ফ্লিকাসের কাটা মাথাটি আবার খলখল করে হাসতে থাকে! নিকি তার মাঝে বিস্ফোরকটি তার মুখে গুঁজে দিয়ে ত্রিপিকে নিয়ে বড় একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে গেল। কিছুক্ষণের মাঝে প্রচণ্ড একটি বিস্ফোরণে পুরো এলাকাটি কেঁপে ওঠে। ফ্লিকাসের খলখল করে হাসির শব্দ হঠাৎ করে থেমে। গেল। চারপাশে তখন অত্যন্ত বিচিত্র একটা নৈঃশব্দ।
নিকি ত্রিপির হাত ধরে বলল, চল এখন ক্রিনিটিকে নিয়ে আসি। এতোক্ষণে সে নিশ্চয়ই স্বাভাবিক হয়েছে।
ত্রিপি বলল, চল।
১২. হ্রদের তীরে
হ্রদের তীরে অনেকগুলো ছোট বড় পাথর সাজানো। নিকি আর ত্রিপি পাথরগুলোর পাশ দিয়ে গুনতে গুনতে হেঁটে যায়। নিকি গোনা শেষ করে বলল, আঠারটা।
নিকির কথা শুনে ত্রিপি হি হি করে হাসল। নিকি বলল, কী হলো তুমি হাসছ কেন?
তুমি এমন করে বলছ যেন তুমি জান না যে এখানে আঠারটি পাথর। আছে। যেন তুমি গুনে আবিস্কার করেছ এখানে আঠারটি পাথর!
জানি তাতে কী হয়েছে? জানা থাকলে কী গোনা যায় না? একবার গোনা যায়!
ত্রিপি মাথা নাড়ল, বলল, সেটা ঠিক। জানা থাকলেও একশবরি গোনা যায়।
এখন আমরা আঠার নম্বর পাথরটি হ্রদের পানিতে ফেলে দেব, তখন। এখানে পাথর হবে সতেরটি! তার মানে–
তার মানে আর সতেরদিন পর পাহাড়ের গহ্বর থেকে ঘুম ভেঙে মানুষেরা বের হয়ে আসবে?
নিকি হাত কঁকুনি দিয়ে বলল, ঠিক বলেছ! তারপর সে নিচু হয়ে ভারি পাথরটা গড়িয়ে গড়িয়ে হ্রদের দিকে নিয়ে যায়। হ্রদের তীর থেকে সেটাকে ধাক্কা দিতেই পাথরটা ঝপাং করে পানিতে পড়ে হারিয়ে গেল।
ফ্লিকাসের সাথে তারা যখন পাহাড়ের গহ্বরে গিয়েছিল তখন তারা জেনে এসেছিল যে সেখান থেকে তেত্রিশদিন পর মানুষদের প্রথম ব্যাচটি জেগে উঠবে। তারা তাদের এলাকায় ফিরে এসে তেত্রিশটা নানা আকারের ছোট-বড় পাথর সাজিয়ে রেখেছে। প্রত্যেক দিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙার পর দুজন হেঁটে হেঁটে হ্রদের তীরে আসে, তারপর একটা পাথরকে গড়িয়ে গড়িয়ে হ্রদের পানিতে ফেলে দিয়ে আসে। যার অর্থ তাদের অপেক্ষার দিন আরো একটি কমেছে।
নিকি পাথরগুলোর চারপাশে ঘুরে এসে বলল, আর মাত্র সতের দিন। তারপর আমাদের সাথে থাকবে আরো শত শত মানুষ।
ত্রিপি মাথা নাড়ল, শত শত সত্যিকার মানুষ।
আমাদের দেখে তারা কী বলবে বলে মনে হয়?
মনে হয় একটু অবাক হবে।
নিকি বলল, আমাদের সেদিন সুন্দর কাপড় পরে থাকা উচিত। ক্রিনিটি বলেছে সভ্য মানুষেরা সুন্দর কাপড় পরে।
আমরা কোথায় পাব সুন্দর কাপড়?
