খুব ধীরে ধীরে নিকির মুখে হাসি ফুটে উঠল, সে নিচু গলায় বলল, আমার বন্ধুরা।
ফ্লিকাস অবাক হয়ে বলল, তোমার বন্ধুরা? তারা কোথায়?
আসছে। তারা আসছে।
কোথা থেকে আসছে?
তাকিয়ে দেখ।
ফ্লিকাস তাকাল, দেখল বনভূমির উপর থেকে পাখি উড়ে আসছে। একটি দুটি পাখি নয়, হাজার হাজার পাখি লক্ষ লক্ষ পাখি। তাদের লাল চোখ। ধারালো ঠোঁট। তারা তাদের শক্তিশালী পাখা বাতাসে ঝাঁপটা দিতে দিতে উড়ে আসছে। তারা স্থির নিশ্চিত জানে তাদের কী করতে হবে। তাদের ভেতরে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই।
ফ্লিকাস হতবুদ্ধির মতো তার অস্ত্রটি পাখিদের দিকে তুলে ধরল, একবার ট্রিগার টেনে ধরার জন্যে দুর্বল ভাবে চেষ্টা করল, কিন্তু তার আগেই লক্ষ লক্ষ পাখি ফ্লিকাসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের তীক্ষ্ণ ধারালো ঠোঁট দিয়ে তারা ফ্লিকাসের চোখে, মুখে, দেহে আঘাতের পর আঘাত করতে শুরু করেছে।
ফ্লিকাস একটা আর্তনাদ করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল হাজার, হাজার, লক্ষ, লক্ষ পাখি তাকে ঘিরে রইল, আঘাতের পর আঘাত করে তাকে মাটি থেকে উঠতে দিল না। ফ্লিকাসের কাতর আর্তনাদ পাখিদের তীক্ষ্ণ চিৎকারে চাপা পড়ে গেল।
পাখিগুলো যখন উড়ে গেল তখন নিকি আর ত্রিপি এগিয়ে যায়। ছিন্নভিন্ন কিছু দুমড়ে মুচড়ে থাকা ধাতব যন্ত্রপাতির অবশিষ্টাংশ ছাড়া আর কিছু নেই। নিকি ভয়ে ভয়ে এদিক-সেদিক তাকাল, তার মনে হলো হঠাৎ করে ফ্লিকাসের ছিন্ন মাথা বুঝি খলখল করে হেসে উঠবে। কিন্তু কেউ খলখল করে হেসে উঠল না।
নিকি ত্রিপির দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। ত্রিপি তাকে জাপটে ধরে বলল, নিকি আমরা বেঁচে গেছি।
হ্যাঁ। পৃথিবীতে আমরা থাকব।
তাদের মাথার উপর দিয়ে কিকি ক ক শব্দ করে উড়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে তার ঘাড়ের ওপর বসল। নিকি আদর করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কিকি যখন সব মানুষেরা আসবে তখন আমি তাদের বলব তোমাকে আর তোমার পাখির দলকে মেডেল দিতে।
কিকি বলল, কঁ কঁ। নিকি মাথা নাড়ল, বলল, না বোকা। মেডেল খাবার জিনিস না।
কিকি উড়ে যাবার পর নিকি ক্রিনিটির কাছে গিয়ে বসে, তার দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে যাওয়া হাত পায়ে হাত বুলিয়ে বলল, ক্রিনিটি তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি আর ত্রিপি গিয়ে বাইভার্বালটি নিয়ে আসছি। তোমাকে নিয়ে যাব। তোমাকে আবার আমরা নতুনের মতো করে ফেলব।
১৩. শেষ কথা
বিশাল কালো টেবিলের একপাশে মাঝবয়সী একজন মহিলা বসে আছেন, তার। সামনে একটা ক্রিস্টাল রিডার। তার কাছাকাছি আরো বেশ কিছু নানাবয়সী মানুষ। টেবিলের অন্যপাশে নিকি চুপ করে বসে আছে।
