নিকি হতচকিতের ভাবে মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি।
ফ্লিকাস হ্রদের নরম বালুবেলায় অন্যমনস্কভাবে কয়েক পা হেঁটে গাছের বড় একটা খুঁড়িতে বসে। একধরনের বিষঃ গলায় বলে, বুঝলে নিকি আর ত্রিপি। আমি খুব নিঃসঙ্গ প্রাণী। আমি জানি তোমরা আমাকে প্রাণী হিসেবে মেনে নেবে না, তোমরা বলবে আমি একটা যন্ত্র। কিন্তু আমি আসলে একটা প্রাণী। সত্যিকারের প্রাণী থেকেও আমি বেশি প্রাণী বুঝেছ?
ফ্লিকাস অস্ত্রটি হাত বদল করে বলল, আমাকে ডিজাইন করতে পাঁচ বছর সময় লেগেছে। যখন দেখেছে পৃথিবীতে আর মানুষ নেই, তখন পৃথিবীর দায়িত্ব নেবার জন্যে আমাদের প্রজন্মকে ডিজাইন করা হয়েছে। মানুষের যে সীমাবদ্ধতা ছিল আমাদের সেই সীমাবদ্ধতা নেই। সেই সীমাবদ্ধতা কি জান?
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, না।
মানুষের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে তাদের অযৌক্তিক ভালোবাসা। যেখানে ভালোবাসার কারণে তাদের ক্ষতি হতে পারে সেখানেও তারা ভালোবাসে। মানুষ মানুষকে ভালোবাসে, যন্ত্রকে ভালোবাসে। বনের পশুকে ভালোবাসে, কীট পতঙ্গকে ভালোবাসে এমনকি গাছের পাতাকেও ভালোবাসে।
নিকি জিজ্ঞেস করল, তোমরা কাউকে ভালোবাস না?
ফ্লিকাস কঠিন চোখে নির্কির দিকে তাকাল, বলল, অবশ্যই ভালোবাসি। আমাদের কপোট্রনের তুলনায় তোমাদের মস্তিষ্ক হচ্ছে একটা ছেলেমানুষি খেলনা। তোমাদের যেটুকু ভালোবাসার ক্ষমতা, আমাদের ভালোবাসা তার থেকে হাজার গুণ বেশি। কিন্তু আমাদের ভেতর অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর ভালোবাসা নেই।
নিকি কোনো কথা বলল না। ফ্লিকাস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, শুধু ভালোবাসা নয়—আমাদের কপোট্রনে অনেক নতুন নতুন অনুভূতি আছে যেটা তোমাদের নেই।
নিকি জিজ্ঞেস করল, সেগুলো কী?
তোমাদের বললে তোমরা সেগুলো বুঝবে না।
কেন বুঝব না?
তুমি কী একটা পিঁপড়াকে বিশুদ্ধ সিম্ফোনিশুনতে কেমন লাগে সেটি বোঝাতে পারবে?
নিকি মাথা নাড়ল।বলল, না।
এটাও সেরকম।
নিকি বলল, ও।
আমি জানি তোমরা বাচ্চা মানুষ, আমার কথা বুঝবে না। তবু বলি-আমার কেন জানি কথা বলতে ইচ্ছে করছে। যেমন মনে করো ভালবাসা এবং ঘৃণা। তোমাদের কাছে দুটি ভিন্ন ব্যাপার তাই না?
নিকি অনিশ্চিতের মতো বলল, হ্যাঁ।
যেটাকে তুমি ভালোবাম সেটাকে তুমি ঘৃণা করতে পার না। কিন্তু আমরা পারি। আমরা কোনোকিছুকে ভালোবাসতে পারি। কোনোকিছুকে ঘৃণা করতে পারি। আবার কোনোকিছুকে একই সাথে ঘৃণা করতে পারি ভালোবাসতে পারি। দুটিই সমান সমান। দুটিই তিব্র।
ত্রিপি জানতে চাইল, সেটার নাম কী?
তোমাদের ভাষায় এর কোনো নাম নেই, আমরা বলি রিভাল। রিভালের মতো আরেকটা অনুভুতির নাম হচ্ছে যিগ্ধা।
যিগ্ধা সেটা কী?
