শব্দ করে উড়ে গেল।
চিতাবাঘটি মাথা তুলে তাকাল, একটু গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করল এবং হঠাৎ করে নিকিকে দেখতে পেল। সাথে সাথে সেটি সতর্ক পদক্ষেপে নিকির দিকে এগুতে থাকে। কাছাকাছি এসে সেটি খুঁড়ি মেরে বসে তারপর বিদ্যুৎগতিতে। নিকির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গাছের ডালে বসে থাকা কিকি আর মিক্কু তার স্বরে চিৎকার করে ওঠে সাথে সাথে।
নিকি চমকে উঠে চিতাবাঘটির দিকে তাকাল এবং মুহূর্তে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে চিতাবাঘটির গলা জড়িয়ে ধরে বলল, দুষ্টু! দুষ্টু চিতা! তুমি কোথায় ছিলে এতোদিন?
চিতাবাঘটি মুখ দিয়ে ঠেলে নিকিকে নিচে ফেলে দিয়ে পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। নিকি উঠে দাঁড়িয়ে চিতাবাঘটির গলা জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ ঘষে বলল, কোথায় ছিলে তুমি? কোথায়?
চিতাবাঘটি তার বুকের ভেতর থেকে ঘরঘর করে শব্দ করে, বন্ধুর সাথে। ভাব বিনিময়ের গভীর ভালোবাসার একধরনের শব্দ।
ক্রিনিটি নিকির প্লেটে একটু খাবার তুলে দিয়ে বলল, তোমার এখন বাড়ন্ত শরীর। এখন তোমাকে খুব হিসেব করে খেতে হবে। মানুষের শরীর তো আর যন্ত্র নয় যে একটি ব্যাটারি লাগিয়ে দিলাম আর সেটি চলতে থাকল। মানুষকে খেতে হয় খুব হিসেব করে।
নিকি এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে স্যুপে ভিজিয়ে খেতে খেতে বলল, হিসেব করে না খেলে কী হয়?
শরীর দুর্বল হয়ে যায়। শরীরে রোগজীবাণু বাসা বাঁধে।
তুমি বলেছ আমার শরীরে কোনো রোগজীবাণু বাসা বাঁধতে পারে না। সেই জন্যে সবাই মরে গেছে কিন্তু আমি বেঁচে গেছি।
হ্যাঁ। সেটি সত্যি। কিন্তু রোগজীবাণুর কী শেষ আছে। পৃথিবীতে কত রকম রোগজীবাণু আছে তুমি জান?
নিকি মাথা নাড়ল, না জানি না। জানতেও চাই না।
না জানলে হবে না। মানুষকে সবকিছু জানতে হয়।
আমি তোমাকে বলেছি আমি মোটেও মানুষ হতে চাই না?
না চাইলেও লাভ নেই। তোমার মানুষ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ক্রিনিটি তার প্লেটে একটু খাবার তুলে দিয়ে বলল, এইটুকু শেষ করে ফেল। তাহলে তোমার খাওয়াটা সঠিক হবে।
নিকি খাবারগুলো হাত দিয়ে নাড়তে নাড়তে বলল, ঠিক আছে, আমি খেতে পারি কিন্তু একশর্তে।
কী শর্ত? তুমি আমাকে আজকে গণিত পড়াতে পারবে না।
তুমি এখন বড় হচ্ছ। প্রতিদিন তোমাকে কিছু না কিছু পড়তে হবে। মানুষকে অনেক কিছু জানতে হয়।
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, না ক্রিনিটি আমি আজকে কিছু পড়তে চাই না।
তাহলে কী করতে চাও?
