ত্রিপি বলল, ফ্লিকাস দেখতে কী সুন্দর, তাই না?
হ্যাঁ।
আরো যে সব বাচ্চারাও আসবে, তারাও নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর হবে, তাই না নিকি?
নিকি মাথা নাড়ল, তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, অন্য বাচ্চারা আরো সুন্দর হোক আর যাই হোক তুমি কিন্তু অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। আমি আর তুমিই কিন্তু বিয়ে করব। ঠিক আছে?
ত্রিপি গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে।
ক্রিনিটি বাইভার্বালটি ঠিক করল, ফ্লিকাসের সাথে যোগাযোগ করল তারপর তার সাথে দেখা করার জন্যে রওনা দিল। নিকি আর ত্রিপি বাইভার্বালের রেলিং ধরে আনন্দে চিৎকার করে গান গাইতে লাগল। দুজন আগে কখনো গান গায় নি, গান গাওয়া বলে যে একটা ব্যাপার থাকতে পারে সেটাও তারা জানত না, কিন্তু তারপরও তাদের গান গাইতে কোনো সমস্যা। হল না।
সারাদিন সারারাত তারা বাইভার্বাল চালিয়ে গেল। ফ্লিকাস ক্রিনিটিকে যে। ঠিকানা দিয়েছে সেখানে তারা যখন পৌঁছাল তখন দুপুর হয়ে গেছে। গাছগাছালি ঢাকা ছোট একটা বাসা। বাসার বাইরে দুইজন রোবট পাহারা দিচ্ছে, তারা হাত তুলে বাইভার্বালটিকে থামাল। একজন রোবট জিজ্ঞেস করল, কী চাই?
ক্রিনিটি বলল, আমরা মহামান্য ফ্লিকাসের সাথে দেখা করতে এসেছি।
তোমরা কারা?
আমি একজন তৃতীয় মাত্রার রোবট। আমাকে ক্রিনিটি নামে পরিচয় দেওয়া হয়। আমার সাথে দুজন মানবশিশু আছে।
একটি রোবট অন্য রোবটের দিকে তাকিয়ে বলল, পৃথিবীতে মানবশিশু বলে কিছু নেই। সব মরে গেছে।
নিকি কঠিন মুখে বলল, সবাই মরে নি। আমরা বেঁচে আছি।
তোমরা সূত্যিকারের মানবশিশু?
হ্যাঁ। ফ্লিকাস আমাদের সবাইকে ডেকে পাঠিয়েছে আমরা তার সাথে দেখা করতে এসেছি।
রোবটটি একধরনের ঘোলা চোখে তাদের দুজনকে দেখল তারপর বলল, ঠিক আছে, তোমরা গেটে অপেক্ষা কর। আমরা খোঁজ নিই।
নিকি ভাবছিল একটা রোবট ভেতর গিয়ে খোঁজ নেবে কিন্তু তার দরকার হলো না। গেটে দাঁড়িয়ে থেকেই কোনো একভাবে খোঁজ নিয়ে নিল তারপর ওদের বলল, তোমরা ভেতরে যাও, মহামান্য ফ্লিকাস তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।
ক্রিনিটি মাটির কাছাকাছি রেখে বাইভার্বালটি বাসার সামনে হাজির করল এবং প্রায় সাথে সাথেই দরজা খুলে ফ্লিকাস বের হয়ে এলো। হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে তাকে যেটুকু সুদর্শন দেখা গিয়েছিল সে তার থেকে অনেক বেশি সুদর্শন। দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে নিকি আর ত্রিপির দিকে ছুটে যায়, দুজনকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে বলল, মানুষের পৃথিবীতে তোমাদের আমন্ত্রণ। নিকি আর ত্রিপি তোমাদের জন্যে আমার ভালোবাসা আর ভালোবাসা।
এভাবে কেউ আমন্ত্রণ জানালে কী বলতে হয় নিকি আর ত্রিপি কেউই জানে না। জানে না। তাই দুজনেই হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। ফ্লিকাস বলল, তোমরা অনেক দূর থেকে এসেছ। এখন দ্রুতগামী ট্রেন নেই, জেষ্ট নেই মহাকাশযানও নেই, তোমরা এসেছ সেই আদিম বাইভার্বালে করে। তোমাদের নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হয়েছে?