কোনো কোনো মানুষের মাঝে সেটা থাকে। মানুষ সেটাকে মনে করে অপরাধ। আমাদের কাছে সেটা অপরাধ না। এটা আমাদের জন্যে খুবই স্বাভাবিক একটা অনুভূতি।
নিকি কিংবা ত্রিপি কোনো কথা বলল না। ফিকামএকটু চুপ করে থেকে বলল, এই অনুভূতিটা হচ্ছে অন্য কাউকে যন্ত্রণা দিয়ে আনন্দ পাওয়া। আমাদের ভেতর সেটা আছে। আমাদের যখন প্রয়োজন হয় তখন আমরা অন্যকে যন্ত্রণা দিতে পারি, দিয়ে তীব্র আনন্দ পেতে পারি। আমি এখানে এসেছি যিগ্ধা উপভোগ করতে।
নিকি এবং ত্রিপি শিউরে উঠল, কিন্তু কিছু বলল না, ফ্লিকাসের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ফ্লিকাস কাঠের গুঁড়ি থেকে এসে কয়েক পাহদের দিকে এগিয়ে যায় কিছুক্ষণ হ্রদের পানির দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর আবার নিকি আর ত্রিপির দিকে ফিরে আসে। কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে, আস্তে আস্তে নরম, প্রায় বিষণ্ণ গলায় বলল, নিকি তুমি একজন অসাধারণ মানবশিশু। আমার মনে একজন পঞ্চম মাত্রার রোবটকে তুমি হত্যা করেছ! আমাদের ইতিহাসে সবসময় তোমার নাম লেখা থাকবে। তুমি যে নিষ্ঠুরতায় আমাকে হত্যা করেছ আমাকে তার সমান নিষ্ঠুরতায় তোমাকে হত্যা করতে হবে। যতোক্ষণ সেটা না করব পঞ্চম মাত্রার রোবটদের সম্মান ফিরে আসবে না। ফ্লিকাস নিকির দিকে তাকিয়ে বলল, নিকি! সারা পৃথিবীতে কী কেউ আছে যে তোমাকে আর তোমার এই বান্ধবীকে এখন রক্ষা করতে পারবে?
নিকি কোনো কথা বলল না। ফ্লিকাস বলল, নেই! পাহাড়ের গহরের মানুষগুলো জেগে উঠবে সতের দিন পর। আমি তাদের ঘুমন্ত অবস্থায় ধ্বংস। করতে পারি নি, কিন্তু জেগে ওঠার পর ধ্বংস করব! সেই মানুষগুলো তোমাদের রক্ষা করতে আসতে পারবে না। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে মানুষগুলো আছে তাদের মতো অসহায় জীব এই সৃষ্টিজগতে নেই! তাদের। অনেকে বড় হয়েছে বনের পশুর মতো, তাদের কোনো অনুভূতি নেই, কোনো ভাষা নেই। আমি খুঁজে বের করে তাদের একজন একজন করে হত্যা করব। এখন তারা হয়তো কেউ কেউ বেঁচে আছে কিন্তু তারা তোমাদের বাঁচানোর জন্যে আসতে পারবে না। তাহলে এই মুহূর্তে তোমাদের কে বাঁচাতে আসবে? কে?
ক্রিনিটি।
হ্যাঁ। ক্রিনিটি। ফ্লিকাস মাথা নাড়ল। তোমাদের গলায় যে মাদুলি ঝোলানো আছে সেটি আসলে একটি পঞ্চম মাত্রার ট্রাকিওশান। সে যেই মুহূর্তে জানতে পেরেছে আমি এসেছি সেই মুহূর্তে কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে ছুটে আসছে। তার ভেতরে কোনো অনুভূতি নেই। সে তৃতীয় মাত্রায় তুচ্ছ একটা রোবট। তার ভেতরে ভালোবাসা নেই, স্নেহ মমতা নেই, রিভাল নেই যিগ্ধা নেই। আছে শুধু কিছু বাঁধাধরা নিয়ম। সেই নিয়ম পালন করার জন্যে সে ছুটে আসছে। আমি ইচ্ছে করলে এই মুহূর্তে তাকে বিকল করে বনের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারি। কিন্তু আমি তাকে আসতে দিয়েছি। কেন তাকে আমি আসতে দিয়েছি তোমরা জান?