নিকি লাজুক মুখে বলল, আমি আমার মা-কে দেখতে চাই।
ক্রিনিটি কয়েক মুহূর্ত নিকির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, ঠিক আছে।
একটু পরেই দেখা গেল নিকি দুই গালে হাত দিয়ে বসে আছে, সামনের শূন্য জায়গাটিতে তার মা কথা বলছেন। হলোগ্রাফিক ছবি, দেখে মনে হয়। জীবন্ত কিন্তু নিকি জানে এটি জীবন্ত নয়। সে অনেকবার তার মা-কে ধরার। চেষ্টা করেছে, ধরতে পারেনি। যতবার ধরতে গিয়েছে দেখেছে সেখানে কিছু নেই।
নিকি ঘুমিয়ে যাবার পর ক্রিনিটি তাকে একটি পাতলা চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়। গলায় ঝোলানো মাদুলিটি খুলে নিয়ে সে ক্রিস্টাল রিড়ারের সামনে বসে। মাদুলিটির ভেতর থেকে ছোট ক্রিস্টালটা বের করে সে ক্রিস্টাল রিডারের ভেতর ঢুকিয়ে সেদিকে তাকায়। আজ সারাদিন নিকি কী কী করেছে সব এখানে রেকর্ড করা আছে।
ক্রিনিটি খানিকক্ষণ দৃশ্যগুলো দেখে তারপর ছোট একটি মাইক্রোফোন কাছে টেনে এনে নিচু গলায় কথা বলতে শুরু করে। রোবটের একঘেয়ে যান্ত্রিক স্বরে ক্রিনিটি বলে, আমি ক্রিনিটি। নিকি নামের মানবশিশুটির দায়িত্বে আছি। আমার দৈনন্দিন দায়িত্ব হিসেবে আজকের দিনের ঘটনাগুলো ভিডি মাধ্যমে উপস্থাপন করছি।
আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট। আমার পক্ষে এই দায়িত্ব নেয়া সম্ভব ছিল, কিন্তু অন্য কোনো উপায় না থাকার কারণে আমি দায়িত্বটি নিতে বাধ্য। হয়েছিলাম। আমাকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল সেই সিদ্ধান্তগুলো সঠিক সিদ্ধান্ত কিনা আমি সেটি এখনো জানি না। নিকির মা আমাকে বলেছিল আমি যেন ভালোবাসা দিয়ে নিকিকে বড় করি। আমি তৃতীয়। মাত্রার রোবট, ভালোবাসা বিষয়টি কী আমি জানি না। একজন মা যখন তার সন্তানের সাথে কথা বলার সময় কিছু অর্থহীন শব্দ করে, কিছু অর্থহীন কাজকর্ম করে সেগুলো সম্ভবত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। আমি সেই শব্দগুলো উচ্চারণ এবং সেই কাজকর্মগুলো করার চেষ্টা করে দেখেছি সেগুলো প্রকৃত অর্থেই অর্থহীন এবং হাস্যকর কাজকর্মে পরিণত হয়েছে। কাজেই আমি সেই বিষয়টি পরিত্যাগ করেছি।
আমার মনে হয়েছে আশপাশে কোনো মানুষ না থাকলেও অনেক পশুপাখি আছে এবং সেইসব পশুপাখিদের মাঝে একধরনের ভালোবাসা। আছে। মানুষ অনেক সময়ই পশুপাখিকে পোষ মানিয়েছে এবং তাদের সাথে একধরনের ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তাই আমি খুব সতর্কভাবে নিকির সাথে কিছু পশুপাখির সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করেছি। কাজটি আমাকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে করতে হয়েছে, প্রয়োজনে যেন তাকে ঘিরে একটি শক্তি বলয় তৈরি হয় এবং কোনো পশু যেন তার ক্ষতি করতে না পারে, গোড়াতে আমি সেই বিষয়টি নিশ্চিত করেছি। আমি এক মুহূর্তের জন্যেও নিকির প্রাণের ওপর কোনো ঝুঁকি আনিনি। এখনও আমি তাকে সতর্কভাবে রক্ষা করি। তার গলার মাদুলিটি একটি শক্তিশালী ট্রাকিওশান। মূল তথ্য কেন্দ্রের সাথে এটি যোগাযোগ রাখে এবং তাকে রক্ষা করে।