উপরে এসে ফ্লিকাস অলস পায়ে হেঁটে হেঁটে পাহাড়ের এক কিনারায় এসে দাঁড়িয়ে সামনে নীলাভ পাহাড়ের মাথায় সাদা বরফের চূড়োর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, আমার আসলে সত্যিকার একটা প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করার ইচ্ছে করছে। তোমাদের মতোন অবুঝ দুটি শিশুকে খুন করার মাঝে কোনো গৌরব নেই, কোনো আনন্দ নেই। আমার মনে হচ্ছে আমি পা দিয়ে মাড়িয়ে দুটো ফড়িংকে পিষে ফেলছি।
নিকি বলল, তুমি আমাদের কখন মারবে?
ফ্লিকাস একটু অবাক হয়ে নিকির দিকে তাকাল, বলল, তোমার কণ্ঠস্বরে ভয় নেই কেন? কণ্ঠস্বরে একধরনের উপহাস। কেন?
নিকি ঠোঁট উল্টে বলল, তোমার বুদ্ধি মানুষ থেকে অনেক বেশি, তুমি বলো।
ফ্লিকাস বিড়বিড় করে বলল, একটু আগেও তোমার ভেতরে ভয় ছিল, আতঙ্ক ছিল, এখন নেই। কেন নেই? কী হয়েছে? বলো আমাকে?
নিকি বলল, ঠিক আছে, আমি বলব, কিন্তু তার আগে আমি ত্রিপির সাথে একটু কথা বলতে চাই।
ফ্লিকাস কিছুক্ষণ শীতল চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, ঠিক আছে বলো।
আমি লুকিয়ে কথা বলতে চাই, তুমি যেন শুনতে না পার। দেখতে না
পার।
ঠিক আছে।
আমি আর ত্রিপি ঐ পাথরটার আড়ালে গিয়ে কথা বলতে পারি?
ফ্লিকাস কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, ঠিক আছে যাও।
নিকি ত্রিপির হাত ধরে বড় একটা পাথরের আড়ালে নিয়ে গেল। ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাকে কী বলবে?
আমি কিছুই বলব না।
তাহলে এখানে কেন এনেছ?
আমি ফ্লিকাসের পকেটে একটি বিস্ফোরক রেখে এসেছি, সেটি এক্ষুণি ফাটবে। সেটি যখন ফাটবে তখন যে বিস্ফোরণ হবে সেটির ঝাঁপটা থেকে বাঁচার জন্যে এর পেছনে দাঁড়িয়েছি।
ত্রিপি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে নিকির দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, সত্যি?
সত্যি।
এন্ড্রোমিডার কসম?
এন্ড্রোমিডার কসম।
মহাকালের কসম?
মহাকালের কসম।
আমরা আসলে মরব না?
আমরা আসলে মরব না। ফ্লিকাস এক্ষুণি উড়ে যাবে। ধ্বংস হয়ে যাবে।
নিকি আর ত্রিপি হঠাৎ করে ফ্লিকাসের গলার স্বর শুনতে পেল, তোমাদের কথা শেষ হয়েছে?
নিকি মাথা তুলে দাঁড়াল, পাথরের আড়াল থেকে বলল, হ্যাঁ শেষ হয়েছে।
এখন আমাকে বলবে, তোমার কণ্ঠস্বরে কোনো ভয় নেই কেন? মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে তোমার এতো সাহস কেন?
বলব?
ফ্লিকাস বলল, বল।
দুটি কারণ আছে। প্রথম কারণ হচ্ছে মাইক্রো মডিউল সে আসলে টাইমার লাগানো বিস্ফোরক আমরা সেটি জানতাম। তাই আমরা ভেতরে বসে। সবগুলো বিস্ফোরককে বিকল করে এসেছি। কোনো ক্যাপসুলে সেগুলো। লাগাই নি।
ফ্লিকাসের চোখ দুটি ধ্বক করে জ্বলে উঠল, বলল, কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ। সত্যি বলছি। আমরা বিস্ফোরকগুলো ভেতরে রেখে এসেছি। সেগুলো নিজে থেকে ফাটবে না, তাই কোনো ভয় নেই। কিন্তু–
কিন্তু কী?