ক্রিনিটিকে বলব তৈরি করে দিতে।
ত্রিপি মাথা নাড়ল, বলল, শুধু সুন্দর করে কাপড় পরলেই হবে না। আমাদের সুন্দর করে কথাও বলতে হবে। সুন্দর করে ব্যবহার করতে হবে।
হ্যাঁ। ক্রিনিটি বলেছে আমরা যখন তাদের সাথে খেতে বসব তখন গপগপ করে খেলে হবে না। একটু একটু করে খেতে হবে। সভ্য মানুষেরা একটু একটু করে খায়।
ত্রিপি বলল, আমাদের নক কেটে ছোট করতে হবে। শুধু অসভ্য মানুষের। বড় বড় নখ হয়।
হ্যাঁ। চুলগুলো ভালো করে ধুয়ে আঁচড়াতে হবে। সভ্য মানুষের কখনো উশখো-খুশকো চুল থাকে না।
নিকি আর ত্রিপি সভ্য মানুষের আর কী কী থাকতে হয় কী কী থাকতে হয় সেগুলো আলোচনা করতে করতে দের বালুবেলায় হাঁটতে থাকে। একটা গাছের উঁচু ডালে তখন মিক্কু বসে নিকি আর ত্রিপির দিকে তাকিয়েছিল। তার হাতে একটা রসালো ফল, সেটা কামড়ে কামড়ে খেতে খেতে অস্পষ্ট একটা শব্দ করল। নিকি আর ত্রিপি তখনো শুনতে পায় নি, কিন্তু মিক্কু শুনতে পেয়েছে। অনেক দূর থেকে একটা বাইভার্বাল আসছে।
নিকি আর ত্রিপি যখন হ্রদের এককোণায় একটা বড় গাছের গুঁড়ির কাছে এসে পৌঁচেছে তখন তারা বাইভার্বালের চাপা গর্জনটি শুনতে পেল, তারা অবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকায় আর ঠিক তখন দেখতে পায় কুচকুচে কালো একটা বাইভার্বাল আকাশ দিয়ে উড়ে আসছে। বাইভার্বালটি অতিকায়। একটা পাখির মতো তাদের মাথার উপর দিয়ে একবার উড়ে যায় তারপর গর্জন করে ধূলো উড়িয়ে কাছাকাছি নেমে আসে।
নিকি আর ত্রিপি বিস্ফারিত চোখে বাইভার্বালটির দিকে তাকিয়ে থাকে, অবাক হয়ে দেখে তার দরজা খুলে সোনালি চুল আর নীল চোখের একজন। মানুষ নেমে আসছে। মানুষটি সুদর্শন এবং হাতে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। মানুষটি তাদের দিকে কয়েকপা হেঁটে এসে থেমে গেল, জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ নিকি? ত্রিপি?
নিকি আর ত্রিপি দুজনেই মানুষটিকে চিনতে পারল, মানুষটি ফ্লিকস। যে মানুষটিকে তারা বিস্ফোরক দিয়ে মাত্র কিছুদিন আগে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল।
ফ্লিকাস হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি অবহেলার ভঙ্গিতে হাত বদল করে বলল, মনে আছে নিকি তোমাকে বলেছিলাম, তোমাকে খুঁজে বের করতে যদি আমাকে নরকেও যেতে হয় আমি সেখানে যাব? আমি এসেছি।
নিকি বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, কিন্তু-কিন্তু–
আমি বুঝতে পারছি, তুমি কী জানতে চাইছ! তুমি জানতে চাইছ আমাকে বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেবার পরেও আমি কিভাবে ফিরে এসেছি। তাই না?
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।
তুমি ভুলে গিয়েছিলে আমি হচ্ছি পঞ্চম মাত্রার রোবট। পঞ্চম মাত্রার রোবট পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যান্ত্রিক আবিষ্কার। প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় উদাহরণ। কেউ এতো বড় একটা জিনিস মাত্র একটি তৈরি করে না। কমপক্ষে দুটি তৈরি করে। তাই পৃথিবীতে ফ্লিকাস একজন ছিল না, ছিল দুজন। তুমি যখন প্রথমজনকে বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলে তখন তার কপোট্রনের সকল তথ্য দ্বিতীয় ফ্লিকাসের কপোট্রনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই ফ্লিকাসের শরীরটা ধ্বংস হয়েছে কিন্তু ফ্লিকাস ধ্বংস হয় নি। বুঝেছ?