মাঝবয়সী মহিলা হাত দিয়ে তার চুলগুলোকে পেছনে সরিয়ে বলল, নিকি। ক্রিনিটি নামে যে রোবটটি তোমার দেখাশোনা করতে সে তার দিনলিপি আমাদের দিয়েছে। তোমাকে কিভাবে বড় করা হয়েছে তার সব। খুঁটিনাটি সেখানে আছে। বিশেষ করে পঞ্চম মাত্রার রোবটের ষড়যন্ত্র তুমি যেভাবে বানচাল করেছ, যেভাবে তাদের ধ্বংস করে পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করেছ সেই বিষয়গুলো আমরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। তোমার চিন্তাভাবনার ধরন, কাজের প্রকৃতি, বাস্তব বুদ্ধি ধৈর্য এবং সাহস দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছি।
নিকি চুপ করে কথাগুলো শুনল, কোনো উত্তর দিল না। মাঝবয়সী মহিলা চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, তুমি নিশ্চয়ই জান পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় হিমঘরে লুকিয়ে রাখা মানুষদের জাগিয়ে তোলা শুরু হয়েছে। দেখতে দেখতে আমরা কয়েক হাজার মানুষের একটা সম্প্রদায় হয়ে যাব। এই মানুষদের জীবন পদ্ধতি পরিচালনার জন্যে আমাদের একটা সুপ্রিম কাউন্সিল গঠন করা প্রয়োজন। সেখানে এগারজ সদস্য থাকবে, আমরা তোমাকে তার একজন সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিতে চাই। যদিও তোমার বয়স মাত্র সাত কিন্তু আমরা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছি যে তোমার মানসিক পরিপক্কতা আমাদের সমান সমান। আশা করছি তুমি আমাদের জন্যে এই দায়িত্বটি পালন করবে।
নিকি বলল, আমি?
মহিলাটি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, হ্যাঁ তুমি। পৃথিবীতে মানুষকে ঠিকভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আমাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা কী নিউক্লিয়ার শক্তি ব্যবহার করব না নবায়নশীল শক্তির দিকে যাব। মহাকাশ গবেষণায় কতোটুকু শক্তি দেব, শিক্ষা কিভাবে হবে, পরিবেশের। সাথে সম্পর্ক কেমন হবে—সব ব্যাপারে তোমার মতামত নিতে হবে। তোমাকে পূর্ণ সদস্যের মর্যাদা দেওয়া হবে। তুমি সব ধরনের সহযোগিতা, বাসভবন–
নিকি মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল, তোমাদের সাহায্য করতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু–
কিন্তু কী?
আমি তো খুব ব্যস্ত, তাই তোমাদের সময় দিতে পারব না।
মধ্যবয়স্কা মহিলাটি ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কী নিয়ে ব্যস্ত?
হ্রদের উপরে একটা গাছ থেকে আমরা একটা মোটা দড়ি ঝুলিয়েছি, সেই দড়ি ধরে ঝুল খেয়ে আমরা পানিতে লাফ দিই। ভারি মজা হয় এখন। আগে তো শুধু আমি আর ত্রিপি ছিলাম—এখন আমাদের সাথে কুশ, লিবান, রিহা, ক্রন, নুশা, রিশ, ক্রিপাল এরা সবাই আছে। এখন আরো অনেক বেশি মজা হয়। সে জন্যে খুব ব্যস্ত।
মধ্যবয়স্কা মহিলাটি বিস্ফারিত চোখে নিকির দিকে তাকিয়ে রইল, আস্তে আস্তে বলল, গাছ থেকে দড়ি।
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। মাঝে মাঝে খুব ঝামেলা হয়। কুশ হচ্ছে অসম্ভব দুষ্টু, সেদিন রিহাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিয়েছে। অনেক রকম সমস্যা।