আমরা দুটি বিস্ফোরক নিয়ে এসেছি। একটিতে টাইম সেট করে সেটি তোমার পকেটে রাখা হয়েছে। মনে আছে একটু আগে আমি সিড়িতে গড়িয়ে পড়েছিলাম? আসলে সেটি ছিল অভিনয়। যখন হাত-পা ছুড়ছিলাম তখন এক ফাঁকে সেটি তোমার কোনো একটি পকেটে রাখা হয়েছে। তুমি ইচ্ছে করলে সেটি খুঁজে বের করতে পার। তুমি এটি খুঁজে বের করার আগেই সেটি ফাটবে। বিশ্বাস কর।
ফ্লিকাস অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে নিকির দিকে তাকিয়ে রইল। নিকি বলল, তুমি বল? পৃথিবীতে কে বেশি বুদ্ধিমান? মানুষ নাকি পঞ্চম মাত্রার রোবট? নিকি নাকি ফ্লিকাস? কে ফড়িংকে পিষে মারছে? তুমি নাকি আমি?
নিকির কথা শেষ হবার আগে একটি ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে ফ্লিকাস ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তার আগেই নিকি পাথরের আড়ালে লুকিয়ে গেছে, সে অনুভব করল একটি বাতাসের ঝাঁপটা ফ্লিকাসের ছিন্নভিন্ন দেহ তাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেছে। একমুহূর্ত পরে নিকি সাবধানে মাথা বের করল, এদিক-সেদিক তাকাল তারপর পাথরের আড়াল থেকে বের হয়ে এলো। বাতাসে। পোড়া একটা গন্ধ, যেখানে ফ্লিকাস দাঁড়িয়েছিল সেখানে কালো পোড়া বিস্ফোরণের চিহ্ন। চারদিকে ছিন্নভিন্ন যন্ত্রপাতির চিহ্ন—ফ্লিকাসের শরীরের অংশ।
হঠাৎ ত্রিপি চিৎকার করে উঠল, নিকি!
কী হয়েছ?
দেখ! ত্রিপি হাত তুলে দেখাল, নিকি সেদিকে তাকায়। ফ্লিকাসের পোড়া মাথাটি একটা পাথরে আটকে পড়ে আছে, সেটি এখনো নড়ছে। নিকি এগিয়ে গেল, পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সেটিকে নীচে ফেলে দিতেই ফ্লিকাস চোখ খুলে তাকাল। নিকি ভয় পেয়ে এক পা পিছিয়ে আসে। গলা থেকে কিছু তার টিউব বের হয়ে এসেছে। সেখান থেকে সাদা কষের মতো কিছু একটা ফোটা ফোটা করে পড়ছে। তার সোনালি চুল জায়গায় জায়গায় পুড়ে গেছে। মুখের চামড়া উঠে ভেতর থেকে ধাতব কাঠামো বের হয়ে আসছে। নিকি আর ত্রিপিকে দেখে সেই ছিন্ন মাথাটি খলখল করে হাসল, খসখসে গলায় বলল, তুই ভেবেছিস তুই আমার কাছ থেকে মুক্তি পাবি? পাবি না।।
নিকি সাবধানে এগিয়ে গেল। উবু হয়ে নিচে পড়ে থাকা মাখাটির দিকে তাকাল, বলল, কী বললে?
তোকে হত্যা করার জন্যে যদি আমার নরকেও যেতে হয়, আমি যাব!
তুমি? তোমার এই কাটা মাখা?
আমি পঞ্চম মাত্রার রোবট! তুই আমাকে এখনো চিনিস নি। তুই এখনো আমার ক্ষমতার পরিচয় পাস নি?
নিকি ত্রিপির মুখের দিকে তাকাল, বলল, ত্রিপি এই কাটা মাথাটা কী বলছে? সে আমাকে কেমন করে হত্যা করবে?
ত্রিপি মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি না।
নিকি বলল, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না। কিন্তু সত্যি সত্যি যেন। এই কাটা মাথা হয়েই তুমি আমাকে কামড়ে ধরতে না পার আমি তার ব্যবস্থা। করছি। নিকি তার পকেট থেকে দ্বিতীয় বিস্ফোরকটি বের করে বলল, এই যে বিস্ফোরকটি দেখছ আমি সেটি তোমার মুখের মাঝে ছেড়ে দেব। তিরিশ সেকেন্ডের মাঝে সেটি বিস্ফোরিত হবে। তোমার এই কাটা মাথাটা আর থাকবে না, সেটাও তখন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। আমি দেখি তখন তুমি কেমন করে। আমাকে ধরতে আস!