এবারে নিকি বলল, না আমাদের কোনো কষ্ট হয় নি।
ত্রিপি বলল, আমরা গান গাইতে গাইতে এসেছি।
কী মজা! পৃথিবীর সব মানুষকে যখন আমরা একত্র করব তখন প্রথম কাজটি হবে একটা গানের কনসার্ট। কী বল?
ত্রিপি হাত তালি দিয়ে বলল, কী মজা হবে তখন!
ফ্লিকাস বলল, তোমরা হাত মুখ ধুয়ে কিছু একটা খেয়ে নাও। তোমাদের জন্য আমি কিছু জৈবিক খাবার তৈরি করে রেখেছি।
নিকি জিজ্ঞেস করল, অন্য মানবশিশুরা কী এসে পৌঁছেছে?
না, তারা এখনো পৌঁছায় নি। কেউ কেউ রওনা দিয়েছে, কেউ কেউ রওনা দেবে।
ত্রিপি জানতে চাইল, সব মিলিয়ে কতোজন মানবশিশু আছে পৃথিবীতে?
কমপক্ষে দুইশ। আরো বেশিও হতে পারে।
আমরা সবাই মিলে এক জায়গায় থাকব?
ফ্লিকাস হাসল, বলল, অবশ্যই। সারা পৃথিবী খুঁজে আমরা সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটা খুঁজে বের করব। একপাশে পাহাড় অন্যপাশে হ্রদ, মাঝখানে থাকবে সবুজ বন। আমরা বাচ্চাদের জন্যে চমৎকার একটা স্কুল বানাব–সেখানে বাচ্চারা হইচই করে পড়বে। ছোটাছুটি করবে, খেলবে, হ্রদে সাঁতার কাটবে। যখন অন্ধকার হয়ে আসবে আমরা তখন কোথাও একটা আগুন জ্বালাব, সেটাকে ঘিরে আমরা বসব। একজন গিটার বাজাতে বাজাতে গান গাইবে— কথা বলতে বলতে ফ্লিকাসের চোখে যেন স্বপ্নের ছোঁয়া লাগে। দেখে মনে হয় সে যেন তার চোখের সামনে পুরো দৃশ্যটি দেখতে পাচ্ছে।
নিকি দাঁত বের করে হাসল। বলল, কী মজা হবে? তাই না?
হ্যাঁ অনেক মজা হবে। হঠাৎ ফ্লিকাসের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। সে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমরা যে শুধু মজা করব তা কিন্তু নয়। আমাদের ওপর তখন থাকবে অনেক বড় দায়িত্ব। অনেক অনেক বড় দায়িত্ব।
ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, কী দায়িত্ব?
মানুষের দায়িত্ব। পৃথিবীর দায়িত্ব। আমাদের সারা পৃথিবীর দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা যে কয়জন মানুষ আছি তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাদের। দিয়েই আস্তে আস্তে সারা পৃথিবীতে একসময় মানুষে ভরে উঠবে। ভবিষ্যতের যে পৃথিবী হবে আমরাই হব তার স্থপতি। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে যে মানুষ থাকবে আমরা হব তার পূর্বপুরুষ!
ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, আর রোবট? রোবটদের কী হবে?
রোবটেরাও থাকবে। মানুষকে সাহায্য করার জন্যে রোবটেরা আগেও ছিল, এখনো থাকবে।
লিপি ভুরু কুঁচকে বলল, কিন্তু অনেক জায়গায় রোবটেরা সবাই মিলে মানবশিশুকে আটকে রেখেছে।